ব্রহ্মাণ্ড

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: শনি, ২৬/০২/২০২২ - ৫:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূলঃ এন্ডি উইয়ারের The Egg অবলম্বনে

মারা যাওয়ার পর তুমি তোমার গন্তব্যে যাচ্ছিলে।
একটা সড়ক দুর্ঘটনা ছিলো। তেমন আহামরি কিছু নয়, যদিও মরণঘাতী। স্ত্রী আর দুই সন্তান রেখে গিয়েছিলে। যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম (ইএমটি) তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো তোমাকে বাঁচাতে, পারেনি। তোমার শরীর এমন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো, বিশ্বাস করো এই ভালো হয়েছে।

আর তখনই আমার সাথে তোমার দেখা হলো।

"কী...কী হয়েছিলো?" তোমার জিজ্ঞাসা। "কোথায় আমি?"
"তুমি মারা গেছো," আমি নির্বিকারভাবে বললাম। এখন রাখঢাক করার কোন মানে নেই।
"একটা ট্রাক ছিলো...সরে যাচ্ছিলো..."
"হ্যাঁ," আমি বললাম।
"আমি...আমি মরে গেছি?"
"হ্যাঁ, কিন্তু এটা নিয়ে মন খারাপ করো না। সবাই মারা যায়," বললাম আমি।

তুমি আশেপাশে তাকালে। চারপাশে কেউ নেই। শুধু তুমি আর আমি। "এই জায়গাটা কোথায়?" জিজ্ঞেস করলে তুমি। "এটা কি পরকাল?"
"সেরকমই," বললাম আমি।
"তুমি কি ঈশ্বর?" তোমার প্রশ্ন।
"হ্যাঁ," আমি জবাব দিলাম। "আমিই ঈশ্বর"।
"আমার বাচ্চারা...আমার স্ত্রী," তুমি বললে।
"কী ব্যাপার ওদের?"
"তারা কি ঠিক থাকবে?"
"সেটা আমিও দেখতে চাই," বললাম আমি। "তুমি একটু আগে মারা গেছ, তবুও তোমার মূল উৎকণ্ঠা তোমার পরিবার নিয়ে। এটা বেশ ভালো ব্যাপার।"

তুমি কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে তাকালে। আমাকে দেখে তোমার কাছে মোটেও ঈশ্বরের মতো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন লোক বা মহিলা। হয়তো ধোঁয়াটে কোন কর্তৃপক্ষ। ঈশ্বরের চাইতে অনেকটা ইংলিশ গ্রামার স্কুলের টিচারের মতো লাগছে।

"চিন্তা করো না," বললাম আমি। "ওরা ভালো থাকবে। তোমার বাচ্চারা তোমাকে সবকিছুতে নিখুঁত হিসেবে মনে রাখবে। তারা তোমাকে অপছন্দ করার কোন সময় পায় নি। তোমার স্ত্রী কিছুদিন বাইরে লোক দেখানো কান্নাকাটি করবে, কিন্তু মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। তাছাড়া, তোমার বিয়ে এমনিতেই ফেঁসে যাচ্ছিলো। সান্ত্বনা যদি কিছু থাকে, সে এখন হাঁফ ছাড়ার জন্য মনে মনে নিজেকে দোষী ভাববে।"
"ওহ," বললে তুমি। "এখন তাইলে কী হবে? আমি কি এখন স্বর্গ বা নরক কোথাও যাব?"
"কোথাও না," বললাম আমি। "তোমার পুনর্জন্ম হবে।"
"তাই নাকি," বললে তুমি। "হিন্দুরা তাহলে ঠিক।"
"সব ধর্মই তাদের মতো করে ঠিক আছে," আমি বললাম। "চলো আমার সাথে"।
তুমি আমার সাথে বড় বড় পা ফেলে আসতে থাকলে। "কোথায় যাচ্ছি আমরা?"
"তেমন কোথাও না," বললাম আমি। "কথা বলার সময় হাঁটলে ভালো লাগে।"

"এসবের অর্থ কী ?" জিজ্ঞেস করলে তুমি। "যখন আমার পুনর্জন্ম হবে, আগের সবকিছু মুছে যাবে, তাই না? একটা শিশু হয়ে যাব। আমার আগের সব অভিজ্ঞতা, এই জীবনে যা কিছু করেছি তা আর আসবে যাবে না।"
"উহু, সেরকম না!" বললাম আমি, "তোমার আগের সব জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা তোমার ভেতরে আছে। তুমি শুধু তা এখন মনে করতে পারছো না।"
আমি হাঁটা বন্ধ করে তোমার কাঁধে হাত রাখলাম। "তোমার আত্মা তোমার কল্পনার চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী, সুন্দর ও সুবিশাল। মানুষের মস্তিষ্ক এর কণামাত্রই শুধু ধারণ করতে পারে। এটা গ্লাসের মধ্যে আঙুল দিয়ে পানি ঠাণ্ডা না গরম বোঝার মতো। তুমি তোমার একটা ক্ষুদ্র অংশ এই বিশাল পাত্রের মধ্যে রাখলেও, যখন আবার এটা তুমি ফিরিয়ে নাও, সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাই তুমি লাভ করো।"
"গত ৪৮ ঘণ্টা তুমি একটা মানুষের মধ্যে ছিলে, তাই এখনো সেখান থেকে তুমি বের হওনি এবং তোমার বাইরের বিশাল বিবেকবান সত্ত্বাটিকে এখনো অনুভব করো নি। আমরা এখানে যদি আরো কিছু সময় কাটাই, তোমার সবকিছু মনে পড়তে শুরু করবে। কিন্তু প্রতিটা জন্মের মাঝখানে এমন করার তো কোন মানে নেই।"
"এ পর্যন্ত কতবার তাহলে আমার পুনর্জন্ম হয়েছে?"
"ওহ, অনেকবার। অনেক, অনেকবার। এবং নানাভাবে পুর্নজন্ম হয়েছে।" আমি বললাম। "যেমন, এইবার তুমি জন্ম নেবে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দে এক চৈনিক কৃষক কন্যা হিসেবে।"
"দাঁড়াও, কী বলছ?" তুমি তোতলাচ্ছিলে। "তুমি আমাকে অতীতে পাঠিয়ে দিচ্ছ?"
"তা বলতে পার, টেকনিক্যালি। তুমি তো জানই, সময়ের অস্তিত্ব শুধু তোমাদের বিশ্বে। আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে হিসাব অন্যরকম।"
"তুমি কোথা থেকে এসেছ?"
"ওহ আচ্ছা," আমি ব্যাখা করলাম "আমি অন্য এক জায়গা থেকে এসেছি। অন্য কোথাও। এবং সেখানে আমার মতো আরো অনেকেই আছে। আমি জানি তুমি শুধু জানতে চাও সেখানকার অবস্থা কীরকম, কিন্তু সত্যি বলতে কী তুমি সেটা বুঝবে না।"
"ওহ", একটু হতাশ গলায় বললে তুমি। "কিন্তু আমি যদি অন্য জায়গায় অন্য সময়ে জন্ম নিতে থাকি, একসময় তো আমার সাথেই আমার দেখা হয়ে যাবে।"
"ঠিক তাই। এটা সবসময়ই হয়। এবং দু'টো জীবনই শুধু নিজের সম্পর্কে জানতে পারে। এমনটা যে হচ্ছে তুমি সেটা বুঝবেও না।"
"তাহলে এত সবকিছুর মানে কী?"
"সিরিয়াসলি?" আমি জানতে চাইলাম "তুমি আসলেই জীবনের মানে জানতে চাইছ? এটা কি একটু গতানুগতিক হয়ে যাচ্ছে না?"
"কিন্তু এটা একটা যৌক্তিক প্রশ্ন," তুমি নাছোড়বান্দা।

আমি তোমার চোখে চোখ রাখলাম। "জীবনের মানে হচ্ছে, এই সারা বিশ্ব আমি বানিয়েছি যেন তুমি এখানে ম্যাচিওর বা পরিপক্ক হতে পার।"
"মানে সমগ্র মানবজাতি? তুমি চাও আমরা পরিপক্ক হই?"
"আমরা না, শুধু তুমি। এই সমগ্র বিশ্ব আমি বানিয়েছি শুধু তোমার জন্য। প্রতিটা জন্মের সাথে তোমার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি হয় এবং দিনে দিনে তোমার পরিপক্কতা আরো বাড়ে।"
"শুধু আমি? তাহলে বাকী অন্যরা?"
"তুমি ছাড়া আর তো কেউ নেই।" আমি বললাম। "এই বিশ্বে শুধু তুমি আর আমি আছি।"

তুমি শূন্যদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে।"কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ তাইলে..."
"সবাই তুমি। তোমার বিভিন্ন পুনর্জন্ম।"
"মানে। সবাই আমি!?"
"এই তো এখন তুমি বুঝতে পেরেছ," তোমার পিঠে একটা অভিনন্দনসূচক চাপড় দিয়ে বললাম আমি।
"এ পৃথিবীতে যত মানুষ এসেছে সবাই আমি?"
"অথবা যত মানুষ আগামীতে আসবে, হ্যাঁ"
"আমি আব্রাহাম লিংকন?"
"তুমি জন উইল্কস বুথও।"
"আমিই হিটলার?" হতবাক হয়ে বললে তুমি।
"এবং তুমি অগণিত লক্ষ মানুষ যাদের সে হত্যা করেছে।"
"আমিই যীশু খ্রিস্ট?"
"এবং তুমি প্রত্যেকে যারা তাঁকে অনুসরণ করে।"

তুমি চুপ করে রইলে।
"যখন তুমি কাউকে আঘাত করো," বললাম আমি, "তুমি আসলে নিজেকেই আঘাত করো। তোমার প্রতিটা দয়ালু কাজ, তুমি আসলে নিজের প্রতি করো। মানুষ হিসেবে তোমার প্রতিটা সুখকর বা দুঃখময় অভিজ্ঞতা আসলে তুমি নিজেই লাভ করো।"

তুমি বহুক্ষণ ধরে ভাবলে।
"কেন?" জিজ্ঞেস করলে তুমি। "এসবের কী দরকার?"
"কারণ একদিন তুমি আমার মতো হবে। কারণ এটাই তুমি। আমাদের একজন। তুমি আমার সন্তান।"
"ওয়াও," অবিশ্বাস্যভাবে বললে তুমি "তাহলে আমি ঈশ্বর?"
"না, এখনও নয়। তুমি এখন ভ্রূণ। এখনও বেড়ে উঠছো। যখন তুমি প্রত্যেকটা মানব জীবন পূর্ণ করবে সব সময়কালে, তখন তোমার জন্ম হবে।"
"তাইলে এই সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড," বললে তুমি, "শুধু একটা..."
"একটা ডিম।" আমি উত্তরে বললাম। "এখন তোমার সময় হয়েছে পরবর্তী জীবনে যাবার।"
এবং তোমাকে গন্তব্যে পাঠিয়ে দিলাম।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।
এটা নিয়ে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলছবি বানানো হয়েছিল:
https://www.youtube.com/watch?v=h6fcK_fRYaI

তানভীর এর ছবি

পড়া ও চলছবির লিংকের জন্য ধন্যবাদ।

নুশান এর ছবি

পড়তে খুব ভালো লাগল, অন্তত এরকম একটা সময়ে!
এটার একটা সিনেমা দেখেছিলাম কিন্তু পড়া হয়নি। দ্য এগ এর ম্যাসেজ যদি মানবজাতি বুঝত!!

নুশান

তানভীর এর ছবি

পড়া ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

তানভীর এর ছবি

ধন্যবাদ হে মডু 'ব্রহ্মাণ্ড' বানান ঠিক করে দেয়ার জন্যে। কবি খেলায়েত যদিও বলেছেন, 'বানানই কি সব?'

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর অনুবাদ । ভালো লাগল । ধন্যবাদ ।

নাজমুছ ছাকিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।