ডিজাইন ফল্ট

উৎস এর ছবি
লিখেছেন উৎস (তারিখ: শনি, ০৯/০৬/২০০৭ - ১১:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:
কে যেন অমরত্ব নিয়ে লেখা দিচ্ছিল এখানে, ভাস্করদা মনে হয়, পিতৃত্বে অমরত্ব বা এরকম বিষয়ে৷ অমরত্বের আকাঙ্খা আসলে বেশ পুরোনো, হয়তো সবচেয়ে পুরোনো৷ ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সবসময়ই মনে হয় মানুষের মৃত্যু একটা চরম অপচয়৷ পরকাল আছে ভেবে নিজের সাথে প্রতারনা করা যায়, কিন্তু সমস্যার সমাধান তাতে হয় না৷ একটা প্রশ্ন করা যায়, বুড়িয়ে যাই কেন? অথবা আমরা কেন ৫০০ বছর বেঁচে থাকতে পারি না? সংক্ষেপে উত্তরটা হচ্ছে এরকম, আমাদের শরীরের ফান্ডামেন্টাল ডিজাইনে আসলে অনেক bug আছে৷ আমাদের জিনে যে ইন্সট্রাকশন সেট আছে সেগুলোও নানা security hole এ ভরা৷ যে বা যারা এগুলো প্রোগ্রাম করেছে, তারা এই কাজে ভীষন দক্ষ নয় (মানে পাঁচশ বা হাজার বছর বাচিয়ে রাখার জন্য যে দক্ষতা দরকার)৷ আমাদের জিনের সেই অদক্ষ প্রোগ্রামার কারা, সেসব আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু চর্বিত চর্বন পুরাবৃতি করি, যেন এই লেখাটা সেল্ফ কন্টেইন্ড হয়৷ এই যেমন আপনি যখন মনিটরের দিকে তাকিয়ে লেখাটি পড়ছেন, আপনার শরীর কিন্তু বসে নেই৷ বিলিয়ন কোষের সবাই ব্যস্ত, কেউ ভেঙ্গে গিয়ে দুটো হচ্ছে, কেউ মরে যাচ্ছে, কেউ নানা রকম রাসায়নিক উপাদান তৈরী করছে, যেমন ইনসুলিন, কেউ অক্সিজেন পরিবহন করছে ইত্যাদি৷ কিন্তু কোষগুলো ঠিক বুঝে কিভাবে কোন কাজটা কিভাবে করতে হবে? যেমন ইনসুলিন কিভাবে বানাতে হবে এই সুত্রটা ওরা জানে কোত্থেকে৷ প্রতিটা কোষের কাছে একটা বড় লাইব্রেরী আছে, নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোম গুলোতে৷ এই লাইব্রেরীতে আসলে ডিএনএ দিয়ে সাজিয়ে রাখা আছে সব সুত্র৷ যদি লাইব্রেরীর সব বইয়ের অক্ষর সংখ্যা হিসেব করি তাহলে কয়েক বিলিয়ন অক্ষর আছে এখানে৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে সব কোষের কাছেই সব সুত্র আছে (অল্প কয়েক ধরনের কোষ বাদে যাদের নিউক্লিয়াস নেই), মানে ইনসুলিন বানানোর সু্ত্র অগ্নাশয়ে যেমন আছে (যেখানে ইনসুলিন তৈরী হয়) তেমন হাতের চামড়ার কোষেও আছে, তবে হাতের চামড়ার কোষ সুত্র জানলেও ইনসুলিন বানায় না, কেন বানায় না সে আলোচনা আরেকদিন৷ তো যখন ইনসুলিন বানানোর প্রয়োজন হয় তখন অগ্নাশয়ের কোষ লাইব্রেরী থেকে ১১ নম্বর বইটা নিয়ে বসে (মানুষের ৪৬ টা ক্রোমোজোম, বা বই বলতে পারি)৷ ওখান থেকে খুজে বের করে ইনসুলিনের চ্যাপ্টার (বা gene)৷ এর পরের প্রক্রিয়া অনেকটা Lego সেট দিয়ে খেলনা বানানোর মতো৷ প্রোটিনের অনেক অনু আছে যেগুলোকে বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে বিভিন্ন বড় সাইজের প্রোটিন অনু বানানো যায়৷ ঠিক যেমন লেগো’র ক্ষেত্রে ছোট ছোট বিল্ডিং ব্লকগুলো থেকে গাড়ী, ট্রেন, বাড়ী, প্লেন, ব্রীজ এরকম অনেক কিছু বানানো যেতে পারে৷ কোষের ক্ষেত্রে যেটা হয় রাইবোজোম নামে কোষের একটা ছোট প্রিন্টারের মতো মেশিন আছে, যেটা জিন দেখে দেখে ছোট ছোট প্রোটিনের অনুগুলোকে সাজায়, ওরকম সাজিয়ে ইনসুলিনের অনু তৈরী করে৷ একইভাবে হিমোগ্লোবিন, আরও অন্যান্য নানা জিনিষ তৈরী করতে পারে, জিনের ফর্মুলা অনুযায়ী৷ একটা প্রুফ রিডারও আছে, বানানোর পরে যদি দেখা যায় ভুল হয়েছে তখন আবার পুরোটা ভেঙ্গে নতুন করে তৈরী করে৷ চমৎকার নিঃসন্দেহে, তবে মনে রাখতে হবে প্রকৃতি কয়েক বিলিয়ন বছর সময় পেয়েছে এই মেশিনারী উদ্ভাবন করতে৷ এবং প্রকৃতির উদ্ভাবন প্রক্রিয়া কোন ডিজাইন বোর্ড বসিয়ে করা হয় নি৷ বিশাল কোন মহা আবিস্কারকের কাজেরও প্রমান নেই৷ বরং উল্টোটা, প্রকৃতি একটা সহজিয়া পন্থা বের করছে এজন্য, সহজিয়া বুদ্ধির দিক থেকে, যদিও সময়ের বা রিসোর্সের কথা ভাবলে ভীষন ব্যয়বহুল৷ পন্থাটা হলো evolution৷ প্রতিবার random কিছু পরিবর্তন করা হয় আগের ডিজাইনে, তারপর যদি নতুন পরিবর্তিত ডিজাইন আগের চেয়ে পরিবেশের সাথে বেশী খাপ খাওয়াতে পারে (not necessarily it has to be an improvement) তাহলে সেটাকে রেখে দেয়া হবে৷ হয়তো হাজার হাজার ট্রায়াল/এরর এর পরে একটা সুবিধাজনক ডিজাইন পাওয়া যায়৷ এজন্যই প্রকৃতির বিলিয়ন বছর লেগেছে এটুকু আসতে৷ সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রকৃতির যেহেতু লক্ষ্যহীনভাবে random পরিবর্তন করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে, অবধারিতভাবে নানা রকম ভুলভাল ঢুকে পড়ছে ডিজাইনের ভেতরে, এক্ষেত্রে ঐ লাইব্রেরীতে৷ পরিস্থিতি এতদুর গড়িয়েছে যে আগেই যেমন বল্লাম লাইব্রেরীর ৯৫% লেখা আর পাঠযোগ্য নেই, বা পড়তে পারলেও ব্যবহারযোগ্যতা হারিয়েছে৷ এমনকি কার্যকরী যেসব ফর্মুলা আছে সেগুলো শর্ট টার্মে কাজ করলেও, লংটার্মে মঘা ইউনানী দাওয়াই শ্রেনীর৷ যদি কেউ ভুল খুজতে বসে তাহলে আমাদের জিন লাইব্রেরীর প্রতি পাতায় লাল কালির দাগ পড়বে৷ এর ওপর আছে চলমান মিউটেশন, জন্মানোর সময় লাইব্রেরীর যে কপি নিয়ে জন্মেছিলেন, আজকে ৩০ বছর পর বার বার ফটোকপি করতে করতে যেগুলোর অনেকগুলোই ঝাপসা হয়ে গেছে৷ এক পর্যায়ে রাইবোজোম টুকটাক ভুল করা শুরু করবে, কারন অনেক জায়গায় সু্ত্রে হয়তো ভুল ঢুকে পড়েছে৷ দুঃখজনকভাবে ক্যান্সারের কারন হচ্ছে এই ফটোকপি জনিত ভুল (মিউটেশন)৷ বয়স যতো বাড়বে তত এসব ভুল জমতে থাকবে, এবং তত বুড়িয়ে যেতে থাকবো, রোগশোকের কাছে ততটাই vulnerable হয়ে যাবো৷ আবার অনেক সময় মুলসুত্রটাই গোজামিল দেওয়া সুত্র৷ যেমন আমরা যে খাবার খাই তার মধ্যে যত শক্তি থাকে পুরোটা কিন্তু বের করে নিতে পারি না, বলতে গেলে অধিকাংশ অপচয় করে বসি৷ কারন প্রকৃতি তার উদ্ভাবনী ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্য বের করতে পারে নি৷ এরকম আরো উদাহরন আছে, আমাদের রক্তের লোহিত কনিকা অক্সিজেন পরিবহন করে খুব inefficient পদ্ধতিতে৷ যে কারনে শরীরে শক্তি থাকার পরও ট্রান্সপোর্টেশন যানজটে আমরা পুরোটা ব্যবহার করতে পারি না৷ সংক্ষেপে, আমরা কেন হাজার বছর বেচে থাকতে পারি না, তার কারন আমাদের শরীরের ডিজাইনটা অতটা ভালো হয় নি৷ এই সুত্রগুলোর প্রোগ্রামিংটা ঠিক সেরকম ভাবে করা হয় নি৷ এজন্য চল্লিশেই শরীরটা হেলে যেতে থাকে, ষাটে গিয়ে মোটামুটি যুদ্ধ করে বাচতে হয়৷ তবে উপায় আছে, অথবা তৈরী করা হচ্ছে, কয়েকবছর আগে জিনোম প্রজেক্টের সমাপ্তির পর মানুষের পুরো লাইব্রেরী এখন আমাদের হাতের মুঠোয়৷ যদিও পুরো কোডের সবটা এখনও ব্যাখ্যা করা হয় নি৷ আশার কথা হচ্ছে যেসব বাগ আছে এগুলো কিভাবে ফিক্স করা যায় তা নিয়ে তুমুল গবেষনা শুরু হচ্ছে৷ বেশ বড়সড় ফান্ডিং পাওয়া যাচ্ছে এসব কাজের জন্য৷ আমার ধারনা ২০১০ এর দশকে এটা একটা হট সাবজেক্ট হবে ডিগ্রী নেয়ার জন্য৷

মন্তব্য

হিমু এর ছবি
লিখতে লিখতে হঠাৎ থেমে গেলেন মনে হলো। পরের পোস্টে তাহলে আরো চাই।
উৎস এর ছবি
তা ঠিক, সকালে না খেয়ে লিখতে ছিলাম, পানিও খাই নাই। তাই শেষ করে দিলাম। আর তুমি এমএসএন এ গলং গলং করছিলা তাই আরো তাড়াতাড়ি শেষ করলাম।
হিমু এর ছবি
আয়হায় বস করছেন কী! এইখানে কিন্তু কমেন্ট মোছা যায় না!
ভাস্কর এর ছবি
যদিও আমি এই লাইনে আগাইনাই তাও আমার লেইগাই এই লেখার সূত্রপাত হওয়াতে ভালো লাগলো অনেক বেশি...ধন্যবাদ উৎস! ----------------------------------------------------- বরফখচিত দেশ ক্যান এতোদূরে থাকো!

স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

নিঘাত তিথি এর ছবি
আমি মাঝে জোড়ে জোড়ে পড়ি কেন যেন কিছু লেখা। মজা লাগে। এটা শুরুই করলাম সেরকম করে! মিউটেশনকে ফটোকপির উপমায় বলাটা দারুণ লাগলো। "জন্মানোর সময় লাইব্রেরীর যে কপি নিয়ে জন্মেছিলেন, আজকে ৩০ বছর পর বার বার ফটোকপি করতে করতে যেগুলোর অনেকগুলোই ঝাপসা হয়ে গেছে৷" এইটা পড়ে মনটা খারাপ হতে থাকে...বুড়া হওয়া শুরু হয়ে গেছে প্রায়। --তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

উৎস এর ছবি
লিখলাম আর কি। অমর হতে আমারো খুব মন চায়, তবে পিতা হয়ে অমর হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। খালি দুঃখ যে আর ৫০ বছর পরে জন্মালে একটু নিশ্চিত হওয়া যেত।
হযবরল এর ছবি
সিরিজ এবার শেষ করবেন। এর আগে অনেক সিরিজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ধন্যবাদ উৎস।
নিঘাত তিথি এর ছবি
নাহ, অমর হবার অবশ্য কোনই ইচ্ছা নেই। ব্যাপারটা ভীষন একঘেয়ে হতো! --তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

হিমু এর ছবি
একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। ধরে নিই, মানুষের বুড়িয়ে যাবার ব্যাপারটা আরো ধীর হয়ে গেলো। ৬০ বছরের বদলে ১২০ বছরে গিয়ে লোকজন বুড়ো হওয়া শুরু করবে। তবে এ সুযোগ পাবে অল্প কিছু লোক, ধরা যাক লাখে একজন। এই দীর্ঘযুবা প্রথম জেনারেশনের মানুষের মধ্যে কী কী মনোজাগতিক পরিবর্তন আসবে বলে আপনাদের ধারণা?
উৎস এর ছবি
এটা নিয়ে একটা সায়েন্স ফিকশন লেখা যেতে পারে। তবে এরকম পরিবর্তনের উদাহরন আছে। যেমন ৫০/৬০ বছর আগে ৪০ পেরোলেই বুড়ো ধরা যেতো। ৪০ এ নাতি নাতনীও সম্ভব ছিল (যেমন আমার নানার ক্ষেত্রে)। তখন জীবনটাকে মানুষ ওভাবে সাজাতো। যেমন ধরো এখন আমরা নানা রকম প্রজেক্ট হাতে নেই, ধরো এপার্টমেন্ট কিনবো, বা ৩০ বছরের লোন নেবো ইত্যাদি, এই ডিসিশন গুলো ৭০ বছর বয়সে কম লোকই নিবে। কিন্তু যদি তোমার অনুমান থাকে তুমি ২০০ বছর বেচে থাকবে তখন আবার ওরকম ভাবে সিদ্ধান্তগুলো এডজাস্ট হয়ে যাবে। দীর্ঘজীবন বলে কিছু নেই। জীবন যত বড়ই হোক করার মতো কাজের অভাব হয় না।
হিমু এর ছবি
তাহলে একটা প্রোজেক্ট নিলাম। একটা সায়েন্স ফিকশন হয়ে যাক সচলায়তনে।
এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
শুরু হোক হিমু। আর উৎস বস আসেন এট্টু পিঠ চুলকে দেই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।