যার নির্দেশে আকাশে সূর্য থেমে গেল -২ : মানুষের পয়গম্বর হয়ে ওঠা

দীক্ষক দ্রাবিড় এর ছবি
লিখেছেন দীক্ষক দ্রাবিড় (তারিখ: বুধ, ২৮/০৩/২০০৭ - ৬:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


(আগের লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় দু' ভাগ করতে হয়েছে। মূলত: এটি সমসাময়িক একজন মানুষের পয়গম্বর হয়ে ওঠার ইতিহাস। লেখাটি দু' প্যারা আগে থেকে এখানে শুরু করছি। )

পয়গম্বর ও তার যোদ্ধা বড় ভাই মিলে ফোর্ট গ্রিনভিলে সাদাদের প্রভাবমুক্ত এক শহরের পত্তন করলেন। যার নাম হলো পরবর্তীতে 'প্রফেটস্ টাউন'। পয়গম্বরের নগর। তিনি তখন রেড-ইন্ডিয়ানদের বিভিন্ন রাজ্যে যাচ্ছেন, সেগুলোকে সাদাদের শয়তানীমুক্ত করছেন ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী, আর দলে দলে রেড-ইন্ডিয়ানরা তার ধর্ম বরণ করে নিচ্ছে। ইন্ডিয়ানার গভর্নর উইলিয়াম হ্যারিসন (পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট) পয়গম্বরের এই অগ্রযাত্রায় প্রমাদ গুণলেন। কারণ পয়গম্বর ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন ইন্ডিয়ানা, ইলিওনয়, মিশিগান ও উইসকনসিনে যে ভূমি কিনেছেন বলে গভর্নর দাবী করছেন তা ধর্মবিরুদ্ধ।

গভর্নর তখন দেশবাসীকে হুশিয়ার করে সংবাদ পাঠাতে শুরম্ন করলেন যে, টেনসকাওয়াতাওয়া একজন জোচ্চোর, প্রতারক, একজন ভন্ড পয়গম্বর। ডেলওয়ারের অধিবাসীদের পরামর্শ দিলেন হ্যারিসন যে, টেনসকাওয়াতাওয়া যদি সত্য পয়গম্বর হবেন, তবে কোথায় তার স্বগর্ীয় ক্ষমতা। "তাকে বলো যে, তার ক্ষমতা থাকলে সূর্যকে থামাতে, চাঁদের গতি পরিবর্তন করতে, নদীর স্রোতধারা বদলে দিতে, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করে তুলতে। তবেই না মানবো সে সত্যিকার পয়গম্বর"।

হ্যারিসনের এই চ্যালেঞ্জে দমে গেলেন না টেনসকাওয়াতাওয়া। তার ভাই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে নিষেধ করলেন তাকে। পয়গম্বর শুধু আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে বললেন, সদাপ্রভু তুমি তোমার ধর্মকে জয়ী করো। তোমার পয়গম্বরকে জয়ী করো। তারপর পয়গম্বর হ্যারিসনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। পয়গম্বর জানালেন 1806 সালের 6 জুন তারিখে তিনি সূর্যকে গ্রিনভিলের আকাশে থামিয়ে দেবেন।

পয়গম্বরের জানানো তারিখ ও সময়ে বিপুল সংখ্যক জনতা জড়ো হলো পয়গম্বরের ঐশি ক্ষমতা নিজ চোখে দেখতে। পয়গম্বরের ইশারায় সূর্য থেমে গেলো আকাশে। গ্রিনভিলের মানুষেরা দেখলো এক নাটকীয় সূর্যগ্রহণ। পয়গম্বরের সত্যতা নিয়ে রেড-ইন্ডিয়ানদের আর কারো মনেই কোনো সন্দেহ রইলো না। তার জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো, তার ধর্মানুসারীদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সাদা বাসিন্দারা সন্দেহ প্রকাশ করে বললো, কোনোভাবে টেনসকাওয়াতাওয়া আগেভাগে জেনে গিয়েছিলেন সূর্যগ্রহণের কথা। তার এসবই ভন্ডামি। কিন্তু দলে দলে তীর্থযাত্রীরা আসতে শুরু করলো পয়গম্বরের গ্রামে। আর তিনি তার ঐশি ক্ষমতায় তাদের রোগ-শোক দূর করে দিতে থাকলেন মুহুর্তের মধ্যে।

ঈশ্বরের নির্দেশে পয়গম্বর তার জাতিকে আলো ও সত্যের পথ দেখান। সাদাদের বিরম্নদ্ধে অনেক যুদ্ধে তিনি ও তার বড়ভাই সাফল্যের সাথে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু 1813-তে টেমসের যুদ্ধে যখন বড়ভাই টেকুমসে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হ্যারিসনের হাতে নিহত হলেন তখন মনোকষ্টে পয়গম্বর তার অনুসারীদের নিয়ে হিজরত করলেন কানাডায়।

অন্যদিকে হ্যারিসন 1840-এ নির্বাচিত হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তাতে কি? পয়গম্বরের অভিশাপ তো ছিলই। দায়িত্বগ্রহণের মাত্র একমাসের মধ্যে পরাক্রান্ত সেনাপ্রধানকে আক্রমণ করলো সামান্য ঠান্ডাজ্বর এবং তাতেই তিনি মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়লেন। তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ক্ষমতায় থাকতেই মারা যান। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পয়গম্বরের অভিশাপে বিশ বছর পর পর আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা এভাবে ক্ষমতায় থাকতেই দেখছেন মৃতু্যর মুখ। 1860/1880/1900/1920/1940/1960 এই বছরগুলোতে নির্বাচিত হওয়া প্রেসিডেন্টরা গদিতে থাকতেই মৃতু্যবরণ করেন। 1980-তে এসে রোনাল্ড রিগ্যান যখন আততায়ীর গুলি খেয়েও বেঁচে গেলেন তখন যুক্তরাষ্ট্রবাসী হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলো এই বলে যে পয়গম্বরের অভিশাপ ভেঙে হয়তো মুক্তি পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

প্রেসিডেন্ট হ্যারিসনের মৃতু্যর আগেই দেশে ফিরে এসেছিলেন পয়গম্বর। 1837 এ তার তিরোধানের আগে তিনি বিশ্বাসীদের শুনিয়ে গেছেন ঈশ্বরের আশ্বাস বাণী। "অবশ্যই একদিন পয়গম্বরের মাতৃভূমি মুক্ত হবে সাদাদের শোষণ-শাসন থেকে"। পয়গম্বরের তিরোধানের পর তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আরো অনেকে নিজেদের ঐশিক্ষমতার কথা দাবী করেছে। কিন্তু তারা কেউ জাতিকে মুক্তি এনে দিতে পারেননি, ঐক্যবদ্ধও করতে পারেননি।

পয়গম্বর ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন যে, তারপর এক মহিলা নবী আসবেন, কিন্তু তাকে হত্যা করা হবে। এবং একজন বালক নবী আসবেন এবং রেড-ইন্ডিয়ান জাতির উচিত সেই বালক-নবীর কথা শোনা। তার অনেক ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়েছে। তিনি বলেছিলেন হটকাগারা উপজাতি তাদের মুখের ভাষা লিখতে সক্ষম হবে। পরে তা সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, এমন একদিন আসবে যেদিন বৃক্ষ তার শেকড় থেকে মুক্ত হবে এবং পৃথিবী ভ্রমণ করবে। যেদিন তার জাতভাইরা দেখলো পাহাড়ের বৃক্ষকে মানুষ শেকড় থেকে আলাদা করছে এবং ট্রেনে বা জাহাজে করে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যপ্রানত্দে সেদিন তারা বেদনায় অশ্রম্ন ফেললো। তাদের পয়গম্বর কত প্রজন্ম আগে তাদেরকে এসব কথা আগাম জানিয়ে গিয়েছিলেন।

তাদের পয়গম্বরের বাকী কথাগুলোও সত্যে পরিণত হবে এই আশায় এখনও বুক বেঁধে আছে রেড-ইন্ডিয়ান জাতির বিশ্বাসীরা। এখনও তারা ছোঁয় না সাদাদের হুইস্কি, প্রেমে পড়ে না সাদা নারীর। ঘরে পোষে না সাদাদের আনা ইউরোপের কুকুর ও বেড়াল। এখনও তারা স্বপ্ন দেখে বালক নবীর। যে তাদের মাটিকে স্বাধীনতা এনে দেবে, মুক্ত করবে সাদা দসু্যদের হাত থেকে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।