এলিস ওয়াকার এবং 'দ্যা কালার পারপল"

নাবিলা এর ছবি
লিখেছেন নাবিলা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৯/০১/২০১৬ - ৪:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি একটি অনলাইন লাইব্রেরীর সদস্য। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন চোখে পড়লো একজন ফেরত দিয়ে গেছেন এলিস ওয়াকারের লেখা 'দ্য কালার পারপল'। বিবরণ দেখতেই বেরিয়ে এলো এটি ১৯৮৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত। ২০১৫ তে একটি রিডিং উইশলিস্ট ফলো করছিলাম, তাতে পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপ্ত একটি বই পড়বার কথা আছে। এটিই কি পড়বো? ঠিক করার আগে গুডরিডসে ঢুঁ মেরে আসা যাক, দেখি পড়ুয়া বন্ধুরা কে কী বলছেন। গুডরিডসে ঢুকে দেখি বন্ধুদের কোনও বক্তব্য নেই তবে সাড়ে তিনলাখেরও বেশি গুডরিডস সদস্য বইখানা পড়ে ফেলেছেন। ঠিক করে ফেললাম এটিই পড়বো, ঝটপট লাইব্রেরী থেকে নামিয়ে নিলাম, অন্য কেউ নিয়ে নেবার আগেই।

প্রথম চারটি লাইন অনুবাদের চেষ্টা করি-
---------------------------------------------------------------------------------------------
খোদা ছাড়া অন্য কাউকে তুমি যদি এসব বল, তবে তোমার মাকে মরতে হবে।

প্রিয় বিধাতা,
আমার বয়স চৌদ্দ। সারাজীবন ধরে আমি ভাল মেয়ে হয়েই আছি ছিলাম। হয়তো তুমিই পারবে আমাকে এমন কোনও সংকেত দিতে, যাতে করে আমি বুঝতে পারি আমার সাথে কী ঘটছে।
---------------------------------------------------------------------------------------------

সেলি লিখছে বিধাতাকে। চিঠি খানা শেষ করার আগেই বড়সড় এক ধাক্কা খেয়ে বলে উঠলাম হায়খোদা! হায়-খোদা!

পুরো উপন্যাসটিই চিঠিতে চিঠিতে লেখা। প্রথমদিকের চিঠিগুলো সেলির লেখা, বিধাতাকে। সেলি স্বল্প শিক্ষিত একটা মেয়ে। শিশু অবস্থা থেকেই যৌন হয়রানির শিকার। অন্ধকার জীবন নিয়ে কাউকে কিছু বলবার সুযোগ না পেয়ে বিধাতাকেই চিঠি লেখে সে। চিঠিগুলোর মাঝে আঞ্চলিকতা, বানান ভুল, ব্যাকরণে ভুল বা আঞ্চলিক বাক্যরীতি পাঠকের কাছে সেলিকে পুরোপুরি বাস্তব করে তুলে ধরে। পরবর্তীতে কিছু চিঠি সেলির হাতে পড়ে, সেগুলো তাকে তার ছোটবোন নেটির লেখা। ছোট বোনের চিঠি খুঁজে পেয়ে সেলি প্রিয় বিধাতার বদলে প্রিয়তম বোনকেই চিঠি লিখতে শুরু করে। সেলির চিঠিগুলোতে ইউএসএর দক্ষিণাংশে বসবাসরত কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের জীবনযাত্রা, বিশেষ করে নারীদের, যাদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল, তাদের কথা বলা আছে। আবার নেটির চিঠিতে আফ্রিকার কালো বর্ণের প্রান্তিক মানুষদের জীবনযাত্রারও খোঁজ মেলে। সেই সাথে উঠে আসে কলোনিয়াল আগ্রাসনের। কালো বলেই যে আফ্রিকান কালো এবং আমেরিকান কালোদের মাঝে ভাতৃত্ববোধ থাকতে হবে এমন কোনও কথা নেই তারও সাক্ষাত মেলে বইটিতে। এছাড়াও খোঁজ মেলে কিছু সাহসী মেয়েদের যারা তাদের খারাপ অবস্থাকে মেনে না নিয়ে সবার বিপরীতে নিজের জন্য লড়েছে, নিজের মত বাঁচার জন্য লড়েছে, প্রশ্ন করেছে ধর্মবিশ্বাসকে, সমাজ ব্যবস্থাকে। খোঁজ মেলে দোষে-গুনে মিলে একগাদা মানুষের। উপন্যাসটি যে সময়দৈর্ঘ্য দখল করেছে, বোঝা যায় তার শেষ দিকটায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। সেখান থেকে পুরো উপন্যাসটির সময়কালের ধারণা পাওয়া যায়।

'দ্য কালার পারপলে' এলিস ওয়াকার চরিত্র চিত্রায়নে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এক সময় থেকে অন্য সময়ে যাতায়াতে নিপুণ ছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর সীমাবদ্ধতা উপন্যাসটিকে দিয়েছে জীবনের ব্যাপকতা। একটা উপন্যাসের হয়তো এমনটাই হওয়া উচিৎ, হয়তো এগুলোই একটা উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য তবুও ২০১৫ তে আমার পড়া সেরা বইয়ের একটি 'দ্য কালার পারপল' এবং 'এলিস ওয়াকার' আবিষ্কৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একজন।

যতটা সহজে আমি ভাল না লাগাটা পরিষ্কার করে বলতে পারি, সেভাবে ভাল লাগা বইগুলো নিয়ে নিজের অনুভূতি ঠিক মত প্রকাশ করতে পারি না। এই যেমন, এই বইটা। এই বইতে এমন কিছু পাতা রয়েছে যার শুধু এক পাতাতেই পুরো একটি গল্পের গভীরতা ও শক্তি। অনেকদিন পর এমন শক্তিশালী একটা উপন্যাস পড়লাম যেটা নিঃশ্বাস চেপে ধরে। না, কী হবে এই আশঙ্কা বা কৌতূহলে নয়, কী হয়ে গেল সেই ধাক্কায়। যেটা পড়তে পড়তে মনে হয় যতটাই আলো থাকুক না কেন, চারপাশটা অন্ধকার। আবার কখনোও মনে হয় এইতো, সবার বিরুদ্ধে একাই জিতে গেলাম। যেটা শেষ করার পর মনে হয়, শেষমেশ জীবনটা খারাপ না। এমন বই নিয়ে কিছু বলা মুশকিল। জমা হয়ে থাকা সব কথা এক সাথে বের হয়ে আসতে চায়। ধাক্কাধাক্কিতে সবই শেষ পর্যন্ত ভেতরেই রয়ে যায়। রয়ে যায় দীর্ঘদিন।

---------------------------------------------------------------------------------------------

পরিশিষ্ট ০১ঃ এলিস ওয়াকার প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান নারী যিনি পুলিৎজার পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন নিজের মমতার গণ্ডিকে বাড়িয়ে নেবার সুযোগ সবারই রয়েছে। তাই শুধুমাত্র মানবাধিকার নয়, লড়ছেন সকল প্রাণীর অধিকার রক্ষার্থে।

পরিশিষ্ট ০২ঃ পড়বার পর দেখেছিলাম বইটির উপর ভিত্তি স্টিভেন স্পিলবার্গের তৈরি করা একই নামের মুভিটি। বইটির মূল কাহিনী থেকে বড় ছোট কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। শেষের দিকে বড় ধরণের কিছু পরিবর্তন ছিল। তবুও মুভিটি বেশ ভাল লেগেছে। হয়তো বইটার সাথে ক্রমাগত তুলনা করতে না থাকলে আরও অনেক ভাল লাগতে পারতো। মুভিটি ছাড়াও বইটির উপর ভিত্তি করে বেশ কিছু মঞ্চ এবং রেডিও প্রযোজনা রয়েছে।


মন্তব্য

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

চমাৎকার রিভিউ। পড়তে ইচ্ছা করছে বইটি।
চলুক

নাবিলা এর ছবি

পড়ে ফেলুন। বই জোগাড় করতে না পারলে openlibrary.org এর সদস্য হয়ে যান। ধার নেয়া যায় ওখান থেকে।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটায় সততা চোখে পড়েছে। তবে রিভিউটায় পুরো একটা চিঠির অভাব বোধ করছি। বাই দ্যা ওয়ে, পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপ্ত বেশ কিছু বই থেকে মনে হয় পরবর্তীতে সিনেমা হয়েছে।
__________________
সৌমিত্র পালিত

নাবিলা এর ছবি

প্রথম চিন্তাটা ছিল সেই একটা চিঠি হিসেবে একদম প্রথম চিঠিটা অনুবাদ করে তুলে দেবার। তারপর মনে হলো আসলে প্রথম চিঠিটা বেশিরভাগ পাঠকের কাছেই ডিসাইডিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে বইটা সে পড়তে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না। তাছাড়াও প্রথমদিককার বিষয়বস্তু বেশ স্পর্শকাতর। অনুবাদের টোন যদি মূল টোন থেকে ভিন্ন হয়ে যায়, সেটা ঠিক হবে না। পরবর্তী পাতা থেকে কিছু তুলে দিতে গেলে স্পয়লার হয়ে যাবে অথবা পাঠকের কাছে মাঝথেকে হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক লাগতে পারে। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম তারচেয়ে দু-এক পাতা মূল লেখা পড়েই পাঠক না হয় সিদ্ধা‌ন্ত নিবেন। হাসি

এক লহমা এর ছবি

লেখা ভাল লেগেছে। আরও কিছুটা বর্ণনা আশা করছিলাম।
হাচল হিসেবে এটাই প্রথম লেখা কি? অভিনন্দন।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নাবিলা এর ছবি

হাচল কি হাফ সচলের সমাসবদ্ধ পদ? দেঁতো হাসি সেক্ষেত্রে ঠিকই ধরেছেন। নিজ একাউন্ট থেকে পোস্ট করা প্রথম লেখা এটাই। এবং আপনাকে ধন্যবাদ। হাসি

ওহ হো! আরও কিছুটা বর্ণনা আশা করলে মনেহয় আপনাকে ভবিষ্যতেও একই ভাবে আশাহত হতে হবে। মন খারাপ মন খারাপ আমি সাধারণত (খুব দরকার না পড়লে) ধরি মাছ না ছুঁই পানি স্টাইলে বই নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করি। কাহিনী থেকে গা বাঁচিয়ে, খুব সাবধানে সরু রাস্তা দিয়ে নিজের অনুভূতি এবং টেকনিক্যাল দিকগুলো বলি। যে ব্যাপারগুলো বলি তাও এমনভাবে বলার চেষ্টা করি যাতে কারও কাছে এটাই এবসোল্যুট জাজমেন্ট মনে না হয়। এতে করে বইটি পড়ে সারপ্রাইজ হবার পথটা খোলা থাকে এবং সেই সাথে অন্যের জাজমেন্ট দিয়ে প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা কম থাকে। কত সারপ্রাইজ কত রিভিউ পড়ে মাঠে মারা গেছে, অন্যের মুগ্ধতাও কত বইয়ে খুঁজে বেরিয়েছি। সে দুঃখ থেকেই বোধহয় এমনটা করি।

দেবদ্যুতি এর ছবি

দারুণ লেখা, নাবিলা হাসি । নিজের অ্যাকাউন্ট প্রাপ্তিতে অভিনন্দন....

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

নাবিলা এর ছবি

আপনিও বোধহয় আমার মতই নতুন পেয়েছেন। প্রথম বর্ষে নতুন ভর্তি হওয়া আরেকজন খুঁজে পেলে যেমন অনুভূত হয় তেমনটা হচ্ছে। অভিনন্দন আপনাকেও। হাসি

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অভিনন্দন। বইটি পড়তেই হবে। হাসি

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নাবিলা এর ছবি

হাসি হাসি

দেবদ্যুতি এর ছবি

হাসি হাসি

মোরা দুজনা, রাজার জামাই

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

দময়ন্তী এর ছবি

ইন্টারেস্টিং!! বইটা পড়তে হবে।

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

নাবিলা এর ছবি

হাসি হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হাচলাভিনন্দন! হাততালি

বই কমন পড়ে নাই, তাই বেশি কিছু কইলাম না। দেঁতো হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।