দৃষ্টিসঙ্গী

সাবরিনা মোস্তফা রিমি এর ছবি
লিখেছেন সাবরিনা মোস্তফা রিমি [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৯/১২/২০০৯ - ৪:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্লাস সেভেনে থাকতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলার সময় আমি প্রথম টের পাই যে আমি টিভির ডান কোণায় থাকা স্কোর ঠিকমত পড়তে পারছি না, খাটুনি হচ্ছে। কিছুদিন পর ডাক্তার দেখাতে হল। এবং প্রথমবারের মত আমার নাকের গোড়ায় চশমা এঁটে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এতদিন যেটুকুকে সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পারা মনে করতাম আসলে তার থেকে বেশি দেখে স্বাভাবিক চোখের মানুষেরা। সেই থেকে চশমা আমার সঙ্গী। প্রথমে ছিল কার্বন ফ্রেমের হালকা খয়েরি একটা চশমা। পরে সেটা হল আরেকটু গাঢ় খয়েরি। বছর ঘুরতেই সোনালি, কারণ তখন চশমার জন্য সোনালিই স্মার্ট ফ্রেম ছিল। সেই সাথে নিয়মিত চেকআপ আর সাথে গুটি গুটি করে কাঁচের শক্তিবৃদ্ধি হওয়া তো ছিলই। ততদিনে আমি অনেক চালাক। শিখে গেছি দূরের জিনিস কম দেখলে মাইনাস হয় আর কাছের জিনিস কম দেখলে হয় প্লাস। প্লাস চশমা থাকে আব্বুদের যারা খালি চোখে থাকলে খবরের কাগজ ভালভাবে পড়তে পারার জন্য মুখের কাছাকাছি না এনে বরং চোখ কুঁচকে দূরে মেলে ধরেন। একবার ডাক্তারের কথা শুনে অবাক হয়েছিলাম। আমি তখন ক্লাস এইটে। ডাক্তার আব্বুকে বললেন, ‘মেয়ের চোখের পাওয়ার তো দিনে দিনে বাড়বে, আপনার একটা কথা জানা থাকা ভাল। সেটা হচ্ছে মেয়ের যখন বিয়ে দিবেন দেখবেন ছেলে যেন মাইনাস পাওয়ারের না হয়। প্লাস হলেও সমস্যা হবে না। কারণ দুইজনই যদি মাইনাস হয় তাহলে বাচ্চারা হবে ডাবল মাইনাস।’ আমি তো শুনে বিশাল বিব্রত। আরে ডাক্তার আমার সামনে এসব কি সব বিয়ের কথা বলে? আমি ছোট না? সেই থেকে কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল। তখন আবার প্যাকেজ নাটকের স্বর্ণযুগ। বড় হলে যে একটু আধটু প্রেমপ্রীতি হয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক তা খুব বুঝতাম। ভার্সিটিতে পড়ার সময় যদি কোন মাইনাসওয়ালা ছেলেকে মনে ধরে যায় তাহলে যে মুশকিল হবে সেটা ভেবে একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ক্লাস টেনে উঠে পদার্থবিদ্যার বইয়ের কল্যাণে জানতে পারলাম আমার প্রবলেমটার নাম হচ্ছে মাইওপিয়া এবং কেউ যদি জিজ্ঞেস করত চশমার পাওয়ার কত তাহলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতাম মাইনাস এত ‘ডাইওপ্টার’।

যাই হোক, সোনালি চশমা চালু থাকা অবস্থাতেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে মেন্ডেল এসে আমার রোমান্টিক মনে আরেকটা খোঁচা দিল। তার দ্বিতীয় সূত্র থেকে বের করে ফেললাম আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনের চোখের সমস্যা থাকবে না। তবু খুশি হবার উপায় ছিল না। কারণ তখনও চশমা পরা ছেলেদেরকেই একটু মুডি লাগলেও আর বেশি পছন্দ হলেও চার চারটা ছেলেমেয়ে বড় করার ঝামেলার কাছে তা ম্লান হবার মত ছিল না কিছুতেই। ভার্সিটিতে উঠে চশমাটা বিচ্ছিরি হয়ে গেল, কালো রঙের আজব একটা ফ্রেম। আবার তাড়াতাড়ি সেটা বদলে একটা মোটা কালো হাফরিম। কাঁচ মোটা হওয়ায় রিমলেস পরার শখ কখনোই মিটল না, এখনকার কালো হাফরিমটাই তাই ভরসা। পাশাপাশি আমি বেশ উদারও হয়ে গেছি দিনে দিনে। ডাক্তারের পরামর্শটা অন্যদের শোনালেও চশমা পরলে কাউকে ভাল লাগাটা বাতিল করার কথা মাথায় আসে না আর।

এই চশমার অনুগ্রহে ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের শুভ্রর জ্বালা কিছুটা বুঝতে শেখা হয়েছে। কখনও ইচ্ছা হত একদিন সকালে উঠে যেন দেখি সব ঠিক। কতবার ভেবেছি আমাকে যদি কেউ মরণোত্তর চক্ষুদান করে যেত। মনে মনে চেয়েছি কেউ যদি অনেক টাকা দিয়ে আমাকে ল্যাসিক করিয়ে দিত যেখানে কোন রিস্কই থাকবে না। কেউ যে এমনি এমনিই সব কিছু দেখতে পায় এটা এখন আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। যখন দেখতাম কেউ শখ করে চশমা পরে তখন খুব রাগ হত। ক্লাসের কেউ নতুন চশমা নিলে একধরণের ভাল লাগত, আমি একাই কেন কষ্ট করব, অন্যরাও করুক। কিন্তু অন্যদেরগুলো হত মাথাব্যথার চশমা যেগুলো মাস কয়েকের মধ্যে উধাও হয়, আমার মত গেড়ে বসে না।

আমার চশমাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কয়েক বছর ধরে ঘরে আছে কন্ট্যাক্ট লেন্স। প্রথম যেদিন চোখে দিই আমি তো অবাক। কত বছর পর আমি চশমা ছাড়াই সত্যি সত্যি সব দেখতে পাচ্ছি! ইচ্ছামত কাজল লাগাতে পারছি। সানগ্লাসও পরতে পারছি। শুধু মন ভরে ঘুমাতে পারছিনা এটা নিয়ে। আর লেন্স পোষাটা চার ছেলেমেয়ে না হোক, জমজ ছেলেমেয়ে লালনপালন করার মত ঝামেলার হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাই চশমাই বেশি প্রিয়।

চোখে এতখানি ঘাটতি থাকার দুঃখটা আমার মত ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ একটুও বুঝতে পারবে না। তারপরও আগের মত খারাপ লাগে না এখন। জানি না সেটা অভ্যাসের জন্য নাকি এমনিতেই। চোখের কমতি পুরোটাই পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে। আজকে যদি পা না থাকত কিংবা হাত, এত সহজে পারতাম একটা সঙ্গী পেতে যে এত বেশি সাহায্য করতে পারে? আর আয়নাতে দেখতেও মন্দ লাগে না। আমার পাওয়া সেরা কমপ্লিমেন্ট আমার নার্সারি পড়ুয়া চাচাতো বোনের যে বক্তব্য দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভেবে নেয়; “রিমি আপু, তোমাকে তো চশমা পরলে বেশ সুন্দর লাগে। আমি তো আগে লক্ষ্য করি নাই।”

উড়ে এসে জুড়ে বসা যন্ত্রণাটাকে ছাড়া এখন কেমন কেমন খালি খালি লাগে।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সচলায়তনের নীতিমালা মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখুন। অন্য কোনো কমিউনিটি ব্লগে পূর্বপ্রকাশিত লেখা সচলায়তনে নিরুৎসাহিত করা হয়। পুরনো লেখা ডাম্প না করে সচলের জন্যে আনকোরা নতুন কিছু লিখবেন, পাঠক হিসেবে এ প্রত্যাশা জানিয়ে রাখলাম।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।