এই মেলায় কোনো পাকিস্তানি পণ্য নেই

নাশতারান এর ছবি
লিখেছেন নাশতারান (তারিখ: শুক্র, ১৭/০৬/২০১৬ - ১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মেলাটার নাম রাঙতা। আয়োজনে এক ঝাঁক বোকাটে ক্ষ্যাপাটে পাগলাটে মেয়ে। এরা সবকিছুর সাথে রাজনীতি মিশায়। সুশীলতার খাতিরে এরা 'অতীত ভুলে মিলেমিশে' থাকে না, পাকিপ্রেমীদের সাথে 'সুইট করে কথা' বলে না। 'ম্যারি মি আফ্রিদি' আর 'পাকি লন' ঘরানার 'আপ্পি'দের দাবড়ানি দিয়ে এরা কীবোর্ড ক্ষয় করে।

ছবি সূত্র: আম বাংলা

কেন পাকি পণ্য বর্জন করব, কেন পাকি লন পরব না ইত্যকার বহু বহু বিতর্কের মাঝে একটা হতাশাজনক বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে দেদারসে পাকি পণ্য বিক্রি হয়। শুধু তা-ই নয়, পাকি পণ্যের প্রতি এক শ্রেণীর ভোক্তার এমন অন্ধ ভক্তি যে বিক্রেতারা দেশি পণ্যও পাকি বলে বিক্রি করে থাকেন। যে দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করতে চল্লিশ বছর পেরিয়ে যায় সে দেশে দুই তিন প্রজন্ম বিস্মৃতিপ্রবণ নাগরিক গড়ে ওঠাটাই হয়ত স্বাভাবিক। আমাদের মতো হাতে গোনা কিছু বোকা মানুষ প্রাণের টানে যতই প্রতিরোধ গড়ে তুলি না কেন, ব্যবসায়িক স্বার্থ যখন মূল্যবোধের থেকে থেকে ওজনদার হয়ে ওঠে, খুব কম আবেগই তখন ধোপে টেকে। অর্থ বড্ড অনর্থজনক শক্তি।

২০১৩ সালের কথা। 'মেয়ে' তখন বছর দুয়েকের যাত্রা পেরিয়ে শাহবাগ গণজাগরণের সূত্রে তুমুল ল্যাঞ্জামুক্তি অভিযানের পরে আরো পরিচ্ছন্ন কাঠামো পেতে শুরু করেছে। নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন ইত্যাদি আলোচনার সূত্রে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বরাবরই খুবই প্রাসঙ্গিক আলাপ। আমাদের মধ্য থেকে যেসব মেয়ে নিজে কিছু করতে চাইছিলেন, সামাজিক ও পারিবারিক বাধার পাশাপাশি অনেক বড় একটা বাধা ছিলো বাজারগত। বিশেষ করে আমাদের পোশাকের বাজার আশংকাজনক মাত্রায় পাকি অভিমুখী। ঢাকার অভিজাত পাড়ায় এমন অনেক নারীই রয়েছেন যারা পাকি পোশাক ছাড়া কিছু ছুঁয়েও দেখেন না। দেশে তখন পাকি লন কাপড়ের জোয়ার। বাণিজ্যিক মেলাগুলোতে পাকি কাপড়ের প্রতাপে দেশি ব্যবসা কোণঠাসা হয়ে পড়ে থাকে। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে পছন্দ করেও কাপড়টা 'পাকিস্তানি নয়' বলে ছ্যা ছ্যা করে ফেলে রেখে গেছে এমন ক্রেতাও দুর্লভ নয় তখন। সে সময় আমরা ভাবলাম, নিজেরাই কেন একটা মেলার আয়োজন করি না? বাজারের অসম প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে না চাইলে নিজের বাজার নিজেকেই তৈরি করতে হবে, ব্যবসার জবাব ব্যবসা দিয়েই দিতে হবে। আর দশটা ক্ষ্যাপাটে উদ্যোগের মতো 'রাঙতা'র শুরুটাও হয়ে গেল এভাবেই। ২০১৩'র ৪ আর ৫ অক্টোবরে ধানমন্ডিতে মেলা হলো। মেলার ব্যানারে বড় বড় করে লেখা ছিলো 'এই মেলায় কোনো পাকিস্তানি পণ্য নেই।'
সেটা নিয়ে দুয়েকজন যে গাঁইগুঁই করেনি, তা নয়।
"পাকিস্তানি পণ্য নেই বলার কী দরকার? দেশি পণ্যের মেলা বললেই তো হয়!"
তারা বলে এভাবে নাকি ব্যবসা হয় না, ব্যবসা করতে গেলে অত ছুঁৎমার্গ নাকি থাকতে নেই।

দরকারটা যে কী, এবং কতখানি সেটা যে জানার সে-ই জানে। প্রথম চেষ্টায় ভরাডুবির প্রস্তুতি নিয়েই মেলা হলো। কোনোরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া, প্রচারণা এবং প্রত্যাশা ছাড়া রীতিমতো ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল। দুর্জনের মুখে চুনকালি মেখে বিক্রিবাট্টা হলো ভীষণ ভালো। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হলো আনিকা আলমের কেক আর নজু ভাইদের স্টলের বই। নিজেদের ত্যাড়ামির এমন সিধেসাধা সাফল্যে সেই যে ডানা গজালো, তার উড়াল সময়ের সাথে বেড়েছে বৈ কমেনি। এখান থেকেই বেশ কিছু উদ্যোগ দাঁড়িয়ে গেছে আস্তে আস্তে। পরের বছর রাঙতার দ্বিতীয় কিস্তিও হয়েছে। দেশে এখন মেলার মৌসুমে রাঙতা ছাড়াও আরো অনেক 'দেশি পণ্যের মেলা' হয়। বলেকয়ে পাকিমুক্ত মেলা আর কেউ করে না যদিও। একদিন তারা সেটাও করবেন আশা করি।

আপাতত খবর এই যে আবারো রাঙতা হচ্ছে। ১৭ আর ১৮ জুন, মানে এই শুক্র আর শনিবারে। প্রাণের টানে একত্রিত কিছু পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট মানুষজনের ক্ষ্যাপামির পালে হাওয়া দিতে সেখানে সবাই আমন্ত্রিত।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পাকি-পণ্য বর্জন করে সবারই স্বদেশী-পণ্যে ধন্য হওয়া উচিত।

সাইয়িদ রফিকুল হক

দুনিয়া  এর ছবি

সালাম ! এই বীর বোনদের জন্য শুভকামনা ।

সোহেল ইমাম এর ছবি

শুধু দেশাত্মবোধই নয় আমার ধারনা এই মনোভাব অদূর ভবিষ্যতের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী বাংলাদেশের আগাম বার্তা নিয়ে এসেছে। এখনও বেশ কিছু কাঠ-খড় পোড়াবার অবকাশ আছে, রাজনীতির ধারায়ও কিছু পরিবর্তন আসাটা জরুরী এবং অবশ্যম্ভাবি কিন্তু সেই দিনটা আসছে। রাংতার মত দৃষ্টিভঙ্গী আর অবস্থান নিয়ে যে কোন বাণিজ্যিক প্রয়াসই সামনে এগিয়ে আসুকনা কেন আমি সুখবরের বার্তা পাই। অনেক শুভেচ্ছা রইলো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

শেহাব এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

বাজারের অসম প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে না চাইলে নিজের বাজার নিজেকেই তৈরি করতে হবে, ব্যবসার জবাব ব্যবসা দিয়েই দিতে হবে

- একদম ঠিক! কিন্তু একটা বড় ভবনের ১২-তলায় মেলা করলে লোকের কতটা চোখে পড়বে? অনলাইনের সামাজিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এর বিশেষ কোন প্রচারণাও তো নেই। এদিকটাতে একটু খেয়াল দেবেন। ইদের বাজার ধরার ইচ্ছে থাকলে সময়টা ঠিক বেছেছেন, কিন্তু এর জন্য দুই দিন যথেষ্ঠ না। রাঙতা'র প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে একটা আউটলেট দিতে পারলে সারা বছর এই পণ্যগুলো অফলাইনে, সহজে কেনা সম্ভব হতো।

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবই চমৎকার উদ্যোগ। এই পোস্ট দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময় করে উঠতে পারি নি। শুভকামনা রইল আপনাদের জন্য। সেই সাথে একটা অনুরোধ, একটু বড় পরিসরে এবং উন্মুক্ত কোন স্থানে যদি পরবর্তীতে মেলার আয়োজন করতে পারেন তাহলে মনে হয় আরও ভাল হয়। অন্তত প্রচারটা ভালোই জমবে।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাঙালিকে দেখায়ো না আঙুল, হয়ে যাবে নিজেই ভন্ডুল

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

চলুক

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।