গান খেকো - শ্রোতা চোথা ২

সুফি ফারুক এর ছবি
লিখেছেন সুফি ফারুক [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৬/০৫/২০১৪ - ১:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শোনার, বোঝার ও রসাস্বাদনের প্রস্ততি

জয়নুল আবেদীনের ৭৬-এ আঁকা (Struggle) নামের পেইন্টিংটি দেখতে আমার ভালো লাগে। ছোটবেলায় প্রথম দেখে ভালো লাগলেও, আহা-মরি কিছু লাগেনি। তখন না জানতাম হাতে আঁকা তৈলচিত্রের মর্ম, না অনুমান করতে পারতাম জয়নুল আবেদীনের উচ্চতা। আজ তা সামান্য বুঝলেও এ ছবির পটভূমি জানি না, ইতিহাস জানি না, কারিগারি বিষয় বা ক্রাফটসম্যানশিপের উচ্চতা... সবই আমার অজানা। আমি নিশ্চিত, সেসব ডিটেইল জানলে, ভালোলাগাটা আরও বাড়তো। কারণ ছবিটার এরকম আরও অসংখ্য রূপ দেখতে পেতাম, যা আজ দেখি না। তবে সেসব না জেনেও, দেখতে দেখতে অনেক ভালো লেগে গেছে। আমার মনে হয় আর্টের যেকোনো ফর্মই এরকম। না বুঝেও এক ধরনের মজা মেলে। এরপর যে যতো ডিটেইলে মনোযোগ দেয়, সে ততো বেশি মাত্রার মজা নিতে পারে।

তবে আর্টের অন্যান্য ফর্মগুলোর মতো সঙ্গীতে ঢোকাটা ততোটা কঠিন নয়। মজা পাবার আগের রাস্তাটা বোধহয় ততো বেশি শুষ্ক নয়। যেকোনো বয়সী, যেকোনো ভাষাভাষী, যেকোনো মানের জানা-শোনা নিয়েই যাত্রা শুরু করা যাবে। শুরু থেকে মজাও পাওয়া যাবে। এরপর আরও মজা পাবার জন্য, মনোযোগ দিয়ে, সময় নিয়ে শুনতে থাকাটাই প্রধান শর্ত।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনা মানে কোনো একটি রাগকে শোনা, হতে পরে তা কণ্ঠে বা যন্ত্রে। সেই রাগের উপরে বিভিন্ন ধরনের জনরার (genre), বিভিন্ন ধরনের গায়কি/গৎকারিতে (style) বিভিন্ন ধরনের কম্পজিশন শোনা এবং তার মজা নেয়া। ব্যস!

সাধারণ রাগাশ্রয়ী হালকা গান-বাজনা শুনতে শুনতেই কান তৈরি হয়। একটি রাগের গানবাজনা শুনতে শুনতে, ক্রমশ কানে-মনে রাগের রূপ (অবয়ব, রস) ধরা দিতে থাকে। আবেগের নির্দিষ্ট অবস্থানের সাথে, রাগের ম্যাপিং হতে শুরু করে। যেকোনো ঘটনায় আপনার মন সেই অবস্থাতে গেলেই রাগটা শুনতে ইচ্ছে করে। তখন রাগটা শুনলে প্রিয় মানুষের সাথে সঙ্গ দেবার অনুভূতি হয়। নির্দ্বিধায় সুখ-দুঃখ শেয়ার করার সুখ পাওয়া যায়।

রাগটা যখন আরও প্রিয় হয়, প্রিয় মানুষের মতোই তাকে আরও বেশি জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে তার প্রতিটি অঙ্গ দেখতে কেমন, কোথায় তার জন্ম, বাড়িঘর, বেড়ে ওঠা, চলন-বলন, ইতিহাস, বিবর্তন, সঙ্গী-সাথীর বিস্তারিত। তার পুরো অবয়বকে স্পষ্ট দেখতে ইচ্ছে হয়। জানাশোনার এই পথপরিক্রমায় প্রেম-ভালোবাসা বাড়তে থাকে। যুগে যুগে ওস্তাদরা একেকটি রাগকে আরও সাজিয়ে-গুছিয়ে উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কায়দা উদ্ভাবন করেছেন। সেই কাজগুলোকে চিনতে ইচ্ছে হয়। বিভিন্ন ঘরানা বা পরিবেশনশৈলীর বিশেষত্ব বুঝতে ইচ্ছে হয়। বিশেষত্বগুলো কখন, কীভাবে এবং কতখানি ফুটে উঠছে, সেটাকে জানতে ইচ্ছে হয়। সেই জানার যাত্রায় সঙ্গীতের কারিগরি বিষয়গুলোর সাথে পরিচয় হতে থাকে, রাগের রূপটাও স্পষ্ট হতে থাকে। তাই অন্য যেকোনো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই, ভারতবর্ষীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বেশি মজা নেবার জন্য ক্রমশ জানাশোনার ক্ষুধাটা বাড়তে থাকে। যতো বেশি জানা যায়, মজাটা ততোই বাড়তে থাকে। একসময় নেশার মতো হয়ে যায়। এক জীবনে যেহেতু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সবকিছু জানাশোনা শেষ হয় না, তাই একটা মিষ্টি প্রেমের অপূর্ণতা নিয়ে মরা যায়।

কী শুনবো ?
শুনবেন রাগ। তার বিভিন্ন রঙে সাজানো রূপ। বিভিন্ন ধরনের পরিবেশন। কণ্ঠসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশন। শুদ্ধ শাস্ত্রীয়, উপশাস্ত্রীয়, মিশ্র... সব। শুনবেন যেটা কানে-মনে সহ্য হয়।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশ মানেই, গাওয়া-বাজানোর মাধ্যমে একটি রাগ পরিবেশন। একটি রাগ শুধুমাত্র আকার (আ, ই, উ শব্দ করে) বা সারগাম দিয়ে (সা-নি) গেয়ে পরিবেশন করা যায়। রাগের অবয়ব পুরো প্রতিষ্ঠা করা যায়। একসময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূল রীতিটা এরকমই ছিল। তবে যুগে যুগে, পরিবেশন আরও আকর্ষণীয় করার জন্য, সঙ্গীতকে বিভিন্ন রকম করে সাজগোজ করা হয়েছে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের গায়ন/বাজনা রীতি (genre: dhrupad, khayal) উদ্ভাবন করেছে। বিভিন্ন জায়গার লোকসঙ্গীতের গায়কী (style) থেকেও এসেছে বিভিন্ন রকম গায়কী-অঙ্গ । বড় শিল্পীদের গায়কি/গৎকারির স্বতন্ত্রতা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঘরানা (gharana) বা স্কুল। বিভিন্ন ঘরানা, বিভিন্ন গায়নরীতিতে, বিভিন্ন রাগে তৈরি হয়েছে সুন্দরসব বান্দিশ (composed composition) । তাই রাগ ছাড়াও, গায়নশৈলীর ভিন্নতা শ্রোতাকে অন্য ধরনের স্বাদ নেবার সুযোগ করে দিয়েছে। এজন্য একই রাগ ভিন্ন রীতিতে ভিন্ন অঙ্গে ভিন্ন ঘরানার গায়কের কাছে শুনে ভিন্ন রকম মজা পাবেন। তাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনা মানে বিভিন্ন রাগের পাশাপাশি সেসব বৈচিত্রের মজা নেয়া। যতো শুনতে থাকবেন, ততো এসব বৈচিত্র্য আপনার কাছে স্পষ্ট হবে। শোনার মজা বাড়তে থাকবে, নেশাও বাড়তে থাকবে।

শোনার জার্নিটা যেভাবে হতে পারে
আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনা শুরু হতে পারে হালকা উপ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দিয়ে (light/semi classical)। মানে রাগাশ্রয়ী হালকা গান-বাজনা। শ্রোতা হিসেবে যেকোনো রাগের বিশুদ্ধ রূপ বোঝার চেষ্টা করার আগে ওই রাগের হালকা গানগুলো (উপশাস্ত্রীয় ও সাধারণ গান/বাজনা) যথেষ্ট পরিমাণে শোনা দরকার। এগুলো এমনিতেই আশেপাশে থেকে শোনার অভ্যাস থাকার কারণে আলাদা করে শোনা শেখার পরিশ্রম করতে হয় না। আবার এতে কান তৈরি হতেও সুবিধা হয়। উপশাস্ত্রীয় জনরা গুলোর মধ্যে শোনা যায় গজল, ঠুমরি, রাগাশ্রয়ী প্লেব্যাক, আধুনিক, টপ্পা, কীর্তন, কাজরি, হরি, চৈতী, রাগাশ্রয়ী রবীন্দ্র-নজরুল, ইত্যাদি।

এরপর ক্রমশ এগোতে হবে শুদ্ধ শাস্ত্রীয় (classical) গানের দিকে। শুদ্ধ গায়নরীতির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ধারা দুটো হলো ধ্রুপদ (Dhrupad) ও খেয়াল (Kheyal)। ধ্রুপদ খুব প্রাচীন এবং সবচেয়ে শুদ্ধ হলেও খেয়ালের মতো অতোটা সার্বজনীন ও জনপ্রিয় হয়নি। ধ্রুপদ শোনা যায় বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে, বিশেষত প্রার্থনা অনুষ্ঠানে। আজকাল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানগুলোতে মূলত খেয়াল রীতিতেই গান-বাজনা করা হয়। কণ্ঠশিল্পীদের পাশাপাশি যন্ত্রশিল্পীরাও মূলত খেয়াল গায়নশৈলী অনুসরণ করেই বাজান। সুতরাং কণ্ঠের পারফরমেন্স বুঝতে পারলেই যন্ত্রের পারফরমেন্সের অনেকটাই বোঝা যাবে। যেটুকু সামান্য পরিবর্তন আছে, সেটার নোটও শেষে যুক্ত করা হবে।

প্রথমে উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতগুলো দিয়ে গান-বাজনা শুনতে শুরু করুন। এর মাধ্যমে রাগের চেহারার সাথে পরিচিত হতে চেষ্টা করুন। এরপর যাবো শুদ্ধ শাস্ত্রীয় রীতির গান-বাজনার দিকে। বৈঠকী পারফরমেন্সগুলো বোঝার চেষ্টা করবো। মনে রাখতে হবে, বৈঠকী পারফরমেন্স আর রেকর্ডিং রিলিজ এক জিনিস না-ও হতে পারে। কারণ রেকর্ডিঙে সময়ের কারণে পুরো খেয়ালের বদলে অনেক সময় খেয়ালের যেকোনো একটি অংশ প্রকাশিত হয়। বৈঠকী আসরে সচরাচর খেয়ালের সবগুলো অংশ ক্রমানুসারে গাওয়া/বাজানো হয়।

রেকর্ডেড সঙ্গীত দিয়ে শুরু:
প্রথমে যেকোনো একটি রাগ বেছে নিন। এরপর ওই রাগের প্লেব্যাক, আধুনিক, গজল, রবীন্দ্র-নজরুল, টপ্পা, কীর্তনগুলো পছন্দমত শুনতে থাকুন। পাশাপাশি বোঝার চেষ্টা করতে থাকুন গানগুলোর মধ্যে কোথায় যেন সুরের মিল আছে। বারবার শুনতে শুনতে মিলগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে। যেখানে মিল, সেখানেই আসলে রাগের কারসাজি। এরকম ১/২ দিন শুনতে পারেন (তবে বোঝার জন্য সময় বেশি লাগলে দোষের কিছু নেই)।

মনে রাখবেন, যে কদিন একটি বিশেষ রাগকে মাথায় বসাবার চেষ্টা করছেন, ওই কদিন অন্য রাগের বা মিশ্র রাগের গান-বাজনা না শোনাই ভালো। তাতে মনোযোগটা ভালো থাকে। রাগের রঙ-রূপ মাথায় বসতে সুবিধা হয়।

এরপর রাগের রূপরেখা এবং আবহটা বোঝার জন্য যেকোনো বাদ্যযন্ত্র নিয়ে (হারমোনিয়াম হতে পারে) আমার প্রতিটি রাগ নোটের ‘স্বর ব্যবহার’ সেকশনটা নিয়ে বসবেন। মনোযোগ দিয়ে বারবার পড়তে হবে। পাশাপাশি বাজিয়ে/গেয়ে দেখার চেষ্টা করতে হবে। গাওয়া/বাজাবার সময়, আগে শোনা গানগুলোর সাথে মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। গানের পুরো সুরের সাথে মিল না খুঁজে, গানগুলোর মধ্যে কমন সুরের সাথে মিল খুঁজতে হবে। একটা সুর যখন আপনার কানে-মনে ধরা দেবে, তখন এক ধরনের স্বর্গীয় সুখের আবেশ অনুভব করতে পারবেন। সে সুখ শুধু অনুভব করা যায়, বর্ণনা কেউ করতে পারবে না। যদি মনে হয় কিছুই হচ্ছে না, তার পরেও থামবেন না। ফলটা বোঝার জন্য একটু সময় দিতে হবে।

রাগ নোটে ‘স্বর ব্যবহার’ সেকশনটা নিয়ে খেলাধূলা করার পরে স্বরমল্লিকা ও লক্ষণগীত শুনে স্বরগুলোর চলাফেরা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যতোক্ষণ দু-চারটি মিল আপনি খুঁজে না পাচ্ছেন, ততোক্ষণ হালকা গানগুলো শুনতে থাকুন। পাশাপাশি ‘স্বর-ব্যবহার’ সেকশনটি দিয়ে খেলুন, স্বরমল্লিকা-লক্ষণগীত শুনুন, গাইতে/বাজাতে চেষ্টা করুন।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওই রাগের যন্ত্রসঙ্গীতগুলো ছেড়ে রাখতে পারেন। রাতে শোবার সময় হালকা করে ছেড়ে রাখলে ভালো কাজে লাগে।

একটু আরাম এলে এরপরে শোনা শুরু করুন স্লো আলাপ। সেখানে স্বরের ব্যবহারগুলো ধরার চেষ্টা করুন। ধরতে না পারলেও অসুবিধা নাই, চেষ্টা করে গেলেই কাজটা হয়ে যাবে।

একই রাগে গাওয়া/বাজানো ২৫ টি বিভিন্ন ধরনের কম্পোজিশন নিয়মিত শোনার চেষ্টা করতে হবে। অল্প কয়েকদিনেই আপনি এই রাগটি চিনে যাবেন। যে কেউ গাওয়া শুরু করলেই, নিজের অজান্তেই বলে উঠবেন, অমুক রাগ গাইছে। সেখানে দু-একবার ভুল হলেও লজ্জার কিছু নাই, কারণ অনেক বড় সঙ্গীতজ্ঞদেরও অনেকদিন ধরে না শোনা রাগ ধরতে কষ্ট হতে পারে।

সঙ্গীত শোনা শুরু করার জন্য প্রথমে দরকার একটা ভালো অডিও লাইব্রেরি। সেখানে একটি রাগের পরিচিত সব জনরার বিখ্যাত প্রতিটি ঘরানার প্রচলিত সব তালের অন্তত ২৫টি গান-বাজনা থাকা দরকার। সেরকম একটি লাইব্রেরি গুছিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগে। ওরকম একটি লাইব্রেরির আকার-প্রকার এতো বড়ো হয়, সেটার ব্যবস্থাপনাও ভীষণ কঠিন। সেটা মাথায় রেখে আমরা প্রতিটি রাগের শ্রোতাসহায়িকা নোটের সাথে ওই রাগের বিভিন্ন ধরনের গান-বাজনার অনলাইন লিংকগুলো গুছিয়ে দেবো (অফলাইনের জন্য DVD তৈরি করছি)।

এভাবে রাগের সাথে মোটামুটি পরিচয়টা ঘটে গেল ক্রমশ বৈঠকী রীতির গান-বাজনা শোনার দিকে এগোতে হবে। কারণ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূল মজা বৈঠকী রীতিতে। বৈঠকী পারফরমেন্স নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে দিয়ে হয়। তাই বৈঠকী পারফরমেন্স বোঝা ও মজা পাবার জন্য পারফরমেন্সের রীতিনীতিগুলো জানা দরকার।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বৈঠকী পরিবেশন

বৈঠকী পরিবেশনা:
আগে আলোচনা করা হয়েছে রেকর্ডিং সঙ্গীত শোনার বিষয়ে। কিন্তু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনার রীতি মূলত বৈঠকী আসরে। সঙ্গীতের আল্টিমেট মজা পাবার জন্য বৈঠকী আসরের বিকল্প নেই। বৈঠকী পরিবেশনা কিছু রীতি-নীতির মধ্যে থেকে করা হয়। পরিবেশনার মজা নিতে হলে সেই নিয়মগুলো বোঝা দরকার।

সঙ্গীতের ধরন অনুযায়ী পরিবেশনের নিয়মকানুনে ভিন্নতা আছে। সব জনরার সঙ্গীত একই ক্রমে গাওয়া/বাজানো হয় না। পাশাপাশি কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের উপস্থাপনার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।

এই নোটে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা কণ্ঠসঙ্গীতে খেয়াল এবং একটি যন্ত্রসঙ্গীতের বৈঠকী পরিবেশন নিয়ে আলোচনা করবো।

বৈঠকের নিয়ম:
সব ধরনের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় বৈঠকী স্টাইলে। পরিবেশন মূলত একক (solo) হয়। মানে প্রধান একজন গায়ক/বাদককে কেন্দ্র করে সব আয়োজন। তিনি কণ্ঠ দিয়ে বা তাঁর বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সুরের নেতৃত্ব দেন, বাকিরা সহায়তা করেন। যুগলবন্দীর ক্ষেত্রে গায়ক/বাদক একাধিক হতে পারে। যুগলবন্দীর শিল্পীরা আগে থেকে নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে নেন। ইম্প্রোভাইজ করলেও, ওই বোঝাপড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন।

প্রধান শিল্পীকে একটানা টোনিক সাপোর্ট দেবার জন্য সাথে ১/২ জন তানপুরা বাদক থাকেন (এঁরা সচরাচর প্রধান শিল্পীর শিষ্য হন)। একজন তালবাদ্যবাদক থাকেন, যিনি তবলা বা পাখোয়াজ নিয়ে তাল-ঠেকা ধরে রাখেন। যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীর আর কিছু লাগে না।

কণ্ঠশিল্পীর হাত সচরাচর খালি থাকে। কখনও তাঁর হাতে সুরমণ্ডল বা তানপুরা থাকতে পারে। কণ্ঠশিল্পীকে সুরের আবহ ধরে রাখার সহায়তা করার জন্য, একজন সারেঙ্গীবাদক বা হারমোনিয়ামবাদক থাকেন। সারেঙ্গী বা হারমোনিয়ামবাদক গায়ককে অনুসরণ করে গায়কের সুরের আবেশ তাঁর যন্ত্রে ধরে রাখেন।

প্রধান শিল্পী বসেন মাঝখানে, সবার সামনে। শিল্পীর পেছনে তানপুরাবাদকরা থাকেন। ডানপাশে থাকে তবলা, বামে সারেঙ্গী/হারমোনিয়াম। যুগলবন্দী হলে প্রধান দুজন শিল্পী পাশাপাশি বসেন। অনেক সময় জ্যেষ্ঠ্যতা অনুসারে শিল্পী সামনে পিছনে বসতে পারেন।

আগের কালে এ ধরনের অনুষ্ঠান হতো ঘরোয়া মেহফিল হিসেবে, যেখানে শিল্পী ও শ্রোতা একই উচ্চতায় মেঝেতে বসতেন; তাঁদের মধ্যে ভাববিনিময় হতো। আজকাল বেশি শ্রোতাকে একবারে গান শোনানোর জন্য সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। শিল্পীকে সবাই যেন দেখতে পারেন, সেজন্য স্টেজ বানানো হয়।

বৈঠকী খেয়াল পরিবেশন:
খেয়ালের ইতিহাস পরিচিতি এবং বিভিন্ন কারিগরি বিস্তারিত পাওয়া যাবে এই সিরিজের ‘সঙ্গীতের ধারা (Genre)’ বিভাগের ‘খেয়াল-গান’ আর্টিকেলটিতে। এখানে আমরা মূলত আলোচনা করবো খেয়ালের পরিবেশনরীতি নিয়ে।

আজকাল একটি খেয়াল পারফরমেন্স চলে ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় নিয়ে। খেয়ালের অনেকগুলো ধাপ/ভাগ (constituent parts) আছে। গোয়ালিয়র ঘরানার খেয়ালিয়াদের মতে খেয়ালের অষ্টাঙ্গ হলো আলাপ (aalap), বন্দিশ (bandish), বোল-আলাপ/বড়হত (Bool-alaap and Badhat), বোল-বাঁট (bool-baant), বোল-তান (bol-taan), সারগাম (Sargam), লয়কারী (Layakari)। সকল ঘরানার গায়করা এই সকল অংশ গান না, বা এই ক্রমেও গান না। তবে মোটামুটি তিনটি অংশ খেয়ালে আবশ্যক এবং প্রধান: আলাপ (Alap), বন্দিশ (Bandish), তান (Taan)।

খেয়ালের কনসেপ্ট হল ফ্রি ইমপ্রোভাইজেশন, যেখানে শাস্ত্রীয় রীতিনীতি বজায় রেখে, শিল্পী পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ইমপ্রোভাইজ করতে পারেন। এই ইমপ্রোভাইজেশনের কারণেই একই শিল্পীর অন্যদিনের পারফরমেন্সের মধ্যেও অনেক নতুনত্ব পাওয়া যায়। ফ্রি ইমপ্রোভাইজেশন হলেও শিল্পী সচরাচর কয়েকটি ধাপে খেয়াল পরিবেশন করেন এবং ওই ধাপগুলোর মধ্যেই ইমপ্রোভাইজেশনের সুযোগ নেন। এর মধ্যে ‘অনিবন্ধ’ ইমপ্রোভাইজেশন হয় সচরাচর তাল ছাড়া, আর ‘নিবন্ধ’ ইমপ্রোভাইজেশন হয় তালের মধ্যে।

আমরা এই লেখায়, প্রচলিত ধারার খেয়াল উপস্থাপনের ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। আপনি যখন শ্রোতা হিসেবে একটি পারফরমেন্স দেখবেন/শুনবেন, তখন সহজে ধাপগুলো রিলেট করতে পারেন।

আলাপ (Alap) :
খেয়াল পরিবেশন শুরু হয় ‘আলাপ’ দিয়ে। এটা খেয়াল বা ধ্রুপদ পরিবেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আলাপ শুরু হয় খুব ধীর গতিতে, তাল ছাড়া। এর পরের অংশে ‘অতি বিলম্বিত’ বা ‘বিলম্বিত লয়ে’ তালবদ্ধ আলাপের মতো করে যেটা করা হয়, সেটাকে বিস্তার বলে। রাগের মূল রূপটা প্রস্ফূটিত হয় এই অংশেই। যেটা (সময় কম থাকলে মধ্যলয়েও শুরু হতে পারে)। তালবাদ্য সহায়তা ছাড়া, আ-কার বা অর্থহীন শব্দ (নোম, তোম) দিয়ে আলাপ করা হয়। সচরাচর ষড়জ (টোনিক স্বর) থেকে আলাপ শুরু হলেও কখনও বাদী স্বর থেকেও আলাপ শুরু হতে পারে। এরপর শিল্পী প্রথমে নিচের দিকের সপ্তকে গিয়ে, সেখানের এই রাগের নোটগুলো শোনান। তারপরে ওপরের দিকের সপ্তকের নোটগুলোকে দেখিয়ে, আবার ষড়জে ফেরেন।

এখানে শিল্পী ধীরে ধীরে রাগটির পরিচয় করান। নোটগুলো ধরে ধরে শ্রোতাদের দেখান। গুরুত্বপূর্ণ স্বরগুলোকে (বাদী-সমবাদী) প্রতিষ্ঠিত করেন। একে একে রাগের সুন্দর মিউজিক্যাল ফ্রেইজগুলোর ভাঁজ খোলেন। যেন একটা ক্যানভাসে শিল্পী এক একটা টান দিয়ে ক্রমশ পোর্ট্রেইট ফুটিয়ে তুলতে থাকেন।

পারফরমেন্সের এই অংশটি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। শিল্পীর রাগ বোঝার গভীরতা এবং উপস্থাপনের দক্ষতার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয় আলাপে। যে শিল্পী যতো দক্ষ, তিনি ততো সুন্দর করে আলাপের মাধ্যমে রাগের মূলভাব প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। শ্রোতার মনে রাগের ছায়া তৈরি হয়ে যায় এই পর্বেই। তবে নতুন শ্রোতাদের এই বিভাগটি খুব ভালো নাও লাগতে পারে। রাগটা যতো ধরতে থাকবে, এই অংশের মজা ততো বাড়বে।

আজ এই তাড়াহুড়োর স্রোতে আলাপের প্রচলন ক্রমশ কমে আসছে। খেয়ালিয়ারাও দ্রুত আলাপ শেষ করে বন্দিশ/গৎ-এ ঢুকে পড়েন। এখন খুব বিস্তারিত আলাপের প্রচলন মূলত ধ্রুপদিয়ারাই ধরে রাখছেন।

আলাপ-গান সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য এই সিরিজের ‘সঙ্গীতের ধারা (Genre)’ বিভাগের ‘আলাপ-গান’ আর্টিকেলটি দেখতে পারেন।

বন্দিশ (Bandish):
আলাপের পরেই আসে বান্দিশ। বন্দিশকে চিজ (Cheez) বা গৎ (Gaat) বলা হয়। কণ্ঠসঙ্গীতের ক্ষেত্রে এটাকে বলে বন্দিশ, যন্ত্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে বলে চিজ বা গৎ। এ অংশ পারফরমেন্সের যেকোনো সময় গাইতে/বাজাতে পারে। তবে শেষ তান করার আগে বান্দিশ শেষ করতে হয়।

বন্দিশ/চিজ/গৎ মানে কম্পোজড্ কম্পোজিশন। একটি নির্দিষ্ট রাগের আধারে নির্দিষ্ট তালে নিবন্ধিত। সুর, তাল নির্দিষ্ট হবার কারণে, ইমপ্রোভাইজেশনের সুযোগ খুব সামান্য। আমাদের সবার কান কম্পোজড কম্পোজিশনে অভ্যস্ত হওয়ায় সঙ্গীতের এই অংশটিতে কমিউনিকেট করা সবচেয়ে সহজ হয়। তাই সব ধরনের শ্রোতা সবচেয়ে আগে বন্দিশ অংশটি উপভোগ করতে পারেন।

বন্দিশ খেয়ালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। খেয়ালের বন্দিশ দু অংশে বিভক্ত: ‘স্থায়ী’ (আস্থায়ী নামেও পরিচিত) ও ‘অন্তরা’। এছাড়া ধ্রুপদের বন্দিশে ‘সঞ্চারী’ ও ‘আভোগী’ নামে আরও দুটি অংশ থাকে বা থাকতে পারে।

বিভিন্ন ঘরানার কিছু সিগনেচার পুরনো বন্দিশ রয়েছে। এর বাইরে এখনো বিভিন্ন গুণী গায়ক নতুন বন্দিশ কম্পোজ করে গেছেন। তবে এখনও পুরোনো বন্দিশগুলোই বেশি জনপ্রিয়।

তান (Taan):
পারফরমেন্সের শেষের অংশে সচরাচর তান করেন শিল্পী। এই অংশে শিল্পী রাগের নোটগুলোর ওপর দিয়ে বিভিন্ন ছন্দে খুব দ্রুত আসা-যাওয়া করেন। তানের মাধ্যমে একটু জমিয়ে পারফরমেন্স শেষ করা হয়।

তানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তানগুলো হলো: বোল তান, সপাট বা শুদ্ধ তান, কূট তান, মিশ্র তান, গমক তান। এছাড়া বিভিন্ন ঘরানায় তৈরি বিভিন্ন ধরনের তানও প্রচলিত ছিল (যেমন: পাল্টা তান, হলক তান, জটকা তান, গীতকারি তান, ইত্যাদি)।

বোলতান গাওয়া হয় বন্দিশের শব্দগুলো থেকে শব্দ বেছে নিয়ে। সপাট তানের গতিপথ সরল (দুটি বা তিনটি সপ্তকের রাগের আরোহ-আবরোহের স্বরগুলো বেছে নিয়ে সোজা যাওয়া-আসা করে সপাট তান করা হয়)। কূটতানের গতিপথের এরকম কোনো চরিত্র নেই।

এই অংশে দেখা যায় শিল্পীর কণ্ঠ কতোটা তৈরি। রাগের বোঝাপড়ার চেয়ে বেশি প্রমাণিত হয় শিল্পীর গলার ওপরে কতোটা নিয়ন্ত্রণ। কিছু শ্রোতা তান শুনতে খুব পছন্দ করেন। হালকা মেজাজের পারফরমেন্সে তানগুলো ভালো চলে। আবার খুব গুরুমম্ভীর পারফরমেন্স বাড়তি তানের কারণে নষ্ট হতে পারে।

নোট:
অনেক সময় শিল্পী তানের আগে/পরে খানিকট তারানা গাইতে পারেন। তারানা মানে তানা, দেরে, দ্রুম, ইত্যাদি শব্দ দিয়ে কম্পোজড কম্পোজিশন।

যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন:
যন্ত্রশিল্পীরাও এখন মূলত খেয়াল গায়নশৈলী ফলো করে বাজান। তাই আলাপের অংশ অনেকটা একই রকম।

জোড় (Jod):
জোড় মানে দুটি অংশকে জোড়া দেয়া। আলাপ আর গৎকে জোড়া দেবার অংশকে বলে জোড়। এ অংশে শিল্পী ক্রমশ তালে প্রবেশ করেন এবং আলাপের গতি বাড়তে থাকে। এতোক্ষণ ধরে বিস্তার করা রাগকে জোড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়, যে ফাউন্ডেশনের ওপরে বাজানো হবে গৎ। জোড় খুব দীর্ঘ হয় না।

গৎ বিলম্বিত (Gat Vilombit)
জোড়ের পরে শিল্পী প্রবেশ করেন গৎ বিলম্বিতে। এখানে গৎ বা বন্দিশ বিলম্বিত লয়ে শুরু করা হয়। বিলম্বিত লয়ে বিভিন্ন ভাবে গৎ-এর স্থায়ী-অন্তরাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ অংশে গৎ-এর বিভিন্ন অংশের ডিটেইল কম্পোজিশন দেখা যায়। এখানে শিল্পী নিবন্ধ ইম্প্রোভাইজ করার ক্ষমতা দেখান।

গৎ দ্রুত (Gat Drut)
গৎ বিলম্বিতের পরে আসে গৎ দ্রুত। এখানে একই গৎ দ্রুত তালে বাজানো হয়। এখানে বন্দিশ টাইট হয় এবং সকল ডিটেইল কাজ বাদ পড়ে যায়।

ধুন, তারানা, ঝালা (Dhun, Tarana, Jhala), ইত্যাদি
তানের মতো যন্ত্রসঙ্গীতের পারফরমেন্স শেষ হয় ঝালা দিয়ে। এসময় বাদ্যযন্ত্রে ঝড় ওঠে। শিল্পী তার সব দক্ষতা দিয়ে রাগের নোটগুলোতে খুব দ্রুত চলতে থাকেন। এখানে রাগের দখলের চেয়ে বেশি প্রমাণ হয় শিল্পীর হাতের দক্ষতা। তানের আগে-পরে শিল্পী হালকা মেজাজের ওই রাগের ভিত্তিতে তৈরি ধুন (উপশাস্ত্রীয় কোনো কম্পজিশন) বা তারানা বাজাতে পারেন।

নোট:
আমি যে ধারাবাহিকতায় বর্ণনা করেছি, সেটা প্রত্যেকে ঘরানা বা শিল্পীর জন্য প্রজোয্য নাও হতে পারে। এমনকি শিল্পী স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পারফরমেন্স-এর ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন করতেও পারেন। কখনও একটি অংশকে দু ধরনের টেম্পোতে ভাগ করে নিতে পারেন। তবে পারফরমেন্স সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি হলে সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হবে না।

ছবি: 
16/07/2010 - 4:43পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

খুবই আগ্রহ নিয়ে লেখাটা পড়লাম। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আমার পাহাড়প্রমান মুর্খতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক রসাস্বাদনের ক্ষেত্রে বাঁদ্ধা হয়ে দাঁড়ায়। আপনার এই সিরিজের মাধ্যমে অনেক কিছু জানতে পারছি।

এই সিরিজটা বহাল থাকুক!

অফুরান শুভ কামনা---

সুফি ফারুক এর ছবি

ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এই সিরিজটা উপকারে আসবে, অথবা দেখা যাবে গান শোনাই ভুলে যাচ্ছি!
কোনটা হবে এখনি বলা যাচ্ছে না, আপাতত পড়তে আর বুঝতে চেষ্টা করতে থাকি।
সিরিজ চলুক।
ভালো লাগছে।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুফি ফারুক এর ছবি

ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ হাসি
আমার লেখার বেগুনে গান শোনা ভুলে যাবেন কিনা জানি না। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মানে-প্রাণে লাগলে অন্য গান আর শুনতে ইচ্ছে হবেনা হয়তো হাসি

নির্ঝর অলয় এর ছবি

অসাধারণ, দুরন্ত, দুর্বার!
শাস্ত্রীয়সঙ্গীত বা রাগসঙ্গীত সঙ্গীতের বিপন্ন প্রজাতি। এ নিয়ে এ ধরণের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

দু একটা বানান নিয়ে কথা বলি। "বান্দিশ" বা 'গাত' না লিখে 'বন্দিশ' ও 'গৎ' লেখাটা উত্তম। 'বাধাট'বলে কিছু নেই ভাই, ওটা 'বঢ়ত' বা 'বড়হত' মানে অগ্রসর হওয়া!

অষ্টাঙ্গের ব্যাখ্যাটাও ঠিক করতে হবে। সর্বসম্মতিক্রমে খেয়ালের অষ্টাঙ্গ হচ্ছেঃ
১। বন্দিশ নায়কী
২। বন্দিশ গায়কী
৩। বিস্তার বা বোল-বিস্তার বা বড়হত
৪। বহলাওয়া (মীড় যুক্ত অতি ধীরগতির আ-কারের তান)
৫। বোল-বাঁট
৬। বোলতান
৭। তান
৮। লয়কারী।

উল্লেখ্য সরগম খেয়ালের কোন অপরিহার্য অঙ্গ নয়। জনপ্রিয়তা ও রাগের ব্যাখ্যার জন্য একে নবম অঙ্গ বা অতিরিক্ত অঙ্গ হিসেবে জায়গা দেয়া যায়। আমার অতি প্রিয় গায়ক পণ্ডিত উলহাস কশলকর সরগম করেন না। বাকি আটটি অঙ্গ একদম এই সঠিক ক্রমেই গেয়ে থাকেন। রশিদ খাঁ লয়কারি কম করেন। এছাড়া পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর গানে আটটি অঙ্গই উপস্থিত থাকে যদিও তিনি নবম অঙ্গ নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করেন!

আলাপও আদিতে খেয়ালের অঙ্গ ছিল না। আপনি যে আলাপের কথা লিখেছেন- সেটার স্থলে বিস্তার লেখাই ভালো। অনলাইনে অনেক ভারতীয় সাইটে বিস্তারকে আলাপ বা বোল-আলাপ বলেছে। কিন্তু দ্বিধার সৃষ্টি করতে পারে বলে আমি নতুন শ্রোতাদের এই অভিধা এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করি। আদি যুগের খেয়াল শিল্পীরা বসে খোলা আ-কারে সা লাগিয়েই বন্দিশ গাওয়া শুরু করতেন। খেয়ালে আলাপ প্রথম গাওয়া শুরু করেন উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব। তিনি দীর্ঘ ধ্রুপদী নোম-তোম আলাপ শেষে ধ্রুপদ বা ধামার গেয়ে খেয়ালে ঢুকতেন। এছাড়া গোয়ালিয়র ও সহসওয়ান ঘরানায় গান শুরুর আগে ৪-৫ মিনিটের আউচার আলাপ গাইবার রীতি ছিল। ইদানীং উস্তাদ রশীদ খাঁ এই রীতিতে আউচার গেয়ে থাকেন। কিন্তু সত্যিকার আলাপ বলতে যে জিনিস বোঝায় তা ধ্রুপদে এবং যন্ত্রসঙ্গীতেই আছে। তবে হ্যাঁ খেয়ালের বিস্তার অঙ্গটি কিন্তু আলাপের মোডিফিকেশন। পার্থক্য বিস্তার লয়বদ্ধ, আলাপ অনিবদ্ধ! এটাও কিন্তু উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ সাহেবের অবদান। তাঁর আগে খেয়ালে বিস্তার ছিল না। বিস্তারকে কেউ কেউ স্বরবিস্তারও বলে থাকেন। আসলে কিছুই না। স্বরের বিস্তার কেউ বোল দিয়ে করে, কেউ সরগম দিয়ে করে, কেউ বা আ-কারে করে।

সবচেয়ে সঠিক অনলাইন গাইড হচ্ছে আই,টি,সি-এস,আর,এর ওয়েবসাইট।

অনিকেত এর ছবি

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর গানে আটটি অঙ্গই উপস্থিত থাকে যদিও তিনি নবম অঙ্গ নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করেন!

সহমত--কিন্তু সেইটা তো খানিকটা তার ঘরাণার কারনেও তো হতে পারে--নাকি ঐটা তার নিজস্ব দোষ?

পন্ডিত রাজন মিশ্র আর সাজন মিশ্রের খেয়াল গাওয়ার সময় মাঝে মাঝে একটা জিনিস 'খেয়াল' করেছি--তাঁরা গভীর খাদ থেকে মীড়-জাতীয় একটা তান করেন--অনেকটা উদারার সা থেকে তারার সা-তে যান--আমার ঐটে শুনতে খুব ভাল লাগে। এই জিনিসটার কী কোন বিশেষ নাম আছে নির্ঝর-দা/ সুফি ভাই?? উদাহরণ হিসেবে এইখানে ভিডিও একটা দিচ্ছি-- একেবারে শুরুর দিকে ১৩ সেকেন্ড থেকে ১৭ সেকেন্ডের মধ্যে দুইবার কাজটা করেছেন পন্ডিত সাজন মিশ্র!

নির্ঝর অলয় এর ছবি

বড়দা, ১৩ থেকে ১৭ সেকণ্ডের মধ্যে উদারার 'সা' কই পেলেন? মুদারা আর তারা আছে বটে। এগুলো মীড়, মীড়ের তান নয়। আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পেরেছি। ওটাকে সূঁত বলে। গলায় দ্রূত মীড় গাইলে সেটাকে সূঁত বলে। এগুলো সাধারণত সপ্তকে লাফিয়ে চলে। একই জিনিস যন্ত্রে প্রযুক্ত হলে তাকে ঘসীট বলে। আমি এস,আর,এ ফলো করি কারণ ওদের ব্যাখ্যাগুলো পরিস্কার। যদিও আগ্রা ঘরানার উস্তাদ খাদিম হুসেন খান একটা ডিমনস্ট্রেশনে গলায়ও ঘসীট বলতে একটা বিশেষ অলঙ্কারকে বুঝিয়েছেন।

সুফি ফারুক এর ছবি

ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো একজন পুরনো শ্রোতা গুছিয়ে সংশোধনগুলো দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা। অনেক কিছু নতুন জানলাম।

আমি একদম শিক্ষানবিশ শ্রোতা। এখনও সপ্তক ঠিক মতো চিনি না। দু-দশটা রাগে কানে বসছে মাত্র। একদিন ভাল শ্রোতা হবার আশা নিয়ে প্রতিদিন ভুল-শুদ্ধ মিলিয়ে শিখছি।
এত ভাল জিনিস, একা খেয়ে পুরো মজা পাচ্ছিনা বলে, মজা শেয়ার করতে এই সিরিজ শুরু করলাম। এটা আমার শোনা শেখার জার্নির এক্সপেরিয়েন্স। আপনারা এভাবে ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে আমার জার্নিটা সহজ হয়।

বানানের সংশোধনগুলো যতখানি সম্ভব টিক করে নিলাম। বিস্তার/আউচার বিষয়টা যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করে দেব।
খেয়ালের অষ্টাঙ্গ নিয়ে ভাল কোন আর্টিকেলের রেফারেন্স দিবেন প্লিজ? অথবা সময় থাকলে প্রতিটি অঙ্গ নিয়ে ২/১ লাইনক করে লিখবেন? আমার খুব উপকার হতো।

আপনার "কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী" রিভিউ পড়লাম। অসাধারণ। গত কদিন আগে বইটা পেয়েছি। ফুড়ুৎ করে শেষ হয়ে গেল। আবার পড়ছি বেছে বেছে।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ওই কান বসানোটাই জরুরি ভাই। শোনা এবং লেখা চালিয়ে যান।

খেয়ালের অষ্টাঙ্গ উপলব্ধি করতে হলে পণ্ডিত উলহাস কশলকরের গান খুব মন দিয়ে শুনতে হবে। আপনি কুমার প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের 'খেয়াল ও হিন্দুস্থানী সংগীতের অবক্ষয়' বইটা অবশ্যই পড়বেন।

গানবাজনা নিয়ে লেখার কোন উদ্দীপনা পাই না। কারণ আলোচনার লোক পাই না। মন খারাপ

দীনহিন এর ছবি

বান্দিশ, আলাপ ইত্যাদি শুনেই এসেছি এতটা বছর, আর মাথার চুল ছিঁড়েছি!

যাই হোক, বান্দিশ এখন আমিও বুঝি! বড় বড় গাইয়েরা যখন বান্দিশ শোনাবে, তখন জানব যে, বান্দিশ শুনছি!

সুফি ভাইকে অসংখ্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

সুফি ফারুক এর ছবি

হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন। এক বৈঠকে অনেক কিছুই জানা হল। পরের পর্বের প্রতীক্ষায়।

গোঁসাইবাবু

সুফি ফারুক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।