যাদুকর

ভবঘুরে এর ছবি
লিখেছেন ভবঘুরে (তারিখ: বুধ, ১৩/০৮/২০০৮ - ৯:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
'হ্যা ভাই, দেখেন, এই যে দেখেন আমার হাতে একটা পয়সা। এই আমি ছুমন্তর দিয়া দিলাম।' - হাতের কয়েনটা মুখের কাছে এনে ফু দেয় শমশের। -'হা হা এই যে এইবার দেখেন।' - দুই হাতের তালু এক করে তালুর ভেতর পয়সাটা নিয়ে নেয় সে। তারপর সশব্দে সুর করে মন্ত্র উচ্চারন করতে থাকে-

হুলা বিলাইএর তিন ঠ্যাঙ
ইন্দুর আইয়া মারল ল্যাং
তাই দেইখা নাচে বান্দর
দেখা গেল খুবি সোন্দর
দিলাম মন্ত্র কইসা
বাইর হইব এইবার পয়সা
পয়সা বাইর হ পয়সা

বিছিয়ে রাখা মাদুরে হাটু গেড়ে বসে দুই হাতের তালু ঘসতে থাকে সে। তালুর ভিতর থেকে ঝুর ঝুর করে মাটিতে পড়তে থাকে একটাকা পাঁচটাকার কয়েন গুলো।

মনে মনে খুবই বিরক্ত আজ শমশের। এরই মধ্যে দুইবার আসর বসিয়েছে সে আজ। প্রথমবার তো একেবারে ফাউ গেছে। অল্প কয়েকজন লোক দাড়িয়েছিল হাটে যাবার সময়। এক ফাইল ওষুধও বেচতে পারেনি। এইবারও মনে হচ্ছে খুব একটা সুবিধা হবে না।

যাদুর খেলা দেখানোর পর্ব শেষ। মানুষকে আকৃষ্ট করার প্রাথমিক প্রচেষ্টা কিছুটা সফল। অল্প কিছু মানুষ গোল হয়ে দাড়িয়ে গেছে। এইবার ব্যাবসার ধান্ধা শুরু করা যায়।

'হ্যা ভাই, মন দিয়া শুনেন। দাঁত থাকতে বাঙালী দাঁতের মর্যাদা বুঝে না...। বাসর রাইতে নয়া বউ যখন বুইড়া ভাইবা খিচা দৌড় দিবো হেইদিন বুঝবেন দাঁত কি জিনিস...।' - শমশের তার 'বিখ্যাত' দাতের মাজন বিক্রির উদ্দেশ্যে চলাচলকারী মানুষগুলোকে কথায় ভুলিয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।

হাটে যাবার পথে মানুষগুলোর কেউ থমকে দাড়ায়; কেউ ঠেলে উকি দেয় ভিতরে। এদের ভিতর থেকেই কেউ কেউ শমশেরের চটকদার কথাবার্তায় মজে গিয়ে বসে পড়ে তার মজমায়।

'আমার এই দাঁতের মাজন এক মিনিটেই আপনের দাঁত ফকফকা সাদা কইরা ফালাইবো। দাতের কুনাকাঞ্চিতে যত ব্যাথা আছে সব এক নিমিশে খতম হইয়া যাইবো।'

'তোমার ওষুধতো কাম করে না।' - হঠাৎ কেউ একজন মন্তব্য করে ওঠে।

শমশের আড় চোখে তাকায় মন্তব্যকারীর দিকে। মনে মনে ওর মা'বোন তুলে গালি দেয়। তার ব্যবসা লাটে উঠানোর মতলব? কিন্তু মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে তোলে - 'ভাই, আমি আপনেরে যেইভাবে কইছিলাম আপনে তো সেইভাবে ব্যাভার করেন নাই। দাঁত পরিস্কার হইব কেমনে? গরম পানির মধ্যে দুই চিমটি লবন মিশাইয়া গার্গল কইরা তারপর মাজতে কইছিলাম। আপনে তা করেন নাই।'

লোকটি আরো কিছু বলার জন্য মুখ খোলা মাত্রই সে তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ধমকের শুরে আবার বলতে থাকে - 'দেখেন ভাইসব - এই ভাইজান পয়সা দিয়া আমার কাছ থিকা মাজন কিনছে। কিন্তু নিয়ম মানে নাই। আরে বাঙালী সবজায়গায় নিয়ম ভাঙতে ওস্তাদ...'

এ যাত্রা বেশ কয়েক ফাইল ওষুধ বিক্রি করে ফেলে সে।

২.
সদ্য বিক্রী করে পাওয়া টাকাপয়সা গুনছিল শমশের। আর একবার আসর বসাবে কিনা ভাবছে। আকাশের দিকে তাকায় একবার। বেলা তো রয়েই গেছে। হঠাৎ সামনে খেয়াল করল সে, ছোট সেই ছেলেটি কাঁদছে। আসরে ছিল ছেলেটি প্রথম থেকেই। মলিন চেহারা। সবাই চলে গেলেও সে বসে আছে আগের যায়গায়।

'এই পোলা এইদিকে আহো।' - শমশের হাত ইশারায় ডাকে ছেলেটিকে।

ধীরে ধীরে উঠে আসে ছেলেটি। দুইগালে গড়িয়ে পড়া অশ্রুধারার আভাস। শমশেরের ইশারায় ওর সামনে বসে পরে সে।

'তুমি কান্দ কেন? কি হইছে তোমার?'

'আইজ সকাল থিকা কিছু খাই নাই।' - আনমনে নখদিয়ে মাটি খুটে ছেলেটি।

'কেন মায় ধইরা মারছে?'

ছেলেটি ডানে বায়ে মাথা নাড়ে!

'তাইলে কি হইছে?'

হু হু করে কেদে ওঠে ছেলেটি -'বাইত মায়ও সকাল থিকা না খায়া হুইয়া রইছে। মায়ের অশুখ। মায় কইছে হাটে থিকা ভিক্ষা কইরা ট্যাকা নিয়া ওষুধ নিয়া যাইতে। আমি কোনদিন ভিক্ষা করি নাই। '

শমশের শুধু বলে -'আহারে'। আর কিছু বলতে পারে না সে। আজ তার নিজের ঘরেও চাল নেই। সন্ধ্যে বেলা বাজার করে নিয়ে যেতে হবে তবেই খাওয়া।

'আফনে আমারে একটা কাম কইরা দিবাইন?'- ছেলেটির চোখমুখ একটু ঝলমল করে উঠে।

'কি কাম কও?' - শমশের শুধায়।

'আপনে তো যাদু কইরা একটাকা থিকা অনেক টাকা বানাই ফেলান। এই দেহেন আমার কাছে একটাকা আছে। দেন না আমারে অনেক ট্যাকা বানায়া। '- আশা ফুটে ওঠে ছেলেটির চোখে।

ছেলেটার করুন মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটু কষ্টই অনুভব করে শমশের। হায়রে, সে যে হাত সাফাই করে মানুষকে মজা দেবার উদ্দেশ্যে এই কান্ড করে তার ওষুধ বিক্রী করার জন্য - এ সামান্য বিষয়টা বোঝার ক্ষমতা এই ছেলের নেই।

'আরে পোলা শুন; আমিতো' - আসল কথাটা বলতে গিয়েও কি ভেবে আবার থেমে যায় সে। একটুকরো মলিন হাসি ফুটে উঠে তার মুখে।

'ঠিক আছে তোমার পয়সাটা দেও দেহি আমারে।'

ছেলেটি তার কয়েনটি তুলে দেয় যাদুকরের হাতে।

শমশের কয়েন হাতে নিয়ে তার কৌশল শুরু করে। - 'এই দেখ এই আমার হাতে একটা পয়সা। এই আমি ছু মন্ত্র দিয়া দিলাম।' - ফু দেয় সে তার হাতের কয়েনে। তারপর শশব্দে তার প্রচলিত মন্ত্র শুরু করতে গিয়েও হঠাৎ থেমে যায়। কি ভেবে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করে সে। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে - 'হে খোদা! জীবনে তোমার কাছে কোনদিন কিছু চাই নাই। আইজকা বিপদে পইড়া তোমারে ডাকি। আইজকা একবারের জন্য তুমি আমার যাদু সত্য কইরা দাও। একবারের জন্য আমার যাদু সত্য কইরা দেও খোদা।'

তার চোখের কোনে অশ্রু জমে ওঠে। হাটু গেড়ে বসে সে খালি হাতের তালু দুটো জোরে জোরে ঘসতে থাকে। তার মনে ক্ষীন আশা জেগে উঠে। বিধাতা আজ তার ডাক শুনবেন মনে হচ্ছে! তার সারা গায়ে হঠাৎ রক্তের ঝিলিক দিয়ে উঠে; শরীরের রোমগুলো দাড়িয়ে যায়! খোদা তার প্রার্থনা পুরন করবেনই আজ! খালি হাতের তালু দুটো আরো জোরে ঘসতে থাকে সে।

শমশের ভুল করে। বিধাতা যে এ ধরনের ডাকে কখনো সাড়া দেন না তা বুঝতে পারে না শমশেররা। মানুষের কান্নাকাটি, অনুরোধ, উপরোধের থোড়াই কেয়ার করেন তিনি।

এদিকে ছেলেটি অবাক হয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। 'কই, পয়সা তো বের হচ্ছে না! ঘটনা কি? ও হ্যা তাইত' - হঠাৎই তার মনে হয় - 'যাদুকর তো মন্ত্র পড়েনি। সে জন্যই কি--?'

সে দ্রুত যাদুকরের হাত চেপে ধরে, তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে থাকে -'আপনে তো মন্ত্র কন নাই।'

'ও হ তাইতো' - গলাটা একটু কেপে যায় শমশেরের। বিধাতা তার ডাকে সাড়া না দেয়ায় অভিমানী হয়ে ওঠে সে। চোখ থেকে টুপ করে একফোটা পানি ঝড়ে পড়ে। - 'তুমার দিলে দয়া মায়া নাও থাকবার পারে। ভাবতাছ আমার নাই? আমারে তুমি কি মনে করছ?' - মনে মনে ভাবে আর ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে সে।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলতে থাকে -'তাইতো কই পয়সা বাইর হইতেছে না ক্যান। মন্ত্রই তো পড়ি নাই।'

সে আবার শুরু করে প্রথম থেকে। 'এই যে দেখ তোমার পয়সা। এই আমি ছুমন্তর দিয়া দিলাম।' দুই হাতের তালুর ভেতর পয়সা ঢুকিয়ে রাখে সে। তারপর শশব্দে মন্ত্র পড়তে শুরু করে -

হুলা বিলাইএর তিন ঠ্যাঙ
ইন্দুর আইয়া মারল ল্যাং
তাই দেইখা নাচে বান্দর
দেখা গেল খুবি সোন্দর
দিলাম মন্ত্র কইসা
বাইর হইব এইবার পয়সা
পয়সা বাইর হ পয়সা

ইশারায় ছেলেটিকে তার হাতের নিচে হাত পাততে বলে সে। ছেলেটি হাত পাতে শমশেরের ঘসতে থাকা দুই তালুর নিচে।

ঝুরঝুর করে তার হাতে একটাকা, পাঁচটাকার কয়েন পড়তে থাকে। আনন্দে চোখ চকচক করে ওঠে বালকের। আরে আশ্চর্য, পঞ্চাশ টাকার একটা নোটও বের হয়ে এল দেখি হাতের ভিতর থেকে!

বিষ্ময়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট ছেলেটি। যাদুকরের কত ক্ষমতা!

'এইবেলা বড় যাদু কইরা বড় নোট বাইর করলাম। এখন যাও, ডাক্তরের কাছ থিকা ওষুধ নিয়া যাও, আর বাকি ট্যাকা দিয়া মায়ের লিগা কিছু খাওন কিনা নিও।' - ছেলেটিকে আড়াল করে ঘাড়ের গামছা দিয়ে চোখ মুছে সে। তার নিজের বাড়িতে আজ রান্না হবে কি?

ছেলেটি হাতে টাকা পয়সা গুলো নিয়ে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে যাদুকরের দিকে।

'খাড়াইয়া রইলা কেন যাও; আর ট্যাকা পয়সা সাবধানে নিয়া যাইও। হারাইওনা।'

সংবিত ফিরে পায় ছেলেটি। আর দাড়ায় না সে। হাটের ভিতর ছুটে যায় ওষুধের দোকান লক্ষ্য করে।

শমশের উঠে দাড়ায়। শেষ বিকেলে হাটুরে লোকজনের চলাফেরা কিছুটা বেড়ে গেছে ইতোমধ্যে। আবার সে তার বাক্স সাজায়। নতুন উদ্দমে শুরু করে -'আসেন ভাইসব দেখেন। যাদুর খেলা দেখেন। খেলা দেখেন আর জরুরী খবর শোনেন। দাঁত বিষয়ক অতি জরুরী খবর। হায় বাঙালী, দাঁত থাকতে দাতের মর্যাদা বুঝলা না...বাসর রাইতে যখন বউ...'

কেউ একনজর দিয়ে চলে যায় আবার কেউ দাড়ায়। ধীরে ধীরে আবার লোকজন জড়ো হতে থাকে তার চারপাশে।

'এই দ্যাখেন আমার হাতে একটা পয়সা--' যাদুকর শমশের আবার তার যাদুর খেলা শুরু করে।

ওদিকে একহাতে ওষুধ আর অন্য হাতে খাবার নিয়ে বাড়ির পথে ছুটে চলে ছেলেটি যেখানে তার প্রতিক্ষায় চেয়ে রয়েছে তার মমতাময়ী মা।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চমৎকার! টাচি!! কিন্তু ডেপথ একটু কম। যাদুকর ব্যাটার ব্যাপারে আরেকটু আলাপ করতে পারতেন। তার ঘরের দুদর্শা বর্ণনা করতে পারতেন। তারপর দিতেন ব্যাটাকে আরো বেশী টানাপোড়েনে ফেলায়ে। তাহলে তার ভিতরের দেবতাটা আরো মহান হয়ে ধরা পড়ত।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ভবঘুরে এর ছবি

ব্যাপারটা মাথায় রইল। পরবর্তী গল্পে প্রয়োগ করার চেষ্টা করব। তাড়াহুড়ায় লিখি তো! ধন্যবাদ।

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

আমাদের মাঝেই লুকানো থাকে দেবতা ------ সেজন্যই তো এত দুৎখী হয়েও আমরা বুক ফাটিয়ে হাসতে জানি।
অ নেক ভাল লাগল গল্পটি।
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

রাফি এর ছবি

দারুন গল্প...

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

খেকশিয়াল এর ছবি

গল্পটা দারুন লাগসে, তবে শেষ দিকে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেসে, আরেকটু বিস্তারিত ব্যাপ্তির আশা করসিলাম । গল্প কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস !

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

হায় ভগবান!, তুমি কোথায়?
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

ভবঘুরে এর ছবি

আপনার মাথায়!

কীর্তিনাশা এর ছবি

আসলেই গল্পটা দারুন!! আপনি খুব ভালো লেখেন।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মর্ম এর ছবি

অনেক অনেক বছর আগে একটা বই পড়েছিলাম- 'যাদুঘর'- মিন্নাত আলীর লেখা। পঞ্চাশের দশকের বই। সে বইয়ের শিরোনাম গল্পটা মনে পড়ল 'যাদুকর' পড়ে।

সন্দর মানবিক গল্প- শেষটা এমন হবে আশা করে বসে ছিলাম, হয়ে গেল যখন ভাল লাগল খুব চলুক

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।