নববর্ষের প্রতিশ্রুত অবগাহন ডুব-সাঁতারে তুলে আনুক অনাগত সমৃদ্ধির মুক্তভরা ঝিনুক

শেখ নজরুল এর ছবি
লিখেছেন শেখ নজরুল [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৮/১২/২০০৯ - ৪:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নববর্ষ। নিউ ইয়ার ডে। নতুন বছরের আনন্দ-উৎসবের অন্যতম আয়োজন। নিজ নিজ ধর্ম উৎসবের পরই বিশ্ববাসী অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে বহু বছর ধরে নববর্ষ বা নিউ ইয়ার ডে পালন করে আসছে।

নববর্ষের জাঁকজমকপূর্ণ বিষয়টিই কেবল গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, বরং এটি পালনের সাথে মনস্তাত্ত্বিক পরিসর জড়িত। নির্মাণের সঙ্গে পত্তনের বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নতুন বছরের প্রথম দিনটি- ব্যক্তি কিংবা সমাজ জীবনে স্বপ্ন-সম্ভাবনা জাগ্রত করে। ফেলে আসা দিনের জীর্ণতা, ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি- সব কিছু ভুলে মানুষ বছরের নতুন দিনটি শুরু করতে চায় নতুনভাবে, নতুন উদ্যমে।

প্রার্থনা যেমন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তেমনি নতুন বছরের প্রথম দিনটি বরণের জন্য দিনটি দিন না হয়ে একটি সিম্বল হিসেবে বিবেচিত। সিম্বলটি অবশ্যই প্রগতির এবং সমৃদ্ধির। দেবতাকে খুশি করতে যেমন মানুষ তার কীর্তনে ব্যস্ত থাকে তেমনি নববর্ষের প্রথম দিনটিকে সৌভাগ্যের বিষয় হিসেবে বরণ করতে মানুষ নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। এই অনুষ্ঠানটি বাহ্যিকভাবে যতই রঙচঙা দেখাক না কেন এর গুরুত্ব অবশ্যই সেই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়েরই অংশ। আর যারা পালন করে তারা অনেকটা নিজের অজান্তেই আত্মায় ধারণ করে থাকে। ফলে নতুন বছরের শুরুতে সাধ্যমতো সবাই ভালো কিছু খেতে চায়, পরতে চায়, আনন্দে থাকতে চায়- তার অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, সারাটা বছর যেন এমনভাবেই পার হয়ে যায়!

নববর্ষ এক এক দেশে একেকভাবে পালন করা হয়। কোনো কোনো দেশে একাধিক নববর্ষ উদযাপিত হয়। আমাদের দেশে তিনটি নববর্ষ পালিত হয়- পহেলা বৈশাখে পালিত হয় বাংলা নববর্ষ, যেটি বাঙালির প্রকৃত কৃষ্টির সঙ্গে একান্নবর্তী। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে পালিত হয় ইংরেজি নববর্ষ যা বিশ্বের সার্বজনীন সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত, আরবি মাস মহররমের প্রথম দিনে পালিত হয় হিজরি নববর্ষ।

বাংলাদেশের তেরটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মার্মা এবং ত্রিপুরারা প্রতি বছর বৈসাবি নামে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে নববর্ষ পালন করে। চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে বৈশাখ মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত অত্যন্ত আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালিত হয়। প্রাচীনকালে গ্রিসে ২১ জুনের পর চাঁদ ওঠার দিনটিকে তারা নববর্ষ হিসেবে পালন করত। মধ্যযুগে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ২৫ মার্চ তারিখে নববর্ষ পালন করত। জুলিয়াস সিজারের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত রোমানরা নববর্ষ পালন করত মার্চের প্রথম দিনে। চীনারা জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে নববর্ষ পালন করলেও তাদের নিজস্ব পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রথম মাসের প্রথম দিনে আরও একটি নববর্ষ পালন করে থাকে। ইন্দোনেশিয়াতেও পয়লা জানুয়ারি এবং হিজরি সাল মোতাবেক দুটি নববর্ষ পালিত হয়। রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ১৪ জানুয়ারি অনুসারে নববর্ষ পালন করে। ইহুদিরা তাদের পঞ্জিকা অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে নববর্ষ পালন করে। ভিয়েতনাম নববর্ষ পালন করে ফেব্রুয়ারি মাসে। ইরান পারসিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে নওরোজ নামে নববর্ষ উৎসব পালন করে থাকে। ২১ মার্চ তারিখ যখন সূর্যের অবস্থান কর্কটক্রান্তির ঠিক উপরে থাকে সেই দিনে নওরোজ পালনের উপযুক্ত দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।

মরক্কবাসী নববর্ষ পালন করে ১০ মহররম তারিখে। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে তিনদিন নববর্ষ পালন করে থাকে। নববর্ষ পালনের দিন ভিন্ন হতে পারে, রীতি ভিন্ন থাকতে পারে, তার গ্রহণ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু সমৃদ্ধির প্রার্থিত স্বরূপ এক, অভিন্ন।

তবে আমাদের দেশে নববর্ষের আনন্দ একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপিত। বাহত্তরের জানুয়ারির প্রথম দিনের ঠিক ১৫ দিন আগে অর্থাৎ একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। তাই প্রতি নতুন বছরে মাত্র ১৫ দিন পূর্বে পালিত হওয়া বিজয় দিবসকে স্বজন হারানো মানুষরা কোনভাবেই ভুলতে পারেন না। তবু বিজয়ের সেই আনন্দের সামনে উন্মুক্ত হয় জানুয়ারির প্রথম দিনটি।

প্রতি বছর নববর্ষে আমরা নতুন করে শুরু করি- নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজ। হিসাবের খেরোখাতা খুলে হিসাব কষতে থাকি কী আমাদের অর্জন? প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ফলাফল। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে, আজও আমরা আমাদের প্রকৃত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি।

ইতোমধ্যে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ৩৮টি নববর্ষ পালন করেছি। প্রতিজ্ঞার উচ্চকিত স্বরে ইথার কাঁপিয়েছি। নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়েছি। সম্ভাবনার বীজ বপন করেছি কিন্তু পোকা-মাকড়ের তুমুল বিরুদ্ধাচরণে প্রত্যাশিত ফলাফলে হতাশার নির্বাচিত শূন্য ছাড়া কিছুই যোগ করতে পারিনি। বারবার আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিন কিংবা উৎসব এসেছে যার তাৎপর্য ধারণ করে আমাদের অর্জন সমৃদ্ধ হতে পারত শত ভাগে কিন্তু সত্তার ভিন্নতায়, নির্দেশনার শূন্যতায়, দুর্নীতিগ্রস্থ হবার কারণে আমরা তা পারিনি।

আমরা বর্গীর কথা বলি, বিদেশী শোষণের কথা বলি কিন্তু আমরা তো বর্গীর চেয়ে ভালো হতে পারিনি। বর্গী তাড়িয়ে নিজেরাই বর্গী সেজেছি। সামগ্রীক চিন্তা চেতনার চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। দুর্নীতির প্রসারিত হাতের অনামিকায় প্রত্যহ পরিয়ে দিচ্ছি নিকাহের চাকা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে ছুটতে ছুটতে বাজার ছেড়ে পথ ভুলে এখন রাজার উঠোনে। যে উঠোনে রাজা দাঁড়ায় না কোনোদিন। আশা-নিরাশার দোলাচলে আবর্তিত জীবনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ- অবিরাম। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানের মাঝখানে দৃশ্যমান পাঁজরে বসেছে শকুন। স্বজনপ্রীতির রীতিতে যোগ্যতার অধিক মাশুল পেয়ে অনেকেই এখন আত্মমূল্যায়ন ভুলতে বসেছে।

জনগণের ভূলুণ্ঠিত আশা-আকাক্ঙ্ক্ষার পাশাপাশি মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে। তবুও মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সেই লঙ্ঘনকারীর অনেকেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আর যুদ্ধাপরাধিদের তালিকায় ঢেকে গেছে দেশের উন্নয়ন সম্ভবনা। কয়েক বছর আগেও লাল-সবুজ পতাকাকে উড়েতে দেখেছি দেশদ্রোহীর গাড়িতে। অথচ মানুষ নির্মাণে সামগ্রিক অর্জন শূন্য।

কী পেলাম আর কী নিয়ে দাঁড়াই আর একটি নতুন বছরে! দেশদ্রোহীরা ভোগের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে আনন্দে দিন কাটাচ্ছে রুটি-পরাটার মচমচে আওয়াজে। সুদিন চেয়ে তবু আশা বেড়েই চলে। অনাগত দিন সুন্দর হবে প্রত্যাশিত অনুভবে। উৎসবের আনন্দ নিছক আনন্দে না ভেসে ডুব-সাঁতারে তুলে আনবে আগামী সমৃদ্ধির মুক্তভরা ঝিনুক- অবারিত স্বপ্নের মধ্যে আপাতত এইটুকুই প্রত্যাশা।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বাংলাদেশের তেরটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে

জাতী হইতে গেলে কী কী উপাদান লাগে?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শেখ নজরুল এর ছবি

প্রথমত একটি দাও লাগে যেটি দিয়ে উপটাকে কেটে ফেলা যায়। হাঃ হাঃ মিতা। ধন্যবাদ আপনাকে।

শেখ নজরুল

শেখ নজরুল

শেখ নজরুল এর ছবি

দেরীতে হলেও আপনাকেও শুভ নববর্ষ জানাচ্ছি।

শেখ নজরুল

শেখ নজরুল

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

শুভ নববর্ষ।
----------------------------------------
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
----------------------------------------
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।