জোসেফ স্টিগলিজ: মুক্তবাজারি মৌলবাদ ও বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয়

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি
লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ (তারিখ: মঙ্গল, ০৫/০৮/২০০৮ - ৯:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মনে হচ্ছে বিশ্বের বাস্তবতা আর নব্য-উদারতাবাদী মতবাদের প্রতি সদয় নয়। এক গুচ্ছ মৌলবাদী ধ্যানধারণায় ভরপুর নব্য-উদারতাবাদ আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, বাজার ব্যবস্থা নিজের ভুল আপনা-আপনি সংশোধন করতে পারে, দতার সঙ্গে সম্পদ বন্টন করতে পারে এবং জনস্বার্থকে সেবা করায় তা অতি দ। এ ধরনের চিন্তাই ব্রিটেনের থ্যাচারিজম আর আমেরিকায় রিগানোকমিকস এবং তথাকথিত ‘ওয়াশিংটন-সম্মতি’ বা ওয়াশিংটন কনসেনসাস এর ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। আর এর ল্য ছিল বেসরকারিকরণ, উদারিকরণ এবং বুনিয়াদি বিষয়গুলো বাদ দিয়ে কেবল মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক-কে ব্যতিব্যস্ত রাখা।
গত ২৫ বছর জুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা জারি আছে এবং তাতে পরাজিতদের পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে। যারাই এই নব্য-উদারতাবাদের তরিকায় চলেছে তারা কেবল প্রবৃদ্ধির সুযোগটাই হারায়নি, প্রবৃদ্ধি যদি কিছু হয়েও থাকে, তা চলে গেছে ওপর তলার লোকদের কাছে।
নব্য-উদারতাবাদীরা স্বীকার না করলেও এই মতবাদ আরেকটা পরীক্ষাতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফাইবার অপটিক খাতে ৯৭ শতাংশ বিনিয়োগ সত্ত্বেও নব্বই দশকের শেষাবধি অর্থবাজারে এর সুফল আলোর মুখ দেখেছে বলে কেউই দাবি করতে পারবেন না। তবে এই ভুল থেকে একটি অনিচ্ছাকৃত সুবিধার ব্যাপার ঘটেছে। যোগযোগ ব্যয় বিপুল পরিমাণ কমে যাওয়ার সুবিধা নিয়ে ভারত ও চীন বৈশ্বিক অর্থনীতির মধ্যে আরো প্রোথিত হতে পেরেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন খাতে এই ভুল বন্টনের ফল অতি মারাÍক হয়েছে। পারিবারিক ব্যবহারের জন্য নতুন বানানো বাড়িগুলোর ব্যয় ল ল পরিবার আর বহন করতে না পারায় তারা সেইসব বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। যারা তা হয়নি, সরকার নিজেই তাদের সরিয়েছে। অতএব সেইসব স্বচ্ছল নাগরিকেরা যা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, এখন তা-ই হয়েছে। তাদের বাড়িঘরের মূল্য কল্পনাতীতরকম পড়ে গেছে।
বিষয় হচ্ছে, আবাসন শিল্পে মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগের একটা সাময়িক সুবিধা রয়েছে। কিছু মার্কিনি হয়তো কয়েক মাসের জন্য বিরাট বাড়িতে থাকা এবং বাড়ির মালিক হওয়ার আনন্দ ভোগ করেছেন। কিন্তু ভাবতে হবে যে, বিশ্ব অর্থনীতিকে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এবং সকলেই ভাবছেন চলমান মন্দা আরো ছড়াবে এবং দীর্ঘকাল থেকে যাবে।
অন্যদিকে লাফিয়ে বাড়তে থাকা তেল ও খাদ্যের দামের ব্যাপারেও বাজার আমাদের কোনো হুঁশিয়ারি জানায়নি, প্রস্তুতও করেনি। তাই এমন কোনো ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না যা মুক্তবাজার অর্থনীতির আদর্শ নমুনা হতে পারে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, যখন বিশেষ কোনো স্বার্থ এর সুফল পায় তখন এর প্রশংসা হয়, আর যখন হয় না তখন বিচ্ছিন্ন থাকা হয়।
সম্ভবত বুশ প্রশাসনেরও অল্প কয়েকটি নীতির একটি হলো, বাস্তব আর বাণীর মধ্যে বিপুল ফারাক রাখা। রোনাল্ড রিগানের আমলে এই পার্থক্য আরো কম ছিল। জনাব রিগান মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়গানের মধ্যেও নির্দ্বিধায় নানানরকম বাধানিষেধ আরোপ করতেন। জনাব বুশের নীতি আরো খারাপ। এই অর্থে যে, তিনি খোলাখুলি আমেরিকার সামরিক-শিল্প স্বার্থকে সেবা করে যাচ্ছেন। একমাত্র ইথানল দিয়ে জ্বালানী তৈরির বিষয়েই তিনি পরিবেশবাদী সেজেছেন যদিও পরিবেশের বেলায় এর সুফল কী তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। বৈশ্বিক জ্বালানী বাজারে বিকৃতির মন্দ ফল অব্যাহতই থাকবে মনে হচ্ছে। আর বুশীয় কারবার চলতে থাকলে অধিকতর মন্দ ফল অবধারিত।
মুক্তবাজারি বুলিবাগিশতার সঙ্গে সরকারি হস্তেক্ষেপের মিশ্রন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য খারাপ হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, তারা যেন কৃষিতে কোনো সংরণমূলক নীতি না নেয়। কিন্তু এর মাধ্যমে তৃতীয় দুনিয়ার কৃষকদের ইউরোপ-আমেরিকার দানবীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এক সর্বগ্রাসী অসম প্রতিযোগিতার ভেতর ফেলে দেয়া হয়েছে। ব্যপারটা যদি এমন হতো যে তাদের ইউরো-মার্কিন কৃষকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, তবে তার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ইউরো-মার্কিন কৃষি-সংঘগুলোর ভর্তুকির সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সামর্থ্য কোথায় তাদের? কারণ তাদের সরকার তাদের সেই পরিমাণ ভর্তুকি তো দিচ্ছেই না, উপরূন্ত বাজারের অব্যবস্থাপনার জন্য তাদের উৎপাদন ব্যয় উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তাই এতে কোনো অবাক হওয়ার ব্যাপার নেই যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষিতে নতুন বিনিয়োগ হারিয়ে যাচ্ছে এবং খাদ্য চাহিদা ও ঘাটতির ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
যারা এইসব ক্ষতিকর পরামর্শ দিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের কিন্তু এর জন্য সৃষ্ট বিপর্যয়ের দায় নিতে হচ্ছে না। এর মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ঐসব দেশের গরিব কৃষকদের। তাই এ বছর আমরা বিরাট আকারে দারিদ্র্যের পরিমাণ বৃদ্ধি দেখতে পাব। অবশ্য যদি সঠিক ভাবে হিসাব করা হয়।
খুব সরলভাবে বললে, যে মুহূর্তে দুনিয়ায় প্রাচুর্য চলছে, সেসময় উন্নয়নশীল দেশের কোটি কোটি মানুষ ন্যুনতম পুষ্টি চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক দেশে খাদ্য ও জ্বালানীর দাম এত বেড়ে গেছে যে, তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনধারণকেই বিপন্ন করে তুলছে। কারণ, খাদ্য ও জ্বালানীর পেছনেই তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করতে হয়।
সুতরাং দুনিয়া জুড়ে যে বিক্ষোভের তরঙ্গ দেখা যাচ্ছে তা স্বাভাবিক। ফটকাবাজরা এই ক্রোধ গায়েই মাখছে না। তারা তর্ক করে: ‘আমরা তো আর সমস্যার জন্য দায়ি নই; আমরা তো কেবল ‘মূল্য আবিষ্কারে’ নিয়োজিত রয়েছি’’। অর্থাত আমরা ঘাটতি আবিষ্কার করেছি।
কিন্তু উত্তরটির মধ্যে শয়তানি বুদ্ধি রয়েছে। লাগাম ছাড়া দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখে কৃষকরা আগাম সতর্কতা নিচ্ছে। তাদের শস্যের কিছু পরিমাণ আজ মজুদ করে কাল বিক্রি করলে তারা লাভবান হবে সত্য। আগামী বছর শস্য উৎপাদন যদি কমে যায় সেই ভয়ে এ ছাড়া তারা চলতেও পারবে না। এভাবে গোটা দুনিয়ার কৃষকরা একটু করে শস্যও যদি মজুদ রাখে, তার যোগফল কিন্তু বিরাট হয়ে যায়।
মুক্তাবাজারের ওকালতি করনেওয়ালারা বলতে চান, দোষ বাজারের নয় সরকারের। আমি একমত। কিন্ত তাহলেও কি বাস্তবতা পাল্টাবে? আমেরিকার ব্যাংকগুলোর ভুল চালের জন্য গোটা দুনিয়ার বিরাট অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যারা এগুলো চালায় তারা কিন্তু ঠিকই তাদের তিপূরণ আদায় করে নিয়েছে। আজ সামাজিক ও ব্যক্তিক প্রাপ্তির মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না। এ দুটো যদি নিবিড়ভাবে যুক্ত না থাকে তাহলে বাজার ভাল ভাবে কাজ করবে না।
নব্য-উদারনৈতিক বাজার-মৌলবাদ আসলে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থের সেবা করে। কখনোই এটা অর্থনৈতিক তত্ত্ব দ্বারা সমর্থিত ছিল না। সেরকম কিছু দ্বারা একে বোঝাও যাবে না। এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। এ থেকে শিক্ষা নিলে সেটাই হবে বৈশ্বিক আকাশে ঘন হয়ে আসা মেঘের ফাঁকে আলোর রেখা।
;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;
সহব্লগার সুবিনয় মুস্তফীর সৌজন্যে পাওয়া, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা

এ বিষয়ে রেমন্ড লোটার একটি লেখা পাবেন এখানে

গ্লোব এন্ড মেইল থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত
জোসেফ স্টিগলিজ: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।


মন্তব্য

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

বাজারের টানাটানিতে বিরক্ত হয়ে নেট কানেকশন বাসা থেকে বিদায় নিয়েছে আপাতত। সুতরাং কাল পর্যন্ত বিদায়।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

বলে রাখা উচিত যে নিওলিবারেল অর্থনৈতিক মতবাদকেই এখানে "নব্য-উদারতাবাদী" হিসাবে বোঝানো হয়েছে।

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন:
বাজারের টানাটানিতে বিরক্ত হয়ে নেট কানেকশন বাসা থেকে বিদায় নিয়েছে আপাতত। সুতরাং কাল পর্যন্ত বিদায়।

ফারুক ভাই, বাজারের টানাটানিতে তো আপনার অল্পের উপর দিয়েই গেছে। তাহলে আমাদের আবুল ভাইয়ের কথা শুনুন। আবুল ভাই মানে আমাদের অফিসের ড্রাইভার আবুল ভাই। প্রতিদিন সকালবেলা আমাকে শাহবাগ থেকে নিয়ে আসে। আবার সন্ধ্যাবেলা ফিরিয়ে দিয়ে আসে। আবুল ভাই বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে এতোদিন ঢাকাতেই ছিলেন। কিন্তু হালের মুদ্রাস্ফীতিতে আর টিকতে পারেন নি। কয়েক মাস আগে তাদের সবাইকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেদিন তাই দুঃখ করে বলছিলেন, এই ফখরুদ্দীন সরকার আমার বউ'কে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিছে। ভাগ্যিস, আপনার বেলায় এমনটি হয়নি!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি
এ থেকে শিক্ষা নিলে সেটাই হবে বৈশ্বিক আকাশে ঘন হয়ে আসা মেঘের ফাঁকে আলোর রেখা।

ইতিহাস থেকে কেউই শিক্ষা নেয় না। কাজেই আশার আলো সুদূরপরাহত।

অন্যদিকে @ পান্থ রহমান রেজা
আমার আয় যা দেশে পাঠাই তার সবই খরচ। সঞ্চয় নেই কানাকড়িও। দেশে ফিরলে যে কাজ জুটবে, তার বেতনে সংসার চলবে না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে আমাকে আমৃতু্্য প্রবাসে থাকতে হবে- স্ত্রী-সন্তানের অন্ন-বস্ত্রের যোগান দিতে হলে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।