দীর্ঘশ্বাস!!

নুসদিন এর ছবি
লিখেছেন নুসদিন [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০১/১০/২০১০ - ২:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকা শহরের শুরু বা শেষ প্রান্তে বাসা হওয়ায় স্কুল পাশের পর আরো বিদ্যা অর্জনের লক্ষ্যে আরেক প্রান্তে ছোটা-ছুটি শুরু হয়। প্রতিদিনের ছোটা-ছুটিতে ট্রাফিক জ্যামের সাথে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা পাড়ি দেয়ার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বন্ধুরা যতক্ষনে বাসায় যেয়ে খেয়ে-দেয়ে আরাম করে পড়তে বসে যায়, আমি দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে সেই সময়ে বাসায় পৌঁছাই। আর প্রথম ক্লাসে আধ ঘন্টা দেরীতে পৌঁছানোতো আমার একটা রুটিন হয়ে গেছে। আশার কথা এই ভুক্তভোগী এখন আমি আর একলা নই। এখন আমরা অনেকেই দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসে ঢুকি ক্লাস শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সবার একই উত্তরঃ জ্যাম ছিল। স্যার/ম্যাডামরাও আর কিছু বলে না। দীর্ঘ একটা রাস্তা পাড়ি দেয়ার কারণে অনেক ঘটনার ফলসরুপ জ্যাম প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে। যেমনঃ সিগনালের জ্যাম, বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জ্যাম, মারামারি/ভাঙচুর জ্যাম, উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের জ্যাম, বিশাল জনসভার জ্যাম, ট্রাফিক পুলিশের মন/মেজাজ খারাপ থাকার কারণে জ্যাম। প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথেও হর-হামেশাই দেখা হয়ে যায়, খালি কুশলাদি বিনিময় হয় না।

জ্যাম পুরানো কাসুন্দি হলেও এই সপ্তাহের জ্যাম কল্পনারও সীমা ছাড়িয়ে গেছে। খুব বেশী হলে আমার পৌঁছাতে দুই ঘন্টা লাগে।কিন্তু এই সপ্তাহের সোমবার থেকে ঘটনার সূত্রপাত। দুই ঘন্টা পাড় হওয়ার পর দেখি আমি এখনো পনেরো মিনিটের দূরুত্বে জ্যামে আটকে আছি। আমি ভাবি ছেড়ে দিবে। কতক্ষণ আর লাগবে। কিন্তু একটা গাড়িও দেখি নড়ে না। তার ওপর ভ্যাপসা গরম। এক মিনিট, দুই মিনিট করে সময় যায় কিন্তু কোন গাড়ি সামনে আগায় না। কেউ মনে হয় সবাইকে স্ট্যাচু করে রেখেছে। অনেকক্ষন পর একটু ছাড়ে। পরের সিগনালে, সামনের গাড়ীদের লাইন দেখে মনে হচ্ছিল আজকে মনে হয় না সারাদিনেও কেউ আমাকে উদ্ধার করতে পারবে। মানুষ যে নেমে হাঁটবে সেই উপায়ও নেই। একেকটা গাড়ী এত গায়ে গায়ে লাগানো যে গেটও খোলা যায় না। অবশেষে সেই পনেরো মিনিটের রাস্তা থেকে আমি এক ঘন্টা পনেরো মিনিট পর মুক্তি পাই। তিন ঘন্টা পনেরো মিনিট পর মুক্তির আনন্দ উপভোগ আর করা হয়ে উঠেনি কারণ ক্লাস ততক্ষণে শেষ। পরে বাসায় এসে দেখলাম সেদিন সম্ভবত পর্যটন দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের করা হয়েছে। দুই-দুইয়ে চার মিলিয়ে নিজেকে সান্তনা দেই থাক একদিনই তো। কালকে নিশ্চয়ই আর এরকম হবে না।

পরের দিন আরেকটু আগে রওনা দেই। মনে মনে অবশ্য ভাবি আজকে নিশ্চয়ই রাস্তা খালি থাকবে। কিন্তু আমারতো খেয়ালই ছিল না সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘন্টা পর আমি ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছাই। যথারীতি ক্লাস এইবারো শেষ। একটা ক্লাস থাকায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর পৌঁছে বেকুবের মত কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। মনে আতঙ্ক, এই জ্যাম ঠেলে এখন আবার বাসায় যেতে হবে! আবার রওনা দেই। এইবার দুই ঘন্টায় পৌঁছে যাই। বাসায় এসে দেখি এক চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে, ঢাকার রাস্তায় আজকে তীব্র যানজট, নতুন কোন ট্রাফিক সিস্টেম পরীক্ষা করা হচ্ছে।যোগাযোগ মন্ত্রী বলেছেন ডিসেম্বরের পর আর নাকি যানজট থাকবে না... পুরোটা দেখার ধৈর্য্য আমার আর ছিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে দোষারোপ করতে করতে টিভি বন্ধ করে দেই। কার জন্মদিন, কোন দিন নতুন ট্রাফিক এক্সপেরিমেন্ট হবে এগুলা না জেনে রাস্তায় বের হওয়ার জন্য নিজের ওপরই রাগ লাগে।

পরের দিনের আপডেট নিতে অবশ্য ভুল করিনি। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরবেন। ক্লাস পাঁচটার আগে শেষ হয়ে যাওয়ায় নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয়। কিন্তু যাদের এই সময়ে কাজ আছে তাদের কথা ভেবে দুঃখ লাগে। সেইদিনও বাসায় এসে দেখি ব্রেকিং নিউজ, সায়েদাবাদে ট্রেন আর বাসের সংঘর্ষ। মন খারাপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। পরের দিন পরীক্ষা। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে পড়তে চলে যাই। পরে রাতে দেখি ফেসবুকে এক বড় ভাইয়ে স্ট্যাটাস, উনি প্রধানমন্ত্রীকে হেলিকপ্টার কিনে দিতে চান। কী পরিমাণ ঝড় যে মানুষের উপর দিয়ে গেছে বুঝতে আর বাকী থাকে না। জ্যাম নিয়ে একজনের সাথে কথা বলার সময় আমাকে হাসতে হাসতে বলে কালকে থেকে দেখ আবার না তোমার সাথে দেখা হয়ে যায়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! হাইকোর্ট থেকে রমনা পর্যন্ত যেতেই দেখি হঠাৎ এক পুলিশ অফিসার এসে সামনের মাইক্রোবাস আটকে দিল। তখনো মাথায় আসেনি যে প্রধানমন্ত্রী যাবেন। আমি ভাবি কাগজ চেক করবে মনে হয়। কিন্তু উনি দেখি রাস্তা আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তো আছেনই। সামনে দিয়ে প্রেসের গাড়ীরা যায়। ঘটনা বুঝতে আর বাকী থাকে না।শুরু হয় অপেক্ষা। আশে-পাশের মানুষজন বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার একটু রাগে গজগজ ও করে। কখন না কখন যাবে। এত আগে আটকিয়ে দিল। বিশ মিনিট পর প্রধানমন্ত্রীর গাড়ী আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, এইবারো কুশল বিনিময় হল না।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।