একজন কবি অথবা একটি কবিতার মৃত্যুর গল্প

ফকির লালন এর ছবি
লিখেছেন ফকির লালন (তারিখ: শনি, ০৪/০৪/২০০৯ - ৫:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যদিও জানা ছিলো কবিতায় ভাত নাই, তবু লিখতে যখন শুরু করলেন, ঠিক কখন যে সেই মাহেন্দ্রক্ষন তা তিনি নিজেও কি জানতেন, বা আমরাই কি জানতে পেরেছিলাম, সে এক গবেষনার বিষয় বই কি, তবে তা একুশেরই কোন এক মাতাল সময়েই হবে নিশ্চয়ই, লিখলেন কবিতাই। ছোট, পরিশীলিত এবং নির্ভেজাল প্রেমের কবিতা।

আমারা ভেবেছিলাম, নদীর দেশে যেখানে নারীও নদীর মতো কথা কয়, এমনকি যেদেশের নারী সর্ম্পকে কামরুপ কামাখ্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর সব মীথ পূরানে নাকি লেখা আছে, সেখানে কবিতা লেখা ছাড়া যুবকের আর কোন গতি নেই। এ প্রেমের পূর্ব লক্ষন, পূর্ব নির্ধারিত, বলা যায় অবধারিত। রোকেয়া কিংবা শামসুনন্নাহার, নারী জাগরনের আইকন ভেবে যে ছাত্রীনিবাসের নাম, সেখানে জাগ্রত নারীদের চে কাংখিতা প্রেমিকাও কম আবাসিত হননা এবং নিঃসন্দেহে আমাদের ধারনা ছিলো তার সেখানে বোধহয় যাতায়াত বেড়েছে। এবং তার কবিতা যে সে গমনাগমনেরই বাই প্রোডাক্ট হবে, দু একবার বার্ষিকীতে উঁকি দিয়ে অবশেষে প্রেমিকাটি হারাবার ভয়হীন-ভাবে হস্তগত হলে কাব্যানুরাগ যে বিসিএস গাইডের পাতায় নিমজ্জিত হবে তাতেও আমাদের সন্দেহ থাকেনা। বড় জোর ন্যুমার্কেটে দু একবার গাঁজার তালিমে যদিও বা তা থার্ড ইয়ার পার হয়, হবে; তবে এর বেশি কিছু নয়; যেমন ছোটবেলায় সকলেরই একবার করে চিকেন পক্স হয়, এও তেমনি হইবার জন্যই হইতে হয়, আর অভাগা হলে দু একটা দাগ ছাড়া আর কোন স্মৃতি রেখে যায়না। কিন্তু ভুলেও দ্বিতীয়বার হয়না কিংবা হলেও চিরস্থায়ী হয়না।

অতএব আমরা র্নিভাবনায় ছিলাম এবং আমাদের নিয়মিত আড্ডায়, বিড়ির ধোয়ায়, জুনিয়রদের শরীরি গবেষনায় মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে কবিতা বা পড়ালেখা বা রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হবার আবশ্যক অনুষঙ্গ বা উপসর্গ বটে। এবং পাশ করবার সাথে সাথেই তা থেকে যথারীতি নিষ্কৃতি ও উত্তরন ঘটে।

আমাদের সব আত্মবিশ্বাসকে অবিবেচনায় নিয়ে তিনি তবু লিখতে থাকলেন, এবং তাও কবিতাই। তখন অবশ্য লিখবার উপাদান ছিলো। মানুষের হাতে কথা বলতে বলতে ঘুরতে পারে, পুলিশের ওয়্যারলেস বা রিক্সাওয়ালার ট্রানজিসটর ছাড়া আর কোন তেমন যন্ত্র তখনো বিশ্ববিদ্যালয়কে আগ্রাসন করে নাই, অতএব চিঠি ও যুগলের নিয়মিত দেখাসাক্ষাতের একটা প্রয়োজন ছিলো এবং বিরহ থেকে পালাবার কোন আর রাস্তা ছিলোনা। প্রেমিক মিলতো প্রেমিকার সাথে ঠিকই কিন্তু শান্তি পেতোনা। অতএব সে রক্তক্ষরনের, কবিতা ব্যাতিত অন্য কোন ধারনপাত্র ছিলোনা বললেই চলে। আর যেহেতু কবিতা তার প্রেমেরই বহিরঙ্গ সেহেতু তিনি না লিখে কি আর করতে পারতেন?

অতএব তিনি লিখতেন এবং নিরন্তর অতৃপ্তি থেকে কবিতাই লিখতেন। আমরা প্রায়শই তাকে ‘আবাল’ বলে উপেক্ষা, উপহাস করলেও বা তিনি ‘এই গরু সর’ জাতীয় মেয়েলী হয়ে উঠছেন কিনা তা বিকালের পর বিকাল নিজেদের ঝগড়ার হাস্যময় সমাপ্তি হিসেবে ব্যবহার করলেও তার কবিতা পছন্দই করতাম। যদিও সাবিনা বা জয়াই যে তার প্রেমিকা বা কাব্যলক্ষী এবিষয়ে একমত না হতে পেরে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে ইছামতীর পারের কোন মেয়েই তার বিরুদ্ধে পঞ্চশরের ষড়যন্ত্র করেছিলো যদিও তার দেশের ছেলে, হিস্ট্রির সুব্রত, সে সন্দেহের স্বপক্ষে নিঃসন্দেহ হবার মতো কোন প্রমানাদি উপস্থাপন করতে পারেনি। তদুপরি এরশাদ সাহেবের দয়া না হলে তাকে হলছাড়া হতেও কম দেখা যেতো, তাই তিনি যে ব্যর্থ প্রেমিক, এ সন্দেহও প্রবল ছিলো। ব্যর্থ বা সফল যাই হোক, ভালোবাসাই যে তার সব কবিতার উৎস তাতে অবশ্য আমাদের কোন দ্বিমত ছিলোনা।

তাই শাহীন এবং পুজা যখন আমাদের কারো কারো মন ভেঙ্গে বিয়ে করে ফেলে তখন আমাদের আর কোন সন্দেহই থাকলোনা যে তিনি একজন বড় কবি না হয়েই যাননা কেননা তিনি দীর্ঘদিন আমাদের থেকে দূরে থেকে, ও শাহীন বা পূজার নির্দয় প্রত্যাখানের ইতিবৃত্ত না জেনেই, কবিতায় আমাদের তৎকালীন গভীর বিষাদকে তুলে আনতে পেরেছিলেন। তখন থেকেই মানুষ হিসেবেও তাকে আমাদের কাছের মনে হতে লাগলো; এবং আমরা সমবেত প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন তিনি কবি ব্যাতিত অন্যকিছু না হন এবং সারাজীবন প্রেম ও বিরহ ব্যাতিত অন্য বিষয়ে কবিতা না লেখেন। তাই দেখা হলে ভালোভাবে হেসে মাথা নাড়ানো বা একটা ফাইভ ফিফটি ফাইভ অফার করে আমাদের পূর্ব উপহাসজনিত অনুতাপ স্খলনের সচেষ্ট প্রচেষ্টা থাকতো। শুধু তাই নয়, আমাদের এ নব উপলব্ধি এত প্রগাঢ় হলো যে, আমরা জানলাম যে কবিরা আমাদের চাইতেও আমাদের অনুভূতি ভালো বোঝেন ও আমাদের হয়ে তা অন্যকে বোঝাতে পারেন। তাই তার সদ্য প্রসবিত দু একটি কবিতা আমাদের আরো সদ্য আবিষ্কৃত পূরাতন কবিদের লেখার সাথে যখন তখন মুখস্থ যে উচ্চারিত হতোনা তা জোর দিয়ে দাবী করতে পারিনা।

অবশ্য তিনিও ইতোমধ্যেই কিছুটা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লম্বা চুল, পাঞ্জাবী এবং কাধে ঝোলানো ঝোলা না পড়লেও লোকে তাকে কবি হবেন এমন সম্ভবনাময় হিসেবেই গন্য করেছিলো। আমাদেরো কবি মাত্রই যে গোসল করেননা বা ডাইল খান এ ধারনা টলে গিয়েছিলো। আমাদের এ আস্থা ও ক্রমবর্ধমান সহানুভূতি সত্বেও তিনি অবশ্য আমাদেরকে খানিকটা বিট্রে করেছিলেন কারন ততদিনে তিনি প্রেম ছাড়াও আরো অনেক কিছু নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। আশাহত হলেও আমরা তার প্রতি গভীর স্নেহে সেই বিচ্যুতি মেনে নিয়েছিলাম কেননা ধনী ও গরীবের পার্থক্য যে অন্যায়, এবং তার প্রতিবাদ ও মোচনের চেষ্টা যে কেউ কেউ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো করেই যাবে তা আমাদের অবাক করতোনা; তাছাড়া তখনো বার্লিনের দেয়ালের মতোই সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন জাগরুক ছিলো; এরশাদের বিরুদ্ধে গনতন্ত্রের জন্য ট্রাকের চাকার নীচে পড়ার মতো ছাত্র ছিলো। আমরা এর সবকিছুকেই মিল্কীর জন্য সফিক ভাইর এনড্রিন খেয়ে মারা যাবার মতো একইরকম পূজনীয় ও নিবেদনযোগ্য ভাবতাম। সে কারনে প্রেমের নতুন অর্থ ও দ্যোতনা আমাদের জীবনে আনার জন্য আমরা আরো বেশী তার প্রতি কৃ্তজ্ঞ ছিলাম ও আছি।

তাই আমরা যখন টোফেল, জিম্যাট, আইবিএ বা বিসিএসের মতো জাগতিক বিষয়ে অবতীর্ন হলাম, অথচ তিনি ইয়ার গ্যাপ দিয়ে বিচিন্তা জাতীয় নিউজপ্রিন্টেড পত্রিকায় লেখা শুরু করলেন, তখন তাকে লেলিন মনে না হলেও সমাজ-সংসারে আর একজন বিদ্রোহীই মনে হলো। শুধু তাই নয় এ প্রার্থনাও অব্যাহত থাকলো যেন তিনি কবিতা লিখতেই থাকেন। আর তা প্রেমের না হলেও আমরা তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিলাম। সেই সাথে শ্রদ্ধা করতেও বোধ করি শুরু করেছিলাম, কেননা কে পুজা আর কে সাবিনা তা তখন আমাদেরই মনে থাকতো কি, আর প্রেম যে বিয়ে এবং ক্যারিয়ারের পরেই আসে সে বিষয়েও আমাদের ততদিনে একটা প্রাথমিক ধারনা হয়ে গিয়েছিলো, আর তাছাড়া, আমরা যা পারিনা, তিনি অন্তত তা পারেন তার উপর সে বিশ্বাসও ছিলো। শান বাধানো পথে না হাঁটার জন্যই যে তার জন্ম তাও আমরা তখন আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জেনে গিয়েছিলাম। বস্তুত আফ্রোদিতি বা সরস্বতী কোন দেবীর জন্যই আমাদের অত ত্যাগের ক্ষমতা ছিলোনা, যেমন ছিলোনা আমাদের পিতাদের, তাই ঝাঁকের কই ঝাঁকে মেশার জন্য বা চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাবার জন্য আমাদের অতিরিক্ত তাড়ায় নিজেদের সার্টিফিকেট নিয়ে আমরা প্রথমবারে মতো চিন্তিত হতে শুরু করেছিলাম। বলা যায় সেই আমাদের সাবালক হবার প্রথম পাঠ ছিলো যার জন্য হয়তোবা সেই প্রথম আমাদের বাবারা আমাদের মাকে তোমার ছেলে না বলে আমাদের ছেলে বলতে শুরু করেছিলেন, এবং আমরা তাকে যাতে আমার ছেলেতে পরিনত করতে পারি সেজন্য জান প্রান দিয়ে চেষ্টা করছিলাম। আর যখন তা সত্যিই হলো তখন আমরা আমদের নিজেদেরই হয়ে গেলাম প্রথমে এবং আরো পরে আমরা পরিনত হলাম শুধুমাত্র আমাদের স্ত্রীদের।

তখন থেকেই বোধকরি ভবিষ্যতের অনাগত সেই গ্লানিবোধ থেকে কবির জন্য ভালোবাসাটা আরো বাড়তে থাকে। আমরা তাকে একটা না পূরো প্যাকেটই কিনে দিতে থাকি, বেনসন বা অন্য যে কোন ব্রান্ড, যা আমাদের কল্পিত কল্পনায় তার জন্য ট্রিট বলে মনে হয়। তাই যখন তিনি পত্রিকায় এরশাদের নব পিতৃত্ব নিয়ে রম্য লিখে তার পত্রিকার নিষিদ্ধ হওয়ার বা নিজের জন্য হাজতের পিটুনির ভাগ্য অবধারিত করেন তখন আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রিপারেশনের তোয়াক্কা না করে সম্মিলিত ছাত্রসমাজের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বৈকালিক মিছিলে আমরাও যোগ দেই। এবং পুলিশের টিয়ারগ্যাস বা অভিদের দৌড়ানী খেয়ে শাহবাগ মোড়ে চা আর মুড়িমাখা খেতে খেতে লেগে থাকলে তার মতো ব্রিলিয়ান্ট আর কে ছিলো, এ আক্ষেপে সত্বেও তার বর্তমান কার্যক্রম সমস্বরে সমর্থন করি, কেননা, সমাজে তার মতো কবিরাই স্বপ্ন দেখেন, দেখান এবং অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন আনেন।

সে অর্থে কবিতার অর্থ আমাদের মতো স্বার্থপর আর অর্বাচীনদের কাছেও আরো বিস্তৃত হয় বইকি। শব্দ ও সুর ছাড়াও তখন মিছিল, দেয়াল লিখন বা সমাজতন্ত্র সবই কবিতা মনে হতে থাকে। গরীবের সাথে যে পার্থক্য আরো ব্যাপক করার ব্যাক্তিগত সংগ্রামে আমরা তখন ব্যাস্ত আছি তাও বুঝি তুচ্ছ মনে হতে থাকে যদিও পরদিন আমাদের সকলের হয়ে তিনিই তা করে যাচ্ছেন বলে আমরা তার লিটল ম্যাগাজিন কিনে ফেলি দু এক কপি, এবং যথারীতি অতঃপর নিজেদের বাবার ছেলে হয়ে ওঠার নিয়মিত কার্যক্রমে অধিক আগ্রহে মনোনিবেশ করে সুখী থাকি। তাছাড়া তার লেখা হালের কবিতাও আমাদের বোধের অগম্যই থাকে যদিও তা তার কবি প্রতিভা ও পরিবর্তনের দায়বদ্ধতা সর্ম্পকে আমাদের ধারনাকে আরো দৃঢ় করে। কেননা নিঃসন্দেহে যা কিছু বোঝা যায়না তাই আধুনিক, অন্তত চিত্রকলা ও কবিতার বেলায়তো বটেই। যদিও যখন আমরা ক্লাবের টেবিল টকের জন্য বাধ্যতামুলকভাবে এ গাইড টু মর্ডান আর্ট পড়বো, দেখবো, যে তা মোটেই সত্য নয়, কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তিনি যে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন আধুনিকতার ধারক ও বাহক সে সর্ম্পকে আমাদের কোন সন্দেহ থাকেনা।

অবশ্য নিশ্চয়ই ঈশ্বর, যদি তিনি থেকেই থাকেন, বা নিশ্চয়ই তিনি আছেন, না থাকলে আর এমনই বা হবে কেন, মুচকি হেসেছিলেন আমাদের এই ইস্পাত দৃঢ় প্রতীতিতে। কেননা বহুদিন পর যখন ঈদের নাটকে, প্রবাস বাসের কারনে যা রেকর্ডেড দেখতে হয়, একে বাসী তার উপর তা কিনা কোরবানীর ঈদ, যা কবিদের সাথে নিজগুনেই সর্ম্পুন বেমানান, সেই চটুল নাটক প্রশান্তি নিয়ে স্ত্রীস্‌ঙ্গে দেখবার পর নাট্যকার হিসেবে কবির নাম দেখে অবাক হলাম, নাকি হলামনা। হলেতো অন্তত স্ত্রীকে উনি ভার্সিটিতে আমাদের সমসাময়িক ছিলেন বলার কোন যৌক্তকতা থাকেনা, কেননা তাতো প্রকারন্তরে বোধহয় এই ইঙ্গিতই বহন করে যে আমরাও সমান প্রতিভাবান বা অন্তত হতে পারতাম কিংবা প্রতিভাবান ছাড়া আর কেউ আমাদের সমসাময়িক হবার যোগ্যতা রাখেনা। অথবা হয়েওছিলাম, নতুবা তার অথবা তার কবিতার মৃত্যু নিয়ে পরবর্তীতে লেখার তাগিদই বা কেন এলো? অথবা তা ছিলো তারো চে বেশী, কিছুটা ব্যাক্তিগতও বটে; যার উপর বদলানোর দায় চাপিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, সেও আমাদেরই পরে, আমাদেরই অনুসরন করে আমাদেরই রাস্তায় নামলে একরকম প্রতারিত হবার বোধতো হতেই পারে।

যদিও এমন কোন প্রকাশ্য আলোচনা হয়ইনি তবু, তারইতো আমাদের অস্বার্থপরতাকে ধারন করার কথা ছিলো, অন্তত অবচেতনে সে সর্ম্পকে আমাদের কারো কোন দ্বিধা ছিলোনা, তাই আমরা তার লিটল ম্যাগাজিন কিনেছিলাম, অথবা তাকে বেনসনের প্যাকেট দিয়েছিলাম। তার সাথে বলা যায়, আমাদের, সেই অলিখিত চুক্তিই ছিলো। নতুবা আমরাই তো কবি হবার দায়িত্ব নিতে পারতাম, কেননা প্লেটো যাই বলুকনা কেন সেটা রাষ্ট্রে একটা জরুরী কাজ এবং তার ও আরো অনেক কবিতা সর্ম্পকিত বিষয়ের মতোই সে সর্ম্পকেও আমাদের সন্দেহ ছিলোনা। তাকে হারানোর, অথবা তার মধ্যে অবশিষ্ট আমাদের কবিত্বটুকুকে হারানোর আগে, স্ত্রীর দেয়া ঠান্ডা স্যুপ বিনা প্রতিবাদে খেতে খেতে যে বিষন্নতা প্রায় বিশ বছর পর আমাদের গ্রাস করবে এবং আশ্চর্যজনকভাবে তাকে অথবা নিজেদেরকে নিয়েই আমাদের লেখাতে বসাবে তার জন্য তাকে ছাড়া আর কাউকে দায়ী করার উপায় দেখিনা। যদিও যখন থেকে তাকে ভালোবেসেছিলাম তখন থেকেই বার্লিনের দেয়াল ভাঙার সব লক্ষনই প্রবল ছিলো।

তিনি তখন সদ্য নতুন পত্রিকার কোন এক সম্পাদক হয়েছেন, কবিতার বদলে কলামই বেশী লিখছেন। উপন্যাসও বেড়ুচ্ছে প্রতি মেলায়, ঈদে, যেন যখনই গর্ভধারন হোকনা কেন, প্রসবের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া নবজ়তাকের আর বেরোবার সময় নেই, অথবা, বিয়ের রাতেই যেমন রুটিন করে অনাঘ্রাতা হবার কথা থাকে, নিদেন পক্ষে তার ভানটুকু থাকে, তেমনি বিভিন্নভাবে ঐ মাসটিতেই তার সব সৃষ্টি ভুমিষ্ট হতে বাধ্য হয় কেননা বাকীটা সময় তিনি কলাম ছাড়া কলমই খুলতেন না। বোধকরি পরে তিনি সেই ভানটুকুও বাদ দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠিত হবার পর, যেমনটি আমরা প্রার্থনা করেছিলাম, তারো চে আরো বড় কবি হবার পর, যখন আবৃত্তিকাররা তার কবিতা আবৃত্তির ক্যাসেটে পাঠ করা শুরু করেছিলো, তারও পর, তিনি এমনকি ভক্তদের দেখা দেবার জন্যও মেলাতে অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলেন। কেননা তখন তিনি যা লিখছেন, তাই অধীর হয়ে পাঠক কিনছে কেননা কেনা জানে অসির চেয়ে মসি কতো শক্তিশালী। আর তাই তিনি হরদম বিদেশও যাচ্ছেন লেখকমেলায় যোগ দিতে, এমনকি এই পোড়ার মার্কিন মুলুকেও, যেখানে কিসিঞ্জারের ব্যাক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে গন্য ছিলো বাংলাদেশ, সেখানেও তিনি কবিতা পড়তে এসেছিলেন, প্রেমেরই কবিতা হবে বোধহয়, কেননা আর যে সব বিষয় নিয়ে তিনি এককালে লেখা শুরু করায় আমাদের নিজেদের বিট্রেড মনে হয়েছিলো, মার্কিন দূতাবাসের দাওয়াতে সে কবিতা পড়া অশোভন হতে পারে বলে তারো বোধকরি মনে হয়ে থাকতে পারে। তাই প্রেমের কবিতাই সই, এমন বোধই বোধ হয় হয়ে থাকবে।

আমরা তাতে খুব যে আহত হবো তাও না, কেননা আমরা তখন ঢাকায় কি করে একটা ফ্লাট কেনা যেতে পারে সে নিয়ে ব্যস্ত; অতএব দু ঘন্টার ড্রাইভ হলেও বহুবিভক্ত বাংলাদেশী এসোসিয়েশনের কোন একটার দাওয়াত পেয়েও তার কবিতা শোনার চাইতে ফ্লাটের আশু ডিজাইন পরিবর্তন যে বেশী দরকারী মনে হবে, তাতে তার হাজতমুক্তির জন্য মিছিল করার পর ঝালমুড়ি খাওয়ার সময়ও আমাদের কোন দ্বিধা থাকেনা। এবং তিনি যে লেগে থাকলে ব্রিলিয়ান্ট হতেন সেটা মনে রেখেই আমরা আশা করতে থাকি যে তিনি আমাদের কখনই সেই কাব্য প্রত্যাশা থেকে নিরাশ করবেন না তা সে প্রেম বা বিরহের কবিতা না হলেও। কেননা শেষ পর্যন্ত সব কবিই স্বপ্নবাজ, এবং নারীর বা দেশের, যা কিনা একটি গোলাপেরই সমার্থক, অন্তত মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আমরা তাই জানি, বা আমাদের দেখা, না দেখা স্বপ্ন; করা, না করা কর্তব্য; অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত কিনা মানুষের জন্য কাজ করা, স্বপ্নবাজ হওয়ায় তারই উপর দায়িত্ব হিসেবে বর্তায়। অন্তত আমরা তাকে সে দায়িত্ব তিনি না জানলেও অর্পন করেছিলাম, নতুবা আমরাই বা কবি না হয়ে অন্যকিছু হবার জন্য, অন্তত আমাদের পিতাদের প্রতিচ্ছবি হবার জন্য প্রানান্ত হবো কেন?

তাই যখন আমরা টোফেল বা বিসিএস নিয়ে নিজেরা ব্যস্ত হলাম, তখনই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, যে কবি বিশবছর পর যখন ফ্লাট কেনার জন্য টেলিফিল্ম বা ঈদের নাটক লিখবেন, তখন আমরা তাকে শপথ ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত করবো যদিও এ নিয়ে আমাদের যে মেইল চালাচালি হবে তাতে কবির চাইতে নিজেদের ব্যাবসা বা চাকরির কথাই বেশী থাকবে, তবুও তার শপথভঙ্গের বিষয়েও আমরা একমত হবো। আর যখন এ নিয়ে লিখবো তখন তা কবি না আমাদেরই জীবনেরই কথা তা নিয়ে আমাদের যে সংশয় হবে তাও আমরা তখনই ঠিক করি এবং তাই ব্লগের নির্ধারিত ক্যাটাগরিতে এটা জীবনকাহিনী না গল্প সে নিয়ে আমাদের এতই সিদ্ধান্তহীনতা থেকে যায় যে আমরা পারলে তা ব্ল্যাঙ্ক রাখারই সিদ্ধান্ত নেই এবং না পারায় একে গল্প হিসেবে লিখি, কিন্তু একমত হইনা ও ব্লগডিজাইনারের শাপান্ত করি।

কিন্তু কিছুতেই আমরা কবিকে ক্ষমা করতে রাজী হইনা কেননা যখন তিনি আমাদের আশাহত করে আমাদের নির্ধারিত প্রেম বা বিরহের বাইরে প্রকৃ্তি ও মানুষকে নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন তখন তাকে আমরা তাকে একবার ক্ষমা করেছিলাম, তাছাড়া কবিতার অন্য অর্থ বুঝতে শুরু করাও যে তারই হাত ধরে, তাই তাকে আরেকবার ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। তাছাড়া দেয়াল ভাঙার পর তিনিও যে তার কাছে রাখতে দেয়া স্বপ্ন ভেঙে ফেলবেন এমন কোন চুক্তিও আমরা করিনি। তাই তাকে আমরা মৃত ঘোষনা করে একটা সম্মিলিত লেখা লিখতে শুরু করি এবং যেহেতু নতুন করে স্বপ্ন দেখা যথেষ্ট কঠিন, সেহেতু সে দায়িত্ব আমরা পূনরায় মৃত কবির উপর দিয়েই পূনঃনিশ্চিন্ত হই কেননা আমরা স্থির জানি যে মৃত কবিকেও শপথ ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করা যায়।


মন্তব্য

প্রথম মাল্যবান এর ছবি

করলেন কী মশাই! এতো আমার কথাগুলোই বলে দিলেন এতক্ষণ ধরে। অসাধারণ লাগলো।

পুতুল [অতিথি] এর ছবি

শোনলাম কবি নাকী এখন পূর্ণজন্ম নিয়া বঙগদেশের রাজধানীতে হুক্কা টান্যে!
লেখা সেই রকম। মানে কবিতার মতন।

সময়টার কথা বেশ সুন্দর করে লিখেছেন। আহা! রোদমাখা সেই দিন!!!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।