নারীমূর্তি ভাঙায় ব্যস্ত পুরুষ ঈশ্বর (উত্সর্গঃ উত্স)

দীক্ষক দ্রাবিড় এর ছবি
লিখেছেন দীক্ষক দ্রাবিড় (তারিখ: বুধ, ০২/০৫/২০০৭ - ৬:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


(নারীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে একক ঈশ্বরের প্রবক্তারা-২)

এই একটি বিষয়ে ধর্মে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী পুরুষেরা একমত। মানুষের কখনও নারী-ঈশ্বর ছিল না। তাদের জোর দাবী ঈশ্বর সর্বদাই পুরুষ ছিলেন। অর্থাত্ সমাজে নারীর মর্যাদা এত উঁচুতে কখনও ছিল না যে মানুষ সৃষ্টিকর্তার কল্পনা করতে গিয়ে তাকে নারী ভাবতে পারে। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকরা দুনিয়ার গুহাচিত্র আর মূর্তির ধ্বংসাবশেষ ঘেঁটে শেষ কথা বলে দিয়েছেন যে এমন কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ তারা পাননি। পাওয়া নাই যেতে পারে। শুধু মাটির নীচে পাওয়া জিনিসেই সত্য থাকে না, সত্য অন্যত্রও আছে, অন্যভাবেও সত্যকে পাওয়া যায়। আর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিজে থেকে কথা বলে না, মানুষই এর ব্যাখ্যা দেয়। একেক ব্যাখ্যা একেক রকম হয়। তবু যুত্সই নারী-ঈশ্বর মূর্তি না পেয়ে এটাই চালু তত্ত্ব যে নারী কখনও ঈশ্বর হওয়ার যোগ্য ছিল না। এমনকি উর্বরতার দেবী নারী ছিলেন তার প্রমাণও তারা পান না।

তাই যখন মার্লিন স্টোন ১৯৭৬ সালে লিখলেন `হোয়েন গড ওয়াজ ওম্যান` তখন বিরোধীমতের লোকেরা হা রে রে রে করে তেড়ে আসলেন। তবে মার্লিন স্টোনের ব্যাখ্যার সূত্রে ৭০ ও ৮০-র দশকে চালু হলো রিলিজিয়াস ফেমিনিজম। এই মতের এক প্রবক্তা এলিজাবেথ ডেভিস লিখলেন `দ্য ফার্স্ট সেক্স' বইটি। যাতে তিনি দেখালেন মিথিওলজি, এ্যানথ্রোপলজি এবং ডিসিপ্লিন হিসেবে হাঁটি হাঁটি পা পা করলেও আর্কিওলজির সব তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ করে যে সমাজ আগে মাতৃতান্ত্রিক ছিল। এবং মহাদেবীকে (গ্রেট গডেস) প্রতিস্থাপিত করে ইহুদি, খ্রিস্টান মুসলিম ধর্মের অনুসারীরা প্রতিহিংসাপরায়ণ পুরুষ ‌ঈশ্বরের সৃষ্টি করেছে।

গত কিস্তিতে জ্বিনের বাদশা প্রশ্ন করেছেন আমার উষ্মাটা শুধু খ্রিস্টান ধর্মের উপর কিনা? না, অবশ্যই নয়। ইসলামের ইতিহাস অনেক বেশি প্রামাণ্য, অনেক সাম্প্রতিক। সেখানেও নারী-মূর্তি, নারী-দেবীর প্রতি আক্রোশ দেখতে পাই। একক ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নারী-দেবীদের ধ্বংস দেখতে পাই। পুরুষ প্রধান সমাজের ভ্যালুজ চালু করতে গিয়ে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে তোলা দেখতে পাই।

মক্কা বিজয়ের পর নবী মুহাম্মদ কাবার মধ্যে ঢুকে পাগানদের দেবী-মূর্তিগুলোকে বাইরে এনে ভাঙ্গেন। এর মধ্যে ছিল লাত, উজ্জা ও মানাত। এরা পূজনীয় দেবী ছিল শুধু কুরাইশদের নয় সেই উত্তর আফ্রিকা থেকে যারা ফি বছর হজ্জ্ব করতে আসতো সেইসব পাগানদের। নবী মুহাম্মদ ও তার সঙ্গী-সাথীরা দেবীদের মূর্তি ভাঙেন কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মানুষের মূর্তি ভাঙেননি। মেরি ও শিশু যীশুর মূর্তি নবী ভাঙেননি। ভেঙেছেন সেসব নারীমূর্তি যারা থাকলে একক ঈশ্বরের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। আর আল্লাহও চরম হুমকিতে থাকেন এসব মূর্তিগুলোর কাছে। তার একটা ব্যাখ্যাও তিনি দেন কোরানের সুরা আন নাজমের ২৩ নং আয়াতে।

نْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاء سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنفُسُ وَلَقَدْ جَاءهُم مِّن رَّبِّهِمُ الْهُدَى
(এগুলো কিছু নাম ছাড়া কিছু নয়, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছো। এর সমর্থনে আল্লাহ কোনও দলিল নাজিল করেননি। .......)

মাটির নীচে প্রত্নতাত্ত্বিকদের হাতে আবিষ্কার হওয়ার মত নারী-ইশ্বর, নারী দেবীর মূর্তি থাকবে কি করে? যদি পুরুষের তলোয়ারের আঘাতে সেসব টুকরো টুকরো হয়ে যায়। লোককাহিনী থেকে আমরা সেসব কথা পেতে পারি। সেসব নারী দেব-দেবীর গল্পগাঁথা মনে করিয়ে দেয় একদা এমন সমাজ ছিল যখন নারীকে ঈশ্বর ভাবতেও মানুষের আপত্তি ছিল না।

একক ঈশ্বরের প্রবক্তারা গল্পে, মিথে থেকে যাওয়া দেবীদের, নারী-ঈশ্বরদের নামগুলো মুছতে পারেনি। মূর্তির মত এগুলো তো আর ভাঙা যায় না। তবে তার একটা বিকৃত ব্যাখ্যা চালু করেছে তারা। খ্রিস্টানরা পাগান নারী দেবীদের নাম চুরি করে এ্যাঞ্জেলদের নাম দিয়েছে আর তা দিয়ে গল্প চালু করেছে। যাতে পরবর্তীতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে নারী-ইশ্বরদেরকে ভুল করে খ্রিস্ট ধর্মের এ্যাঞ্জেল ভাবে। কোরানেও একই তথ্য দেখা যায়। একই সুরার ২৭ আয়াতে সেই ব্যাখ্যা পাই আমরা।
نَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ لَيُسَمُّونَ الْمَلَائِكَةَ تَسْمِيَةَ الْأُنثَى

(যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তারাই ফেরেশতাদের নারীর নাম দিয়ে থাকে।)

পাঠ্যপুস্তকে তাই আমরা ইসলামের আগের সময়কে জাহেলিয়াত বলেই পড়ি। পড়ি, `আরবের মানুষেরা তখন জীবন্ত কন্যাসন্তান কবর দিত`। অথচ মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রার নাম আমরা ইতিহাসে পাই। সেই যুগে নারীরা রাণী হতে পারতো? খাদিজা বিধবা হয়েও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হতে পারতো? তবু খাদিজার কর্মচারী থেকে স্বামী হওয়া মুহাম্মদ যখন নবী হলেন তখন তার প্রচারিত ধর্মের অনুসারীরা দাবী জানান ইসলামেই নারীকে সত্যিকার অধিকার দেয়া হয়েছে। তখন বিস্ময় লাগে। এই সেই ধর্ম যে ধর্মে নারী নেতা হতে পারে না, ইমাম হতে পারে না, রাষ্ট্রের অধিপতি হতে পারে না। অথচ ইতিহাস বলে, ইসলাম আসার আগে আরবের বেদুইন সমাজে নারীদের প্রভাব পুরুষদের চেয়ে কম ছিল না। (এখনও আরবের বেদুইন মহিলাদের স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রকেই বিপাকে পড়তে হয়।)। উমর খলিফা হওয়ার আগে মক্কা ও মদিনার নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক ছিল না। নারীদের ভাগ্যের চাকা এই পেছনে ঘুরানোর প্রক্রিয়ায় এক ঈশ্বরের প্রবক্তাদের সক্রিয় ভূমিকার কথা ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এ জানার জন্য মাটি খুঁড়তে হয় না, প্রত্নতাত্ত্বিক হওয়ার দরকার করে না।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।