হুঁক্কুঁ (শেষ পর্ব)

জুলফিকার কবিরাজ এর ছবি
লিখেছেন জুলফিকার কবিরাজ (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৩/২০০৯ - ৫:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হুঁক্কুঁ (শেষ পর্ব)

দুপুর না গড়াতেই ঘটনাটি অনেকের কানে কানে ছড়ায়ে গেল । সবাই ঘটনাটা বেশ উপভোগ করল। তারা কেউ কেউ নিজে নিজে উচ্চারণ করল - হুঁক্কুঁ। উচ্চারণ করে একা একাই হাসতে লাগল। তিন চার জন মিলে কোরাসও শুরু করল – হুঁক্কুঁ, হুঁক্কুঁ, হুঁক্কুঁ। আহা কী সুন্দের নাম। হাসির একটা রোল পড়ে গেল।

পর দিন মোরের দোকানে এই নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে। ঐ দেখ লিটন যাচ্ছে, লিটনেক ডাকেক, উচ্চেরণ সোয়ি করে লেই। লিটন দেহতো ভাই আমারে উচ্চেরণ ঠিক হতেচে কী না, তুমি দুই একবার কও আমরা তুমার সাতে সাতে কই। লিটন বলল, ‘হতেছে তয় (তবে) মজাডা ঠিক তাল পাচ্চে না। ‘হ’ লাকের (নাকের) ভিদেন (ভেতর) লিয়ে ‘হ’-র উপের একটা ধাক্কা মারে উচ্চেরণ করা লাগবি ‘হুঁহ্’ তার পর দোম আটকা রাখি ‘ক’ লাকে রাখেই আরেকটা ধাক্কা মারে উচ্চেরণ করেই আলগোছে ছাড়ে দিয়ে ‘কুঁ’ কওয়া লাগবি’। সবাই লিটনের সাথে সাথে বার বার হুঁক্কুঁ উচ্চারণ করে কৌশলটা বুঝে নিল।

এর পরে হাটে-মাঠে যেখানেই মণ্ডল বাড়ির যার সাথেই দেখা হতে লাগল তাকেই লোকে হুঁক্কুঁ বলা শুরু করল। তারা যতই রাগতে লাগল রাগানোর মাত্রা ততই বৃদ্ধি পেল।

বাড়ি সংলগ্ন বাগানে টেনু মণ্ডল তার নাতি হামজাকে নিয়ে হাটা শিখাচ্ছে। ‘হ্যাঁ আরেক পা আরেক পা হ্যাঁ বেশ আরেক পা বা বা বাহ্, বেশ’ – খুশিতে মণ্ডল হাত তালি দিয়ে উঠল। সাথে সাথে ঝোপেঁর আড়াল থেকে অনেকগুলি হাত তালি শুরু হওয়ায় টেনু থেমে গেল। লিটন বলে উঠল,
-সাবাস হুঁক্কুঁ সাবাস! আর একটু হাটলিই তোর নানার রাজ্য জয় করে ফেলবু, থামিসনে হুঁক্কুঁ থামিসনে চালায়ে যা।

টেনু রেগে গিয়ে গালি শুরু করে দিল,
- কোন বেজন্মার ঝাঁড় আমার লাতিক উল্ট-পালট লামে ডাহে (ডাকে); তার বাড়িত গজব পড়ুক, তার বংশ নিপাত যাক, কত সুন্দের দেহে লাম রাকলেম আর এই শুয়েরের বাচ্চারা ডাহে কি লামে।
- হুঁক্কুঁ আরো সুন্দের । একবের ডাহেই দেহো তুমার বুকডা শান্তিত ভোরি যাবি।
- খারা মজা দেহাচ্চ।
সবাই পালায়ে গেল।

টেনুর কাছে ব্যাপারটা হরষে বিষাদ হয়ে দেখা দিল।তার পথ চলা ভার হয়ে গেল। সেই সাথে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা রাস্তায় বের হলে তাদেরকেও বলে, কিরে হুঁক্কুঁ কোনে যাস? কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেগে যাবার ব্যাপারে তারা টেনুকেও ২/১ ডিগ্রী ছাড়ায়ে গেল।

এক দিন এক দাওয়াত বাড়িতে লিটনের সাথে হামজার বাবার দেখা হল। সে জানতে চাইল,
- লিটন তুমরা আমার ছাওয়ালডাক ভ্যাংয়াও ক্যা?
- আসলে আপনের শ্বশুরির সোয়ি সোয়ি (সহী) খেলার পাগলামির লেগেন এই কাম করিচি। দেহেন পাড়া সুদ্দি (ধরে) ২/১ ঘর বাদে সবই তো আমরা মোসলমান, সগলতেরিতো (সবার) একটা ইসলামি নাম আচে। কারু নাম আল্লার ৯৯ নামের সাতে মিল করি রাহা (রাখা), কারু নাম নবী-রসুলির নামের সাতে মিল করি রাহা, আবার অনেকের নাম হাদিস কুরান থে রাহা সে সব নাম তো আমরা আরবী বোলে উচ্চেরণ করিনি, মায়ের মুখির বোলেই উচ্চেরণ করি। তার বাদেও মার কোল থে গোর পন্তক (পর্যন্ত) সব কতাইতো আমরা দেশাল টানে কই; সেনেতো কুনো অসুবিদি হয় না। খালি (শুধু) তুমার ছাওয়ালের বেলাই সোয়ি করি কওয়া লাগবি। তুমার নিজির মুখির বোলই কী খুব সোয়ি? তুমি নিজিই কী তুমার নামডা ঠিক মত কবের পার? না যে গাঁয়ে জন্ম লিছ্যাও সেডিই ঠিক মত আওরাও? মণ্ডলও কী পারে?

নানা নাতি পুকুর ঘাটে গোছল করছে দেখে ঘেঁটু বনের আড়াল থেকে একজন বলে উঠল,
- কিরে হুঁক্কুঁ নানার সাতে লাতিছিস (গোসল করছিস)? লা লা ভাল করি লা।
টেনু জুতা ছুড়েঁ মারল। তাতেও কাজ না হওয়ায় লাঠি নিয়ে তেড়ে গেল। কিছু দূর যাবার পর রুমি বলল, মণ্ডল তুমার লাতি পানিত পড়েছে। তারা টেনুকে রাগানো বাদ দিয়ে দৌড়ে এসে হামজাকে পানি থেকে তুলল। টেনুকে বাড়িতে খবর দিতে বলে রুমি ও লিটন হামজাকে কাঁধে করে দৌড়াতে দৌড়াতে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
হামজা সুস্থ হয়ে ফিরে আসলে মণ্ডল সালিস ডাকল। সে সত্য-মিথ্যা জুড়ে বলল, ‘ঐ আকুব্বর (আকবর)-এর ছাওয়াল লিটন ইচ্চে করি আমার লাতি ডাক পানিত ফালায়চে’।

এলাকার মাতব্বররা লিটনকে শাস্তি দিল।

টেনু নিরুপদ্রপেই দিন কাটাতে লাগল। সে বলে বেড়াতে লাগল ব্যাটাক যে শিক্কি দিচি
লজ্জা থাকলি আর আমাক লারবি লায়।

আল পথ ধরে টেনু হাটে যাচ্ছে দেখে লিটন দল বল নিয়ে পিছু নিল। টেনু লিটনকে দেখে টিটকারির হাসি হেসে বলল, লজ্জা হয়চে তো? আমার পিছোনে ফেউ লাগা; ঠ্যালাকিন বুজিছিস তো? ক্যাম্বা লাগে? দেখ্ ল্যাং ঘুরে দিলেম।
- আসলে দাদা ভুল হয়ে গেচে, মাপ করি দিয়েন।
- একুন মাপ? হে হে ঠ্যালায় পোলি বাগেও ধান খায়।
মাঠ বেশ নির্জন দেখে লিটন বলল, লে সগলে মিলে ধর -
থুক্কু থুক্কু,
আর কব লা হুঁক্কুঁ।
হুঁক্কুঁ হুঁক্কুঁ,
আর কব লা থুক্কু।
থুক্কু থুক্কু,
----
মিছিল করতে করতে লিটন টেনুকে পাশ কেটে বের হয়ে গেল।

রাতে মোরের সজনে তলায় লিটন তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। আড্ডার বিষয় বুশ ইরাক দখল করবে কিনা, দখল করলে সাদ্দাম কি ভাবে তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিবে। টিপু বলল
- অলৌকিক ঘটনা ঘটা ছাড়া সুমকা-সুমকি যুদ্দি ইরাক পারবি লায়। কানাই একটু হ্যাবলা গোছের ছেলে। সে বলল,
- অলৌকিক ঘটনা কি জিনিষ বুজলেম না।
টিপু বলল
- মনে কর আমেরিকার সোন্যরা একটা ইসকাট খেপন মারলে, সে ইসকাট ইরাকে না যায়ে ঘুরে সুজা বুশের গুয়ার ভিদেন (ভেতর) সাধা (ঢুকে) গেল, তার নাম অলৌকিক। বুজিছিস’?
- হ্যাঁ এই বের বুজিছি।
এক জন অপরিচিত লোক সাইকেল থেকে নেমে টর্চের আলো জ্বেলে বলল,
-ভাই মুক্তার কোন বাড়ি থাকে?
- কোন মুক্তা
-মাস খানেক হোলি ঢাকায় গার্মেন্টে কামে গেছে, নানার নাম টেনু মণ্ডল। উরা নানার বাড়িতই থাকে।

- একটু আগে যায়ে ২ বাড়ি পরে হাতের বামের বাড়ি।
- মুক্তার তো বাড়ি নেই কাক ডাক দেবো?
- হুঁক্কুঁ কয়ে ডাক দেন গা বার হয়ে আসপিনি। রাস্তা ঘেসে যে দোচালা খেরে (খরের ) ঘর, ঐ ঘরেই হুঁক্কুঁ থাহে।

আসলে ঐ ঘরে থাকে টেনু।

লোকটি ডাকা শুরু করল, হুঁক্কুঁ, হুঁক্কুঁ, হুঁক্কুঁ, হুঁক্কুঁ ভাই বাড়িত আছ্যান।
- এ কোন শুয়েরের বাচ্চারে, আঁদার রাতি আসি হুঁক্কুঁ হুঁক্কুঁ ঠাপাচ্চে। খচ্চর গুলেনের লেগেন রাতির বেলা ইকটু চোকের পাতাও এক করা যাবি লায়।
পশ্চিমের ভিটে থেকে হুঁক্কুঁর আব্বা চেচাতে লাগল, কি হয়চে আব্বা কি হয়চে?
- আর কোসনে, বিছেনে গতর এলা কেবলই ইকটু আলছা ঘুম (তন্দ্রা) গিচি; অম্বাই কোন হারামজাদা আসি হুঁক্কুঁ হুঁক্কুঁ মারাচ্চে।
হুঁক্কুঁর আব্বা গলা চড়ায়ে দিয়ে বলল, ফাট্টা শালাক ফাট্টা।
লোকটি ভয় পেয়ে মোড়ে এসে বলল, আরে ভাই কি শিকা দিলেন যে মারতি আসে।
- শিতির রাত, ঘুমির মানষেক কী অত জোরে ডাকে? জোরে ডাক শুনি ঘুমির মিতেলে (ঘোরে) আবল তাবল কচ্চে। ওদো মুক্তার আব্বা আসতেছে, বলেই সবাই ভেগে গেল।

- এ, হেনে চ্যাচা মেচি কিসিররে?
- চাচা মি, আমি মুক্তার সাতে ঢাকায় কাম করি। আমার বাড়ি পাটকেবাড়ি।
- হ্যাঁ তাই কি হয়চে?
- মুক্তার কয়ডা ট্যাকা পাটায়চে।
- ও আচ্চ আচ্চা; তে বাবা বাড়ির পর চল।
- না চাচা মি আপনে হেন থেই ল্যান, সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল ।

(শেষ)


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

কঠিন ভাষা, কঠিন গল্প।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

জুলফিকার কবিরাজ [অতিথি] এর ছবি

পড়েও কঠিন পাঠক

অম্লান অভি এর ছবি

কওতন দেহি হুঁক্কুঁ চাচা'র নাম কিহ্‌?
কতি পারলি তোমার জন্যি..............এক হান সেইতা দেওয়া হবিনি।

(ও ভাই কবর‌্যাজ........আমার 'কম্মেন্ডস' না হলি তুমি ভাই একটু লিহি দিয়ে হ্যা)

মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....

জুলফিকার কবিরাজ [অতিথি] এর ছবি

হেইতার আসা করি নেই। তয় চাচার নাম কব লা

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।