মামা

ভবঘুরে এর ছবি
লিখেছেন ভবঘুরে (তারিখ: মঙ্গল, ০৫/০৮/২০০৮ - ৯:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১. 'এই দাঁড়া! তুই সঞ্জু না?' - বাজখাই কন্ঠ শুনে ভীষন চমকে উঠলাম। আমি অবশ্য বাজখাই কন্ঠের কারনে এতটা চমকাইনি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কেউ আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারে তাও আবার মাতৃভাষায় - কখনো ভাবতেই পারিনি। সে কারনেই এত চমকে উঠা।

ফিরে তাকিয়ে দেখি বিশালদেহী এক ভদ্রলোক। গায়ে সাদা টি সার্ট, জিন্স প্যান্ট। খুবই চেনা চেনা লাগছে। কে যেন, কে যেন - সহসাই তাকে চিনতে পারলাম।

'আপনি সাধু মামা ঠিক?' - কিছুটা সন্দেহমাখা কন্ঠে আমার জিজ্ঞাসা।

'হু চিনতে পেরেছিস তাহলে। তা এখানে এসেছিস কেন?' -মামা জিজ্ঞেস করলেন।

'আপনি এখানে মানে এদেশে? ক-ক-কবে এসেছেন?' - অতি উৎসাহে আগ্রহে আমার তোতলামী শুরু হয়ে গেল। উনি কি বল্লেন তা আর আমার মাথায় ঢুকল না। আমি আসলে ভয়াবহ রকমের আশ্চর্য হয়েছি। দেশ থেকে হাজার মাইল দুরে সুদুর ইটালীর রোম শহরের কোন এক সমুদ্র পাড়ে যদি একান্ত কাছের কোন লোকের দেখা মিলে - কোনরকম পুর্ব যোগাযোগ ছাড়াই! তাহলে কেমন লাগতে পারে! আর উনি যে এদেশে তাতো কেউ আমাকে বলেনি! একেই কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে!

'আমি তো এদেশেই থাকি। কেন তুই জানতি না?' - মামাও কিছুটা বিষ্মিত মনে হল।

'আমিতো জানতাম আপনি আর্মিতে আছেন।' - আমি বলতে থাকি। - 'কিন্তু এদেশে যে আছেন তাতো জানতাম না।'

'আর্মিতে ছিলাম ঠিকই কিন্তু সে তো বেশ কয়েক বছর আগের কথা।'- মামা বলতে লাগলেন। - 'এদেশে আছি তাও বছর দুয়েক তো হবেই।'

তারপর বীচে হাটতে হাটতে মামা আরো অনেক কথাই বললেন। বসনিয়ায় মিশন শেষে ইউরোপ ভ্রমনের সুযোগ পায় মামা। তারপর ইটালীতে থেকে যাওয়া।

'তা তুই এখানে কেন এসেছিস বললিনাতো?' - মামা হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালেন।

'এই অফিসের কাজে এসেছি।'

'অফিসের কাজে? তাই নাকি? আমিতো ভাবলাম দালাল মারফত পালিয়ে এসেছিস। হাঃ হাঃ' - মামা একটু হাসলেন। 'তা কি অফিস তোর?'

আমি জানালাম।

'আরেব্বাহ্, তুই তো অনেক বড় চাকুরী করিস দেখছি।'

'না এই আরকি।' - ভাবটা একটু বজায় রাখার চেষ্টা করলাম। যদিও বসের - বলা যায় 'দয়ায়' আমার এই ট্রিপ; ওয়ার্কসপের মুল পার্টিসিপেন্ট আমার বস, তবুও সবকিছু ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না।

'আপনি কোথায় থাকেন? মানে আপনার বাসা কোথায়?' - আমি জিজ্ঞেস করি। সঙ্গী সাথীহীন কিভাবে কাটাব এ আশঙ্কা ছিল শুরু থেকেই। ইটালীয়ান বসের সাথে এসেছি। সে নিজের বাড়িতে উঠেছে। আর আমি হোটেলে। মামাকে পেয়ে বেশ খুশী লাগছে। সময় কাটানো যাবে তার সাথে।

'আমিতো এখানেই থাকি। বিচে ঘোরাঘুরি করি। হাঃ হাঃ' - মামা রহস্যময় হাসি হাসলেন।

'তা তুই কোন হোটেলে উঠেছিস।' - মামা উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন।

আমি জানালাম।

'শেষ কবে দেশে গিয়েছেন?' - আমিও প্রসঙ্গ পাল্টাই।

'মনে নেইরে সত্যিই মনে নেই।'- একটু উদাসী কন্ঠে বলতে থাকেন তিনি।

তাই নাকি? খুব ব্যস্ত থাকেন মনে হয়?

'আমার আবার ব্যাস্ততা কিরে? ঘুরি ফিরি-'

'বাড়িতে রেগুলার যোগাযোগ হয় তো?'

'আমার আবার বাড়িঘর আছে নাকি। কেউ নেই আমার।' - উদাসী কন্ঠে বলতে থাকেন মামা।

মনে হচ্ছে বাড়িতে মামীর সাথে ঝগড়া ঝাটি হয়েছে। নইলে কিছু বলতে চাচ্ছেন না কেন। যাই হোক আমিও আর ঘাটালাম না তাকে। মামার সাথে এটা সেটা নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম। তবে তিনি তার বাসায় নিয়ে যাবার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখালেন না। আমিও আর সে প্রসঙ্গ উঠালাম না। তিনি না চাইলে আমারও অত ইচ্ছে নেই।

'এই তুই এখানে একটু বসতো। বসে বাতাস খা। আমার খুব জরুরী একটা কাজ করতে হবে। আমি আজ যাই।' - মামা হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে তিনি উঠে দাড়ালেন।

'কিন্তু মামা' -- আমি শুরু করতেই তিনি বাধা দিয়ে বলতে শুরু করলেন।

'তুই তো এই সপ্তাহ থাকবিই তাইনা। আবার দেখা হবে।'

আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি হনহন করে হেটে চলে গেলেন।

কিছুক্ষন কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। তার আচরন কোনভাবেই মেলাতে পারলাম না। বেশ কিছুক্ষন মামার জন্য অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তিনি এলেন না। সুর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই। আমি হোটেলে ফিরে গেলাম। তার অদ্ভুত আচরনের কথা ভেবে অবাক লাগছে। উনি কেন হঠাৎ করে চলে গেলেন?

রাতে হঠাৎই একটা ব্যাপারে একটু খটকা লাগল। মামা আমাকে চিনলেন কিভাবে? উনি দুর সম্পর্কের মামা হলেও একসময় উনাদের সাথে আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল।

'শেষ কবে দেখা হয়েছিল তার সাথে?' - ভাবতে থাকি আমি। যতদুর মনে পড়ে ১৮/২০ বছর আগে একবার গ্রামে বেড়াতে গিয়ে উনাকে দেখেছিলাম। তার পর আর - নাহ্; আরতো দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু তখন তো আমি বেশ ছোট ১৫/১৬ বছর হবে বয়স। একটু ভাবতেই বুঝলাম আর তার সাথে দেখা হয়নি আমার। তবে নিয়মিত তার ছবি দেখা হত। সেকারনেই তাকে চিনতে পেরেছি। আর তার চেহারা, শরীর সব আগের মতই আছে। কিন্তু এতদিন পড়ে উনি আমাকে চিনলেন কি করে? ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক মনে হল আমার কাছে।

ওয়ার্কসপের দিনগুলো অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। বিকেলে বিকেলে অফিসের ব্যবস্থাপনায় ইটালীর বেশ কটা শহর ঘুরে দেখলাম। পিসার হেলানো টাওয়ারটাও দেখতে গেলাম একদিন। বিচে আর যাওয়া হল না। তবে প্রতিদিনই হোটেলে ফিরে কেউ আমাকে খুজেছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার খোজে কেউ আসেনি ভেবে আশ্চর্য লাগত। মামা একবার এলেনও না? তিনি তো জানেন আমি এই হোটেলে আছি।

দেশে ফেরার আগেরদিন আবার হাটতে হাটতে সেই জায়গায় গিয়ে বসলাম। যেখানে মামা আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। বসে বসে ভাবছিলাম মামার সাথে আজ দেখা হলে কিছু কটু কথা বলব। কিন্তু তিনি এলেননা। রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মনে একরাশ দু:খ নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
**********
২. দেশে ফিরে তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি গিয়ে তার কথা মনে পড়ল।

'আচ্ছা মা সাধু মামার লেটেস্ট খবর জানো?' - আমি মা'কে জিজ্ঞেস করলাম।

মা আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমার প্রশ্ন বুঝলেন কিনা জানিনা। তিনি অস্ফুট কন্ঠে বলতে শুরু করলেন - 'আহা বেচারা। মিশন শেষ করে ইটালীতে পালিয়ে যায় সে। তারপর কিভাবে যেন দুষ্ট লোকের পাল্লায় পড়ে নেশার ব্যাবসা শুরু করে। ঐ যে কি যেন নাম। যায়গাটার। ফুমিচিনো না কি--'

'তাই নাকি? নেশার ব্যবসা- মানে ড্রাগ বিজনেস!!' - আমি আশ্চর্য হলাম মা'র কথায়। আমি এসবের কিছুই জানতাম না! তার রহস্যময় আচরনের কারন কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারলাম। কেনইবা তিনি পরে আর দেখা করেননি আমারসাথে। কেন তার বাসায় আমাকে যেতে বলেননি।

'মামা কি এখন আর দেশে যোগাযোগ করেন না?' - আমি মাকে জিজ্ঞেস করি।

মা মনে হল কিছুটা অবাক হলেন। 'তোকে মনে হয় কেউ জানায়নি। গত বছর এই মাসের' - মা একটু চিন্তা করতে লাগলেন। - 'কত তারিখ মনে নেই। তবে এই মাসেই। বিচের উপর তার লাশ পাওয়া যায়। কারা যেন মেরে ফেলে রেখেছিল।'

'কি বলছ এসব? মামা মরে গেছেন নাকি?' - আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

'হ্যা তাইতো বলছি তোকে। এইতো কয়েকদিন আগেই না ওরা সাধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করল?'

'মৃত্যুবার্ষিকী!!' - আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। 'কত তারিখে বলতে পার?' - অবচেতন মনে কি যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি কিন্তু মেলাতে পারছি না।

মা একটু ভাবলেন তারপর তারিখটা বললেন আমাকে। আমার সারা শরীরের রোম মুহুর্তে দাড়িয়ে গেল তারিখটা শুনে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। একই দিনে সাধু মামার সাথে আমার দেখা হয়েছিল সে কথা আমি আর মা'কে বলতে পারলাম না।

*জনাব মা. মুর্শেদ সাহেবকে উৎসর্গ করা হল। যার কারনে খুব দ্রুত একটা গল্প লিখতে পারলাম!


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

ভাই ভালো লিখেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হইলো এত্ত বড় গল্পটারে আপনে অনুগল্প কইতাসেন ক্যান?
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ভবঘুরে এর ছবি

দুইএর মধ্যে পার্থক্য বুঝিনা। অনুগল্প কোনগুলো?

মুশফিকা মুমু এর ছবি

আপনি খুব ভাল লিখেন, আপনার দুইটা গল্প পড়লাম খুব ভাল লাগল, আরো বেশি বেশি লিখেন হাসি
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

ভবঘুরে এর ছবি

বাকী দুটো্ও পড়ে দেখেন কেমন লাগে।

সবজান্তা এর ছবি

বহু পরিচিত এক কাহিনী লিখলেন। অধিকাংশ ভূতের গল্পেই এরকম কাহিনী পড়ি। কিন্তু আপনার লেখার হাতটা খুব ভালো ভাই। গল্পের প্রথম অংশটা দারূন লেখেছেন। শেষের অংশটা ভালো লাগলেও, গতানুগতিক হয়েছে খানিকটা। আমার মনে হয় আপনি চেষ্টা করলেই শেষটা আরো সাসপেন্সময় রাখতে পারবেন।

তবে ভাই আসলেই আপনার লেখার হাত ভালো। আরো লেখা আমাদের পড়তে দিবেন, এমনটা আমরা আশা করতেই পারি - তাই না ?


অলমিতি বিস্তারেণ

ভবঘুরে এর ছবি

এই লেখাটা একেবারে নতুন। গতকাল সারাদিন চেষ্টায় রাতে শেষ করেছি। বাকী গল্পগুলো আগের মানে ২/৩ মাসের পুরোনো। অন্য ব্লগে প্রকাশিত।

মা. মুর্শেদ বলছিলেন নতুন গল্প পোস্ট করতে। তাই লিখে ফেলেছি। সময় নিয়ে লিখলে আর একটু বড় করা যেত।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আপনার তিনটা লেখা তিনরকম স্বাদের।
তবে প্রত্যেকটাতেই একটা সেমি ভৌতিক গন্ধ ছড়ানো।
অলরেডি আপনার ভক্ত হয়ে গেছি।
লিখতে থাকেন।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ভবঘুরে এর ছবি

এটা দিয়ে ৪টা তো! বাকী রাখলেন কোনটা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।