ফিরে দেখা:অপারেশন সূর্যদীঘল বাড়ি-(৩)

নজমুল আলবাব এর ছবি
লিখেছেন নজমুল আলবাব (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০৩/২০০৭ - ৪:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


1ম পর্ব
----------------------------------------
2য় পর্ব
-----------------------------------------
রাত প্রায় সাড়ে 12টা। স্বপন নামের একজন ফটোগ্রাফার বেরিয়ে এল গলির ভেতর থেকে। জানাল ভেতরে একটি বিশেষ বাড়ি ঘিরে জমায়েত হচ্ছে র্যাব। দিলাম ভো-দৌড়। আমাদের আশেপাশে থাকা র্যাব সদস্যরাও সচল হলেন। একজন এমনকী ডাকও দিলেন, ভাইজানেরা কিছুকি পাইছেন! উত্তর না দিয়েই ছুটলাম। শাপলাবাগ নতুন মসজিদের গলিতে ঢুকলাম আমরা কয়েকজন। গিজ গিজ করছে কালো পোষাক। সামনে এগোনো নিষেধ। তবুও আমরা ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে সামনে যাই। এখানে মজার একটা তথ্য হল, গ্রুপ গ্রুপ হয়ে দাড়ানো র্যাবের সৈনিকরা আমাদের দাড় করিয়ে উল্টো তথ্য জানতে চাইছিলেন। প্রথম দিকে সবাইই প্রায় হতচকিত হলেও এটাই হয়ে গেল ঢাল। বুঝলাম অফিসারের অর্ডারে মার্চ করলেও এদের কাছে কোন তথ্য নেই। তাই, গল্প জমিয়ে জমিয়ে সামনে এগুচ্ছিলাম। কিন্তু এক সময় থামতেই হল। মসজিদের সামনে যেতেই এগিয়ে এলেন, এ এস পি হায়দার। ভদ্রলোক র্যাব-9 এর কর্মকর্তা। কিছুটা পরিচিত আমাদের। থামিয়ে দিয়ে বল্লেন, আর এগুনো যাবেনা। হাই রিস্ক। ঘটনার ব্যাপারে ধারনাও পাওয়া গেল কিছুটা। 1শ গজ দুরের ্কটি বাড়ি দেখিয়ে বল্লেন, তল্লাসি করার সময় ওই বাড়ির কেউ দরজা খুলেনি। উল্টো এক কিশোর জানলা দিয়ে হুমকিও দিয়েছে। তাই বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছে। এরচেয়ে বেশি কিছু জানালেননা তিনি। ( পরে বুঝেছি তথ্যগুলো চেপে গিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য তাতে খুব সমস্যা হয়নি। জাতিয় পত্রিকার ছাপা শেষ তখন। আর স্থানিয়গুলোতে ততক্ষনে কাজ বন্ধ করে বড় খবরের প্রতিক্ষা।)

হালকা পাতলা গড়নের একজন অফিসার এসে সেই কথা বলাও থামিয়ে দিলেন। পরে জানলাম ইনি লে. কর্নেল গুলজার। র্যাব এর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। সরে আসলাম। এই ফাঁকে অনেকেই চেস্টা করলেন ঢাকায় নিউজ ধরাতে। সে আরেক মজার ঘটনা। এ বলছে শায়খ রহমান ধরা পড়েছে, তো ও বলছে শায়খ রহমান বোমা ফাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রাত তখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাসার সামনে দাড়িয়ে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে, ভেতরে যারা আছেন তারা যেন বেরিয়ে আসেন। তবুও সাড়া নেই। কিছুন পর, পাশাপাশি থাকা অন্য বাড়ি থেকে মানুষজন সরানো আরম্ভ করল র্যাব। এদর সাথে কথা বলে জানা গেল, বাড়িটির নাম 'সূর্য্যদীঘল বাড়ি'। র্যাব সদস্যরা আবার আমাদের তাড়া লাগালেন। একজন ক্যাপ্টেন এসে বল্লেন, তারা এ্যাকশনে যাবেন। আমরা যেন নিরাপদ দুরত্বে সরে যাই। স্বরন করিয়ে দিলেন কয়েকদিন আগেই ময়মনসিংহে ঘটে যাওয়া এনকাউন্টারের কথা। সেখানে বোমা ফাটিয়ে জঙ্গিরা পালিয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়েই সরে আসলাম প্রায় 1শ গজ। দেয়াল ঘেরা একটি ফাকা প্লটে এস দাঁড়ালাম আমরা। এসময় পুরো এলাকার বিদ্যুত সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।

রাত দেড়টা পেরিয়ে গেছে। পেটে দানাপানি নেই। এমন সময় সিনিয়ার এক ভাই ডিম পারাটা নিয়ে এলেন। তাই ভাগাভাগি করে খাওয়া হল। এসময় আমার আরেক সহকর্মী আবদুর রাহমান ফিরে গেলেন অফিসে। কথা হল, ফোনে তিনি জেনে নেবেন পরিস্থিতি, তার পর লিখবেন অফিসে বসে। এছাড়া আর কিছু করারও ছিলনা। পরের দিন এর ফলও পেয়েছিলাম। স্থানিয় যে দৈনিকে (জালালাবাদ) তখন আমরা কাজ করতাম সেটি বাজারে আসার ঘন্টা দেড়েক পর অন্য দৈনিকগুলো বাজারে এসেছিল। রাত 2টা। মেগাফোন হাতে নিলেন লে. কর্নেল গোলজার। এই প্রথম সেখানে শায়খ রহমানের নাম উচ্চারিত হল। তিনি ডাকলেন, শায়খ রহমান আপনি বেরিয়ে আসুন, আমরা আপনাকে ঘিরে ফেলেছি, পালাবার পথ নেই। নিরবতা নেমে এসেছে আমাদের মাঝে। কান পেতে আছি উত্তর শোনার জন্য। কোন সাড়া নেই। আবারও ডাকা হল। নিঃশব্দতা শুধু। উত্তেজনা বাড়ছে।

প্রায় 10 মিনিট পর, ভেসে এল জলদগম্ভির কন্ঠ- আপনারা ভুল করছেন। আল্লাহর পথে আসুন। বাতেলের পথ ত্যাগ করুন। আমাকে ধরা সম্ভব নয়। আপনারা আমার কাছে আত্মসমর্পন করুন। তারপর কোরআনের আয়াত বলা শুরু করলেন। তাকে থামিয়ে দিয়ে এ প থেকে বলা হয়, এভাবে কথা বলা যায়না। শায়খ রহমান আপনি বেরিয়ে আসুন... বলতেই ধমক, ' আমাকে শায়খ নামে ডাকবেননা, মুজাহিদ বলুন, আমরা মুজাহিদ।' শুরু হল কথা বিনিময়, ধমক ধামক। আমরা চরম উত্তেজিত। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা যেন! আমাদের হাতের নাগালে কুখ্যাত শায়খ। ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল! হঠাৎ করেই শায়খ বলে উঠলেন, তিনি বোমা হামলা চালাবেন, আশেপাশে তার সঙ্গি সাথিরা আছেন তারা হামলা করে তাকে উদ্ধার করবে। আবারও র্যাব তাদের শক্তি বৃদ্ধি করল। আমাদের পিছিয়ে দিল আরও 1শ গজের মত। সত্যি বলতে বোমা হামলার হুমকিতে আমরাও ভয় পেয়ে গেলাম। আর কার কি হয়েছিল জানিনা। আমার চোখের সামনে সব প্রিয় মুখ ভেসে উঠতে লাগল।

মা সেদিন বাসায় ছিলেননা। তুলিও নেই। দাদাভাইয়ের ফোনে ফোন দিলাম। রাত আড়াইটা তখন। ভাবী ফোন ধরে বল্লেন কি হল, তুমি কি শ্বসুর বাড়ি চলে গেলা! এখনও বাসায় আসলানা। ঢঙটা টেনে নিতে পারলামনা। বল্লাম পুরো ঘটনা। দাদা টান দিয়ে ফোন নিয়ে জিঙ্গেস করল, কী। বলতেই হাউ করে উঠল। তার সেকী উত্তেজনা। তখনই সে চলে আসবে স্পটে। ঢুকতে দেবেনা বলে এড়িয়ে গেলাম। বল্লামনা শায়খের হুমকির কথা! ( পরে শুনেছি রাত 3 টায় বৌ-কে নিয়ে প্রায় 8 কি.মি. দুরের টিলাগড়ে সে এসেছিল। র্যাব ফিরিয়ে দেয়ার পর মন খারাপ করে বাসায় ফিরেছে!!!) ফোন করলাম মামাকে। আম্মার কথা জিঙ্গেস করতেই তিনি আম্মার হাতে ফোন তুলে দিলেন। তিনি তখনও মামীর সাথে গল্প করছেন। তাকেও জানালাম, সাথে সাথে আতঙ্ক। কেন আমি সেখানে গেলাম বলে গালিগালাজ শুরু হল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে মামাকে ফোন দিতে বল্লাম। মামাকে বল্লাম হুমকির কথা। সবশেষ ফোন তুলিকে। খুনসুটি করলাম। একফাকে টুক করে বলে ফেলি কোথায় আছি তখন। বলি বাবাই কি করে? ও ফোনে বাবাইর এক বছর বয়সি কুই কাই শুনিয়ে দেয়। তুলিকে বলি ভাল থেক। ও তাড়া দেয় তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যাও। আচ্ছা, বলে ফোন রেখে দিই। বলা হয়না, হয়ত এটাই তোমার সাথে শেষ কথা বল্লাম। কাউকেই বলা হয়নি, শেষবার প্রিয় মানুষগুলোর কন্ঠ শুনার জন্যই ফোন করেছি।

যারা পড়ছেন তারা হয়ত ভাবছেন, ন্যাকামো। কিন্তু পরিস্থিতি আসলেই ছিল ভয়ঙ্কর। আমার লেখার দূর্বলতার কারনে সেঠা বুঝাতে পারছিনা। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন এমন সিনিয়ারকেও দেখেছি ফোন করেছেন ঘরে। বলছেন, ফিরতে পারছিনা, ভাল থেক...

রাত সাড়ে তিনটার দিকে শায়খ হুমকি দিলেন, আধা ঘন্টার মধ্যে অবরোধ তুলে না নিলে তিনি বোম ব্লাস্ট করে পুরো এলাকা উড়িয়ে দেবেন... এই হুমকির পর র্যাব কর্মকর্তারা পরবর্তি করনিয় নির্ধারনের জন্য কথা বলা শুরু করেন। শুনসান নিরবতা নেমে আসে চারদিকে। আতঙ্ককে সাথী করে আমরা কয়েকজন মানুষ কুয়াশায় ভিজতে থাকি...

(চলবে)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।