একটি থ্রিডি থ্রিলার : আতা গাছে তোতা পাখি

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৮/০৮/২০১১ - ২:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


জানি এ লেখাটি কেহই পড়িবেন না। পড়িলেও কেহ পুছিবেন না। তাহাতে কাহার কি? এ লেখক বড়ো ঘড়েল লেখক। ছাতামাতা লেখেন। ছাতিলাঠিবন্দুক--ইহাতে নাই সন্দুক। ইহাতেই আনন্দ। আসেন ডুগডুগি বাজাই। সিম সিম খুল যা--
প্রথম পর্ব : ইহা আমার ভাগ্নে কবি মুহিত হাসান দিগন্তের জন্য লিখিত
--------------------------------------------------------------------------------------

হুলারহাটে হুলা আছে। হুলা বলে ম্যাও।
অ হুলা, তুমি কি কর?
ছ্যাও। মুই দিনে দুফরে ছ্যাও করি।
ছ্যাও করিলে ভ্যাও করিয়া কাঁদিয়া উঠেবে। কাঁদিয়া বলিবে, ওরে পাগল এ দুন্নিয়ায় সুখ নাইরে। তাহার তরে নৈড়া গেছি। নৈড়া নৈড়া কইতে আছি, অ্যাও।
এই হেতু একদিন অ্যাও করিতে হইল।

আগে কৃষ্ণনগর। পরে মরিচাল। মাঝে কেশরতা। তারপর রানীপুর। রানীপুরে রানী নাই। ঘানী আছে। সেই ঘানীতে ত্যাল ভাঙে। সে ত্যালে হুলারহাট ভাঙ্গে। ভাঙ্গিলে কুমীর ভাসে। সে কুমীর জ্যাতা নয়। মরা। কে বা কাহারা এই কালীগঙ্গার ঠোঁটায় কচার নদীর বোঁটায় রইদ পোহানরত একটি কুমীর দেখিয়া ভিতিপ্রাপ্ত হইয়াছিল। এই হেতু গ্রামে কাড়া নাকাড়া বাজিতে আরম্ভ করে। রাত্রি ব্যাপিয়া বাজতে বাজতে চলল ঢুলি—ঢুলি বাজায় কমলা ফুলি। কমলার ফুলির বিয়েটা—সূজ্জি মামার টিয়েটা। এই বিরাট দিনে বা দিবসে কুমীরটা মরিল। সেই হেতু গ্রামটির নাম কমলাফুলি থেইকা কুমীরমারী। অবিশ্বাস হইলে মামু, আরব আলী ফয়ির আছে। ফয়িরের বয়সের গাছপাত্থর নাই। তাহার কাছে জাইবেন। জাইলে তিনি সত্য করিয়া বলিতে পারিবেন। তিনি কথা কহেন না—বাক্য কহেন। ইহাই সহি।

আরব আলী ফয়ির বলেন, বোজলেন বাপা, কথা সইত্য। সেই কুমোইরের চামড়া দিয়া আমার দাদাজানের দাদাজান, তার দাদাজানের দাদাজান একটা ডুগডুগি বানায়ছেলো, সেইটা বাজাইয়া তিনি কইয়াছেলেন, কি কইয়াছেলেন, তাহা কহিবার পূর্বে আরব আরী ফয়ির একটু দম লন। ভম করিয়া এদিক ওদিক চান। তাহার দাড়ি পাকা। কানের কাছে আড়ি পাতিয়া কহেন, এইখানে কুমোইর মইরাছেলো হাচা, কিন্তুক তুমরা জানিবা নিশ্চয়—এই গ্রামে আতাগাছে তোতাপাখি আসিবে। সে তোতা পাখি ভোতা হইয়া চিতরাইয়া পড়িবে। বোজলেন বাপা, চারদিকে গভীর অন্ধকার। না ধরিবেন ধন্ধকার। আমাবইস্যা কাল। আর পাইড়ো না ফাল। ফিনিস।

এইটুকু বলিয়া আরব আলী ফয়ির স্পিকটি নট। বোঝা যায়—এখন তাহার তাম্বুল খাইবার লগন সমাগত। তিনি একটি পান বরজের কাছে যান। চ্যাগর ব্যাগর করিয়া গাম্বুল করিতে থাকেন। এই পান বরজের পাশে একখানি কব্বর। কব্বর দেখিয়া তিনি নিতিরোজ চক্ষু ভাসান। উহা তাহার লীলাবালী। তাহার পরান নাই। ছড়ান আছে।

এই-ই সূত্র। এই সূত্রে তাম্বুল অথবা পান বরজটি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি ইনসান আলীর দারোগার। তিনি থানার ডাইরীতে লিখিয়াছিলেন, অত্র অঞ্চলে রাস্তার পাশে অবস্থিত পান বরজ অতিশয় সন্দেহজনক। সন্দেহজনক বলিয়া গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখিয়াছিলেন, অতঃপর তাহারা দুইজন মোটর সাইকেলে চড়িয়া রানীপুরের দামুদর ভারানী খালের নিকটে পহুছাইলে সেইখানে ওৎ পাতিয়া থাকা কে বা কাহারা বলিয়া উঠিল, আই হে।

(নোট.১. আই হে শব্দটি কাহারা শুনিয়াছিল অকুস্থলে—তাহা অনুসন্ধানে পাওয়া যায় নাই। যাহারা বলিয়াছিল বা বলিতে পারে বলিয়া ধরিয়া নেওয়া জাইতে পারে, তাহারা পরে কহিয়াছিল—তাহারা অইরূপ কোনো আই হে শব্দ শোনে নাই। তাহারা সেইদিন রানীপুরেই আছিল না। আছিল বলেশ্বর নদীর পশ্চিমপাড়ে মোড়েলগঞ্জ উপজেলাধীন বনগ্রামে। বনগ্রামে মতিন মুন্সীর জেয়াফতে তাহারা খাদেমগিরি করিতে গিয়াছিল। মোড়েলগঞ্জ জেহেতু পিরোজপুর বরিশালের অন্তর্গত নহে, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের অন্তর্ভূত, সেই কারণে সরেজমিনে মতিন মুন্সীর উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়া সত্যতা সরেজমিনে যাচাই করিবার সুযোগ নাই। তবে মতিন মুন্সীর জেয়াফতের খবরটি খুলনার দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠার চতুর্থ কলামে ছাপা হইয়াছিল। কাটিং সংযুক্ত। খবরটির শিরোণাম ষাট খাসি--গরু আশি। তবে এই তাহারা যে কাহারা তাহার খোঁজ খবর জানা জায় নাই।
নোট. ২. দামুদর নামে ভারানী খালের যে নামটি করা হইল, তাহার সঙ্গে সংযুক্ত ভারানী শব্দার্থ হইল– দুইটি নদীর সংযোগ খালকে ভারানী খাল বলে। দামুদর ভারানী খালটি পিরোজপুর শহরের পশ্চিম পাশের বলেশ্বর নদের সঙ্গে পিরোজপুর শহরের সাত কিলোমিটার দূরে পূর্বদিকে হুলারহাট বন্দরের কালিগঙ্গা নদীকে সংযোগ করিয়াছে। খালটির পাশে অত্র এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবস্থিত। এই সড়ক পথে পূর্বদিকে বরিশালে এবং পশ্চিমদিকে বাগেরহাট হইয়া খুলনা, যশোর জাওন যায়।
নোট.৩. পান বরজ. দাগ নং ৪৭২, জেএর নং ৫২।. মৌজা রানীপুর। ফসলী ভিটা। পরিমাণ ৩৩ শতাংশ। মালিক—আরব আলী ফকির। পিং সুরত আলী ফকির। সাং রানীপুর। উপজেলা+জেলা : পিরোজপুর, বরিশাল।
জমির অবস্থান : উত্তরে দামুদর ভারানী। পাশে হুলারহাট পিরোজপুর সড়ক। দক্ষিণে শ্রী কমল কুমার সাহার কদলী বাগান। পশ্চিমে নূরুল ইসলামের আখ ক্ষেত। পূর্বে মঞ্জে আলীর সবজি ক্ষেত। )

এবং এইখানে সড়কের উপরে একখানি কালো সালু কাপড় পত পত করিয়া ওড়ে। তাহাতে লেখা—শহীদের দেলোয়ারের খুনীদের ফাঁসি চাই—দিতে হবে। লেখাগুলো সাদা রঙের। জীর্নপ্রায়। তবু কেহ তাহা খুলিয়া লয় নাই। তাহা শূন্য ভাসিতেছে। আর লগে আছে—আই হে।
মুশকিল হল, পান বরজের পাশেই লীলাবালী চাচীজানের কব্বর। তাহাকে সালাম করিত বলিয়া শহীদ দেলোয়ার কোনো রকম ঘষটাই ঘষটাইয়া রাস্তার উত্তর পাড়ে পহুছিতে পারে। কিন্তু তাহা কেবল ধড়। মস্তকটি নাই। তাহা অদ্যাবধি নিখোঁজ। তবে দামুদর খালে মোটর সাইকেলটি পাওয়া গিয়াছিল। জোয়ারে ডুবিয়াছিল। আর ভাটাকালে জাগিয়া উঠিয়াছিল। নং বরি ৫৭২৩১।. ইয়ামাহা ১০০ সিসি। হেডলাইট ভাঙ্গা। অন্ডকোষ আছে। দণ্ড নাই। ছাপা হয়ে গেছে।

(নোট.৪. মস্তকহীন লোকটি যে শহীদ দেলোয়ার হোসেন তাহা কিন্ত সন্দহাতীতভাবেভাবে প্রমাণিত হয় নাই্। ইহা বিচারাধীন কেস। বিচারাধীন বিষয় বলিয়া ইহার বিষয়ে কিছু বলা কওয়া নিসেদ। আদালত মাইন্ড করিতে পারে। তাহাদের মাইন্ডের সীমা পরিসীমা নাই। তবে জীবিত লোকটির নাম সরোয়ার হোসেন। লখাকাঠির প্রবলপ্রতাপান্বিত শহীদ দেলোয়ারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া কথিত। তাহার শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত আছে। এই হেতু সে গাজি। গাজী মুহাম্মদ সরোয়ার হোসেন। আর যদি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় কেসটি তাহলে তাহার ভাইয়ের নাম শহীদ মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।
নোট. ৫. গল্পটিতে একটি খুন আসিয়া পড়িয়াছে। তাই ইহা একটি থ্রিলার জাতীয় রচনা বলিয়া আশা করা যাইতে পারে। বেশ থ্রিল থ্রিল ভাব লাগিতেছে। না জাগিলে পাঠকের ব্যর্ততা—লেখকের নহে। প্রয়োজনে আইসক্রিম খাইয়া লইবেন। তাহাতে শৈত্য অনুভব করিবেন। আরও দরকার হইলে মেরুদণ্ডেও একটু আইস ঘষিতে পারেন। ইহাতে স্পাইন চিলিং বোধ হইবে। দয়া করিয়া কাহিনী হইতে কাটিয়া পড়েবেন না। থ্রিডি চারাগাছের ডাল ভাঙ্গিয়া পড়িতে পারে। থ্রিডি থ্রিলারটি মাঠে মারা যাইতে পারে।
নোট. ৬. বিনোদনহেতু একটি গান সংযুক্ত। গাহিয়া লইতে পারেন।
চারাগাছে ফুল ফুইটাছে ডাল ভাইঙ্গো নারে মালি
ডাল ভাইঙ্গো না। (বাংলা ছিঃনেমা। শিল্পী : এবিসিডি।)

এইখানে কিছু ধন্ধ আছে হে মনু। প্রভাতকালে দণ্ডহীন মুণ্ডুহীন কোনো একটি ধড় দামুদরের পাড়ে পড়িয়া থাকিবার খবর জানা গেলেও প্রকৃত আর্থে কেহ দেহ দেখে নাই। দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল পাতায় ঘটনাটির তিনদিন পরে স্থানীয় সংবাদদাতার বরাত দিয়া একটি খবর প্রকাশিত হয়। প্রকাশ থাকে যে, দামুদরের পাড়ে একটি দেখা যায়। কুমীরটি আট হাত লম্বা। এক হাত চওড়া। উপরের মাড়িতে এক পাটি দাঁত আছে। নিচের পাটিতে নাই। লেজ শ্যাওলা শ্যাওলা।

কুমীরটি মৃত বলিয়া অনেক লোক সেখানে ভিড় জমাইয়াছে। সাহস করিয়া কাছে গিয়া টিপিয়া টুপিয়া দেখিয়া নিয়াছে। পিরোজপুরের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ (অধুনা সৈয়দ পদবী সংযোজিত) মুহাম্মদ সাইদুল ইসলাম পাটোয়ারী সরেজমিনে অকুস্থল পরিদর্শন করেন।

সংবাদে সংবাদদাতার নাম নাই। সেই সময়ে ইত্তেফাকে দুইজন স্থানীয় সংবাদদাতা ছিলেন। একজন শহীদ সুহরাওয়ার্দি কলেজের প্রবীণ অধ্যাপক এস এম সালেহ। আরেকজন এক্স বিএনপি নেতা নাসিম আলী। সাং সোহাগদল। উপজেলা : নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি)।. এস এম সালেহ বাংলার শিক্ষক হিসাবে ৩৪ বছর কর্মরত ছিলেন বলিয়া সাধু ভাষায় লিখিতে পারঙ্গম। এই হেতু তিনি কিঞ্চিৎ কৃশকায়। মুখে বার্নার্ড শ টাইপের সামান্য দাড়ি আছে। আর নাসিম আলী লম্বা চওড়া। একটু গুম্ফ আছে। তাহাকে বিশুবাবু খবর লিখিতে সাহায্য করেন। বিশুবাবুর পূর্ণ নাম শ্রী জগৎপ্রিয় দাশ। সাং মেটারনিটি রোড। পিরোজপুর। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে কর্মরত। তাহাদের ভাষা অসাধু। অসাধু ভাষা ইত্তেফাকে অচল।

মফস্বল সম্পাদককে তাই পুনর্লিখন করে নিতে হয়। এ ছাড়া পথ নাই। বার্তা সম্পাদকের বাড়ি সোহাগদলের পূর্বপাড়ে বানারীপাড়ায়। মাঝে বহে সন্ধ্যা নদী। মোটেই বন্ধ্যা নয়। রাত্রিকালে খলবল করে—ইহা জানিও নিশ্চয়। যদি ঠিকানায় ভুল হয়—তাইলে মাঝে মিয়ারহাট আছে। তারপর সুটিয়াকাঠি ইউনিয়ন। ইহার পরে বাইশারী ধরিয়া লইবেন। বাইশারীর ঠিক পূর্বপাড়ে বানারীপাড়া। শহীদুল হক জামাল ইহার মাবাপ। তাহার সাত খুন মাফ। ইহা খুনের মামলা নহে। ঘুনের গামলা।

(নোট. ৭ . এই থ্রিলার রচনাটি ইত্তেফাকের ভাষায় বর্ণিত হইতেছে বা হইবে বলিয়া ধার্য হইয়াছে। কারণ সেই কালে ইত্তেফাকই লোকে বেশি পড়িত বলিয়া কথিত। তবে সর্বত্র সাধুভাষার গুরুগিরি রক্ষিত করা সম্ভব হইতেছে না। কারণ ইত্তেফাকের মালিক কাম প্রতিষ্ঠাতা মানিক মিয়া খোদ বরিশালের মনু। তাই মনু ভাষাকে এড়ানো সম্ভব নহে। ত্রুটি মার্জনীয়, মামু।)

নাসিম আলী পুরনো একটি ফাইল ঝাড়িয়া পুছিয়া খোলেন। তাহাতে হাওয়া কিঞ্চিৎ ধুলি ধূসরিত হয়। নিজেই দুটো হ্যাচ্ছো দেন। ইহাতে প্রমাণিত হয় তাহার ডাস্ট এলার্জি আছে। হলুদ রংটি পাকা ছিল। এখন কিছুটা ফাঁকা। নাক কুঁচকে সাবধানে নাসিম আলী ফাইলটি খোলেন। বেশ কিছু পাতা উল্টান। বলেন, দ্যাখেন। পেপার কাটিং। আর কারো কাছে পাইবেন না। এই নাসিম আলী কাজ জানে। ইহা ইত্তেফাকের মালিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও জান। নাসিম আলী হাসেন। এবং হাসি থামিয়ে বলেন, রানীপুরে কুমীর ধৃত। ধৃত শব্দটির মানে বিশুবাবু আস্তে করে বলেন—ধরা পড়া। ধৃ ধাতুর সঙ্গে ত প্রত্যয় যোগে ধৃত। উদাহরণ—চৌর্যবৃত্তির দায়ে রানীপুরে তিনজন যুবক ধৃত। তাহাদিগকে পুলিশ পিটাইয়া হইয়াছে প্রীত।

–আজ তাহারা মৃত। বলে নাসিম আলী হা হা হা করিয়া হাস্য করিয়া ওঠেন। তিনজন যুবক ধৃত। তাহাতে হইয়াছি মোরা প্রীত। কেন তবে বলহীন—হৃত।
ইহা কবিতা। তবু লোকে জানে নাসিম আলী লোকটি কবি নহেন। কবিসুলভ তাহার কোনো ঘোড়া রোগ নাই। পিরোজপুরের কবি বলতে কবি বাংলার অধ্যাপক এস এম সালেহ। এম.এ। তাহার জ্যেষ্ঠ্ পুত্র এস এম শামীম আহমেদ, মহাপরিচালক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এস এম সালেহর হাতে অমিত্রাক্ষর খোলে ভাল। নাসিম আলী ইষৎ মিত্রাক্ষর। বিশুবাবু বিষয়টি জানেন বলিয়া লাইন চারটি অমূল্যজ্ঞানে লিখিয়া লইয়াছেন।

নাসিম আলী হাস্য সংবরণ করিয়া ততক্ষণে শমিত। শান্তস্বরে বলেন, খবর এইটুকু। কুমীরই ফাইনাল। ইহার অধিক জিজ্ঞাস্য থাকলে রানীপুরের আরব আলী ফয়িররে জিগাইবেন। তিনি এই এলাকার তেমাথা। প্রবীণ কৃষক। এখনো চাষে আছেন। তাহার উৎপাদিত মূলা প্রতি বছর কৃষি অফিসে যায়। কৃষিমেলায় পুরস্কায় পায়। তিনিই অত্র এলাকার সব জানেন। তিনিই জানেন অত্র এলাকায় রইদ পোহাইতে দক্ষিণা কুমীর ভালবাসে। ভালবাসা ছাড়া এ জগতে আছে কি? ক্যাসেটে লতা মুঙ্গেশকর বেশ দরদ সহকারে গানটি গাহিতে শুরু করেন।
–তাহলে দেলোয়ার?
–দেলোয়ার?
–দেলোয়ার হোসেন। শহীদ দেলোয়ার হোসেন।
–শহীদ দেলোয়ার নামে একাত্তরে অত্র এলাকায় কেউ শহীদ হন নাই। হয়েছিলেন ফয়জুর রহমান আহমেদ। এসডিপিও। তাকে পাক আর্মি ধইরা নিয়া গেছিল। পরে তার মধ্যম পুত্র ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কলাখালি থেইকা আইসা তার ডেডবটি সনাক্ত করছিলেন। বলেশ্বর নদীর পাড়ে চানমারীর নিকটে। পায়ে লাল জুতো। দ্যাটস ইট।

(নোট.৮. উক্ত এসডিপিওর জ্যেষ্ঠ পুত্র বাংলার প্রখ্যত লেখক এবং সিনেমা পরিচালক। মিশির আলী তাহার সৃষ্ঠ চরিত্র। মিশির আলী মুক্তিযোদ্ধা নহেন। শহীদও নহেন। ভুতের গল্পের রহস্যছেদক। তাহার হিমু হলুদ জামা গায়ে দেয়। পকেট নাই। চাননি পশর হইতে জল খায়। এইখানে একটি দীর্ঘশ্বাস কল্পনা করিয়া লইবেন।)

ফয়জুর রহমান আহমেদ শহীদ। তার নামে একটি সড়কের নাম করণ করা হইয়াছে। সে সড়কের এক মাথায় জামায়াতে ইসলামীর জেলা কার্যালয়। আরেক মাথায় পাড়েরহাট রোড। দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর। প্রখ্যাত মুফাসছেরে কোরআন। অধুনা আল্লামা। সাং সাউদখালি। উপজেলা জিয়ানগর (পূর্বতন ইন্দুরকানি)।. সাঈদী এখনো শহীদ হইতে পারেন নাই। শহীদী লাইনে আছেন। বর্তমানে তিনি গাজি কালু চম্পাবতী।

এইখানে বিশুবাবু আবার ধীরকণ্ঠে বলেন, ওরফে রাজাকার। বলার পরেই তিনি তিনি এদিক ওদিক তাকান। দেখেন তাহার পায়ের কড়ে আঙ্গুলে একটি পিঁপড়া কামড় দিতে উদ্যাত। তিনি তাহাকে পায়ে চাপা দিয়া মারিতে গেলেন। কিন্তু চাপাটা জোরে হইল না। দ্রুত বেগে পা উঠাইয়া লইলেন। পিঁপড়াটা কিছুটা আহত হইল বটে। কিন্তু পা ল্যাংচাইতে ল্যাংচাইতে পলাইয়া গেল। জাইবার কালে বিশুবাবুর দিকে রাগত চোখে তাকাইতে তাকাইতে গেল।
এইখানে বিশুবাবু আবার ধীরকণ্ঠে বলেন, সাইদী ওরফে রাজাকার। বলিবারর পরেই তিনি তিনি এদিক ওদিক তাকান। দেখেন তাহার পায়ের কড়ে আঙ্গুলে একটি পিঁপড়া কামড় দিতে উদ্যাত। তিনি তাহাকে পায়ে চাপা দিয়া মারিতে গেলেন। কিন্তু চাপাটা জোরে হইল না। দ্রুত বেগে পা উঠাইয়া লইলেন। পিঁপড়াটা কিছুটা আহত হইল বটে, কিন্তু পা ল্যাংচাইতে ল্যাংচাইতে পলাইয়া জাইল। জাইবার কালে বিশুবাবুর দিকে রাগত চোখে তাকাইতে তাকাইতে গেল। বিশুবাবুর ইহাতে রক্ত হিম হইয়া আসে। এক ধরনের ভয় ভয় করিতে থাকে। গা কাঁপিতে থাকে।

রাজাকার শব্দটি নাসিম আলীর সামনে সব সময় বলা নিসেদ। কিন্তু না বলিয়া উপায় নাই। এই হেতু তিনি মাথা নিচু করিয়া থাকেন। পিঁপড়াটি এখন নাই। চলিয়া গিয়াছে। যে কোনো সময় আবার লাঠিসোটা নিয়া আসিতে পারে। আসুক। তাহার চেয়ে নাসিম আলীর চেতিয়া যাওয়াটা ভীতিকর।

কিন্তু নাসিম আলী চেতিল না। মৃদু হাসিয়া কহিলেন, হৈতে পারে। আবার নাও হৈতে পারে। এতদিনে কেডা রাজাকার আর কেডা রাজাকার না সেইডা ঠিক করা মুশকিল। মাঝখানে মেলা কিছুই বদলাইয়া গেছে। রাত্রি হৈছে দিন—দিন হৈছে ক্ষীণ। আমরা সবাই হীন। জলে চরে মীন।

–মীন মানে মাছ। মৎস। বিশু মিনমিন করে বলেন। বলেন, রবি ঠাকুরের বাল্য কবিতায় আছে—মীনগণ হীন হয়ে সুখে জল ক্রীড়া করে। নাসিম আলীর উক্ত কবিতাটি অমূল্য বিবেচনা করিয়া বিশুবাবু টুকিয়া লইলেন। নাসিম আলীর ইচ্ছা আছে এগুলা আল মুজাহিদীকে দেখাইবেন। আল মুজাহিদ স্বনামখ্যাত কবি। বাড়ি টাঙ্গাইল বাড়ি। টাঙ্গাইলে রেলপথ নাই। বরিশালেও রেলপথ নাই। টাঙ্গাইলের লগে বরিশালের মিল—ও ভাই করে ঝিলিমিল। আল মাহমুদ ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক। তাহার চুল অতিশয় সুন্দর। হাই পাওয়ার সেক্সি। বাতাসে হাওয়া খেলে। তিনি কবিতা বুঝিবেন।
--তাহলে দেলোয়ার হোসেন? শহীদ মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন গেল কোথায়?
—ওয়েট। বলে নাসিম আলী আরেকটা ফাইল খোলেন। ফাইল নং ১৯৭১।. মুক্তিযোদ্ধাদের হাল হকিকত। ফাইলটি লাল কি কালা বোঝা মুশকিল। পুরনো। ভারী। কভার পেজের উত্তর কোণে একটু ছিড়িয়া গিয়াছে। ফাইলটি খুলিয়া পাতা উল্টাইতে থাকিলেন। ইত্তেফাকের দুই নম্বর মফস্বল সংবাদদাতা নাসিম আলী। একটু গম্ভীর। কপাল কুচকাইয়া পাতা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে থাকেন। বিশুবাবু জানালার বাহিরে তাকাইয়া আছেন। রাস্তা দিয়া টেম্পু ফট ফট করিতে করিতে ছুটিতেছে। দুইটি লোক পিছনে ত্যানা ত্যানা হইয়া ঝুলিতেছে। তাহাদের পাছা হইতে বগবগ করিয়া ধুম্র উদগীরণ হইতেছে। ইহাকে দূষণ বলে। দূষণ ছাড়া জীবন অচল। ইহা চলমান স্কুপ নিউজ। দূষ ধাতুর সহিত ণিচ ও অন প্রত্যয় যোগে দূষণ।

--দেলোয়ার হোসেন। হু দেলোয়ার হোসেন। দেল—ও—আআর হোসেন। নাসিম আলী গরর গরর করিয়া বলেন, ডোন্ট অরি। পাওয়া গেছে। শালা দেলোয়ার, তুমি যাইবা কুনহানে। ইহার নাম নাসিম আলী। মোঃ দেলোয়ার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধা। ভয়ঙ্কর ফাইটার। সাং লখাকাঠি। মার্চ মাসে পিরোজপুরের ট্রেজারী ভাঙ্গিবার কাজে অংশগ্রহণ করেন। অস্ত্রপাতি লুট করেন। টাকার বাক্সও। টাকার বাক্স নিয়া এইদিন জামালুল হক মনুর ভাই খোকন পাড়েরহাটের দিকে রওনা করেন। খালে নামিবার সঙ্গে সঙ্গে পিছল মাটিতে পা হড়কাইয়া নামাজপুরের ভারানি খালের পানিতে পড়িয়া যান। টাকার বাক্সটি মাথা হইতে পড়িয়া যায়। পড়িয়া বাক্সটির ডালা খুলিয়া যায়। ইহাতে লক্ষ লক্ষ শতকিয়া জিন্নাসাহেব খলখল করিতে করিতে পানিতে ভাসিতে থাকে। আর খোকন শহীদ হন। তাহার নাম শহীদের খাতায় লেখানো হয়। তাহার নামের পিরোজপুর শহরের একটি সড়কের নাম করণ করা হইয়াছে। সড়কটি মহিলা কলেজের সামনে। এই সড়ক জামায়াতে ইসলামীর অফিস হইতে শুরু করিয়া সোজাসুজি পাড়েরহাট সড়কে চলিয়া গিয়াছে। তারপর চারাখালি নদী। ও পারে ইন্দুরকানি। নট হিন্দুরকানি। ইন্দুরকানির মাথায় সাউথখালি। সেইখানে চাল ছাইত দেল্লু মিয়া। কারো ঘরের চাল ছাওয়ার দরকার হইলে দেল্লু মিয়া আইয়া পড়িত। কইত, ভাইজান, আমি আপনের চালডা ছাইয়াদি। এই চাল ছাইয়াদি শব্দ হইতেই সাইয়েদী শব্দটির উৎপত্তি। সাইয়েদী শব্দটিকে একটু খাতনা করিয়া রাখা হইয়াছে সাইদী। ফাইনালি দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী।

–দেলাওয়ার সাইদী কী করে?
–রাজাকারি করে। মানুষ ধইরা করে ঠুস ঠুস। কাশি আসে খুস খুস। আর ফুস ফুস কইরা লাশের গায়ে লাত্থি দিয়া কয়, হারামজাদারা পাকিস্তান আর ভাঙ্গবি? ক ভাঙ্গবি?
–তাইলে শহীদ দেলোয়ার?
–খাড়ান। শহীদ দেলোয়ার শ্যাষ ম্যাশ শহীদ না। মুক্তিযুদ্ধ করছেন। সাব কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন। সাউথখালিতে দেল্লু রাজাকারের বাড়িও শহীদ দেলোয়ার অভিযান করে। সেখানে কচা নদী। সেখানে এককালে কুমীর আছিল। লোকে কইত—কুম্ভীর। আর আমরা কই কুমোইর। দেল্লু তখন আর সাউথখালি নাই। শঙ্করপাশায় মল্লিকবাড়ি। হ্যায় ঘটনাচক্রে খালুজান লাগে। আর লালাবাবুদের ঘরবাড়ি লুট কইরা মল্লিকবাড়ি ভরে। দ্যাটস ইট। খেল খতম। পয়সা হজম। ফাইল বন্ধ।
–তাইলে দেলোয়ার?
–তাইলে জানা নাই। খবর আছে? খবর নাই।
–তাইলে কি জানেন আপনি?
–তোতা পাখি জানি। আতাগাছে তোতা পাখি। তোতা পাখি আসিবে হে একদিন। হেইডাই জানি। এইটাই খবর। লেটেস্ট খবর। ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচো—আর বউ নিয়া বাঁচো।

আতাগাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মউ
আমি ডাকি তুমি কথা
কও না কেন বউ।।
(চলমান)


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

বড্ড বেশী হেঁয়ালীপূর্ণ লেখা।

চরম উদাস এর ছবি

ভাল লাগছে কিন্তু বুঝি নাই ......... ওঁয়া ওঁয়া

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।