ডিগ্রী বেচার প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ (৩) (শেষ)

রাগিব এর ছবি
লিখেছেন রাগিব (তারিখ: সোম, ১৫/১০/২০০৭ - ৪:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা বড় সমস্যা হলো শিক্ষক ও প্রশাসন। শিক্ষক জোগাড়ের ক্ষেত্রে সাধারণত "ট্রফি" হিসাবে দুই একজন বিদেশী পিএইচডি ডিগ্রিধারীকে ৮০ হাজার হতে ১ লাখ বা তার বেশি বেতন দিয়ে নিয়োগ করা হয়। বুকলেট, ব্রোশিওর, এসবে উনার ডিগ্রির উৎসস্থল নিয়ে বিশাল মাতামাতি করা হয়।

বাকি শিক্ষক হচ্ছে কারা? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থায়ী শিক্ষক থাকেনা। বুয়েট, বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "খ্যাপ" মারা শিক্ষকদের দিয়ে ক্লাস নেয়া হয়। এটাও ব্রোশিওরে বড় করে উল্লেখ করা হয়।

তবুওতো শিক্ষকদের ক্ষেত্রে গুটি কয় ব্যতিক্রম ছাড়া কিছুটা ভালো অবস্থা আছে। কিন্তু প্রশাসন? অধিকাংশ ভুঁইফোড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনই পরিবার কেন্দ্রিক। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সিন্ডিকেট বা এরকম প্রশাসনিক গোষ্ঠীর সদস্যরা মালিকের ভাই-ভাগ্নে হয়ে পড়ে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা আলাদা, কিন্তু ঐ ৬-৭টি বাদে বাকি গুলাতে এই দশা।

আর এই প্রশাসন শিক্ষকদের সাথেও রুক্ষ আচরণে সিদ্ধ হস্ত। গুলশান এলাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান যিনি ছিলেন, তাঁর সাথে মন খুলে কথা বলছিলাম। উনি প্রচন্ড হতাশ, আর অপমানিত - চার বছর আগে ঐ সময় তিনি মাসে ৮৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন, কিন্তু তার বিনিময়ে মাছের বাজারের মতো যে বাজে ব্যবহার পেতে হতো, তাতে তিনি আর পেরে উঠছিলেন না। এই ব্যাপারে আমার নিজেরও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিদেশে পড়তে আসার আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোর্স পড়িয়ে শেষ করেছিলাম, কিন্তু সময়াভাবে বিলটা তুলতে পারিনি। পরে সেই ৭ হাজার টাকার জন্য যখন যোগাযোগ করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-অর্ডিনেটর, যিনি একসময় বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসক ছিলেন, তিনি অশ্রাব্য ভাষায় চিঠি লেখেন, এবং বলেন, "এই বিলটা তোলার কথা মুখে আনলে তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠিয়ে তোমাকে বরখাস্ত করাবো, আর ঢাকার আমেরিকান অ্যাম্বাসির সাথে আমাদের দহরম মহরম আছে, ওদের বললেই তোমার ভিসা বাতিল করিয়ে তোমাকে আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করিয়ে ছাড়বো"। সামান্য ৭ হাজার টাকা বাঁচাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির এরকম রীতিমত মাস্তানী দেখে মন প্রচন্ড খারাপ হয়েছিলো, আর সেই সাথে প্রকাশ পেয়েছিলো এধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত স্বরূপ।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলতি সময়ের হুজুগ যে বিষয়ে, সেটা নিয়েই কোর্স অফার করা হয়ে থাকে। এতে দোষের কিছু নেই, হাজার হলেও যেটা মানুষে চায়, সেটা তো ওদেরকে দিতে হবে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গালভরা সব কোর্স অফার করে থাকে, যা অনেক সময় ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে খাপ খায় না। উদাহরণ দেইঃ ফার্মগেটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিয়াল টাইম সিস্টেমসের ক্লাস নিতে বলা হলো আমাকে। পড়াতে গেলাম তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের, যারা কম্পিউটার ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তো। সিলেবাসটি বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে কেউ টুকে এনেছে। যাহোক, কয়েক দিন পরে আমি যখন ক্লাসে বোর্ডে একটা ফটোইলেকট্রিক ডিভাইসের ডায়াগ্রাম এঁকে ব্যাখ্যা করছিলাম যে, এটার মধ্যে যে ট্রানসিস্টর আছে, তার বেইজে আলো পড়লে তার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বেশি হয়, ফলে এটা তখন অ্যালার্ম চালু করে। ক্লাসের ছেলেপেলে হা করে আছে দেখে, আমি জানতে চাইলাম, সমস্যাটা কোথায়। ওরা জানালো, বেইজ শব্দটা তারা প্রথম শুনছে, কাজেই ওদেরকে আবার কিছু সময় ট্রানজিস্টরের গঠন প্রণালী নিয়ে বললাম। তখনো ওদের বিহবল ভাব দেখে প্রশ্ন করায় ওরা জানালো, জীবনে প্রথম ওরা ট্রানসিস্টরের কথা শুনছে।

(এই উদাহরণটা একটি টেকনিক্যাল হয়ে গেলো, ব্যাখ্যা দেই, ট্রানসিস্টর হলো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশের প্রাণ, এবং এটা ইলেক্ট্রনিক্সের যেকোনো কোর্সের প্রথম পাঠ, যা সাধারণত ১ম বর্ষের ছাত্ররা পড়ে)। ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়ের ৩য় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের মুখে ঐ কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা অনেকটা গণিতে অনার্স পড়া কেউ যদি ত্রিভূজ কাকে বলে জানতে চায়, তার মতো। ওদের প্রশ্ন করে জানলাম, ৩য় বর্ষে উঠে গেলেও ওদেরকে ইলেকট্রনিক্সের কিছুই পড়ানো হয়নি (যদিও ওরা ইলেক্ট্রনিক্স ও কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের ছাত্র)।

ফার্মগেটের ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পরে সরকার বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলো, ৬টা বাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতে ওটাও ছিলো। এখন আবার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক মন্ডলীর প্রায় সবাই ছিলো ভবন মালিকের পরিবারের সদস্য।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক আচরণে নিরীহ ছাত্ররা প্রতারিত হয়ে অনেক সময় প্রচন্ড ক্ষেপে উঠে। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির জন্য যেরকম আন্দোলন হয়, সেরকম আন্দোলন অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও হতে দেখা গেছে, তবে তা অনেকাংশেই বঞ্চিত ছাত্রদের আন্দোলন। জিগাতলার আশে পাশের এক বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি কিছু ক্লাস নিয়েছিলাম। ওখানে একদিন গিয়ে দেখতে পাই, রীতিমত ভাংচুর চলছে। ছাত্ররা ইট পাটকেল ছুড়ে কাঁচ ভাংছে, এবং পরের সপ্তাহ খানেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিলো। অবশ্য কেনো ছাত্ররা ক্ষেপেছিলো, তা সহজেই অনুমেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের "ভবন" বলতে দুইতলা একটি বাসাবাড়ি, আর ক্লাসের অনেক গুলাই হয় দুই গলি পরে আরেক চিপা গলির ভিতরে ৫ তলা একটা ফ্ল্যাট ভবনের ৪র্থ ও পঞ্চম তলায়। বিপুল অংকের নগদ টাকা খরচ করে যদি ছাত্ররা কিন্ডারগার্টেন পর্যায়ের স্থাপনা পায়, তাহলে এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

অনেক সময় একই ভবনের এক তলায় একটা, অন্য তলায় আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় আস্তানা গেড়ে আছে। অনেক সময় কোচিং সেন্টারের বিভিন্ন শহরের শাখার মতো অমুক ইউনিভার্সিটিরও ঢাকা বা চট্টগ্রাম শাখা খোলা হচ্ছে।

সরকারের কী করার আছে? অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা। যাকে তাকে অনুমতি না দেয়া, নিজস্ব ক্যাম্পাস ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে না দেয়া। ধানমন্ডি এলাকার ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে ১ বছরের মধ্যে সরিয়ে নিতে বলা। স্থায়ী শিক্ষক ও অস্থায়ী শিক্ষকদের অনুপাত কেমন হবে, তা বেঁধে দেয়া। সর্বোপরি, কিছু দিন পর পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনঃর্বিবেচনা করা।

শিক্ষা একটা পবিত্র বিষয়, সেটাকে পণ্যে পরিণত করে ফেললে ভবিষ্যত ধাবিত হবে অন্ধকারের দিকেই।

(শেষ)

(প্রথম প্রকাশ সামহয়ারইনব্লগ, মার্চ ২০০৭)


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ভবিষ্যত ধাবিত হচ্ছেই অন্ধকারের দিকে ।
----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

তিন পর্ব একসাথে পড়লাম। সময়োপযোগী লেখা।

দিগন্ত এর ছবি

খুব ভাল লেখা, এই সমস্যা এখন আমাদের দেশেও একই রকম। বরং আমাদের এখানে অনেক আগে থেকেই এই অবস্থা। তবে এর বাস্তব সমাধানের খুব একটা রাস্তা নেই। সরকারের ক্ষমতা নেই সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কন্ট্রোলে আনার। একমাত্র জনগণ যদি এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন নিয়ে কিছুটা জানে আর মিডিয়া যদি কিছুদিন উঠেপড়ে লাগে, তবেই যদি কিছু হয়। টাকার দুনিয়ায় সে আশা কমই ... আমার ধারণা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উচ্চশিক্ষার হাল এরকমি ... শুধু স্ট্যান্ডার্ডটা হেরফের হয়।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

রাগিব এর ছবি

অরূপ, অবশ্যই শোনা যাবে। আপনি কখনো যদি সিএসই বুয়েট মেইলিং লিস্টের সদ্স্য হন, তাহলে সেখানে দেখবেন বুয়েটের সংস্কারের বিষয়ে আমার লেখা পোস্ট।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমার দৌড় বুয়েট পর্য্ন্ত, তাই অন্যগুলার সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলতে পারছিনা। চেপে যাওয়ার কারণটা আসলে আমার নিজেরই অজ্ঞতা, আর কিছু না।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

পড়াশুনার মান বিবেচনায় বুয়েট চমৎকার। তবে এটা শুধু ম্যানজেমেন্ট বা শিক্ষকদের ক্রেডিট নয়; কারণ, বুয়েটের অনেক শিক্ষকই স্টুডেন্ট হিসেবে যত চমৎকার, শিক্ষক হিসেবে ততোই বাজে মূলত কম্যুনিকেশন সমস্যার কারণে। ছাত্ররা মেধাবী এবং পরিশ্রমী হওয়াতে পড়াশুনার ওভারঅল মান বজায় থাকে। রাগিব একমত না-ও হতে পারে; কিন্তু বুয়েটের টেনেটুনে পাস করা ল্যাগার স্টুডেন্টদেরও মেধা এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতা দুটোই আছে। প্রাইভেট ইউনির ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে এই পোস্টের কথাগুলো যেমন সত্য; তেমন স্টুডেন্টদের পড়াশুনা করাতে ম্যানজেমেন্ট বা শিক্ষকদেরকে অনেক বেশি ঘাম ঝরাতে হয়-এটাও সত্য।

শিক্ষাকে যতোই পবিত্রতার আবরণ দেয়া হউক, সেটা আলটিমেটলি পণ্যই। শিক্ষা পণ্য হওয়া তেমন কোনো সমস্যা না, সমস্যা হলো সেই পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা। পণ্যের মান কমলে পণ্যের বিপনণও মার খাবে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এখানে আমি ছাত্র আর অভিভাবকদেরকেও দায়ী করি ।কোন অভিভাবক যদি তার ছাত্রকে ফার্মগেট টেম্পু স্টেশনের একটা মার্কেটে ভর্তি করিয়ে দেন,তাহলে তিনি ভালো লেখাপড়া কিভাবে আশা করেন,জানি না ।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে ছাত্রের ধারন ক্ষমতার কথা ।
মফস্বলের অখ্যাত কলেজ থেকে পাস করা একটি গড় মানের ছাত্রের যে বেসিক জ্ঞান সেটা দিয়ে সে যদি কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে চলে আসে,তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সেই ছাত্রের অভিভাবকদের দায়ও থেকে যায় সমপর্যায়ে ।

হ্যা,একটি জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট পড়তে যে শুধু দুইটা স্ট্যান্ড লাগবে এমন কথা নেই,কিন্তু মিনিমাম দুইটি ফার্স্ট ডিভিশান তো থাকা উচিত ।
সেইটুকু থাকলেই আমি আমার পোষ্যকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবো।

আমার এক বন্ধু একবার জরিপ করে জানিয়েছিল যে,একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসইতে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্রদের ৬০ শতাংশ জীবনে কোনদিন কম্পিউটার চালায় নি ।আরো ১৮ শতাংশ কম্পিউটার দেখেনি কাছাকাছি থেকে কোন দিন !!!

সিএসই পড়া যে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে টাইপ করা শেখা নয়,এটা অভিভাবকদের বোঝানোর মতো দায়িত্বও কোন মিডিয়া কোনদিন নেয় নি ।

আর তাই যার যেখানে ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করে ফেলছে ।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

সিএসই পড়তে আসলে কম্পুটারের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার তেমন কোনো দরকার নেই। যুক্তিতে ভালো প্লাস লেগে রাহো মুন্না ভাই - এই হলেই ১০০ তে ১০০। যুক্তিতে মোটামুটি; কিন্তু মুন্না ভাইয়ের মত ধৈর্য হলে সফটওয়্যার ডেভেলপিং এ ভবিষ্যত উজ্জ্বল; আর যুক্তিতে ভালো না হইলে গুগল সার্চ দিয়া জোড়াতালি।

মফস্বলের অখ্যাত কলেজের উপমাটা ঠিক মানানসই না। ঢাকার কোনো কলেজের স্টুডেন্টের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু একই রকম রেজাল্ট করা মফস্বলের একটি ছেলে সাধারণত বেশি মেধাবী। একটু ধৈর্য ধরে কাজ করতে পারলে অভিজ্ঞতার ঘাটতিকে কাটিয়ে ওঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অভিভাবকরা অবশ্যই দায়ী। কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মত এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে ওঠার দায়ভার আমাদের অপরিকল্পিত এবং অপর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর পড়ে। একটা ছোট উদাহরণ দেই। এবার যতদূর মনে পড়ে ৭০০০+ স্টুডেন্ট জিপিএ ৫ পেয়েছে। এদের সিংহভাগই বিজ্ঞানের স্টুডেন্ট। এদের ৬০% ও যদি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়, তার মত পর্যাপ্ত ইউনিভার্সিটি কি আমাদের আছে? এটা গেলো ৫ পাওয়াদের কথা। আমাদের এক বন্ধু বুয়েটে কম্পুটারে পড়তো। বিজ্ঞানের সাবজেক্টগুলোতে ৯৫% মার্ক্স; কিন্তু সাহিত্যে টেনেটুনে (<৪০%) পাস। বর্তমান গ্রেডিং সিস্টেমে তার রেজাল্ট কোথায় গিয়ে দাড়াতো? অতএব, ওই ৫ পাওয়াদের বাইরেও একটা বিরাট মেধাবী ছাত্রগোষ্ঠী আছে, যাদের জন্যও অনুরূপ শিক্ষার সংস্থান থাকতে হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য, শিক্ষা নিয়ে যারা পরিকল্পনা করবে, তারা হয় বেকুব, নাহয় দুর্ণীতিপরায়ণ। পর্যাপ্ত ইউনিভার্সিটি না থাকার কারণে স্টুডেন্টদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হয়; প্রাইভেট ইউনিগুলো আসে একটি বিকল্প সমাধান হিসেবে। যার বাপের টাকা আছে, সে বিকল্পটাকে বেছে নেয়; যার নেই, তার .......। এখানে ডিমান্ড-সাপলাইয়ের প্রশ্ন তুলতে পারে অনেকে। অনেকেই বলবে, দেশে এত ইঞ্জিনিয়ার কোন কাজে লাগবে? ফ্যাক্ট হলো, দেশ প্রতিবছর ৫০০ ইঞ্জিনিয়ার প্রোডিউস করলেও তার ৪৫০ জন দেশের বাইরে যাবে। অতএব, ডিমান্ড-সাপলাইয়ের সমীকরণ দিয়ে 'ইঞ্জিনিয়ার দরকার নেই' নীতিকে হালাল করা যায় না। এরপরে আসবে সেই অমোঘ প্রশ্ন। দেশের এই সুসন্তানগুলো দেশের বাইরে গেলেই দেশের বিরাট লস। আসলে লস, নাকি উন্নত টেকনোলজির অভিজ্ঞতাঅর্জন এবং দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার অবদান - কোনটা বেশি লাভজনক, সে আলোচনায় আর না যাই!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

আরিফ জেবতিক এর ছবি

মফস্বলের "গড় মানের" শব্দটি আমার কমেন্টে ...খিয়াল করে।

আমি এবং আমার মতো অনেক মানুষই মফস্বল থেকেই আসা,সুতরাং আপনার সাথে একমত যে মফস্বলেও অনেক মেধাবী থাকে ।মফস্বল থেকে আসা আমরা অনেকেই চাকরি জীবনে একবছরে ৩টা ইনক্রিমেন্ট পেয়েছি,যেখানে অনেক ভালো রেজাল্ট করা জার্নালিজমের ছাত্র একই অফিসে ৩ বছরেও একটা ইনক্রিমেন্ট পায় নি।
অন্যান্য পেশাতেও আমার বন্ধুরা অনেকেই দেশ ও দেশের বাইরে ভালো ফাইট দিয়েই টিকে আছে,ভালো করছে ।

কিন্তু আমার অনেক বন্ধুই তখন বাপের টাকার জোরে ঢাকায় পড়তে এসে দুই তিন বছর গুতাগুতি করে আবার ফিরে গিয়ে পাসকোর্সে ডিগ্রী দিতে হয়েছে,সেটাও ভুলতে পারছি না ।

আপনার বাকী কথাগুলোর সাথে একমত ।

রাগিব এর ছবি

আমি আমার স্বল্পদৈর্ঘ্যের শিক্ষকতার জীবনে যে কয়টা প্রাইভেটে পার্ট টাইম পড়িয়েছিলাম, সে গুলোর মধ্যে উচ্চবিত্তদের প্রাইভেট থেকে শুরু করে মধ্য বিত্তদের প্রাইভেট - দুইটাই ছিলো।

আই ইউ বি ছিলো মালদার লোকেদের ছেলেপেলের জন্য। বিশাল ভাব, আর চকচকে প্রস্পেক্টাস। "নর্থ আমেরিকান ডিগ্রিওয়ালা" টিচার। গাড়ি হাঁকানো ছাত্র। আর সেই তুলনায় আহসানুল্লাহ, গাব বা ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ছিলো মধ্যবিত্ত্ব পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। রিকশায় চেপে ছাত্ররা আসে ক্লাসে, ক'দিন আগে হলেও ওরা কলেজে অনার্স বা পাস কোর্সেই পড়তো। কালের হাওয়ায় "কম্পিউটার সাইন্স" পড়ার ফ্যাশনে চেপে এসেছে "বিশ্ববিদ্যালয়ে"। ওদেরকে এসব "বিশ্ববিদ্যালয়" কিভাবে ঠকাচ্ছে, সেটা দেখতে খুব খারাপ লাগতো।

আর এদের ভবিষ্যতটা কী, তাও চিন্তা করতাম। আই ইউ বি'র গাড়ি হাঁকানো পোলাপাইন বাপের কোম্পানিতে বা চাচার রেফারেন্সে চাকরি মুখে করে এসেছে দুনিয়াতে, হাবজাব শিক্ষাতে সমস্যা নেই। কিন্তু জমি বেচা টাকা, বা পেনশনের টাকার শ্রাদ্ধ করে যেসব মধ্যবিত্ত্ব ছেলেপেলে "গাব" এ পড়েছে, তাদের কী হবে?

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

রাগিব, প্রাইভেট ইউনিভেদে স্টুডেন্টদের (বরং স্টুডেন্টদের বাপের)স্ট্যাটাসের বিশ্লেষণ ১০০% ঠিক। তবে প্রাইভেট ইউনিতে পড়া সবাইকে পরবর্তীতে শুধু বাপের স্ট্যাটাসের ওপর নির্ভর করতে হয় না। আহসানউল্লাহর অনেক ছেলেপেলে এখন খুবই ভালো অবস্থায় আছে। জার্মানিতেই আমার বেশকিছু ফ্রেন্ড এবং ছোট ভাই আছে আহসানউল্লাহর। এই দিক দিয়ে প্রাইভেট ইউনির অবদান প্রশংসাযোগ্য। পাস কোর্সে অনার্স পড়ার চেয়ে যেকোনো প্রাইভেট ইউনির সার্টিফিকেট আলটিমেটলি বেশি কাজে লাগে। আর এদের সবাই শুধুমাত্র সার্টিফিকেটধারী না, যথেষ্ট কোয়ালিফাইডও।

আহসানউল্লাহ থেকে কম্পুটারে পড়া এক ফ্রেন্ড ৭৫K+ ইউরোর জব করে। হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার থেকে এ্যাকাউন্টেন্টের সংখ্যা থাকে বেশি
সারা বছর তারা যত নোটিশ দেয় তার মধ্যে ৯৯% থাকে টাকা এবং টাকা নিয়ে আর ১% এ্যাকাডেমিক বিষয়ে....
এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন করলে ভালো হয়
তাহলে আর খামাখা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে টানাটানি করতে হবে না
তখন সম্পর্কটা হবে ক্লায়েন্ট-সেলসম্যান

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হাসি

রাগিব এর ছবি

এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার থেকে এ্যাকাউন্টেন্টের সংখ্যা থাকে বেশি

আপনার এই কথাটা পুরো ঠিক। গাব-বিশ্ববিদ্যালয়ে (Green univ of Bd) আদৌ কোনো স্থায়ী শিক্ষক ছিলো না, অবিশ্বাস্য হলেও নিজে সেটা দেখেছি। গাবের ছিলো কেবল একজন কেরানী - কোর্স কো-অর্ডিনেটরের মতো গালভরা নাম দেয়া, কিন্তু কাজ করতো কেরানীরই। এ ছাড়া পুরা ভবনে আর কাউকে দেখা যেতো না।

গাব "বিশ্ববিদ্যালয়" হওয়ার আগে ধানমন্ডিতে একটা কলেজ হিসাবে ছিলো (নাম ভুলে গেছি), এখানেই আমার ঐ বন্ধু ছাত্রাবস্থাতেই "প্রফেসর" সেজে পড়াতে যেতো।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

অতিথি লেখক এর ছবি

রাগিব ভাই, আপনাকে খাটো করছি না নিচের কথাগুলো বলে।

আপনার মত মেধাবী লোক কি বুঝে বাজে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াতে গিয়েছিল - আমি বুঝি উঠতে পারি না। এর চেয়ে গবেষণায় সময়টা ব্যয় করতেন!

ফেরারী ফেরদৌস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।