মানুষের পয়গম্বর হয়ে ওঠার সুলুক-সন্ধান: ভূমিকা

দীক্ষক দ্রাবিড় এর ছবি
লিখেছেন দীক্ষক দ্রাবিড় (তারিখ: রবি, ২৫/০৩/২০০৭ - ৯:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


ক্ষমতাবান সম্রাটরা আদিকালে নিজেকে ঈশ্বরই দাবী করতেন। জগতে সকল ক্ষমতা যার, প্রশংসা যার একক অধিকার, সিংহাসনে বসে মানব-উধর্্ব ক্ষমতার কল্পিত আস্বাদ পাওয়ার সাধ সেই পরাক্রমশীল নৃপতির হতেই পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যনত্দ পৃথিবীর অনেক জাতি-গোষ্ঠী-দেশে সম্রাট/রাজাধিরাজরাই ঈশ্বরের চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন। নিরীহ প্রজা সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে নিজেদের ধন-প্রাণ নিবেদন করেছে সেইসব ঈশ্বরদের পদতলে। কিন্তু মানুষের সাকার দেহ, মরণশীল জীবন, আর সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে ঈশ্বরের পদ দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায় নি।

তবু বিচিত্র জাতি-গোষ্ঠীর জন-মানবের উপর ছড়ি ঘুরানোর ক্ষমতা নির্বিঘ্ন রাখতে ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া ছাড়পত্র ছাড়া চলে কি করে? সুতরাং মানবের ইতিহাসে ঈশ্বরের পুত্র বলে নিজেদের দাবী করা লোকের সংখ্যাও একাধিক। তবে বাঘের বাচ্চার মত ঈশ্বরের বাচ্চা হয়ে ওঠার জৈব প্রক্রিয়া নিয়ে জনমনে সন্দেহের তালমিশ্রি জমাট বাঁধতে থাকলে এ পদ্ধতি ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তাই খুব বেশি ঈশ্বরের পুত্রকে পায়নি মানবসমাজ।

ক্ষমতার বিপরীত প্রানত্দে ছিল নির্যাতিতরা। ক্ষমতাবান শুধু সিংহাসনে বসেই নিজেকে ঈশ্বর কল্পনা করবে আর নিপীড়িতরা হাড়-চামড়া-সার হয়ে কল্পনাশক্তি হারিয়ে ফেলবে তাতো হয় না। তাদেরওতো কেউ কেউ সাহস করে ঘুরে দাঁড়ায়। তাদের সিংহাসন নেই রোমান বা মিশরীয় সম্রাটের মত। তারা তাই সম্রাট-ঈশ্বরের বিপরীতে নতুন ঈশ্বর বানানোর কায়দা আবিষ্কার করে। তারা ঈশ্বরের আবাস বানায় শূন্যে। সে ঈশ্বর চোখে দেখা যায় না, সে ঈশ্বর মানুষের শরীর ধারণ করেন না; তার সিংহাসন মর্ত্যে নয়, তিনি আছেন উধর্্বলোকে। তিনি শুধু পরাক্রমশালী অশ্বারোহী বাহিনীর নির্দেশদাতা নন, তার নির্দেশে সূর্য ওঠে, তারপর সন্ধ্যা হলে ডুবে গিয়ে আশ্রয় নেয় তার আসনের নীচে। তার আসন এমনই বিশাল, তার ক্ষমতা এমনই বিপুল।

ক্ষমতাবান-ধনাঢ্যদের কাছে পৃথিবীর বিলাসী জীবন বড়, আর বড় সিংহাসনে বসে থাকা প্রতাপশালী সম্রাট। সম্রাটের ক্ষমতায় যে রয়েছে তাদেরও অংশীদারিত্ব। নির্যাতিত-নি:স্ব-দরিদ্র-সহায় সম্বলহীন মানুষের পৃথিবীতো নরকবাসের সময়। তারা তাদের স্বর্গ বানায় শূন্যে, সর্বশ্রেষ্ঠত্বের ক্ষমতা আরোপ করে গড়ে তোলে তাদের মূর্তি। কিন্তু মূর্তি গড়ে তুললেই সে মূর্তি শুধু আমার বলে দাবী করা যায় না। ক্ষমতাশীল সম্রাট বরং আরো জোরে-শোরেই সে নতুন মূর্তির স্বত্ত্ব দাবী করতে পারে। সম্রাট তো আর সর্বময়ের ইচ্ছার বিরম্নদ্ধে পৃথিবীর ক্ষমতার সিংহাসনে বসেননি। বরং তিনিই তো নির্বাচিত পৃথিবীকে শাসন করার জন্য। ঈশ্বর যদি ভালইবাসেন তবে তিনি তার পছন্দের মানুষগুলোকে নি:স্ব করে বানাবেন কেন? বরং ঈশ্বরের করুণাপ্রাপ্তরা তো ইহ ও পরলোকে সমান ঐশ্বর্যশীল হওয়ার কথা।

কে হে তুমি, নি:স্ব দরিদ্র, বংশ-গোত্র-নাম পরিচয়হীন ধর্মপ্রচারক? কিসের বলে, কিসের ভিত্তিতে তুমি দাবী করো তোমার সাথে শূন্যের ঈশ্বরের যোগাযোগ? কেন তোমাকে ঈশ্বর নির্বাচিত করবেন? তুমি ক্যাডা?

"আমিই প্রেরিত পুরম্নষ। ঈশ্বরের কোনো পুত্র-কন্যা নাই। আমি পয়গম্বর। অবিশ্বাসীদের পথে ফেরাতে ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন।" স্বঘোষিত পয়গম্বর বের করেন ঈশ্বরের দেয়া পাথরের খন্ড। এই যে তাতে খোদাই করা ঈশ্বরের দশটি নির্দেশ। নিপীড়িত মানুষরা আশ্বাস পেয়েও যাচাই করে নেয়;

"কিন্তু সম্রাটকে ছেড়ে তোমার ঈশ্বরকে যদি আমরা মেনে নেই তবে কি তিনি সম্রাটের অত্যাচার থেকে আমাদের বাঁচাবেন? সব সময় তোমার সাথে থাকবেন? তোমার ঈশ্বর আবার সম্রাটের দলে ভিড়ে যাবেন নাতো?"

পয়গম্বর কণ্ঠ তীব্র করেন যাতে তাকে সম্রাটের চেয়েও ক্ষমতাশালী মনে হয়। তিনি জানান, ঈশ্বর আমার সাথেই থাকবেন। তেমনই কথা হয়েছে। তার সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়। তোমাদের কথাও আমি তাকে জানাতে পারি।

নিপীড়িত মানুষ আশান্বিত হয়। পয়গম্বর সম্রাট না হোক, ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্র না হোক, শূন্যের ঈশ্বরের সাথে তার নিয়মিত কথা হয়। তিনি তার প্রশ্নের উত্তর দেন। "সম্রাটের শোষণ-শাসন থেকে বাঁচবার জন্য এই 'পয়গম্বর'ত্ব দাবী করা লোকটির ওপর আমরা ভরসা করতে পারি"। সমর্থকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পয়গম্বর তাদের আশার কথা শোনান, আশ্বসত্দ করেন। কিন্তু তারা প্রশ্ন তোলে, তুমি কি তোমার ঈশ্বরকে দেখেছো। পয়গম্বর এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। শূন্যের ঈশ্বরের অসত্দিত্ব নিশ্চিত করতে তিনি জানান, ঈশ্বর আমাকে দেখা দিয়েছেন।

"ঈশ্বর আপনাকে দেখা দিয়েছেন! তাহলে সত্যি সত্যি আকাশে ঈশ্বর আছেন! তিনি আমাদের রক্ষা করবেন সম্রাটের অবিচার থেকে!"
"নিশ্চয়ই তিনি তা করবেন। তার সাথে আমার তেমনই কথা হয়েছে।"

যাদের কিছুই ছিল না, না ধন, না ক্ষমতা, না সাহস, না রম্নখে দাঁড়াবার ক্ষমতা তারা অকস্মাৎ সব পাওয়ার খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তাদের সাথে আছে শূন্যের ঈশ্বর! সে ঈশ্বরের পতাকা নিয়ে তারা খালি হাতে, নাঙা পায়ে, উদোম বুকে লড়াই করবে সম্রাট ঈশ্বরের বিরম্নদ্ধে। তাদের সাথে থাকবেন শূন্যের ঈশ্বর আর তার অদৃশ্য দেবদূতগণ।

পয়গম্বরের গাল-গল্পে বিশ্বাসী লোকদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। কিন্তু আর সব সাধারণ মানুষের মত মানুষ পয়গম্বর তার শূন্যের ঈশ্বর আর দেবদূতের সাহায্য নিয়েও নি:স্বদের নির্যাতনের সমাপ্তি ঘটাতে পারেন না। সুতরাং লক্ষ লক্ষ পয়গম্বর জন্মাতে থাকে আরবের উষর ভূমিতে। নিজেকে পয়গম্বর দাবী করা তখন তরম্নণ আরবদের হাল ফ্যাশন। আজকাল যেমন তরুণরা মডেল সাজে, নায়ক হয়, তখন যুবারা হতো পয়গম্বর (ব্যতিক্রম আছে একালের নায়কদের মধ্যে, নায়করাও কেউ কেউ পয়গম্বর হতে চান, যেমন হলিউডের টম ক্রুজ)।

কিন্তু পয়গম্বর হওয়ার তরিকা কেউ কাউকে জানান দেন না। না ঈশ্বর তার ঐশিগ্রন্থে না পয়গম্বর তার বাণী ও নির্দেশে, কোনভাবেই জানা যায় না, কী প্রকারে একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারে পয়গম্বর, নবী, প্রেরিত পুরম্নষ। কি যোগ্যতায় সে পেয়ে যায় আকাশের ঈশ্বরের লেখা বইয়ের নতুন নতুন সংস্করণ?

কী প্রকারে মেষের রাখাল, গোয়াল-নন্দন শুধু নিজের উচ্চারণের জোরেই, শুধু নিজের সাক্ষ্যেই হয়ে যান পয়গম্বর। মানুষ থেকে পয়গম্বর হয়ে উঠার পদ্ধতিটা না জেনে পয়গম্বরকে 'রূপকথার রূপকার' বলা যায় না কিছুতেই। প্রশ্ন তাই, তরিকাটা কী?

(চলবে)

ছবি:জিওর্জিওস ম্যাজেরাকিস


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।