এমএন লারমার ছিন্নপত্র: ঐতিহাসিক দলিল

বিপ্লব রহমান এর ছবি
লিখেছেন বিপ্লব রহমান (তারিখ: বুধ, ১৪/১১/২০০৭ - ১:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.
প্রায় আড়াই দশক আগে ঘাতক বুলেট কেড়ে নিয়েছে মানবেন্দ্র নারায়ন (এমএন) লারমার প্রাণ, কিন্তু করে গেছে তাকে মৃত্যূহীন। পাহাড়ের জীবন্ত কিংবদন্তী এই নেতা মিশে আছেন পার্বত্যাঞ্চলের ১৩ টি ক্ষুদ্র ভাষাভাষীর লোহিত কনিকার স্ফুলিঙ্গে। আজও যুদ্ধ, সংগ্রাম, আনন্দ, বেদনা আর উৎসবে স্মরিত হয় তার নাম অনেক শ্রদ্ধায়। আজও পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণাধারা, দিগন্ত জোড়া আকাশ চমকিত হয় এমএন লারমার নামে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও এর সাবেক গেরিলা গ্র“প শান্তিবাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এমএন লারমা ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর বিভেদপন্থী প্রীতি গ্র“পের হাতে নিহত হন। এর অল্পকিছু দিন আগে তিনি তার অনুজ, সাবেক শান্তিবাহিনী ও বর্তমান জনসংহতি সমিতি প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার কাছে কিছু গোপন রাজনৈতিক চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনি সন্তু লারমাকে প্রিয় আদরের সম্বোধন ‘তুং’ নামটি ব্যবহার করেছিলেন। আর নিজে ব্যবহার করেছেন ‘প্রবাহন’ নামটি।

জনসংহতি সমিতির শীর্ষ স্থানীয় সূত্রে পাওয়া এমএন লারমার সেই সব চিঠির কিছু খণ্ডাংশ এখানে প্রকাশ করা হচ্ছে। মাও সেতুং চিন্তাধারায় প্রভাবিত, ‘জুম্মল্যান্ড’ এর স্বপ্নদ্রষ্টা, গেরিলা নেতা এমএন লারমার গভীর প্রজ্ঞা, পাহাড়ি জনগণের মুক্তির আকুতি, শান্তিবাহিনীর অভ্যন্তরীণ টানা - পোড়েন ফুটে উঠেছে এসব চিঠিতে। কয়েকটি চিঠি ছোট; আবার কয়েকটি চিঠি তিন - চার পৃষ্ঠার, কি তারও বড়। বেশ কয়েকটি চিঠিতে তারিখ, সাল ও স্থানের কোনো উল্লেখ নেই।

চিঠি এক: পার্বত্য সমস্যার সমাধান হবে কি ভাবে? শান্তিপূর্ণ, নাকি সশস্ত্র পন্থায় আসবে কাঙ্খিত মুক্তি? লারমা গ্র“প বিরোধী সক্রিয় প্রীতি গ্র“প (প্রীতি কুমার চাকমা। গিরি, প্রকাশ, দেবেন, পলাশ -- এই চারজন প্রীতি গ্র“পের অন্যতম প্রধান।) এর সঙ্গে কি কোনো সমঝোতা করা যায়?

এসব বিষয়ে ১৯৮৩ সালের ২৩ মে এনএন লারমা সহযোদ্ধা সন্তু লারমাকে চিঠিতে লিখছেন:

প্রিয় তুং,

আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তুমি, আমি ও গিরি (প্রীতি গ্র“প) আলোচনা করেছি অনেক। শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান, না অশান্তিপূর্ণ পথে সমাধান -- এই দুই পথ থেকে কোন পথ নেওয়া হবে। অনেক কথাই হয়েছিলো। তবে যে কথা সবচেয়ে বেশী ছিলো, অশান্তিপূর্ণ পথে সমাধান করতে হলে পূর্ণ সফলতা অবশ্যই প্রয়োজন। এখন তোমরা কি গিয়ে আলোচনা করে ঠিক করেছো, জানি না। অশান্তিপূর্ণ সমাধানের আগে শান্তিপূর্ণ সমাধানের একটা প্রচেষ্টা নেওয়া যায় কি না, তা তোমরা চিন্তা করেছো কি না, জানি না। তাই এটা চিন্তা করলেও ভাল হবে।...

যাক, কতো কথা লিখতে হয়...মন বলছে, মনে বার বার আঘাত হানছে, আমাদের আন্দোলনে ভাটা পড়েছে, ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। আর তাছাড়া জৈমিনির (ভারত) আশায় থেকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই কিছু একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, কিছু সময়ের জন্য শান্তি যদি পাওয়া যেতো, তাহলে ভালো হতো। আর বিশেষ কিছু লিখলাম না।

ইতি প্রবাহন।
বি. দ্র. তুমি আর আমি লক্ষ্য (প্রীতি গ্র“পের হিট লিস্টের টার্গেট)। তাই ধীর কৌশলে অবস্থার সাথে এগিয়ে চলাই আমাদের উচিত হবে।

চিঠি দুই: একদিকে লারমা গ্র“পের হাইড আউটগুলোতে প্রীতিগ্র“প মাঝে মাঝেই চোরাগুপ্তা হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে সামরিক জান্তা এইচএম এরশাদের হাজার হাজার সেনা বাহিনীও তৎপর। এ অবস্থায় প্রীতি গ্র“পের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টাও চলছিলো। এসব বিষয়ে এমএন রারমা পরবর্তী চিঠিতে লিখছেন:

প্রিয় তুং, ...সমস্যা সমাধান সম্পর্কে যে কথা হলো, যা সেও (প্রীতি) নিজে বললো, তা হচ্ছে -- ক. প্রথমে দুপক্ষের মধ্যে বিরোধী প্রচার বন্ধ করা, যাতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, খ. কার্যকর পরিষদের বৈঠক করানো, গ. সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের বৈঠক এবং ঘ. সবশেষে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। এ সব আমিও বলেছি, সেও বলেছে।

এছাড়া তাকে বলেছি, বিশেষ সেক্টরের শ্রী পলাশকে (প্রীতিগ্র“প নেতা) কেন্দ্রের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থায় তুমি আনতে পারবে কি না? উত্তরে সে বলেছে, পারবো অথবা পারবো না -- এ রকম প্রতিশ্র“তি দেওয়া কঠিন। কারণ শ্রী পলাশ তো একা নয়। তাকে কেন্দ্র করে আরও রয়েছে। তবে আমি চেষ্টা করবো।...

চিঠি তিন: ১৯৮৩ সালে মে মাসে প্রীতি গ্র“পের সঙ্গে লারমা গ্র“পের সমঝোতা বৈঠকের অগ্রগতি হয়। এমএন লারমা সিদ্ধান্ত নেন সন্তু লারমাকে পাঠাবেন প্রীতি গ্র“পের একাংশের কমান্ডার গিরির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে। এ বিষয়ে ওই বছরের ৩১ মে তিনি লেখেন:

প্রিয় তুং,

আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বিশেষ এই, শ্রীগিরি (প্রীতিগ্র“প নেতা) সেখানে আসছে। তার সঙ্গে তুমি স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে। উত্তেজিতভাবে অথবা কোনো বিষয়ে কথা বলতে বলতে উত্তেজিতভাবে উত্তর দিও না। কৌশলগতভাবে এবং কূটনীতির কৌশল প্রয়োগ করে অবশ্যই কথা বলবে। শ্রীগিরির সাথে সেখানের অন্য সঙ্গীরা যাতে স্বাভাবিক ব্যবহার করে, তার ব্যবস্থা করবে। অস্বাভাবিক ব্যবহার করে লাভ হবে না। এই আমার অনুরোধ থাকলো। ...

একটা কথা মনে রাখবে, আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। জৈমিনি (ভারত) সরে যাবার জন্যই এ কাজ করতে পারে, অথবা বাংলাদেশ সরকার পার্টির (জনসংহতি সমিতি) অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে এসব করছে। তবে কোনটি সঠিক, বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এটা বাস্তব সত্যি যে, আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি।

তাই কথা বেফাঁসে শ্রীগিরির নিকট বলা উচিত হবে না। বিশেষ করে জৈমিনি (ভারত) সম্পর্কে। জৈমিনির পেইড এজেন্ট যে হয়নি, এটা সন্দেহের বাইরে নয়। জৈমিনি ওয়েট এন্ড সি বললে পার্টির (জনসংহতি সমিতি) ভাঙন না হোক বাহ্যিকভাবে, আসলে সে কাজই হবে। সুতরাং পার্টি যাতে না ভাঙে তজ্জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এ জন্য ত্যাগ স্বীকার তোমার ও আমার করতে হবে। যদি পার্টির দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়, আমরা সরে যাবো -- এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই হোক আমাদের।...

ইতি- প্রবাহন।

চিঠি চার: জনসংহতি সমিতি তথা শান্তিবাহিনীর বিভক্তি ঠেকানোর চেষ্টার পাশাপাশি এরশাদ সরকারের সঙ্গে শান্তি - সংলাপের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করছিলেন এমএন লারমা। তারিখবিহীন এর পরের চিঠিতে তিনি ‘প্রিয় তুং’ কে লেখেন:

... বার বার একই কথা হচ্ছে, তুমিও অধৈর্য ও অসহিষ্ণু হয়ো না। এই জটিল সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হবে। পার্টির স্থিতিশীলতা আসার পর ঠিক করতে হবে, আন্দোলন চলবে, না আন্দোলন স্থগিত হবে। আন্দোলন চললে অর্থ ও খাদ্য, আশ্রয় ও অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলো পূরণ হবে কি না, সবই সবই যাচাই করতে হবে। তাই আন্দোলন স্থগিত হবে বলে তো যখন তখন তো তা করা যাবে না। যাতে বাংলাদেশ সরকার সহানুভূতির সহকারে গ্রহণ করে, তজ্জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েই তবে আন্দোলন স্থগিত করা সম্ভব।

অর্থ ও খাদ্য সঙ্কট আমাদের আন্দালনকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। এটা প্রত্যেক কর্মীকেও অনুভব করতে হবে। আবেগ প্রবন হয়ে বিবেক সাড়া দেয় না বলে কঠোর হওয়া যাবে না, বাস্তবতাকেই মানতে হবে। অর্থ ও খাদ্য সঙ্কট এড়াতে পারলে টিকে থাকা সম্ভব এটা বুঝি।

তাই সার সংক্ষেপ হচ্ছে -- বর্তমান সমস্যা সমাধানে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আন্দোলন চলবে না থামবে। কারণ জৈমিনির (ভারত) আশায় থাকা যাবে না।...

চিঠি পাঁচ: এই চিঠিতে এমএন লারমা প্রকাশ করেছেন আদর্শিক দৃঢ় অবস্থানের কথা।

...আমরা সংগ্রাম করছি আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রাখার জন্য। আমাদের জাতি তো আর ধ্বংস হচ্ছে না। ধ্বংস হচ্ছে রাজনৈতিক অস্তিত্ব। এই দোষ কার? এই দোষ কি আমাদের? কখনোই না। এ জন্য ১৯৪৭ সালই দায়ী। ১৯৪৭ সালই (দেশ বিভাগ) আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে। তাই এসব বিচার করে আমাদের ঠিক করে নিতে হবে, পার্টির বর্তমান সমস্যা সমাধানের পর ভাবাবেগ নয়, বাস্তবতার নিরিখেই ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।...আমরা টেরোরিস্ট নই। আমরা আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ, অর্থাৎ জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণে সংগ্রামী। আমরা কারো টেরোরিস্ট হবো না, হতেও চাই না।...

*এই লেখাটি এর আগে দৈনিক মুক্তকন্ঠের সাপ্তাহিক প্রকাশনা ‘প্রবাহ’ এ ১৯৯৭ সালের ১৩ নভেম্বর প্রকাশিত হয়। এখন এটিকে আবারো পুনর্লিখন করা হয়েছে।

সংযুক্ত: ক. এমএন লারমা: একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন

খ. গেরিলা নেতা সন্তু লারমার হাইড আউটে


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

গুরুত্বপুর্ন দলিল নিঃসন্দেহে ।
এমএন লারমার চিঠি থেকে অনুমান করা যায়-ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত মধুর থাকেনি ।
-----------------------------------------
'প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাবে মনে ও রাখবেনা
আমি কে ছিলাম,কি ছিলাম--কেন আমি
সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী
হয়েছি হিরন দাহ,হয়েছি বিজন ব্যথা,হয়েছি আগুন'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

ঠিক তাই। সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে এইটুকু বলতে পারি, দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ভারতের চাপেই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগেই ১৯৯৬ সালে ত্রিপুরা থেকে প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়ি শারণার্থীর প্রত্যাবাসন ঘটে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্যও জনসংহতি সমিতির ওপর ভারতের চাপ ছিলো।...


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

জুয়েল বিন জহির এর ছবি

বিপ্লব আপনাকে ধন্যবাদ এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির জন্য।

জুয়েল বিন জহির এর ছবি

আড্ডাঘরে আসতে পারেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।