রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি

বিপ্লব রহমান এর ছবি
লিখেছেন বিপ্লব রহমান (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/০৭/২০০৯ - ৪:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পতিসর, আত্রাই, নওগাঁয় আবিস্কৃত হয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছয় পাতার একটি দীর্ঘ চিঠি। ১৩০৭ সালের ২৮ ভাদ্র তারিখের এই চিঠিটি কবি কাকে লিখেছিলেন, তা জানা যায়নি। কবির এই অপ্রকাশিত চিঠিটি তাঁর পাচক পতিসরের কবিজ উদ্দিনের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। এতে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্মের কথা। নওগাঁর ছোটকাগজ 'অঞ্জলি লহ মোর' এর জানুয়ারি-জুন সংখ্যার সৌজন্যে চিঠিটি এখানে প্রকাশিত হলো।]

ওঁ

বোলপুর

বিনয় সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন-

আমার কাছে আমার ছবি একখানিও নাই। অন্যত্র হইতে সংগ্রহ করাও আমার পক্ষে সহজ সাধ্য নহে। Hopsingকোম্পানী আমার ছবি তুলিয়াছিলেন তাঁহাদের কাছে থাকিতেও পারে।

আমার জীবনের ঘটনা বিশেষ কিছুই নাই এবং আমার জীবনচিত্রও লিপিবদ্ধ করিবার যোগ্য নহে।

আমার জন্মের তারিখ ৬ই মে ১৮৬১ খৃষ্টাব্দ। বাল্যকালে ইস্কুল পালাইয়াই কাটাইয়াছি। নিতান্তই লিখিবার বাতিক ছিল বলিয়া শিশুকাল হইতে কেবল লিখিতেছি। যখন আমার বয়স ১৬ সেই সময় ভারতী পত্রিকা বাহির হয়। প্রধানত এই পত্রিকাতেই আমার গদ্য লেখা অভ্যস্ত হয়।

আমার ১৭ বছর মেজদাদার সঙ্গে বিলাত যাই - এই সুযোগে ইংরেজী শিক্ষার সুবিধা হইয়াছিল। লন্ডন বিশ্বেবিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যাপক হেনরে মর্লির ক্লাসে ইংরেজী সাহিত্য চর্চ্চা করিয়াছিলাম।
..
এক বৎসরের কিছু ঊর্দ্ধকাল বিলাতে থাকিয়া দেশে ফিরিয়া আসি। জাহাজে “ভগ্নহৃদয়” নামক এক কাব্য লিখিতে শুরু করি - দেশে আসিয়া তাহা শেষ হয়। অল্পকালের মধ্যে সন্ধ্যা সঙ্গীত, প্রভাত সঙ্গীত, প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রকাশিত হইয়াছিল। আমার ২৩ বৎসর বয়সে শ্রীমতী মৃনালিনী দেবীর সহিত আমার বিবাহ হয়।
ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, রাজা ও রানী, সোনার তরী প্রভৃতি কাব্যগুলি পরে পরে বাহির হইয়াছে - তাহাদের প্রকাশের তারিখ প্রভৃতি আমার মনে নাই।

সোনার তরী কবিতাগুলি প্রায় সাধনা পত্রিকাতে লিখিত হইয়াছিল। আমার ভাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ তিন বৎসর এই কাগজের সম্পাদক ছিলেন - চতুর্থ বৎসরে ইহার সম্পূর্ণভার আমাকে লইতে হইয়াছিল। সাধনা পত্রিকায় অধিকাংশ লেখা আমাকে লিখিতে হইত এবং অন্য লেখকদের রচনাতেও আমার হাত ভূরি পরিমানে ছিল।

এই সময়েই বিষয় কর্ম্মের ভার আমার প্রতি অর্পিত হওয়াতে সর্ব্বদাই আমাকে জলপথে ও স্থলপথে পল্লীগ্রামে ভ্রমণ করিতে হইত - কতকটা সেই অভিজ্ঞতার উৎসাহে আমাকে ছোটগল্প রচনায় প্রবৃত্ত করিয়াছিল।
.
সাধনা বাহির হইবার পূর্ব্বেই হিতবাদী কাগজের জন্ম হয়। যাঁহারা ইহার জন্মদাতা ও অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে কৃষ্ণকমল বাবু, সুরেন্দ্র বাবু, নবীনচন্দ্র বড়ালই প্রধান ছিল। কৃষ্ণকমল বাবুও সম্পাদক ছিলেন। সেই পত্রে প্রতি সপ্তাহেই আমি ছোট গল্প সমালোচনা ও সাহিত্য প্রবন্ধ লিখিতাম। আমার ছোটগল্প লেখার সূত্রপাত ঐখানেই। ছয় সপ্তাহকাল লিখিয়াছিলাম।

সাধনা চারিবৎসর চলিয়াছিল। বন্ধ হওয়ার কিছুদিন পরে এক বৎসর ভারতীর সম্পাদক ছিলাম। এই উপলক্ষ্যেও গল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ কতকগুলি লিখিতে হয়।

আমার পরলোকগত বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের বিশেষ অনুরোধে বঙ্গদর্শন পত্র পুনরুজ্জীবিত করিয়া তাহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করি। এই উপলক্ষ্যে বড় উপন্যাস লেখায় প্রবৃত্ত হই। তরুণ বয়সে ভারতীতে বউঠাকুরাণীর হাট লিখিয়াছিলাম ইহাই আমার প্রথম বড় গল্প।

এই সময়েই আমি বোলপুর শান্তিনিকেতন আশ্রমে ব্রহ্মার্য্যশ্রম নামক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করি। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তখন আমার সহায় ছিলেন - তখন তাঁহার মধ্যে রাষ্ট্রনৈতিক উৎসাহের অঙ্কুর মাত্রও কোনোদিন দেখি নাই - তিনি তখন একদিকে বেদান্ত অন্যদিকে রোমান ক্যাথলিক খৃষ্টানধর্ম্মের মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। কোনোকালেই বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা আমার না থাকাতে উপাধ্যায়ের সহায়তা আমার পক্ষে বিশেষ ফলপ্রদ হইয়াছিলো। বিদ্যালয় দুই-এক বৎসর চলার পর ১৩০৭ সালে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়।

..
বঙ্গদর্শন পাঁচবৎসর চালাইয়া তাহার সম্পাদকতা পরিত্যাগ করিয়াছি। এক্ষণে বিদ্যালয় লইয়া নিযুক্ত আছে।

উপাধ্যায় ঁমোহিতচন্দ্র সেন মহাশয়ের সহিত আমার আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি আমার বিদ্যালয়ের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবান, ছিলেন - কিছুকাল ইহাকে তিনি চালনা করিয়াছিলেন। এই সময়ে তিনি আমার কাব্যগ্রন্থাবলী বিস্তর পরিশ্রম Edit করিয়াছিলেন। সেইগ্রন্থে বিষয়ভেদ অনুসারে আমার সমস্ত কবিতাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত করিয়া তিনি প্রকাশ করিয়াছেন।

আমার জীবন ও রচনার ইতিহাস সংক্ষেপে উপরে লিখিয়া দিলাম। শন তারিখের কোনো ধার ধারি না। আমার অতি বাল্যকালেই মা মারা গিয়াছিলেন - তখন বোধহয় আমার বয়স ১১/১২ বৎসর হইবে। তাঁহার মৃত্যুর এক বৎসর পূর্ব্বে আমার পিতা আমাকে সঙ্গে করিয়া অমৃতসর হইয়া ড্যালহৌসী পর্ব্বতে ভ্রমণ করিতে যান - সেই আমার বাহিরের জগতের সহিত প্রথম পরিচয়। সেই ভ্রমণটি আমার রচনার মধ্যে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।
.
সেই তিন মাস পিতৃদেবের সহিত একত্র সহবাসকালে তাহার নিকট হইতে ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিতাম এবং মুখে মুখে জ্যোতিষ শাস্ত্র আলোচনা ও নক্ষত্র পরিচয়ে অনেক সময় কাটিত। এইযে স্কুলের বন্ধন ছিন্ন করিয়া মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে তিন মাস স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়াছিলাম ইহাতেই ফিরিয়া আসিয়া বিদ্যালয়ের সহিত আমার সংস্রব বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। এই শেষ বয়সে বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া তাহার শোধ দিতেছি - এখন আমার আর পালাইবার পথ নাই - ছাত্ররাও যাহাতে সর্ব্বদা পালাইবার পথ না খোঁজে সেইদিকেই আমার দৃষ্টি।

ইতি ২৮শে ভাদ্র ১৩০৭
ভবদীয়
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মন্তব্য

মামুন হক এর ছবি

এই শেষ বয়সে বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া তাহার শোধ দিতেছি Ñ এখন আমার আর পালাইবার পথ নাই Ñ ছাত্ররাও যাহাতে সর্ব্বদা পালাইবার পথ না খোঁজে সেইদিকেই আমার দৃষ্টি।

-অনেক ধন্যবাদ এই বিরল চিঠিটি এখানে প্রকাশের জন্য। কিন্তু লেখার মাঝে ঐ N ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ।

লেখাটি বাংলায় এমএস ওয়ার্ড থেকে ইউনিকোডে বদলানোর সময় এ রকম কিছু ওলট-পালট হয়েছিলো। এখন ঠিক করা হয়েছে।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

মামুন হক এর ছবি

এখন পড়েও শান্তি লাগছে। বিপ্লব আপনাকে বিপ্লব হাসি
ভালো আছেন তো বস?

বিপ্লব রহমান এর ছবি

চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ ভালো। আর রবীন্দ্রনাথ তো সবসময়ই ভালোলাগে।

পান্থ রহমান রেজা  [অতিথি] এর ছবি

বিপ্লব ভাই, এখানে প্রকাশ করেছেন বলেই পত্রখানি পড়ার সুযোগ পাইলাম। আর এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। চলুক

রণদীপম বসু এর ছবি

নিজের জবানিতে রবীন্দ্রনাথের জীবনী, দারুণ উপাদেয় !
ধন্যবাদ বিপ্লব দা।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

এত ছোট্ট পরিসরে রবিঠাকুর অসাধারণভাবে তার সংক্ষিপ্ত জীবনগাঁথা তুলে ধরেছেন। পড়তেই ভাল লাগছিল। চিঠিটার জন্য বিপ্লবদাকে ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------

--------------------------------------------------------

বিপ্লব রহমান এর ছবি

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
---
আপডেট: এখন লেখাটির মধ্যে কবির নিজহাতে লেখা চিঠির পাতাগুলো স্ক্যান করে জুড়ে দিলাম। চিঠির পাতাগুলো বড় করে দেখতে ইমেজের ওপর ক্লিক করুন।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সিরাত এর ছবি

কিছু যে বানান ভুল দেখলাম ওগুলিও কি কনভার্সনের সময় হয়েছে? নাকি আগে ওইসব বানানেরই চল ছিল?

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আমি কবির বানানগুলোই অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেছি। আর এখন তো তাঁর নিজ হাতে লেখা চিঠিটিও লেখার মধ্যে আছে। আপনি একটু কষ্ট করে বানানগুলো মিলিয়ে নিন না প্লিজ। হাসি

তবে আমার মনে হয় সে সময় কবির ওই বানানরীতিই অনুসরণ করা হতো। ধন্যবাদ।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সাইফ তাহসিন এর ছবি

মারাত্মক

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

বিপ্লব রহমান এর ছবি

চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

বিপ্লব ভাই,
এটা পড়ানোর জন্য ধন্যবাদ।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।