ডিগ্রী বেচার প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ (২)

রাগিব এর ছবি
লিখেছেন রাগিব (তারিখ: শনি, ১৩/১০/২০০৭ - ৮:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি দেয়া হয় ১৯৯২ সালে। দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত আসনসংখ্যার কথা চিন্তা করে অনুমতি দেয়া হয়, কিন্তু এই আইনের ফাঁক গলে যে অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠবে, তা হয়তো ভাবা হয়নি।

এসব প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক মনোভাবের উদাহরণ পত্রিকাতেই দেখা যায়। মোবাইল কোম্পানিরা যেমন বিভিন্ন প্যাকেজের কোন সেট কতো টাকা, তা নিয়ে আধা পাতার বিজ্ঞাপন দেয়, সেরকম অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অমুক ডিগ্রি এতো টাকা, এরকম বিজ্ঞাপন দিচ্ছে হরদম।

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিন্দু মাত্র সমস্যা নাই। বিশ্বের অনেক প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারী, এবং বেসরকারী বলেই অনেক প্রশাসনিক জটিলতা এড়িয়ে উন্নত মানের গবেষণা করতে পারছে।

কিন্তু ন্যুনতম কিছু বিষয় না থাকলে বাসাবাড়ির সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে তৈরী হয়েছে, তাতে পুরা ব্যাপারটাই জঘন্য অবস্থায় চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এদের স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ধানমন্ডি বা গুলশানের ভাড়া বাসায় চালু হয়েছে। ধানমন্ডিতেই কেবল ১৯টি "বিশ্ববিদ্যালয়" আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনত্বের বিচারে দুনিয়ার মধ্যে ধানমন্ডি এলাকা যে ১ নাম্বার, তা বলাই বাহুল্য।

এবার আসি এদের শিক্ষক কিভাবে যোগাড় হয়, তাতে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী শিক্ষক নেই। বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে দিয়ে ক্লাস নেয়ানো হয়। যারা ক্লাস নেন, তাদেরকে বলে দেয়া হয় ছাত্রদের বেশি বেশি নম্বর দিতে, নইলে আগামী বার ক্লাস দেয়া হবে না। আর বাপের নগদ টাকায় পড়ছে বলে এসব ছাত্রের জোশও বেশি থাকে, নম্বর কম পেলে রীতিমত এসে দাবী করে। আমি গুলশানের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম ক্লাস নিয়েছিলাম। ওখানে এক ছেলেকে এ না দিয়ে বি দেয়াতে সে হতভম্ব হয়ে এসে বললো, আগে কোনো টিচার তাকে এরকম নম্বর দেয় নি। আর পরীক্ষাই দেয়নি এমন এক ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার পরেও আমাকে ইমেইল করে অনেক ঝুলাঝুলি করেছে।

তাও তো ভালো, যদি শিক্ষকরাও কিছুটা অন্তত গ্রহনযোগ্য হয়। অনেক কিপ্টা বিশ্ববিদ্যালয় আবার সেটাতেও দুই নাম্বারি করে থাকে। বুয়েটে যখন আমরা শেষ বর্ষে পড়তাম, তখন অনেকেই প্রাইভেট টিউশনি করতো। এমন সময় এক বন্ধুকে দেখি, দিনের বেলাতে ঘন্টা দুয়েকের জন্য হন্ত দন্ত হয়ে সেজে গুজে কোথাও যাচ্ছে। অনেক চাপাচাপি করাতে সে বললো, ও একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে একটা বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছে!!! ঐ বিষয়টা আমরা বুয়েটে ২ সেমিস্টার আগে পড়েছিলাম মাত্র!!। ওকে নিজের পুরা পরিচয় দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পই পই করে মানা কেনো করেছিলো ও শুরুতে বুঝতে পারেনি। পরে বুঝেছে, ওকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে বুয়েটের শিক্ষক হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিলো!!

দেশের সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এরকম না। ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, অ্যামা, এরকম কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী শিক্ষক আছে, এবং ওখানে গবেষণার কাজও হয়ে থাকে। কিন্তু ৬০-৭০টি অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা করে চলছে।

পরের পর্বে থাকবে ফার্মগেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাস নেয়ার অভিজ্ঞতা।

(প্রথম প্রকাশ, সামহয়ারইনব্লগ, মার্চ ২০০৭)


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

লেখার সাথে একমত প্রকাশ করে আপনার দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মাস্টার্স পাশ করা ছাত্র দিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের কোর্স পড়ানো আপনার দৃষ্টিতে কেমন লাগে? আমি কী জানতে চাইছি বুঝতে পারছেন আশা করি।

কয়দিন ধরেই বিষয়টা মাথায় ঘুরছে। একটু সময় হলেই কিছু একটা লিখব ভাবছি। তার আগে আপনার মত অসাধারণ ছাত্রের মতের সাথে আমার মত সাধারণ ছাত্রের মতের মিল বা অমিলের বিষয়টা একটু যাচাই করতে ইচ্ছে করছে।

কেমিকেল আলী এর ছবি

দিনের বেলাতে ঘন্টা দুয়েকের জন্য হন্ত দন্ত হয়ে সেজে গুজে কোথাও যাচ্ছে। অনেক চাপাচাপি করাতে সে বললো,

বিশ্ববিদ্যালয় নিষেধ না করলেও বিশ্ববিদ্যায়ে পড়া যেসব ছাত্ররা এইসব পার্ট টাইম চাকরী করে তাদেরকে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি, বিষয়টা লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে।

ডিগ্রী বেচাকেনা কম বেশী সব বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়। বুয়েট থেকে শুরু করে ঢাবি, জাবি, খুবি বা রাবি কোনটাই বাদ নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সব বেচাকেনার প্রমান পাওয়া যায়/দেওয়া যায়। আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার চোখের সামনে হয়- এই আরকি।
তবে একথা সত্যি যে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাচ্ছেতাই ভাবে ব্যবসায়িক ভাবে পড়ালেখা সিসটেম চালু করে দিয়েছে।

অমিত আহমেদ এর ছবি

খারাপ লাগে এসব দেখলে!
ছাত্রদের জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশী অভিভাবকদের জন্য!

পরের পর্বের অপেক্ষায়।


ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বনানীতে একটি বিল্ডিংয়েই আছে ৪টা বিশ্ববিদ্যালয়।
না না,ভুল শুনেন নি, ১ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টা ভবন বলিনি, ৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১টা ভবন বলেছি।

এটা নিয়ে আমরা দৈনিক আমার দেশের রম্য ম্যাগাজিনে একটা প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিলাম ।
শিরোনাম দিয়েছিলাম "তলায় তলায় বিশ্ববিদ্যালয়।এর পরে কী ?বাথরুমে বাথরুমে কিন্ডারগার্টেন ??"

সেই প্রচ্ছদটি বাজারে যায় নি।
কেন জানেন ?
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে।

অয়ন এর ছবি

জেবতিক ভাই বাংলাদেশে এমন কোন পত্রিকা আছে যারা বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে চুপ করে থাকে না?

আরিফ জেবতিক এর ছবি

জাতীয় দৈনিকগুলোর সাথে যোগাযোগ ছিল প্রায় ৮ বছর।
দেখিনি তো।
আমি পত্রিকায় লেখালেখি ছেড়েছি একই কারনে।
"ফুলবাড়ী "কয়লা খনি নিয়ে সেখানে গুলি আন্দোলন এসব চলার বহু আগে (প্রায় প্রথম দিকে)আমি একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখা তিনটি পত্রিকায় ছাপা হয় নি।

অথচ পরে কিন্তু ফুলবাড়ী আন্দোলনের পরে বহু লেখালেখি হয়েছে।

সবই ব্যবসারে ভাই।

রাগিব এর ছবি

আরিফ জেবতিক লিখেছেন:
বনানীতে একটি বিল্ডিংয়েই আছে ৪টা বিশ্ববিদ্যালয়।
না না,ভুল শুনেন নি, ১ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টা ভবন বলিনি, ৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১টা ভবন বলেছি।

এটা নিয়ে আমরা দৈনিক আমার দেশের রম্য ম্যাগাজিনে একটা প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিলাম ।
শিরোনাম দিয়েছিলাম "তলায় তলায় বিশ্ববিদ্যালয়।এর পরে কী ?বাথরুমে বাথরুমে কিন্ডারগার্টেন ??"

সেই প্রচ্ছদটি বাজারে যায় নি।
কেন জানেন ?
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে।

জেবতিক আরিফ ভাই, এটা নিশ্চয় কুইন্স ইউনিভার্সিটির বিল্ডিংটা? অন্যগুলার নাম মনে পড়ছেনা।

ফার্মগেটের মালেক মিঞার মালেক টাওয়ারের গ্রীন ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ (GUB) এ পড়িয়েছিলাম কিছুদিন, নামকরণের স্বার্থকতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বাকীগুলোর নাম আমারও মনে পড়ছে না।

একবার আমি ইন্টারভিউতে ডেকেছিলাম "ইউনিভার্সিটি অব হনুলুলু " থেকে পাস করা এক এম.বি.এ ডিগ্রী ধারীকে।

তো,বাসায় সিভি দেখছি আর শর্ট বাছাই করছি।আমার ছোট ভাই বললো,এই ইউনিভার্সিটিটা কিন্তু বিদেশে নয়,ঢাকা শহরেই।

তারপর সেই ইন্টারভিউয়ের করুণ কাহিনী এখানে আর বলতে চাই না।

"গাব" সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করবেন আশাকরি।
ভালো অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা । হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।