নিরীহ কথার আড়ালে ভয়ঙ্করের স্বর

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৮/০২/২০১৩ - ৭:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ কবি। তিনি ফেসবুকে একটা স্টেটাস লিখেছেন। সেখানে লিখেছেন-
১) একদিকে শাহবাগ সহ সারাদেশে আমজনতা অহিংস আন্দোলন করছে।
২) আরেকদিকে ধর্মব্যবসায়ী খুনিরা নির্বিবাদে খুন-জখম ক'রে যাচ্ছে।
৩) সরকার চুপচাপ ঘোলা পানিতে মাছ ধরছে।

এই তিন লাইনের মধ্যে কোনো কবিতা নেই। নিরীহভাবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থার একটা বিশ্লেষণ দিচ্ছেন।

প্রথম লাইনে শাহবাগের আন্দোলনকে অহিংস বলে তার একটা ইতিবাচক অভিধা দিচ্ছেন। দ্বিতীয় লাইনে এসে তিনি ধর্ম-ব্যবসায়ীদের খুনী বলছেন—বলছেন তারা নির্বিবাদের খুন-জখম করে যাচ্ছে। মুশকিল হল ধর্ম-ব্যবসায়ীদের নাম নিচ্ছেন না। নামটি আড়াল করছেন। ধর্ম-ব্যাবসায়ী খুনি জামায়াতে ইসলামীকে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কোথাও বলছেন না এরা একাত্তরে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা যুদ্ধাপরাধী। জামায়াত দাবী করছে তারা যুদ্ধাপরাধী না। তারা ধর্ম-ব্যবসা করে না। সুব্রতর এই স্টেটাস জামায়াতে ইসলামীর সেই বক্তব্যকেই সমর্থন দিচ্ছে।

তৃতীয় লাইনটি দেখুন। সেখানে কবি সুব্রত সরাসরি সরকারের নাম নিচ্ছেন। বলছেন-- দেশে একটা রাজনৈতিক ঘোলা পানি সৃষ্টি হয়েছে শাহবাগের আন্দোলন ও ধর্মব্যবসায়ীদের তৎপরতায়। সেখানে সরকার মাছ শিকার করছে।

এখন প্রশ্ন হল শাহবাগের আন্দোলন কি ঘোলার পানির মত অস্পষ্ট কোনো আন্দোলন? এর কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসুচী, আদর্শ উদ্দেশ্য নেই? আছে। খুব পরিস্কার ভাবেই আছে। শাহবাগে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের দেশের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করছেন। তারা বলছেন যুদ্ধাপরাধীরা একাত্তরে মানবতা বিরোধী যে সব অপরাধ করেছিল তাদের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কোনো মান সম্মত রায় নয়। তারা খুনি। ধর্ষক। তাদের জন্য ফাঁসী—একমাত্র ফাঁসীই হল উপযুক্ত শাস্তি। শাহবাগে উপস্থিত প্রজন্ম এই দাবীটি করছে আদালতের কাছে নয়। রাষ্ট্রের কাছে। যে কোনো আবেদন রাষ্ট্রের কাছে করার অধিকার যে কোনো নাগরিকের আছে। সেই নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে শাহবাগে তরুণ প্রজন্ম আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সেই আন্দোলন এত সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট যুক্তি-সম্মত নিয়মতান্ত্রিক যে দেশের আপামর জনসাধারণ এই আন্দোলনে স্বতস্ফুর্তভাবে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে কোনো গোপনতা নেই।

অপর পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তারা ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বেকসুর মুক্তি দিতে বলছে। এই জন্য তারা সারা দেশে বিপুল অর্থ-বিত্ত-অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নেমেছে। সহিংস কর্মসূচীর মাধ্যমে তারা গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও-ঘুম-খুন করছে। তাদের এই সহিংস তৎপরতা কোনো রাখ-ঢাকের ব্যাপার নয়। স্পষ্টভাবে তারা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারী রেখেছে। এর মধ্যে কোনো ঘোলা পানি নেই। তারা দেশব্যাপী একাত্তরের মতই সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস চালাচ্ছে। দেশের মানুষ জামায়াতে ইসলামীর এই তৎপরতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাদেরকে প্রতিহত করছে।

আর সরকার কারা? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শক্তি আওয়ামী লীগ আর তাদের মিত্রশক্তি। তারা ঐতিহাসিকভাবেই একাত্তরের চেতনাবাহী একটা রাজনৈতিক দল। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সংগঠন রয়েছে। দেশের সিংহভাগ মানুষই উদার পন্থায় বিশ্বাস করে। তারা সাম্প্রদায়িক যে কোনো অপশক্তিকেই বিরোধিতা করে। এই সিংহভাগ উদার মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা রাখে। ফলে আওয়ামী লীগকে যে মুসলমান সমর্থন দিচ্ছেন তিনি প্রকৃত মুসলমান হয়েই তার প্রতিবেশী হিন্দু-খৃষ্টান-বৌদ্ধ বা অন্য যে কোনো মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছেন। আনন্দে-বেদনায়-বিপদে-আপদে একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সম্প্রীতির নীবিড় বন্ধন এই দলটিতে যে কোনোভাবে হোক না আওয়ামী লীগে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে রয়েছে। শেষ মুহুর্তে তাই দেশের উদার-প্রগতিশীল-সহজ-সরল-প্রযুক্তিমুখী মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা রাখে। যে কোনো প্রগতিশীল-সৃজনশীল-মানিবক উদ্যোগের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কখনো বিরোধিতা করেনি। তারা সেই উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া এদেশে কোনো ইতিবাচক আন্দোলন সফল হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ আওয়ামী লীগই নিয়েছে নতুন প্রজন্মের দাবীতে। অন্য কোনো দল বা সরকার এই বিচার করবে না। করা সম্ভব নয়। অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সব প্রক্রিয়াকেই বাতিল করে দেবে।

আওয়ামী লীগ একটি জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে অনেক ত্রুতি-বিচ্যুতি করে থাকে। তাদের দলেও লুটেরা আছে। নিপীড়ক আছে। তারা ক্ষমতা-প্রত্যাশী দল। এই লুটেরা-নীপিড়ক চরিত্র বিএনপির মধ্যেও একটুও কম নেই। কিন্তু বিএনপি এর বাইরে একাত্তরের ঘাতক জামায়াতে ইসলামী সহ মৌলবাদী-জঙ্গীবাদী দলগুলোকে সযত্নে লালন-পালন-বর্ধন করে। এই জামায়াতী অপশক্তিকে তারা ক্ষমতার সঙ্গী করে। এই জামায়াতী অপশক্তি যদি কখনো সুযোগ পায় তাহলে তার মতবাদের বিরুদ্ধ কোনো শক্তি বা দল বা সংগঠন বা ব্যাক্তিকে বিচার-আচারের ধার না ধরেই সবংশে নির্মূল করবে। ঠাণ্ডা মাথায় এদেরকে হত্যা করবে। তখন কোনো কবি-লেখক-শিল্পী-বিজ্ঞানমুখী-যুক্তিবাদী-উদার-সৃজনশীল-মুক্ত চিন্তায় আস্থাশীল কাউকেই তারা রেহাই দেবে না। মেরে কেটে সব সাফ করে দেবে। একাত্তরে তাই করেছিল জামায়াতে ইসলামী পাক-বাহিনীর সঙ্গে মিলে-মিশে। আর আওয়ামী লীগ তার সর্বশক্তি নিয়ে এই সেই পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে-তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল প্রগতিশীল উদার পন্থীরাও। তারা সেদিন কেউই আওয়ামী লীগের এই অংশগ্রহণকে আপত্তি করেনি। যারা আপত্তি করেছিল—তারা এত ক্ষুদ্র যে তাদের কোনো মাইক্রোস্কোপেও দেখা যায় না। তারা ছিল চিনাপন্থী নামধারী কিছু ব্যক্তি বা তাদের হাতে গোনা কিছু সদস্য নিয়ে দল বা গ্রুপ। তারা একাত্তরে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে কার্যত পাকিস্তান-পন্থার সঙ্গেই যোগ দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত তাদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা পাকিস্তানপন্থী জামায়াত-বিএনপির হয়েই কাজ করছে।

তাহলে আজ সুব্রত বা তার মত অন্য কিছু লোকজন যারা বলছেন-- শাহবাগের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ কেনো যোগ দিচ্ছে, আওয়ামী কেনো আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করছে, আওয়ামী লীগ কেনো এই আন্দোলন থেকে আগামী নির্বাচনের জন্য সুবিধা নিচ্ছে-- তারা আওয়ামী লীগের বদলে কাদের চান? বিএনপিকে? জামায়াতকে?

আওয়ামী লীগের বিকল্প কখনো বিএনপি-জামায়াত হতে পারে না। যারা এই সত্যকে অস্বীকার করেন তারা মূলত জামায়াত-বিএনপিরই লোক।


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

প্রথম লাইনে (১) একদিকে শাহবাগ সহ সারাদেশে আমজনতা অহিংস আন্দোলন করছে।) শাহবাগের আন্দোলনকে অহিংস বলে তার একটা ইতিবাচক অভিধা দিচ্ছেন।

এটা আসলে ইতিবাচক অভিধা না। 'অহিংস' বিশেষণের প্রয়োগ বরং নেতিবাচক। এই আন্দোলনে ভাঙচুর, বোমাবাজি নাই; কারণ, এটা সরকার বা ট্রাইবুনালের 'বিরুদ্ধে' আন্দোলন না; বরং তাদের 'পক্ষে' তাদেরকে সাহস দিয়ে সঠিক কাজটি করানোর আন্দোলন। ভাঙচুর, বোমাবাজি না থাকলেই আন্দোলন অহিংস হয়ে যায় না। জামায়াতের সহিংসতার জবাব তাদের মতো সহিংসভাবে দিতে এই আন্দোলনকারীরা একটুও পিছপা হবে না। এজন্যই জামায়াতের হরতাল ব্যর্থ হচ্ছে, পাবলিকও কনটেক্সটে পাইলে জামায়াত শিবির পিটাচ্ছে। (উদাহরণ: শাহবাগ আন্দোলনকারীদের কটূক্তি, মাহফিলে ধোলাই) এই আন্দোলন হলো গুলির পরিবর্তে গুলি, মুক্তিযুদ্ধে যেমন অস্ত্রের জবাব অস্ত্র দিয়ে দেয়া হয়েছিলো, ভালোবাসা বা ফুলের ছোঁয়া দিয়ে না, এটাও তেমনই। আন্দোলনের এখনো প্রাথমিক পর্যায়, সামনের দিনগুলোতে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হবে। এ অবস্থায় যারা একে 'অহিংস', 'নিরীহ' বিশেষণে বিশেষায়িত করতে চায়, তারা মূলত আন্দোলনকে শক্তিহীন করতেই চায়।

আওয়ামী লীগ ও ঘোলা পানির ব্যাপারটা মোটামুটি ভালো বিশ্লেষণ করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাবলিক ও আওয়ামী লীগ একসাথে কাজ করার বিকল্প নাই। আওয়ামী লীগের যেগুলা লুটেরা আছে, সেগুলারে গণ দেয়া হোক; কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে যেহেতু আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই, সেহেতু সরকার হিসেবে তারা পাবলিকের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পাওয়া উচিত।

৭১ এর অসমাপ্ত কাজ শেষ হলে কয়েকটা অপশন আসতে পারে। আওয়ামী লীগের লুটেরাগুলা নিঃসন্দেহে চাপে পড়বে। এগুলা হয় আকাম বাদ দিবে, না হয় নিজেরাই বাদ পড়বে। আওয়ামী লীগ যদি এরপরও এদেরকে বাদ না দেয়, তাহলে পাবলিককেই নোতুন কোনো বেটার অপশন গঠন করতে হবে। শর্ত: প্রো-৭১। বিএনপি জামায়াতের মতো এন্টি-আওয়ামী লীগ = এন্টি-৭১ সমীকরণ না।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

হিমু এর ছবি

জামাতশিবির একদিক দিয়ে আন্দোলনকারীদের অ্যামবুশ করে জবাই করছে, অ্যামবুলেন্সের ওপর হামলা করে রোগী মেরে ফেলছে, চলন্ত বাসে আগুন দিয়ে অসুস্থ যাত্রীকে পুড়িয়ে মারছে, আর সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের মতো বুদ্ধিবেশ্যা আসছে অহিংসার ফাটা পাখা দিয়ে বাতাস করতে।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, True peace is not merely the absence of tension: it is the presence of justice.

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

১) একদিকে শাহবাগ সহ সারাদেশে আমজনতা অহিংস আন্দোলন করছে।
২) আরেকদিকে ধর্মব্যবসায়ী খুনিরা নির্বিবাদে খুন-জখম ক'রে যাচ্ছে।
৩) সরকার চুপচাপ ঘোলা পানিতে মাছ ধরছে।

উত্তরাধুনিক কবিতাটা তো ভালোই লাগলো চোখ টিপি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সৌরভ কবীর এর ছবি

হাসি

__________________
জানি নিসর্গ এক নিপুণ জেলে
কখনো গোধূলির হাওয়া, নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নার ফাঁদ পেতে রাখে

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এর ছবি

কুলদা, আপনার কল্পনাশক্তি আর দুই-এ দুই-এ পাঁচ করার ক্ষমতা আমাকে আবারও মুগ্ধ করল! জামাত-শিবিরের নাম না নিলেই তাদের সমর্থন করা হয়? ধর্ম-ব্যবসায়ী শুধু বলেছি কারণ জামাত ছাড়াও ধর্মভিত্তিক অনেক রাজনৈতিক দল বা উপদল আছে দেশে। আর ধর্মব্যবসায়ী খুনি তাদের প্রায় সব্বাইকে বলা যায়।... আবার আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট না করলেই আমি অভ নেসেসিটি জামাত বা বিএনপির সাপোর্টার, এইরূপ লজিকও আপনাকে আর আপনার মতো ইমবিসল-দের মাথাতেই এসে থাকে... আমি কোনো পার্টির ঘি খাই না, কোনো পার্টিকেই ইরিপ্লেসিবল ভাবি না; অন্যায় যে করে, তারই সাজা হওয়া দরকার, অন্যায়ের মাপে সাজা, কে অন্যায় করল, সেই বিচারে না... আপনি সুখে থাকুন।

নরাধম এর ছবি

সরকার চুপচাপ ঘোলা পানিতে মাছ ধরছে।

সেটাও একটু বিশ্লেষণ করে যান জনাব সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, আমজনতার বুঝতে সুবিধা হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।