গুলাব গুলি

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৪/০১/২০১১ - ১১:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(ভুমিকথা : গল্পটি বড় হয়ে গেছে। আশা করছি পাঠকগণ এড়িয়ে যাবেন। তাতে মন খারাপের কিছু নাই। গল্পটি আমার দিদিভাই জামিলা হাসানের জন্য লিখেছি। তিনি সিলেটে বাস করেন। আর কমলা খান। দিদিভাই পড়তে চেয়েছিলেন--রূপকথা। আমি চেষ্টা করেছি। হয়ে গেছে চুপকথা। সবাইকে হেড লাইন পড়ার জন্য ধন্যবাদ।)
.............................................................................................................................................................

শুপারি বাগানে শুপারি নাই। আছে গুলাব। গোল গোল গুলাব গুলি—নাড়ুর মত। শক্ত। লালচে—কোনটা কালো। গুলাব দিয়ে কি করে? প্রশ্ন নাই। উত্তরে পাহাড়।

একটি মেয়ে আঁচলের আড়াল থেকে তুলে ধরল মাটির পিদিম। লাল আলোতে সোনার মত উজ্জ্বল মুখ। কপালে পরিপাটি সিঁথি। নাকে ছোট্ট একটা নাক ফুল। সোনা নাকি?
--সোনাই তো।মোর নাম সোনা। আপনের শালিক। বলে সোনা চিরিক মিরিক করে একবার শালিক ডাক ডেকে বসল। মেরী একটু পিছিয়ে আসছে ওর বাবার হাত ধরে। অনেকদিন দেখা নাই। শ্বশুরমশাই চোখ মুছতে মুছতে আসছেন। পায়ের নিচে পড়াপাতার খস খস শব্দ হচ্ছে। তিনি বললেন, তোমার বিভূতি কাগার মাইয়া। সোনা। টেনে পড়ে।
ক্লাশ টেন—নাই হেন তেন। সোনার পিদিমে আঙুল ডুবিয়ে চটচটে তেল মেখে চোখের সামনে ধরল। বলল, এই দ্যাখেন—হ্যারে কয় গুলাব ত্যাল। মোগো পিদিম জ্বলে গুলাব ত্যালে। বলেই নাকে তেল লাগিয়ে দিল। বলল, ত্যালে ঝিয়োরী নাচে/ গ্যালে নায়রী বাঁচে।।কনতো জামাই দাদা, আপনে মেরী দিদিরে লৈয়া বাঁচেন, না-- নাচেন?

রাত্রি অনেক হয়ে গিয়েছিল। সোনা চলে গেছে। তার পিদিমটি পিটিপিটি করে জ্বলছে।শ্বশুরমশাই বারান্দায় হা করে আছে। আজ তার গভীর ঘুম এসেছে। তিনি স্বপ্ন দেখছেন—মেরীর মা তাকে উঠিয়ে দিচ্ছে। মুখের একপাশের ঘোমটা সরে গেছে। বলছে---জামাই আইছে। হাটে যাও।
এখন হাটে যেতে ইচ্ছে করছে না। তিনি পাশ ফিরে শুলেন। বহুদিন পরে তিনি শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন।তার ছোট মেয়ে কোথায় তার পিসির কাছে পড়ে আছে। পড়তে পড়তে ঝিমিয়ে পড়ছে। বাড়ি আসার ইচ্ছে। আসতে পারছে না। বলে, অ বাবা, তোমারে দেখবার মঞ্চায়।
--তাইলে বাড়ি আয়।
--আইতে পারি না বাবা।ভয় করে। অ বাবা—আমার ভয় করে।
তিনি ঘেমে উঠেছেন। মেয়েটা কাঁদছে। মেরীর মা বলছে—হাটে যাও। জামাই কি লবণ-ভাত খাইবে?
--খাইলে মন্দ কি?
--আপনের কুইড়াপনা গেল না।আপনে খান।
শ্বশুর মশাই আজ মেয়েটার হাত ধরে ছিলেন আজ বহুদিন পরে। তিনি আজ কোথাও যাবেন না। আয়েশ করে ঘুমোবেন। মুখ কালো করে মেরীর মা সোনার বাবার খোঁজে বের হলেন।

ঘরের মধ্যে ঘর—তারি মধ্যে পর।পরের মধ্যে কি? ঘুম পড়ানি ঝি। ঝিয়ের লগে আড়ি। দিমু সাগর পাড়ি। পরে পরে ঘুমের মধ্যে মেরী নাকের ডগা মুছে দিতে দিতে বলল, গুলাব বাগানে যাবা না। গুলাব বাগানে যাইতে পারবা না। আর কি বলেছিল মনে নেই। শুধু ঘুমের কথা মনে আছে।ঘুমের মত শান্তি আর কি আছে এ চরাচরে?

সকালে সোনা আসে নি। সোনার মা এসেছে। কোমরে আঁচলে পেঁচিয়ে কাঁচা হলুদ বাটছেন। আর বাটছেন গিলা। গিলা বাটা, হলুদ বাটা সরিষা তেলের মধ্যে রেখেছেন। এর মধ্যে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে এঁয়োতি বউ ঝিরা এসে গেছে। কে একজন লক্ষ্মীমতি বউ গড় হয়ে প্রণাম করল। পাশের পিড়িতে মেরী। বলল, ও লক্ষ্মী, বেপারী জেঠি আয়ে নাই?
বেপারী জেঠি আসে নাই। লক্ষ্মীমতি হলুদের বাটি এগিয়ে দিল। সোনা রাজবাড়ি গেছে। ব্যাপারী জেঠিকে সোনা নিয়ে আসবে। সোনার মা জামাইয়ের মুখে তেল হলুদ মাখিয়ে দিলেন। আর বারান্দা থেকে শ্বশুর মশাই হু হু করে কেঁদে উঠলেন। ছোট পিসি নাড়ু বিতরণ করতে করতে বললেন, অ দাদা, কান্দো ক্যানে। বউদি স্বগ্গে গেছে। তার জন্য জন্য কান্দো ক্যানে। আমরা আছি না।

সোনার মা ঘটি ভরে গায়ে জল ঢেলে দিলেন। আজ তিনি কণে-মা।বিয়ে হয়েছে দুবছর। এ বাড়িতে আসা হয় নি। এ পর্বগুলো বাদ গিয়েছিল। সোনার মা কি বাদ দিতে দেবেন?

দুপুরের আগেই বিভুতি কাগা উঠোনে দশা সই একটা বড় রুই মাছ এনে ফেললেন। ইন্দেরহাট থেকে এনেছেন। মাছটিকে ঘিরে গোপালগণেরর ভীড় জমেছে। নেতাই নামে গোপালটি মাছের চোখ উল্টে পাল্টে দেখছে। আজ ইন্দুরহাটে পাঙ্গাস মাছ ওঠে নি। কাল কাউখালির হাটে যাবেন। পাঙাসমাছ বিনা কি জামাইজনদের ব্যাভার হয়?

মণ্ডলবাড়ির তিলি বুড়ি দোক্তা বানাচ্ছেন। তিনি হর পার্বতীর গীত গাইবেন। তার নাত বউ লক্ষ্মীমতি বউটি রুই মাছের মুড়োর কানসে খুলছে। বিশ্বাসবাড়ির ছোট মেয়েটি হুগলী ধানের চিড়া নিয়ে এসেছে।সোনার মা চিড়া আর রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়ি ঘণ্ট রাঁধবেন।
ছোট পিসির কাছে মেরী ছিল। দেখে শুনে রেখেছেন। বিয়েও দিয়েছেন। আজ তাকে বেশ মা মা লাগছে।ছোট পিসি চিড়া বাছতে বাছতে বলছেন তার বড় দিদির বিয়ের গল্পটি। বরের বাড়ি আন্ধারমানিক। জুজখোলা পার হয়ে বাগেরহাট জেলায়। বর এসেছে নৌকায়।নৌকা কালিগঙ্গা থেকে আচি খালে ঢুকতে যাবে –এ সময় ভাটা শুরু হয়ে গেছে। খালের তলা শুকনা। এই বেলা দুখনা। নৌকা চলে না।কথা কেউ বলে না। জোয়ার আসার আগে মাঝি নামাজ পড়ে একটু হেলে পড়েছে। ঘর্ঘর করে নাক ডাকছে। জোয়ার আসতে ছ ঘণ্টা। মাঝির নাক ডাকা বাড়ে—আর বরযাত্রীরও হাই হুই ওঠে।বর কি করে? সবার আগে বর পড়ে পড়ে ঘুমায়। তার নাকের নিচে গোঁফ নড়ে ফুস ফুস করে। আর হেলে দুলে মাঝে মাঝে পাশ ফেরে। তারপর একে একে শান্ত। শুনশান। এর ফাঁকে কখন কুল কুল শব্দ হচ্ছে। মাটি ফুঁড়ে জল আসছে। ডাঙা থেকে জল নামছে। নদী থেকে জোয়ার আসছে। বোঝা কঠিন। মাঝি কপালে হাত তুলে বলে—অ বাবুরা, ওঠেন। উইঠা পড়েন। জোয়ার আইছে। খালে পানি খল খল করতেআছে।

আড়মোড়া দিয়ে সবাই দেখে নৌকাটা হালকা হালকা লাগে। আর জলের রঙ কমলা। নৌকায় ছিল কমলা। দার্জিলিং থেকে আনা। জোয়ারে নৌকা সামান্য কাত হতেই কমলা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়েছে জলে। তিন দিন ধরে নদী নালা খালের জলে সেই কমলা ভাসে—কমলা ছাড়া আর কিছু নাই। পানঘুচি নদীর পরে পশুর নদী। সে নদীতে বাওয়ালিরাও সেই কমলা খেয়ে বলেছে—পরাণ জুড়ালো। অ বাঘ মামা। তোমার বাল্লক এলো বনে। থাকে যেন মনে।আয়ো বাঘো, কমলা খাবা নিকি?

তিলি বুড়ি দোক্তা মুখে মাথা নাড়ে।হাচা গাছা কথা বাড়ে। ঠিক ঠিক ঠিক। সেই কমলা নিয়ে জলাবাড়ির হরিশ সরকার একখান গীত লিখছিলেন। ভাঙা ভাঙা গলায় তার আধখানা ধরল বুড়ি—

কমলার সঙ্গে যাওগো কমলা সুন্দরী।
তোমার বিহনে কান্দি কেমুনে মনধরি।।
কুড়াই শালুক ফুল গোছাই ঝিনুক দুল কেবা পরে কানে।
দুড়াই তালুক কুল পুড়াই ভালুক ভুল কেবা তারে আনে।।
আমি গো সই-- সইগো কেমুন করি…

সোনার মা ছাড়া আর সবাই ধুয়ো ধরে বসল। বারান্দায় বসে শ্বশুর মশাই নড়ে চড়ে বসেছেন। তারও ইচ্ছে সুর ধরে। কিন্তু গলায় সুর নাই। কাশি আসে। সুরটা কি মেরীর মা নিয়ে গেল? আর তক্ষুণি পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে একঝাঁক বক পাখি বসেছে। তাদের পায়ের ভরে কাঁপছে বাশ বন। পুকুর ঘাট থেকে একটা গুঁই সাপ ভাট ফুলের আড়ালে যেতে যেতে থমকে দাড়াল। এঁয়োতিরা বাটনা বাটতে বাটতে, আনাজ ধুতে ধুতে, মাঝ ভাজতে ভাজতে, সরা খাড়তে খাড়তে এক সঙ্গে গাইছে—আমি গো সই সই গো কেমুন করি।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার গাইছে ধুয়াটি।তারপর তিলি বুড়ি আবার সুর ধরেছে-

সইগো তুমি ডুইবা মরো কর্দম মাখা জলে ।
আমি বহুত শান্তি পামু তুমি ডুইব্যা ম'লে ।

বিকেল বিকেল গণ্যমান্য লোকজন এসে গেছে। বিভুতি কাগা খুব ছুটোছুটি করছেন। তখনো কুদ্দুস চেয়ারম্যান আসেন নাই। খবর পাওয়া গেছে বিশাল গ্রামে কী একটা সালিসে আছেন চেয়ারম্যান।আসতে কিঞ্চিৎ দেরী হবে। সেক্রেটারি জগদীশ মিস্ত্রিকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফরাসের উপর লোকজন বসেছে। সামনে থালার উপরে খিলি পান। পাতলা করে কাটা শুপারি। এক থালে কাঁচা শুপারি। আরেক থালে পাকা শুপারি।গুণতে পারে কোন ব্যাপারী। উত্তর পাড়ার রমজান মাঝি সোনাভানের কিসসা বলতে শুরু করেছেন। বিশালের ফেলু শেখকে দেখা যাচ্ছে না।তাকে পাওয়া গেলে দোহারকি করা যেত। রমজান মাঝি বলছেন—খুব ভোরে রূপবানের ঘুম ভেঙেছে। বাড়িতে বিয়ের বাদ্যি বাজনা বাজছে। দাইমাকে জিজ্ঞেস করল,
ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো দাইমা
আমার দাইমা দাইমা গো--
ঢাকো বাজে ঢোলক বাজে গো, আরো বাজে বাঁশি গো
আমার দাইমা দাইমা গো--
বাজাইতে বাজাইতে বাঁশি গো ও দাইমা আসে মোদের বাড়ি গো
আমার দাইমা দাইমা গো—
ও দাইমা, কিসের বাইদ্য বাজে?
দাইমা একগাল হেসে কয়, আজ তর বিয়া।
--কার বিয়া?
--তর বিয়োগো রূপবান। ছেইলা কিন্তু তগো মতো যে সে লয়—হাচা হাচা বাদশাজাদা। নাম রহিম। বার দিনের পোলা। মুখটি ফোলা ফোলা।

রমজান মাঝি বলেন,বার বছরের মাইয়ার লগে বার দিনের সোয়ামী।বার বছর বনবাসে থাকলে রহিম বাদশা বাঁচবে। কিন্তু বার বছরের বড় রূপবানের কী হইবে তখন? খুব কড়া প্রশ্ন বটে। প্রশ্ন করে রমজান শেখ চারিদিকে তাকায়।উত্তর নাই।দক্ষিণে সমুদ্দুর।ঢেউ তুড় বুড়। আর ঘন বন। গা করে ছন ছন।

কোলে শিশু নিয়ে বনের পথে চলেছে রূপবান। রাত্রি ঘনঘোর। ভুত প্রেত তাইড়া আসে। বলে, খাব। খাব।খাব খাব খাব। বনের মধ্যে শিশু কান্দে। তার দুধ চাই। দুধ না অইলে শিশু বাঁচে কেমনে? লোকে শুনে মাথা নাড়ে। বলে—কথা ঠিক ঠিক। দুধ বিনা শিশু বাঁচে না।বন্যেরা বনে সুন্দর--শিশুরা মায়ের দুধে। রূপবানের দিশা নাই। এর মধ্যে হা করে বাঘ্র এসে বলে—হালুম।
মোরা মইরে গেলুম।

লোকজন নড়ে চড়ে বসে হালুম শব্দটি শুনে। তাইলে কি বাঘে খাইবে তাগো? খাইবে নাকি? বাঘের দাঁত কিড়মিড়। বাঘের ল্যাজ তিড় বিড়।রূপবান তখন বাঘের সামনে শিশু কোলে গান গাইছে—কি গাইছে? এই খানে এসে রমজান মাঝি থেমে গেলেন।ফেলু শেখ নাই। থাকলে দোহার দিতে পারত। বুইড়া মানুষ গলায় জোর কম। এই গলায় একা কিসসা জমানো কঠিন।স্রোতারা উসখুস। ততক্ষণে লক্ষ্মীমন্ত বউটি সুর ধরে ফেলেছে—
খাইও না খাইও না বাঘোরে
ও বাঘো খাইও না মোর পতিরে
আমার বাঘা বাঘারে—

লক্ষ্মীমতি বউটির কাছে রূপবান বদলে গেছে—এসে গেছে আরেক মেয়ে, মালঞ্চমালা। তার বাবা কোটালকন্যা। ভাগ্যদোষে আজ বনবাসী। গান শুনে বাঘ হল বাঘো মামা। বাঘিনী হল বাঘোমামী।বলে—ওরে হতভাগিনী ভাগিনী, তর কুনো চিন্তা নাই। মোরা আছি। তারা দুইজন ফালিয়ে ফালিয়ে মালঞ্চমালার শিশুস্বামীর জন্য দুধ খুঁজতে যায়। পোলা কাঁদে ওয়াও ওয়াও। ঘোলা দুধে খোয়াও খোয়াও।

এইটুকু শুনে নিমাইয়ের মনে হল—এরপর বাঁশির সুর না হলে প্রাণ আসে না।বাঁশি আনতে ভুলে গেছে।উঠে দৌঁড়ে গেল বাঁশিটি আনতে। বাড়ির সীমানায় নালাবেড়। জল ফুট ফুট করে।চান্নি পহর তরে। তার উপরে ছোটো বাশেঁর চার। নিমাইয়ের মনে হল—নালা বেড় ফাল দিয়ে পার হয়।পবন পুত্র তারে কয়।

সন্ধ্যা ঘনার আগে কুদ্দুস চেয়ারম্যান এসে গেলেন। মুখটি তার ভার।হইছে কার হার। বিশালের খবর খারাপ। শালিস শেষ হয় নাই। সেক্রেটারি জগদীশ মিস্ত্রীর কানে কানে বললেন, বোঝলেন জগদীশদা। বিশালের দিকে যাওনের কাম নাই।
--ওরা কি কয়?
--কয় মাছুম পোলারে যারা মারছে তাগো লগে মোরা নাই।
--কেডা কয়?
--কয় ছক্কু হারামজাদা।
--হ্যার কথার কি দাম আছে।হ্যায়তো উড়াইয়া ছাই টানে মাই। মাইনসে কি কয়?
--তারা কিছু কয় না। চুপ কইরা আছে।
--হ্যারা কি কুনোকালে কিছু কয়? যেই দিকে বাও—হেই দিকে ধাও।

একটা হ্যাজাগ বাতি ঝোলানো হয়েছে। তেল টেল ভরা রেডি। সলোক কমলেই ম্যান্টেল জ্বেলে দেওয়া হবে। কুদ্দুস চেয়ারম্যান ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে মোলাকাত করে থিতু হয়ে বসলেন। বেশ আয়েশ করে বললেন, জামাই বাবাজীর বাড়ি কুথায়?
--ফরিদপুর।
--ফরিদপুর। মোগো পুরনো আত্মীয় লাগে। আপনেগো লোকজন নাও নিয়া আগে আইতে এদেশে অঘ্রাণ মাসে। তারা ধান কাডতে বড় উস্তাদ। ফরিদপুইরা ছ্যাও। হ্যাগো বড় ম্যাও।

চেয়ারম্যানের কানে কানে সেক্রেটারি জগদীশ মিস্ত্রি আবার ফিস ফিস করে বললেন। শুনে চেয়ারম্যান জিব কাটলেন। বললেন, দাদায়, আগে কইবেন না। মোগো জামাই অপিচার মানুষ। হ্যার একডা ইজ্জত আছে না। মোগো তায়ৈর পোলাও বড় অপিচার। ডিসি অপিচের নাজির। তিনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করলেন। তার ভিতরে একটা সোনার হার। গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন—যেমন মাইয়া--তেমুন জামাই। মোগো আর কিবা কামাই।।
বিভূতি কাগা কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না।মাইয়ার গলা শুন্য। আর আছে কি দুন্য। সোনার মা তাকে ইশারায় ডাকলেন। গলার চেইনটা খুলে দিলেন। বললেন, দ্যাও।
শিউলীগাছে নিশির জমতে শুরু করেছে।খুব কলি এসেছে। ভোরে ফুটবে।ফুলতলাটি ফুলে ঝরে পড়ে থাকবে। বিভুতি কাগু চেনটি হাতে নিয়ে বললেন,কারে দিমু?
--মাইয়ারে দ্যাও।
--হ্যায় কি আইছে? হে তো রাজবাড়ি।
--মাইয়া কি তোমার একা সোনা? মেরী কি মাইয়া না। হ্যার মায়ে থাকলি দেতো না?
সোনার মার দাঁড়ানোর সময় নাই। আরেক পাতিল পায়েস নামবে। ধলুদার বৌ সুরমতি একা পারবে না।সোনার মা তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল—সর সর। তার চোখ ভিজে আসছে। তার জা আজ নাই। মৃত জাকে মনে পড়ছে। আখার মধ্যে ধুম গড়ছে।
চেনগাছা নিয়ে বিভূতি কাগা চেয়ারম্যান সাবের হাতে দিলেন। বললেন, মাইয়ার গলায় পরায় দ্যান। হাত জোড় করে বললেন, মাগো—কী আর দিমু। তোমার গরীব কাগা। তোমার জিনিস—তুমি নেওগো মা।
চেয়ারম্যান খুব খুশী।এক সঙ্গে দুইটা সোনার চেন। খেতে বসার আগে ঘোষণা দিলেন—এ বাড়ির দরোজার নাম হবে—প্রফেসার দরজা।গ্রামের মাইয়া প্রফেসর। আর কোন গ্রামে আছে? টিএনও সাবকে বলে তিনি একটা মেডেল দেওয়ার ব্যবস্থাও করবেন। লোকজন খেতে খেতে জয়ধ্বনি দিল—
ভাত খাইলাম মাছ খাইলাম
আরো খাইলাম কি?
--মেরী রানীর ভি।
কুদ্দুস চেয়ারম্যান কি জিন্দাবাদ।

সেদিনের রুই মাছের স্বাদ খুব ভাল হয়েছিল। তিলি বুড়ি তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে জানাল, এই রকম রুই মাছ তার বড়ো মেয়ের বিয়ের সময় রান্না হয়েছিল। তার পিঠের কাঁটা এখনো তার বেড়ায় গোজা আছে।কাঁটার মইদ্যে তিল। পড়ছে রসের কিল।

পরদিন বাটনাতলা গার্লস স্কুলে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। বেশ পুরনো স্কুল। সঙ্গে হোস্টেল। গেটে একদল ছাত্রী ফুলের মালা গলায় দিয়ে নিয়ে গেল। জয়ন্তী নামে একটি মেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় গাইল আগুনের পরশ মণি ছোয়াও প্রাণে। আরেকজন পড়ল মানপত্র। এই স্কুলের একটি মেয়ে চাঁদকাঠি থেকে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে এসেছে।নিয়মিত বৃত্তি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। সরকারী কলেজের শিক্ষকও হয়েছে। এই স্কুলের জন্য এটা অত্যন্ত গৌরবের। হেড মাস্টার জানালেন—প্রতি বছর সেই মেয়েটির নামে একটি বৃত্তির ব্যবস্থা হবে।
--কি তি?
--বৃত্তি। প্রচুর হাত তালি পড়ল।

অনুষ্ঠানের দরোজায় সুরোচনা দিদি দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে তেল হলুদের দাগ। মেরীকে জড়িয়ে ধরল। বলল, মেরী দিদি। তুই আইজ মোর রান্না খাবা না?
মেরীর সুরোচনা দিদির হাতে দুটো দশটাকার নোট গুঁজে দিল। সুরোচনা দিদি জানে আজ হেড মাস্টার স্যারের বাড়িতে দুপুরে নেমতন্ন। হোস্টেলে খাওয়ার সুযোগ নাই। তবু বড় আশা এই মেয়েটিকে আজ হোস্টেলের রান্না খাওয়ায়। যখন পড়েছে—তখন নিয়মিত খায় নি। মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে বলেছে—অ সুরোচনা দিদি, খিদা লাগছে।তবু মনে দ্বিধা জাগছে।
মেরী সুরোচনা দিদির হাত জড়িয়ে ধরেছে। আগের চেয়ে দিদি একটু শীর্ণ হয়েছে। বলল, বিয়া করলি কবে?
--দু বছর আগে।
--জানাইলি না ক্যান?
--জানামু ক্যামনে? মুই কি গ্রামে আছিলাম হে সুমায়?
--এই বুঝি জামাই। কাত্তিক ঠায়ুর গো।
সুরোচনা দিদি জামাই দেখবে কী—মেরীর হাতে মধ্যে এক পোটলা গজা গুঁজে দিল। আজ ভেজেছে। বলল, খাইও সোনা।
গজা খেতে ভারী মজা।ধাই কুটকুট তারে ভজা। কুটুর কুটুর করে খেতে খেতে কিছু গজা মেরী গুঁজে রেখে দিল। পরে খাবে।

বিভূতি কাগা সঙ্গে এসেছেন।হাতে দানাদারের হাড়ি। বাটনাতলা থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরতে হবে। মাটির রাস্তা। বড় বড় মাঠ। মাঠের মধ্যে নাড়া তুলছেন বুড়ো নীলরতন ঘরামী। লোকজন দেখে একটু থমকে গেছেন।হাতের চেটো চোখের সামনে নিয়ে দেখছেন। হেকে বললেন, কেডা যায়?
বিভুতি কাগা বললেন, মোগো মেরী। মেরী আইছে জামাই লৈয়া।
--কোন বাড়ির মেরী?
--হালদার বাড়ির মেরী।
--ভয়ে পালাইছেলে? আছেলে কই?
--ছোট পিসির লগে। নরসিংদি।
--না পলাইয়া উপায় কি? মার্ডার কেসের ভয়। আইচ্ছা নরসিংদি জায়গাডা কুথায়? কামাখ্যা প্রদেশে?

নীল রতন ওঠে এলেন। হাতে কগাছা নাড়া। মাটি লেগে আছে। মেরী প্রণাম করতেই বললেন, অ মেরী-- তুইতো দেহি বড় হইয়া গেছিস। তারপর কপালে হাত রেখে বলল, নাতনী—সব মিছা। হাচা কিছু নাইরে মা।
বিভুতি কাগা তার হাতে দুটো দানাদার দিতে গেল। নীলরতন ধুতির খুঁটে হাত মুছে দানাদার দুটো নিয়ে বললেন, আর দুইডা দেও। সোয়াদ আছে।
মুখে দিতে দিতে বললেন, অ মেরী গাইটা গাভিন হৈছে। বকনা নিবি না।
শুনে মেরী হেসে ফেলল। নীল রতনের কাছে ছোট বেলায় বকনা বাছুরের বায়না ধরেছিল। বহুদিন পরে বুড়ো এখন মনে করতে পারছে।

সর্পন বাড়ির ভিতর দিয়ে যাওয়ার আগেই উলুধ্বনি উঠল। এ বাড়ির বড় বউ ধানদুর্বা দিয়ে মেয়ে জামাই বরণ করে নিল। পথে যেতে যেতে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে আসছে। মেরীকে ছুঁয়ে দেখছে। আর জামাইকে দেখে ফিসফিস করে বলছে—বাহ। জামাই দেহি টুনির আগায় চৈতা টুপি। পুরা নব কাত্তিক গো।
শরম লাগে। মেরীর কানে কানে জিজ্ঞেস করি—টুনি কিরে ভাই? টুনি পাখি?
--টুনি পাখি ক্যানে হৈবে। টুনি মানে বাঁশের আগার কঞ্চি। কঞ্চির আগায় টুপি দিছে। চিকন চাকন জামাই। খাইয়া মোটা হই।

বিশ্বাস বাড়ির কর্তাবাবু একহাতে গরুর দড়ি আরেক হাতে দানাদার নিয়ে আশীর্বাদ করলেন—বেশ বেশ। সুখে থাক মা। সুখে মা। তিনি এক গোছা ধানের ছড়া হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, রূপেশ্বর ধান মা। রূপে গুণে রূপবতী থাইকো স্বোয়ামী সংসার নিয়া।
কর্তাবাবু খুব সাবধানী মানুষ। মাথায় টাক পড়েছে। তার টাকে ঝাঁক করে একটা চিন্তা এলা, আগের দিনে তিনি কী কইতেন? কি কইতেন তা তিনি সহসা মনে করতে পারছেন না। সুখে থাক স্বামী পুত্র নিয়া? না—স্বামী কন্যা নিয়া? না-স্বামী সন্তান লৈয়া? কোনটা ঠিক? তারপর তার মাথায় হাক করে প্রশ্ন এলো—কেন তিনি সন্তানের লগে সুখী হও মা বলেন নাই? কেন তিনি সন্তান শব্দটি বলতে ভুলে গেলেন? কর্তাবাবুর মাথা ধরেছে। তিনি পুকুরের দিকে গেলেন। মাথায় টলটলে জল দেওয়া দরকার। অনেক কিছুই তার সয় না। এসব কথা কেউ কারে কয় না। দিনকাল খারাপ।

আরও পাওয়া গেল দাসবাড়ি থেকে গোটা চারেক হাসের ডিম। আর কটা আমড়া। পাওয়া গেল দুটো ধুতি। আর গামছা। ধুতি কখনো পরা হয় নি। বিভূতি কাগা মাথা নেড়ে বললেন, নেও বাবা। নিতে হয়। পাড় নেড়ে চেড়ে দেখলেন। বললেন—মন্দ না। মোরো মানাইবে ভাল। এ বাড়িতে রঞ্জিতের ঘরে কেউ নাই। হ্যার বউ খুব ভোরে বাপের বাড়ি গেছে।আর রঞ্জিতে থানার ওসি সাহেবের সঙ্গে ফুসুর ফুসুর করে বলে গ্রামে ঠাঁই নাই।

এরপর মুসলিম পাড়া—নামে বিশাল। এখানে খাল বেঁকে গেছে। খালের মুখে বড় গোটা কয়েক ছৈলা গাছ জলের উপরে ঝুঁকে পড়েছে। মেরী একবার কাগার দিকে তাকাচ্ছে-- আরেকবার গাছগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। কাগা আকাশের দিকে। মেরী কাগার হাত ধরে বলল, কি করব কাগা? ফিইরা যামু? ফিইরা যামু?
তার কপালে ঘাম জেগেছে। তার কপালে ফ্যার আছে। ফ্যার বিনা কেবা বাঁচে।

বেলা বেশ হয়েছে। কাগা ফিরে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়াতেই ছৈলা গাছের আড়াল থেকে নৌকা বেরিয়ে এলো। গলুইতে ছবেদালি চাচা। ফাল দিয়ে নেমে পড়লেন। যেন কোনো মার্ডার কেসের আসামী ধরার জন্য ওৎ পেতে ছিলেন। বললেন, মাগো, ছাওয়ালের বাড়ি না যাইয়া ফিরা যাবা ক্যামনে? পাশে ফেলু শেখ। ফেলু শেখ আজ ছবেদালীর চাচার বাড়ি রূপবানের পালাটি গাবে। তার মনে হল, এই মাইয়া কোনজন--রূপবান না তাজেল? রূপবানের বিয়া হৈল প্রথম যুবতিকালে। মরা স্বামী রহিম তার কোলে। মার্ডার কেসের আসামী।স্বামীর বাপে কয়—বিধবা বউয়ের ভাত নাই। সোজা বনবাস। বনবাসে রূপবান।আর তাজেলের বিয়া হইছে জেতা স্বামীর ল্যাজে। রূপবান ঘুটে কুড়ানী—তাজেল পাটরানী।

ছবেদালী চাচার ডাকে সাড়া না দিয়ে ফেরা কঠিন। বাড়ির দহলিজে দুটো চেয়ার পাতা আছে।চেয়ারে একটি ছোট মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। ছবেদালি চাচা মিটি মিটি হাসছেন। বলছেন, জামাই আইছে—বইতে দ্যাও।
কুটি মেয়ে সালমার নড়ন চড়ন নাই। চেয়ারে শুয়েই আছে। ঘুম বলে কথা।
মেরী কানের দুল খুলে সালমার কানে পরিয়ে দিল। তবু সালমার ওঠার নাম নাই। নসি খালা বদনা ভর্তি জল এনে রাখল পায়ের কাছে। বলল, মাইয়াতো মোগো। জামাই হইলে পর। হ্যার লাইগা ভাবনা আছে।
বোনের দুলে
বোনের মন কি ভোলে।
জামাই আনছে কি?
মোহর ভাঙছে নি?

চেয়ারে বসার আগেই মেরীকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল মেয়েরা। ছবেদালি চাচা কাকে যেন হেকে বললেন—অ কাশেম, সাক্কর কোরা চাইল নামা। আইজ জামাই ভোজ হইবে।
বিভূতি কাগা গদগদ গলায় বললেন, তাইলে অর বাপেরে খবর দেই।
--তোমার চিন্তা নাই। হ্যারে খবর দেওন হইছে। মাইয়া কি তোমগো একারই—মোগো মাইয়া না?

মাইয়া জামাই দেখতে মুসলিম পাড়া বিশালের লোকজন ছবেদালী চাচার বাড়ি চলে এল। দুটো ছেলে উঠোনে সামিয়ানা টানিয়ে দিয়েছে। মসজিদের ইমাম সাহেব বাদ এষা এলেন। সঙ্গে গুয়ারেখার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। তিনি বেশ বড় সড়ো একটা সুতোয় বোনা হাত পাঙ্খা এনেছেন। মাঝখানে লেখা—কীর্তি ছাত্রী মেরী রানীর শুভ পরিণয়।

শেখ বাড়ি থেকে এলো চকচকে তামার বদনা। খাঁ বাড়ির ছমিরউদ্দিনের বউ গামছা বোনে---দুটো গামছা দিয়ে বলল—বড় শান্তি লাগছে। আর পাওয়া গেল ফিনফিনে পাঞ্জাবী। ছবেদালী চাচীর দেওয়া ঝালকাঠির শাড়ি পরে খেতে বসল মেরী। নাকে নথ চাচীর। বললেন—অ জামাই –মোগো মাইয়া কেমুন?
জামাই বলার আগে ছবেদারী চাচা বলেন, মাইয়া মোগো ফাস্টো কেলাস ফাস্ট। হ্যারে মন্দ কয় কেডায়।
সবাই এসেছে। হাকিম মুন্সীর ঘরে তালা। হাকিম মুন্সী নিরুদ্দেশ। নতুন করে নিকে করছে দক্ষিণ দেশে। সেইখানে থাকে।
মেরী বলল, মুন্সী চাচী?
--আছে, কলাখালি। এই গ্রামে আর আসে নাই। নদীর জলে জলে ঘোরে। আর গুলাব গুলি দেখলে চিক্কুর পাড়ে। বলে—রহিম—অরে রহিম, তুই ক্যান গুলাব তুলতি গ্যালি বাপ। হ্যার মাথা ঠিক নাই।

আর আসে নাই ফকু মোল্লা। আসার মুখ নাই। ধরা খাইছে হ্যার জারি জুরি। সবাই জেনে গেছে এই সরলা মেয়ের নামে মার্ডার কেসের কিসসা বানাইছিল। বলছিল—মেরী উস্কানী দিয়া রহিমরে গুলাব বাগান থেকে বের করে দিয়েছে। আর ছেলেটা মনের কষ্টে মহিমের মায়ের লগে নদীতে আত্মঘাতি হইছে। মহিমের মা তারে বাঁচায় নাই।রঞ্জিতেরে নিয়ে কদিন গ্রামে পুলিশ নিয়ে ঘুরে গেছে। আর টাকা পয়সা দাবী করেছে। চাঁদকাঠি লুটপাটের হুমকী দিয়েছে ।
মেরী হাত চেপে ধরল। মধ্যরাতে ফিস ফিস করে বলল, গুলাব গাছের নিচে যাবা না। গুলাব গাছের নিচে যাবা না।

খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল। মেরী অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মাঝখানের ঘরে মেঝের উপর ছোট পিসি। পাশের বাড়ির দুটো মেয়ে। আর লক্ষ্মীমতি বউটি খোকা কোলে ঘুমিয়ে আছে।লতিবুড়ির মাথার কাছে দোক্তা রেখে চক্ষু মুদে আছে। বারান্দায় শ্বশুর মশাই। পাশ ফিরে বললেন—দুর্গা। দুর্গা।

এ বাড়ির বেশ বড় উঠোন। শিউলীতলায় সোনা বসে আছে। ফুল কুড়োচ্ছে। ফিক করে হেসে ফেলল। ব্যাপারী বাড়ির সেজ কাকী উঠোনে গোবর ছড়া দিয়ে গেছেন।
উঠোনের পাশে গাদা ফুল গাছ। তারপরে বেগুন আর আনাজের ক্ষেত। বেশ কয়েকটা কড়াইগাছ উঁচু হয়ে আছে। একটা বড়ো সড়ো আমগাছের ডালে ডালে পরগাছা। তার মধ্যে ঘুঘু পাখি চুপ করে বসে আছে। লতি বুড়ির ঘুম ভাঙলে ঘুঘু পাখি ঘুঘুর ঘুঘুর করে ডাকবে। বলবে, অ বুড়ি গান গাও।
--কি গান গামু বেহানেশ্বর বেহানে?
--শুক সারির গান গাও।
--তুই গা। মুই দোক্তা কুটি।
ঘুঘু পাখি চেয়ে আছে। সে পাখি মানুষ। নাকি ফানুষ? কী গাইবে? লতি বুড়ির সামনে কি আর কেউ গাতক আছে?

শিউলী তলার পাশে তুলশী বেদি। সাদা মাটি দিয়ে লেপা হয়েছে। সাজির মধ্যে রাখা হয়েছে মরিচ জবা। শিউলী ফুল তুলে সোনা দুর্বা তুলতে শুরু করেছে। কাকপায়া আর ভাদলা ঘাসের ভিতর থেকে দুর্বা বেছে বেছে রাখছে।সোনার পরনে নীল ডুরে শাড়ি । একটা মরিচ জবার বৃতি তুলে ফেলে বলল, অ জামাইদাদা, মধু খান।
মরিচ জবার গোড়ায় মধু আছে। ঠোঁটে দিয়ে চুষে খেয়ে দেখিয়ে দিল। ফিক করে হেসে বলল, জামাইদাদাগো-- মধু খান। মধু বিনা বঁধু নাই । স্বাদু চিনে কদু খাই।

এ কদিন সোনা আসে নাই। আজ সূর্য ওঠার আগে এসেছে। চরাচার সোনা সোনা হয়েছে। ফুলে মধু দেখা দিয়াছে। মধু নয় গো সোনা। পরিমল। পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল। কাননে কুসুম কলি সকলে ফুটিল।
বাগানের মধ্যে সোনা কাপড়টা একটু উঁচিয়ে হাঁটছে।বলছে, জামাইদাদা, দেইখা হাঁইটেন। চিনা আছে।
--চিনা কি?
--জোঁক। চিনা জোঁক। রক্ত খায় চুক চুক কইরা। খুব সাবধান হে।
আমাগাছের নিচে এসে সোনা একটা লাফিয়ে উঠে আমপাতা পাড়তে লেগেছে। ডাল ডাল একটু উঁচুতে। নাগাল পাওয়া ভার। এদকি ওদিক তাকিয়ে বলল—জামাইদাদা—আপনে অখন ঘরে যান।
--ক্যান সোনা?
--গাছে ওঠুম।পঞ্চপল্লব পাড়ুম।
--উইঠা পড়ো। অসুবিধা কি?
--মুই ডাঙর মাইয়া। পুরুষ মাইনসের সামনে গাছ বাই কেমুন কইরা? নিন্দে হইব না!

সোনাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। সোনার কাছে থাকতে ইচ্ছে করছে। বলল, যাইবেন না জামাই দাদা? যদি না যান তাইলে ডালটা একটু নিচু কইরা ধরেন।

আমগাছের ডাল থেকে গুলঞ্চ লতা ঝুলছে। বেশ মোটা কাছি দড়ির মত। তার একটা লতা ধরে উঁচু হতেই আমডাল নাগালে পাওয়া গেল। ডালটা নিচু করতেই সোনার হাতে আমপাতা। সোনার হাতে বেল পাতা। সোনার হাতে সোনা পাতা। তারে তারে তাতা।
বাগানের পরেই পথ। পথের পাশে নালাবেড়-- বাড়ির চারিদিকে সীমানা চৌহদ্দি। জোয়ারের জল এসেছে বেড়ে। এটা পার হলেই বেপারী বাড়ি। গোটা তিনেক জুবুথুবু ঘর। একটি ঘরের সামনে উঠোনে দাড়ি কাটছেন প্যান্টুলুন পরা লোক। সোনা চিনিয়ে দিল---ব্যাপারী বাড়ির মহিম দাদায়। জেঠিমার পোলা। ডাক্তার।
--এ গ্রামে ডাক্তারও আছে নাকি?
-থাকবে না ক্যান। আছে। আবার নাই।
খিল খিল করে হাসে সোনা। বলে, উনি ব্যাপারী জেঠির পোলা—কিন্তু ব্যাপারীগো পোলা নয়। বোঝজেন কিছু?
সোনা ফিস ফিস করে বলে, ছি ছি ছি। কি কই আপনেরে। কানে দিয়েন না। এ তল্লাটের সবাই জানে। জন্মের আগে মহিম দাদার বাপে স্বর্গে গেছে। পেট মোছা ছাওয়াল। লোকে কত কিছু কয়!মাইয়া মাইনসের মান—হইছে খান খান।

একদিন সোনা ছিল না। আজ এসেছে বলে এসব গুহ্য কথা সোনা গেল। সোনার কথার কোনো পাপ নাই। সবই ষ্পষ্ট কথা। আকাশ বানী আসে যথা। ততক্ষণে সোনা ফুলের সাজিটি রেখে মাটি থেকে গুলাব গুলি কুড়োতে শুরু করেছে। কুড়িয়ে কোচড়ে রাখছে। গুলাব ভেঙে তেল হবে। তেলে পিদিম আঙাবে। পড়া যাবে রূপবানের পুঁথি।পুঁথিতে লেখা আছে--
মালঞ্চমালার কোলে বেড়ে উঠেছে রাজপুত্র চন্দ্রমানিক রহিম। এখন বিদ্যালয়ে যাবে। তার জন্য দরকার রাজার পোষাক। আর দরকার একটা ঘোড়া। ঘোড়া বিনা স্কুলে যায় কি প্রকারে? সেখানে রাজার মাইয়া কাঞ্চি তাজেল আছে। হাওয়ায় হাওয়ায় গান করে। তাজেলের এই রূপ মনোহর।
রহিম বাদশা গাইছে—
শুনো তাজেল তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
তুমি তাজেল সর্বনাশা গো
তাজেল বলে, মুই রাজার কইন্যা। রাজার পুত্র বিনা মন জানি কেমুন কইরা? তুমি পরমান করো—তুমি রাজার পুত্র।
--কি পরমান –কি পরমান গো তাজেল, তাজেল গো?
--তুমার অশ—মানে ঘোড়া আছে? ঘোড়া?
--অশ্বও আছে। ঘোড়াও আছে নিশ্চয় মোগো। কাল আনুম।
--আইন্যা আইস্য গো কুমার। তখন চিনন হইবে গো তুমার।পরমান বিনে প্রাণ করে হায় হায়।

বিদ্যালয় থেকে বনে রহিম ফেরে । তার মনটা কালো ঠেরে। মাথার উপরে কুকিল ডাইকা ঘেরে। মালঞ্চ রূপবান বলে, বাপনের কি হইছে?
--কিছু হয় নাই। তবে হইবে।
--কি হইবে?
--মাথা হইবে? ঘোড়ার মাথা হইবে?
--কী ঘোড়া?
--ঘোড়া মানে ঘোড়া। টগবগ কইরা চড়বো থোড়া। বলে হু হু করে কেঁদে ওঠে রহিম। একে তো বাদশার ছেলে। তার পরে সদ্য বালেগ। মুখে গোঁফ গজানো শুরু করেছে। তারপর কান্না। শুনে ও দাইমা প্রাণ যায় গো যায় যায় গো আমার,কিসের লেখা কিসের পড়াগো দাইমা, আমার প্রাণ যায় যায়গো…।

রূপবান রূপ তরাসী মেয়ে। ভয়ে কেপে ওঠে। রাজার পুত তারে মা বলে ডাকে! সেতো কোটাল কন্যা। অবস্থাগুণে রাজার ছাও তারে মা বলে ডাকছে। ডাকো বাবা—ডাকো। তার প্রাণ করে থাকো থাকো।
রূপবান কি করে? রূপবান বাঘো মামারে ধরে। বলে, মামায়, মোগো রহিমতো আর বাচে না গো মামায়?
---হ্যার হইছে কি?
--ঘোড়া হইছে?
----খালি ঘোড়া? না—লগে হাতিও আছে?
--হাতি মুনে লয় পরে আইবে। এখুন ঘোড়া রোগ।
-হুউম। ঘোড়া রোগ ভাল লয়গো রুপবান। হ্যায় বিদ্যালয়ে কী করে?
--কয় তো ডাক্তারী পড়ে।

--ডাক্তারী পইড়া কী করবে?
---রাজার মাইয়া তাজেলরে বিয়া করবে।
--হ্যাতে হ্যার জ্ঞাতিগুষ্টি কী কয়?
--কয়, হ্যার বাপের ঠিক নাই, বনে পাঠাইছি—কথা শ্যাষ।
--বাপের ঠিক নাই—মায়ে তো ঠিক আছে? নাকি কও?
--হইতে পারে। আবার নাও পারে। গল্পে তো কত কিছুই হয়গো মামা। এবার তুমি গল্পে ঘোড়া আইন্যা দ্যাও--দ্যাওগো মামা—আমার মামা-- মামাগো।
বাঘ মাথা নাড়ে। মনটা তাহার কাড়ে। বলে, চিন্তা কইরো মা মালঞ্চ। একটা কিছু হইবেআনে।

এইটুকু শুনে সোনাকে জিগাই—কি হইছে সোনা?
--হ্যায় সত্যি সত্যি ডাক্তার হইছে। বাঘো মামার কাছ থিকা ট্যাকা লইছে। লইতে লইতে মালঞ্চমালা ওরফে রূপবানের বারো বাজছে।
--রহিম কি করছে?

--ডাক্তার হইয়া গ্রামে আইসে। জ্ঞাতি গুষ্টি গাইছে—তুই মোগো বংশের পিদ্দুম। অখন কইছি—তর বাপে তরে ঠিক ঠিক জন্মাইছেলে। কুনো ভুল নাই কাগু।
--তুমি কি রহিম বাদশারে চেনো সোনা?
-চিনুম না ক্যান। কত রহিম বাদশা ঘোরে ফেরে চারিদিকে। অইযে দ্যাখেন ব্যাপারী বাড়ির উঠানো বইসা বইসা দাড়ি কামায়। আর হ্যার হ্যার মা থাইক্যা থাইক্যা চিক্কুর পাড়ে… আমার দাইমা দাইমা গো।
--অ, তার মানে উনি রহিম বাদশা?
---অত খুইল্যা কওন যাইবে না। উনি মহিম দাদায়। আর রূপবান হ্যার মা—ব্যাপারী বাড়ির জেঠি রূপসুন্দরী দাসী। মনে লইছেন ফাঁসি।মালঞ্চমালাও হইতে পারে। হ্যাতে দোষ নাই। দোষ ধরিয়া ফোঁস নাই।
-ফোঁস কইরা অখন আইছে ক্যান মহিম ডাক্তার?
--না আইসা উপায় কি? হ্যার ভটভটি লাগে।
--ভটভটি দিয়া কি করবে?
--হ্যার বউ তাজেল ওরফে কাঞ্চিরানীরে লইয়া চড়বে।
--হ্যাতে রূপাসুন্দরীর কি?
--আছে নাকের ঘি। রূপোসুন্দরীরে কয়--মাও। চলো বাপোর দ্যাশে যাই।বাপোর জমি জিরেত বেচি।
--মায়ে কয়, তর বাপো কেডা?
--ছেলে কয় তুমার স্বামী যেডা।
--আন্ধারে সান্দারে বেডা—হ্যারে কি চিনি? তর সগোল কুটুল মাইনসেও জানি। জানে বইল্যাই হ্যারা তরে মোর লগে বনবাস দিছিল।
--অহন বনবাস শ্যাষ। মুই ডাক্তার হইছি। রাজ্যজোড়া বাদশা শ্বশুর পাইছি। রাজার মাইয়ারে বউ গাইছি। আর কুনো দুষ নাই।
শুনে রূপসুন্দরী কাঁদে। কেঁদে চিক্কুর পাড়ে। বলে—অ গোপাল—গোপালরে মোর…।আর মাটিতে আছাড়ি বিছাড়ি করে পড়ে—জননী ধরিততিরিগো—তুমি ফাইটা ফাঁক হও। মুই যে অভাগী আর সইরে লারি গো মাই। কিসের বাদ্য বাজে গো দাইমা দাইমা গো।

সোনা রূপবান অথবা মালঞ্চমালার কিসসাটা থামায়। বলে, হ্যার চেয়ে গুলাব কুড়াই গো জামাইদাদা। গুলাবের সের দুই টেকা। টেকায় ঠেকা আছে। গুলাব-- অরে গুলাব। তর কারণে ফুঁ লাভ। ফুঁয়ের মইদ্যে কি? ত্যালের বদলে ঘি। ঘি দে হয় সাবান--ঘুমের মইদ্যে খাব আন। খাবের মইদ্যে লক্ষ্মী—মোরা দুইজন পক্ষী। চলেন উড়ি। বলেই সোনা দুহাত দুদিকে ডানার মত উঁচিয়ে গুলাব বাগানে পাখির মত ঘুরে ঘুরে ছুটতে লাগল। আর থেকে থেকে শালিক ডাক ডাকতে লাগল। কিচ কিচ কিচ। কিচ কিচ কিচ। ফিস ফিস ফিস। ফিস ফিস ফিস। ইহার নাম নাম সোনা শালিক। কিন্তু কুনো বাদুড় নহিক।
বাদুড় বাদুড় ছায়া। মোরে একটা গয়া। গয়া ভ্রমে বাদুড়গুলি ফল কুটুর কুটুর করে কামড়ায়। আর গুলাব বুইঝা নিচে ফেলায়। ইহারে কয় গুলাব গুলি।

বাগানে যুথি করে এক সারি চিকন চাকন গাছ। পাতা আমপাতা জামপাতা।হৃষ্টপুষ্ট সবুজ। ডালে ডালে গুলাব ধরে আছে। এটা গুলাব গাছ। গুলাব গাছ দেখে প্রাণ উড়ে যায়।
এ সময় ঘুম ভেঙে মেরী ছুটতে ছুটতে আসে। হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বলে, তোমারে কইছিনা, গুলাববাগানে যাবা না। গুলাব বাগানে যাবা না।
মেরীর চোখ ফেটে বেরিয়ে এসেছে মেরীর। নাক ফুলছে। বুক দুলছে। ঘন শ্বাস ফেলছে। এই মেরী ঝড়ো কাক। এ আমার সেই ছোট্ট টিয়া পক্ষীটি নয়।
ছোট পিসি মেরীকে ধরেছেন। ঘরের মধ্যে নিয়ে গেছেন। লতিবুড়ি ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছেন। অ মেরী, অহনও তর ডর গেল না। মাইয়া মাইনসের এতো ডর থাকলি চলে? হ্যার ডর ডর থাকন লাগে শুধু সোয়ামির লাইগা, শাউড়ির লাইগা, শওরের লাইগা আর ভাসুর নন্দের লাইগা। হ্যার পরে আর কুনো ডর নাইগো মা। মাইয়া মাইনসের পরান—কচু পাতার পানি। পানি তো নয় জানি—পড়াত কইরা টানি।

এর মধ্যে শিউলি তলায় সোনা ফুলের সাজিটি রেখেছে। আজ গঙ্গা পূজা। একটি ঘটে তেল সিন্দুরে খাড়তে হবে। পুরান তেতুল ঘষতে হবে। কাসার ঘটিটি সোনার মত চকচকে হবে। সোনা জানে। সোনার কোচড়ে গুলাব গুলি। চাচর চুলে ভোরের নিশির। ঘুঘুটি ডাকছে ঘুঘুর ঘুঘুর। ও লতি বুড়ি—গান করো। লতি বুড়ি গান করে না। দুপা ছড়িয়ে ঠক ঠক করে দোক্তা বানায়। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, কপালের নাম গোপাল—গোপাল যে কহন আসে যায় –কহন যায়, হ্যার কি ঠিক আছে? মা যশোদা কি হ্যারে খালি খালি বান্দে? মা রাধা কি খালি খালি কান্দে? কে বাঁচে—কে বা মরে হেইডা কি গোপাল হালায় কেউরে কইছে কুনো দিন? তুই আমি কেউ না। কেউ নারে দিদি। কেউ না। তিনি হাসেন হাসি—মোরা তাহার দাসী।জনম ধইরা পরছি গলায় ফাঁসি।

একটু বেলাবেলিই গঙ্গাপূজার জন্য গঙ্গা যাত্রা শুরু হল। আগে চলেছেন সোনার মা বিভুতি কাগীমা।হাতে সোনার ঘট। আমপাতা, দুর্বাশ্যামদল, ফুল আর ধান্যদানা। পাঁচ সিকার বাতাসা।এক শিশি তেল। আর এক কৌটো সিন্দুর। আর মাটির পিদিম। জ্বলছে দীপ শিখাটি। গুলাব তেলের পিদিম।
এই গুলাব তলা দিয়ে মেরী বহুদিন যায় না। আজ সে পথেই যাবে। শ্বশুরমশাই মেরীর হাত ধরে আছেন। মেরী আমার হাত। বিভুতি কাগার সঙ্গে ছোট পিসি। লক্ষ্মীমতি বউটির কোলে তার ন্যাংটা গোপাল।গোপালের হাতে সোনার সোনার খাড়ু। পায়ে মল। কোমরে ঝুনঝুনি। মুখের মধ্যে গোপাল আংল পুরে গো গো করছে। ছবেদালি চাচা আগেই এসে গেছেন।ইমাম সাহেবকে শুপারি গুলাব বাগান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। ইমাম সাহেব শব্দ করে সুরা ইয়াসিন পড়ছেন। মাথায় সাদা পাগড়ী। পাগড়িতে একটি গঙ্গা ফড়িং উড়ে বসেছে। চোখে সুরমা।
ইমাম সাহেব দুহাত তুলে মোনাজাত ধরেছেন। তিনি আয়ত গম্ভীর স্বরে বলছে—ইয়া হাবিব, তুমি পরওয়ার দিগার। তোমার ইশারা বিনা এ দুনিয়ার একটাও পাতা নড়ে না। তুমি জানো ইয়া মামুদ, এ গ্রামের মুহাম্মদ হাকিম আলী মুন্সীর একমাত্র পুত্র মুহাম্মদ রহিমউদ্দিন মুন্সি একদিন দুপুরর রইদে গুলাব বাগানে ঘোরাঘরি করছিল। তুমি জানো—এ গ্রামের যতীন হালদারের মাইয়া মেরী রানী হালদার অতিশয় কৃতি ছাত্রী, স্নেহহেতু মুহাম্মদ রহিমরে কইছে--ও পোলা এই রইদে তুমি মোগো গুলাব বাগানে আসিও না। হে খোদা, সেই নাবালেগ মুহাম্মদ রহিম কি বুইঝা কইছে—আর আসুম না।মুই আর আসুম ফুফু। সেই মাছুম পোলার গুলাব বাগান থিকা চলে গেইছে। হে রহমানুর রহিম, তোমার অজানা নয়—এই মেরী মায়ে তারে হাচা হাচা গুলাব বাগান থিকা যাইতে কয় নাই। রইদে ঘুরতে মানা করিছে। তার মনে দোষ নাই। হে দো জাহানের মালিক,মহিম ব্যাপারীর মায়ে কালিগঙ্গার ঘাটে যাইতে আছিল গোসলে। রহিম তার লগে রওনা করিল হে খোদা। অসীম দয়ালু তুমি হে খোদা, মোগো এই মেরী মায়েরে তুমি মাফি করিয়া দ্যাও। হ্যার কুনো দোষ নাই। আর সেই মাছুম পোলা মুহাম্মদ রহিমউদ্দিনরে তুমি জান্নাতবাসি কর। তোমার দয়ার সীমা নাই—হে রহমানীর রাহিম।
ছবেদালি চাচা দুহাত চোখ মুছে বললেন, খোদা মেহেরবান। আমেন আমেন।
আমিন আমিন ধ্বনিটি গুলাবগাছের পাতা ভেদ করে বহু দূরে ছড়িয়ে গেল।দূরে কলবাড়ির চোঙে গিয়া ঠুন করে লাগল। আর কলটি ধুপ ধুপ করে শব্দ করে উঠল। বাঁশ বাগানের সাথার উপরে যে বক পাখিটি এসে মাঝে মাঝে বসে, সে হঠাৎ করে পাখা মেলল। বলল, ক। ক। ক। আর একটি গুঁই সাপ সুড়ুৎ করে পুকুরের মধ্যে ফাল দিয়ে পড়ল। ছবেদালি চাচা এগিয়ে এসে মেরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার কুনো দোষ নাই গো মা। তোমার কোনো কসুর নাই।
মেরী বিহ্বল হয়ে বরল, আমার কোনো দোষ নাই চাচা?
--নাই মা। আল্লাহ মেহেরবান—আল্লাহ পরম দয়ালু। তিনি তোমাকে দয়া করেছেন। তিনি সকলকে দয়া করেন।
তারপর খুব ধীরে ধীরে বললেন, ফেকু মোল্লা তুমার নামে মিছা কথা রটাইছেলে। হ্যার লুটপাটের হাউস আছেলে। পারে নাই। লগে বাটনাতলার রঞ্জিতেও আছেলে। ওগো ক্ষমা কইরো মা।
লক্ষ্মীমতি বউটির কোলের গোপালটি মুখের ভিতরে হাতটি আবার পুরে দিয়েচে। গাল বেয়ে লাল পড়ছে। বেশ শব্দ করে বলছে—গা গা গা।

গুলাব বাগান পেরিয়ে আম বাগান। তারপর কড়ুই গাছের সারি। এর মধ্যে দিয়ে নালা বেড়ের মাটি তোলা পথ।এই পথ থেকেই দেখা যায়-- ব্যাপারী বাড়ির জেঠিমা বহুদিন পরে বাপের বাড়ি থেকে এসেছেন।সাধ গঙ্গা স্নানের। স্নান শেষে আবার ফিরে যাবেন বাপের বাড়ি। এ বাড়িতে তখনো শক্ত ঠাই নাই। তখন ভরা ভাদর। তাল পড়ে ঠাস ঠুস। ছনকুলু পাখি ডাকে ফুসফাস। এর মধ্যে সেদিন রোদ উঠেছে। বেলী ফুল ফুটেছে। কোলে কাখে সামনে পিছনে একগাদা নাড়ু গোপাল। তিনি স্নানে যাচ্ছেন। সোনার মা আসতে দেরী করছে। সোনা আগে চলে এসেছে। গুলাব বাগানে রহিম গুলাব টুকাচ্ছিল। মেরীর ধমকে বাগান থেকে সরে এসে বাড়ির কোলে সিরিষ গাছের শেকড়ে আগডুম বাগডুম খেলছে। জেঠিমাকে দেখে খেলা ফেলে বলছে—অ জেঠি, মুই যামু তুমার লগে।
--তর মায়ে কই?
--হাসু খালার বাড়ি ঢেঁকি পারায়।
--তর বাপে?
--জানি না। মুই তুমার লগে গোসলে যামু।

ব্যাপারী জেঠি কোলে কাখে গোপালগণসহ স্নানে যাচ্ছেন। হালদার বাড়ি পেরিয়ে হারু খাঁর বাড়ি। সে বাড়ির হাসি খুশি। জোড়া মেয়ে। গোপালগণের হা হা হি হি শুনে বেরিয়ে এসেছে। সোনার সঙ্গে আজ গোসল করবে। খুশি আবার ছাবিটা হাতে নিয়েছে। ছাবি পেতে মাছ ধরার তার খুব সাধ। কলবাড়ির সামনে তোতা আকন ছিদেম ঘরামীর ধান ভানছিল। তোতা ব্যাপারী জেঠিকে বলল, অ বৌদি, তোমার পোলার খবর কি?
-হ্যায় তো মামা বাড়ি।
--হ্যায় কি করে?
--ডাক্তারী পড়ে। বইরশ্যাল।
--আল্লা মেহেরবান। তিনি তোমার পানে চক্ষু মেইল্যা চাইছেগো বউদি।
না চেয়ে উপায় কি? পোলা হওনের আগে হ্যার বাপে মরছে। তার গায়ে গতরে লাঞ্ছনা গঞ্জনা। বারদিন বয়সী পোলা লইয়া তিনি বাড়ি ছাড়ছেন। পথে পথে ঘোরেন। পেটে ভাত নাই। বুকে দুধ নাই। আঘাটে বাঘাতে ভুত প্রেত। বনে বাঘ। কে তারে বাঁচায়। আল্লা ছাড়া আর আছে কে এ ভুবনে?
কলবাড়ির সামনে ঘাট। কালিগঙ্গা এইখানে একটু বাক ভারাণী খাল হয়ে ঢুকেছে। তারপর বাটনাতলা। জামিরতলা। রোঙ্গাকাঠি। ব্যাসকাঠি। শেষে রাজবাড়ি। রাজবাড়ির আগায় সন্ধ্যা নদী। ওপারে জলাবাড়ি।

এই ভারাণী খালে এখন ভাটা গোন। হাটু জল। গোপালগণ হাটু জলে নেমে পড়েছে। হৈ হৈ রৈ রৈ রবে ফালাফালি করছে। ব্যাপারী জেঠি এর আগে সবার আগে নিমপাতা আর কাচা হলুদ বাটা মাখিয়ে দিয়েছেন। তিনি জোড় করে গঙ্গা তর্পন করলেন।আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন—অরে অ গোপাল, তরা বেশি দূইরি যাসনে। মোরে ধইরা থাক। তিনি সকাল শিশুর গা মাজন করছেন। আজ তিনি মা যশোধা। এইসব ননী চোরা ছাড়া তার আনন্দ কি?

খুশি ছাবি পেতেছে পাড় ঘেষে। বাশের কঞ্চির আগায় মশারীর এক টুকরো কাপড় বাঁধা। ভিতরে দিয়েছে খুঁদ কুড়ো। জলে ডুবিয়ে জল ছিটিয়ে দিতে দিতে বলছে—আইল বাইলি কাইলি হাক—আইসা পড়রে মাছের ঝাঁক। হারে কারে রে রে রে রে।
হাসি আর সোনা ছাবির দিকে ঝুঁকে চেয়ে আছে। আর তিনজনে মাঝে মাঝে বলছে-- হারে কারে রে রে রে রে। মাছ সগোল আয় রে। বেলা যায় রে।
মাছ আসছে। কল বাড়ির শব্দ হচ্ছে। জোয়ার আসছে। ব্যাপারী জেঠি গোপালগণকে ঠেলে ঠুলে পাড়ে তুলেছে। গোপালগণ অতি চপলমতি। তারা একদিকে পাড়ে ওঠে—অন্যদিকে ঝপ করে জলে নামে। কেবা তারা থামে। ব্যাপারি জেঠি চেঁচিয়ে বলছেন—অ সোনা, অ হাসি, অ খুশি—তরা অগগোরে ওডা। মুই তো একা পারি না গো মা।
ধানকলের ধুপ ধুপ শব্দ বাড়ছে। জোয়ার বাড়ছে। বুক সমান জল উঠছে। ব্যাপারী জেঠি গোপালগণের গাত্র মোছন করছেন। মোছন দিতে দিকে গুণছেন—এক গোপাল, দুই গোপাল, তিন গোপাল।আবার কি মনে করে গুণতে শুরু করেন—চার গোপাল, পাঁচ গোপাল…।
তার গায়ে জল লেগে আছে। তবু ঘেমে গেছ্নে। তিনি রহিম গোপালকে দেখছেন না। রহিম গোপাল গেল কই?
জলের দিকে তাকালেন। জল ছল ছল করে। জল খল খল করে। জলে নাই। রহিমের গলা শুনতে পারছেন না। চেঁচিয়ে তিনি বলছেন—অ সোনা, সোনা, দ্যাখতো—রহিম গোপাল গেল কই?

খুশির ছাবিতে মাছ উঠেছে। ছোট ছোট চেলা মাছ। আর গোটা কয়েক কুচো চিংড়ি। সোনা মাছ খাবলে তুলে কোচড়ে রাখছে। খুশি বলছে-কোচড়ে রাইখো না। ভাইসা যাইবেআনে।
সোনা বলে, বুক দিয়া আগলাইয়া রাখুম। যাইবে কই।
সোনা, হাসি—খুশি হেসে ওঠে। জলের স্রোত তীব্রতর হয়। ধানকলের শব্দ পাল্লা দিয়ে বাড়ে। ব্যাপারী জেঠি দেখেন—জলের স্রোতে টগরপানা ভেসে আসে—টানে দূরে চলে যায়। ডাবের খোসা ভেসে যায। পাক খেতে খেতে কী একটা মরা বন বেড়াল ভেসে মিলিয়ে যায়। মাছির ভ্যান ভ্যান শব্দ শোনা যায় না।

ব্যাপারী জেঠি জলের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েন। তখন জল মাথার উপরে চলে গেছে। সাঁতরে সাঁতরে এপার ওপার করেন। রহিম গোপালরে তিনি দেখতে পান না। তাকে ঠেলে ভাসিয়ে দিতে চায় কালিগঙ্গার ফণাতোলা স্রোত।
খুশির মা ডাকতে এসেছে। হাসি মায়ের বোল শুনে উঠে গেছে। ছাবিটাকে বাঁহাতে নিয়ে খুশি রওনা হয়েছে। সোনা সঙ্গে চলেছে মাছ নিয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে হ্যাগর প্যাগর করে চলেছে গোপালগণ। জলে গোপাল নাই। কুলে গোপাল নাই। জলে পাক খেতে খেতে,অ গোপাল অ গোপাল বলে হাক দিতে দিতে দিশাহীন ব্যাপারী জেঠি জল থেকে উঠে পড়েন।তোতা মিয়া বের হয়ে বলে, অ বৌদি, হ্যারা তো সগোলে অগো লগে গেল।
--কই গেল?
--বাড়ির দিকে।
--মোর রাম গোপাল? মোর রহিম গোপাল?
--হ্যারা সগগোলে গেইছে। আপনের চিন্তা নাই।

চিন্তাশূন্য হয়েই তিনি বাড়ির পানে ছুটলেন। গোপালগণ তখনো ফালিয়ে গালিয়ে ছুটছে। সঙ্গে সোনা। সোনা রূপবানের পালা গুণ গুন করতে করতে যাচ্ছে—
একটি পুত্র দেরে আল্লাহ,
একটি পুত্র দে,
কামাই খাইবার সাধতো নাইরে
মাটি দিবো কে?

সোনা যায় মাটিতে পায়ের জলছাপ ফেলে ফেলে। গোপালগণ যায় আগে পিছে। ব্যাপারী জেঠি তাদের পিছনে ছুটতে ছুটতে গোণেন—এক গোপাল, দুই গোপাল, তিন গোপাল। কী মনে করে ফের গুণতে শুরু করেন—চার গোপাল, পাঁচ গোপাল…।
আবার গোণেন। চেঁচিয়ে ওঠেন--মোর রহিম গোপাল কই? রহিম গোপাল কইরে সোনা?
--সোনা বলে, হ্যায় গেছে বাড়ি।
--বাড়ি গেছে! হ্যায় বাড়ি যায়—একা একা। একা একা আসে। একা একা যায়। ভয় ডর নাই। পারে গো জেঠি মা।

ব্যাপারী জেঠি রহিম গোপালদের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছোটে। বাড়ির দরোজা বন্ধ। এক পাল কুড়হা কুক কুক করছে। উঠোন ফাঁকা। একাপাশে কিছু গুলাব শুকোতে দেওয়া আছে। একটা বিড়াল দাওয়ায় কুকড়ে মুকড়ে ঘুমিয়ে আছে। তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন—অ রহিম গোপাল? রহিম গোপাল, বাড়ি আইছস বাপ?
রহিম গোপাল কোনো কোনো গুলাব গাছের নিচে থাকতে পারে। কোন গুলাব গাছের তলায়? এ বাড়িতে তো গুলাব গাছ নাই। তাইলে কোথায় যাই? একটি জাম্বুরা গাছের নিচে ধপ করে বসে পড়েন। দূর থেকে শুনতে পান কলবাড়ির শব্দ-- ধুপ ধুপ ধুপ।

দুপুর গড়িয়ে গেলে রহিমের আম্মা হাসু খালার বাড়ি থেকে ফেরে। কাখালে আধ ধামা চিড়া। কিছু চিড়া ভাজতে হবে। রহিম খেতে ভালবাসে। ঘরের বারান্দায় ধামাটা রেখে দেখতে পেল—আলু থালু বেশে ব্যাপারী জেঠি বসে আছে জাম্বুরা তলায়। তার চক্ষু থরথর। ছূটে এসে বলে, অ দিদি, দিদি?
অনেক ক্ষণ পরে ব্যাপারী জেঠি ঘোলাটে চোখে বলে, রহিম গোপাল কই? মোর রহিম রহিম গোপাল কই?
ঘুমন্ত বিড়ালটি লেজ তুলে উঠে আসে।বলে ম্যাও।

কলবাড়ির ঘাটে ভাটা গোন। খালের মধ্যে কাদা থকথকে।ফাঁকে ফাঁকে বালি। মাঝখানে তুলু তুলু সোতা। সোনার মা জলে ও কাদায় থালাটি রাখেন। থালার উপরে ঘট। ঘটের ভিতরে জল। জলের মধ্যে পঞ্চপল্লব। আর বেল পাতা। ধান ও দুর্বা তিনি জলে দেন। দেন কিছুটা তেল আর তেলে উপরে সিদুর। তেল সিঁদুর জলে দিতে দিতে গুলাব পিদিমটি জ্বেলে দিল মেরী। জল বাড়ছে। পিদিমটি কাঁপছে। পিদিমটি ভাসছে।পাড়ে ছবেদালি চাচার কাছে ফেলু শেখ বসে আছে। কলাখালি ঘুরে তার আসতে দেরী হয়েছে। একটি আলম বিড়ি ধরিয়েছে। আঙুলের ফাকে নিভে গেছে। রহিমের মায়ের কোনো সন্ধান নাই। লোকে বলে, মাঝে মাঝে গুলাব গাছের তলায় ঘোরে। ঘরে আসে না। জলে ভাসে না। ফলে হাসে না।

ঘাটে তিলি বুড়ির আসার সাধ ছিল। বুড়ির ঘুম পেয়েছে। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে গান গাইওগো বন বিবি, তোমার বাল্লক এলো বনে, থাকে যেন মনে। দোহাই মা বরকদের। দোহাই মা বরকদের।
বারান্দায় মাটির উপরে শুয়ে পড়েছে। মাথার কাছে দোক্তা। উঠোনে একটু কুকুর লেজ তুলে ঘুরছে। বাঁশ বাগানের ভিতর থেকে কট কট শব্দ হচ্ছে। ব্যাপারী বাড়িতে সোনা জেঠিকে আগলে রেখেছে। তার পেটপোছা পোলা মহিম গোপাল তার কাগুবৃন্দের সহিত গুহ্য আলাপ সারছে। তারা ফাঁকে ফাঁকে গুড়ুক খাচ্ছে। আর তুড়ুক তুড়ুক করে বলছে—তুমি মোগো ডাক্তার পোলা। তর উপ্রে কথা নাইরে বাপ। শুনে পোলার হাই ওঠে। বাই জোটে। জেঠিমা রূপসুন্দরী দাসী সোনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে—অ গোপাল। মোর গোপাল গেলে কই?

সোনা জেঠিকে ধরে আছে।সোনা জানে--তাকে ধরে থাকতে হবে।তারপর জেঠি এলিয়ে পড়বেন—ঘুমিয়ে পড়বেন সোনার কোলে। সোনার সোনার কোল ছাড়া আর কি আছে এই ভবে? এই কোল থেকে কে কেড়ে নেয় গো দাইমা, দাইমা গো।
এই পথ দিয়ে ইমাম সাহেব বাড়ি যাবেন। তার বাড়ি রায়েন্দা। কালিগঙ্গা নদী পার হলে বলেশ্বর। তারপর পানঘুচি। তারপর কচা। তারপর রায়েন্দা। ইমাম সাহেবের চোখে সুরমা। মাথায় পাগড়ী। তিনি কোনো এক বিপদনাশিনী সুরা পড়ছেন। পড়ে তিনি একবার আকাশ পানে চাইলেন। হাততালি দিলেন। আকাশে এক ঝাঁক বক পাখি। ওঠে ডাকি ডাকি। তিনি নদীর দিকে যেতে যেতে বলছেন—হক মওলা। আল্লা মেহেরবান।

ছবি: 
31/08/2009 - 2:55am

মন্তব্য

দময়ন্তী এর ছবি

অপ্রাসঙ্গিক্ভাবেই পড়তে পড়তে অবন ঠাকুরের কথা মনে পড়ছিল| ভারী ভাল লেখেন আপনি|

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

কুলদা রায় এর ছবি

আপনি পড়েছেন এই অপাঠ্য দীর্ঘ ছাতামাতা লেখাটি। আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। অবন ঠাকুর ছেলেবেলায় আমার প্রিয় ছিল। এখনো। তিনি রঙের শিল্পী ছিলেন। আমি অক্ষম সঙের মানুষ। তবু আপনি ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন--লেখাটিকে ভারী ভাল বলেছেন--জেনে ভাল লাগল। ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

রানা মেহের এর ছবি

কী মায়াময় লেখা আপনার!

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।