লাল বিড়ালটা

আয়েশা আখতার এর ছবি
লিখেছেন আয়েশা আখতার (তারিখ: রবি, ১৫/০৫/২০১১ - ৮:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লাল বিড়ালটার দুষ্ট আত্মা আমাকে এখনো সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। কাজটা ঠিক করেছিলাম কিনা জানি না। ঘটনাটির শুরু হয়েছিল এভাবে- আমি আমাদের বাগানে একটি পাথরের স্তূপের ওপর বসে আছি। নেহাত পাথরের স্তূপ বললে ভুল হবে। এটা আসলে যুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত আমাদের বাড়ির অর্ধেকেরও বেশীর ধ্বংসস্তূপ। সেখানে আমরা, অর্থাৎ আমি, মা, ছোট ভাইবোন- পিটার ও লেনি থাকি। আমি যেখানে বসে আছি, তার চারদিকে ঘাস, ঝোঁপঝাড়- সবুজের উকিঝুঁকি। আমার হাতে একটা শক্ত রুটি। মা বলেন বাসি শক্ত রুটি নাকি স্বাস্থ্যকর। আসলে বাসি রুটি বেশিক্ষণ ধরে চিবুতে হয় বলে চিবুতে চিবুতে একসময় ক্ষুধাটাই মরে যায়। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য কথাটা ঠিক নয়। যাই হোক, আমার হাত থেকে কখন যেন রুটিটির একটি টুকরো মাটিতে পড়ে যায়। টুকরোটি তুলতে যাব, এমন সময় ঝোঁপ থেকে হঠাৎই একটি লাল বিড়াল ছুটে এসে ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে চলে যায়। আমি বোকার মত কেবল তাকিয়ে থাকি। ঝোঁপের মধ্যে বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠে - লাল আর শীর্ণকায় বিড়ালটা ঠিক যেন একটা ধূর্ত শেয়াল। "শয়তান"- মুখ দিয়ে শব্দটা বেরিয়ে এল। দ্বিতীয়বার একে দেখার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না, তবে একটা ঢিল না ছোঁড়া পর্যন্ত শান্তও হচ্ছিলাম না। ঢিল ছুঁড়ে চলে আসতে গিয়েও আমাকে আরেকবার থামতে হল। কারণ বিড়ালটার চিৎকার! চিৎকারটা ছিল কোন শিশুর চিৎকারের মত। ব্যাথায় সে কুঁকড়ে গেল- কিন্তু দৌড়াল না, ঝোঁপের বাইরে এল না, খুব দ্রুত নি:শ্বাস নিতে লাগল, ওর পেটের ওপরের লাল চামড়ার দ্রুত ওঠানামা আমি স্পষ্ট দেখছিলাম। আমার কেমন কষ্টও হচ্ছিল, সবুজ জ্বলজ্বলে চোখে সে আমার দিকে শুধু তাকিয়ে ছিল।

"কী চাস?" প্রশ্ন করলাম। পরক্ষণেই মনে হল, মাথা খারাপ হল নাকি, এতো মানুষ নয়, যে কথা বলবে। বিড়ালটার ওপর, নিজের ওপর খুব রাগ হল। আর কোন দিকে না তাকিয়ে রুটির বাকি অংশটাও ছুঁড়ে ফেলে কিছুটা দ্বিধা নিয়ে স্থান ত্যাগ করলাম।

বাগানের সমানের দিকটায় বসে পিটার-লেনি মটরশুঁটি ছিলে কপ্ কপ্ করে মুখে পুরছে। লেনি নিচুস্বরে জানতে চাইল আর রুটি আছে কিনা। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, "আমাকে তোর চেয়ে বেশি রুটি দেয় নি, যদিও আমার বয়স তের, আর তোর নয়। বড় হিসেবে আমারতো বেশিই পাওয়ার কথা।" লেনি বলল,"হ্যাঁ, হয়ত!" পিটার সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন কাটল,"বিড়ালটাকেও রুটি দিতে হয়েছে কিনা, তাই বড় টুকরা দরকার ছিল।"
"কোন বিড়ালকে?"- আমি অবাক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম।
"আহা!" লেনি বলল, "ঐখানে একটা শেয়ালের মত লাল বিড়াল দেখলাম যে, কী বিশ্রীরকম শুকনা দেখতে; রুটি খাওয়ার সময় সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে।"
"পাগল নাকি! আমরা নিজেরাই খেতে পাই না, আবার বিড়ালকে - ।" রেগে গিয়ে বললাম। লেনি ঘাড় নাচিয়ে শুধু পিটারের দিকে এক ঝলক তাকাল। আমি নিশ্চিত পিটারও লাল মাথাটাকে ওর রুটিটা দিয়েছে- এতে রাগ আরো দ্বিগুণ হল। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেলাম।

রাস্তায় উঠতেই দেখি, সেখানে একটা বড় আমেরিকান লরি দাঁড়িয়ে আছে। লরি চালক ইংরেজিতে জানতে চাইল, টাউন হলটা কোন দিকে। আমি একটু আধটু ইংরেজি পারি। বললাম, "সামনে গিয়ে বাঁয়ে, তারপর- ", 'সোজাসুজি ' ইংরেজিতে কীভাবে বলে জানি না, তাই ইশারায় দেখিয়ে দিলাম। লোকটা বুঝতে পারল। শেষে বললাম, "এরপর চার্চের পেছনে বাজার, তার পাশেই টাউনহল।" আমেরিকান ভদ্রলোককে ভাল লাগল। লরির ভেতর থেকে একজন ভদ্রমহিলা আমাকে সাদা ধবধরে কয়েক টুকরো রুটি এগিয়ে দিল। রুটিগুলো হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম ভিতরে সসেজ আছে, তারপর একদৌড়ে বাড়িতে- । রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখি ছোট দুজন সোফার নিচে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। হ্যাঁ, সেই লাল বিড়ালটা। ঘরের মেঝেতে একটু দুধ পড়ে আছে - বুঝতে বাকি রইল না, কী ঘটেছে।
"তোরা কি পাগল হয়ে গেলি, মাত্র আধা লিটার দুধ, তাও আবার চারজনের জন্যে-" চিৎকার করে উঠলাম। মেঝে থেকে বিড়ালটাকে তুলে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেললাম। ওরা কোন কথা বলল না। তারপর আমেরিকানদের দেওয়া সাদা রুটি চারভাগ করে একভাগ মার জন্যে ফ্রিজে তুলে রাখলাম।
"রুটি কোথায় পেয়েছিস?"- মা জিজ্ঞেস করে ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকালেন।
"চুরি করেছি।" - বলে আর দাঁড়ালাম না।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম কোন কয়লার গাড়ি যায় কিনা। কয়লার গাড়ি যাওয়ার সময় মাঝপথে রাস্তায় কয়লা পড়ে থাকে। বাগানের সামনে আবার লাল বিড়ালটার সঙ্গে দেখা। বেহায়ার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে গিয়ে মাটিতে পা ঠুকে বললাম, "যা ভাগ!" সে নড়ল না। কেবল ছোট মুখটা খুলল, "মিয়াঁও।" অন্যসব বিড়ালের মত চিৎকার করল না। এমন সহজ ভঙ্গিতে বলল যে, আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবো না। সে সবুজ চোখে স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে আমেরিকানদের দেওয়া রুটির একটু অংশ ছিঁড়ে তার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। কোন রকমে নিজেকে সামলে রাস্তায় উঠলাম। আরো দুইজন ইতোমধ্যে কয়লার খোঁজে সেখানে উপস্থিত। অপেক্ষাকৃত বড়জনের ঝুড়ি কয়লায় প্রায় ভরে গেছে। একদলা থুতু ফেললাম। বিড়ালটা না থাকলে আমিই হয়তো সবগুলো কুড়োতাম। এগুলো দিয়ে সন্ধ্যার খাবার অনায়াসে রান্না হতো। কিছুক্ষণ পর একটা আলুভর্তি লরির সাক্ষাৎ পেলাম। আলুগুলোতে একটু ধাক্কা দিতেই কিছু আলু গড়িয়ে নিচে পড়ল। আমি ব্যাগে আর টুপির নিচে আলুগুলো তুলে লুকিয়ে ফেললাম। গাড়ির লোকটি আমার দিকে তাকাতেই বললাম, "আপনাদের আলু পড়ে যাচ্ছে।" বাড়ি ফিরে দেখি মা একা বসে আছেন, কোলে লাল বিড়ালটা।
"আবার সেই উৎপাত!"- অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে বললাম।
"লাল রংটা এমন কিছু উৎকট নয়," মা বললেন, "বিড়ালটার কেউ নেই, কতদিন না খেয়ে আছে, কে জানে, .. দেখ শুকিয়ে কেমন হাড্ডিসার হয়ে গেছে।"
"আমরাও হাড্ডিসার হচ্ছি!" - আমি আরো রেগে গিয়ে বললাম।
মা বললেন, "আমি আমার রুটি থেকে একটু দিয়েছি।" বলে আমার দিকে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি সারাক্ষণ আমাদের রুটি আর দুধের কথা ভাবছি, এদিকে মা - ... আর কথা বাড়ালাম না। লুকিয়ে আনা আলুগুলো আমরা রান্না করলাম। মা খুব খুশি হলেন। আলুগুলো কোথায় পেয়েছি, জানতে চাইলেন না। এরপর কালো কফি খেত খেতে মা বিড়ালের দুধে চুমুক দেওয়া দেখছিলেন। দুধ শেষ হলে বিড়ালটা জানালা দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি জানালাটা বন্ধ করে ঠিকমত নি:শ্বাস নিলাম।

সকাল ছয়টায় সবজি আনতে ছুটলাম, ফিরলাম আটটায়। টেবিলে ছোটরা সকালের নাস্তা সারছে, লাল বিড়ালটা লেনির পাশের চেয়ারে বসে পিরিচের আশেপাশে পড়ে থাকা রুটির টুকরো খাচ্ছে। কয়েক মিনিট পরেই মা ফিরলেন। সকাল সাড়ে সাতটায় মা মুচির কাছে গিয়েছিলেন। মাকে দেখতেই বিড়ালটা পায়ের কাছে লাফ দিয়ে পড়ল। মা একটু সসেজ ফেললেন। ধূসর রঙের সেই সসেজটা এমন বিশেষ কিছু না। কিন্তু এই সসেজটাই রুটিতে পুরে খেতে মজা লাগতো, মাও এটা জানতেন। কোনরকমে রাগ সামলে টুপি নিয়ে পুরনো সাইকেলটা চালিয়ে শহরের দিকে ছুটলাম। পথে একটা ছোট পুকুর পড়ে, ভাগ্য ভাল থাকলে এখানে মাছ পাওয়া যায়। আমার বড়শী নেই, কিন্তু দুটি তীক্ষ্ণফলাযুক্ত একটি লাঠি আছে। সেইটা নিয়েই মাছ শিকারে নামলাম। দুইটা মাছও পেয়ে গেলাম, শুভদিনই বলতে হবে। তখনও দশটা বাজে নি, এর মধ্যে চমৎকার দুইটা প্রাণী, দুপুরের খাবার হিসেবে যথেষ্ট। যতটা সম্ভব দ্রুত মাছদুটো নিয়ে সোজা বাড়িতে ফিরলাম। রান্নাঘরে টেবিলের উপর মাছদুটো রেখে মাকে ডাকতে ভাঁড়ার ঘরে গেলাম। মাকে নিয়ে ফিরে দেখি, অপেক্ষাকৃত ছোট মাছটা টেবিলে পড়ে আছে। জানালার পাশে বিড়ালটা, মাছের শেষ অংশটা চিবুচ্ছে। এতটাই ক্ষেপে গেলাম যে, হাতের কাছে থাকা কাঠের টুকরোটা তার দিকে জোরে ছুঁড়ে মারলাম। বিড়ালটা টাল সামলাতে না পেরে বাগানের মধ্যে ঝুপ করে পড়ে গেল। "উচিত হয়েছে!" বললাম। মা তৎক্ষণাৎ ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় কষালেন। আমি তখন তের, গত পাঁচ বছরে এমন কোন ঘটনা ঘটে নি। মা অত্যন্ত রেগে চিৎকার করে উঠলেন, "অমানুষ!" স্থান ত্যাগ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। দুপুরে মাছের সালাদ পরিবেশন করা হল, যদিও এতে আলুর পরিমাণই বেশি ছিল।

যেভাবেই হোক আমরা বিড়ালটাকে হারালাম। বাড়ির কেউই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না। ছোটরা বাগানে ডেকে ডেকে বিড়ালটার খোঁজ করত। মা প্রতি সন্ধ্যায় দুধসহ একটা ছোট বাটি দরজার পাশে রেখে দিতেন এবং বিড়ালটার অপেক্ষায় থাকতেন। আমার দিকে তাকাতেন রাগান্বিত দৃষ্টিতে। আমি নিজেও একসময় প্রতিটি কোণে কোণে তার সন্ধান করতে লাগলাম। হতে পারে কোথাও অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কিংবা মরেও থাকতে পারে। তিনদিন পর বিড়ালটি ফিরে এল। ডান পায়ে একটা ক্ষত নিয়ে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। আমার ছোঁড়া কাঠের টুকরোই এর জন্য দায়ী। মা পরম যত্নে তার পাটা বেঁধে দিলেন, সেই সঙ্গে খেতেও দিলেন। এরপর থেকে আবার তার আনাগোনা শুরু হল। খাওয়ার সময় হলেই সে উপস্থিত, এক দৃষ্টিতে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যে, তাকে খাবার না দিয়ে থাকা সম্ভব না। তার কাছ থেকে কোন খাবার লুকানোও সম্ভব ছিল না। সবাই তাকে যা চাইত তা-ই দিতো, এমনকি আমিও, যদিও আনন্দচিত্তে নয়। দিনে দিনে সে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠল, তাকে সুন্দরই লাগতো।

৪৬- এর পর ৪৭- এর শীতকাল উপস্থিত। এসময় আমাদের খাবার মিলে খুব কম। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোন মাংস বা আলুর দেখা নেই। কাপড়গুলো কোনরকম গায়ে এঁটে ছিল। ক্ষুধায় কাতর হয়ে লেনি একবার বেকারি থেকে রুটি চুরি করে। এটা শুধু আমি জানতাম। ফেব্রুয়ারির শুরুতে মাকে একদিন বললাম, "চল এটাকে জবাই করি।" "কোনটাকে?" বলেই মা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। "বিড়ালটাকে।" বলে তাই করতে উদ্যত হলাম। এর প্রতিক্রিয়ায় কী ঘটতে পারে তাও আমি জানতাম। বলতে গেলে সবাই আমাকে একসঙ্গে আক্রমণ করল। "কী! আমাদের বিড়াল? তোমার একটুও কষ্ট লাগল না!" "না" আমি বললাম, "সেতো আমাদের খাবার খেয়েই মোটাতাজা হয়েছে, এখনও কচি, ক্ষতি কী? "
লেনি কাঁদতে শুরু করল, পিটার টেবিলের তলা দিয়ে আমাকে লাথি ছুঁড়লো। মা খুব করুণস্বরে বললেন, "তুমি এত নিষ্ঠুর, আমি ভাবতে পারছি না।" বিড়ালটা চুলার পাশে বসে ছিল এবং একসময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। সে সত্যিই খুব অলস ছিল, খুব কমই বাড়ি থেকে শিকারে বের হত।

আমাদের এখন কী খাওয়া উচিত বুঝতে পারছিলাম না। একদিন আমি একরকম উন্মাদ হয়ে গেলাম, বিড়ালটাকে সামনে রেখে বললাম, "শোন্, আমাদের খাওয়ার মত কিছু নেই দেখছিস্ না?" - সঙ্গে সঙ্গে রুটির খালি পাত্র, আলুর খালি ঝুড়িটাও দেখাই।
যে-ই না তাকে বললাম, "ভাগ এখান থেকে! দেখছিস্ না আমাদের অবস্থা?" অমনি মাথা নাড়িয়ে যথারীতি চুলার উপরে জবুথবু হয়ে পড়ে রইল। রাগে কষ্টে আমার কান্না পেল। টেবিলের উপর জোরে একটা চাপড় দিলাম। তাতে সে কোন ভ্রূক্ষেপ করল না। এরপর একটা ঝোলার মধ্যে বিড়ালটাকে পুরে বগলদাবা করে বের হলাম। বাইরে তখন কিছুটা অন্ধকার। ছোটরা মার সঙ্গে কয়লার খোঁজে রেললাইনের ধারে গেছে। লাল রঙের এই জন্তুটা এতটাই অলস যে, ঝোলায় পোরার সময় কোন প্রতিবাদ করল না। আমি পায়ে হেঁটে চললাম। পরিচিত একজন ভদ্রলোক আমাকে দেখে বিড়ালটা বিক্রি করবো কিনা জানতে চাইলেন। আমি খুশি হয়েই বললাম,"হ্যাঁ।" জবাবে সে শুধু হেসে চলে গেল। একসময় নদীর তীরে এসে থামলাম। ঝড়ো হাওয়া, কুয়াশা আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা! বিড়ালটি আমার গা ঘেঁষে উষ্ণতা খুঁজছিল। আমি তাকে একটা ঘুষি দিয়ে বললাম,"এভাবে চলতে পারে না। আমার ভাইবোন না খেয়ে আছে, আর তুমি কিনা দিন দিন মোটাতাজা হচ্ছো, এটা সহ্য করা যায় না!" একটা চিৎকার দিয়ে বিড়ালটাকে গাছের গুঁড়িতে সমস্ত জোর দিয়ে আছাড় দিলাম, তারপর আছড়াতে লাগলাম। সে আর্তনাদ করতে থাকল। তখনও সে মরে নি, বরফের একটা চাক তুলে ঝোলার উপর আঘাত করলাম। সেখান থেকে একটুকরো বরফ ছিটকে তার মাথায় বিঁধলো এবং তুষারশুভ্র জায়গাটি রক্তবর্ণ ধারণ করল। বিড়ালটি শিশুর মত আর্তনাদ করতে লাগল। আমি হয়তো তখনই থামতাম, কিন্তু কাজটা আমাকে শেষ করতে হবে। বরফের চাকের উপর ওকে ক্রমাগত আছড়াতে লাগলাম। একসময় কড়মড় শব্দ হল, জানিনা সেটা বরফের চাক নাকি বিড়ালটার হাড় ভাঙ্গার শব্দ। লোকে বলে যে, বিড়ালের নাকি সাতটা জীবন। কিন্তু এর মনে হয় তারও বেশি। প্রতিটি আঘাতে সে তীব্র চিৎকার করতে লাগলো, একবার আমিও - । প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে ঘামে ভিজে গেলাম। একসময় বিড়ালটির মৃত্যু হলো, নদীতে ছুঁড়ে ফেলে বরফকুঁচি দিয়ে হাত ধুলাম। একবার বিড়ালটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ভাসতে ভাসতে সে বরফের তলায় কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। কিছুক্ষণ শহরে হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ফিরলাম। "কী হয়েছে? এমন বিবর্ণ দেখাচ্ছে কেন? জ্যাকেটে কীসের রক্ত?" - মা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন। আমি শুধু বললাম, "নাক থেকে রক্ত ঝরেছে।" মা আমার দিকে আর না তাকিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে লবঙ্গ দিয়ে চা করে আনলেন। একটু পর শরীর খারাপ লাগলো, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। মা আসলেন, নরম স্বরে বললেন, "আমি বুঝতে পেরেছি। ঘটনাটা ভুলে যাও।" পরে গভীর রাত পর্যন্ত বালিশের তলা থেকে লেনি আর পিটারের ফোঁপানির শব্দ আমার কানে ভেসে আসে। বিড়ালটাকে এভাবে হত্যা করে ঠিক করেছিলাম কিনা, আমি জানি না। এতটুকু একটা পশু এমন কী-ই বা খায়!

লুইযে রিনযার(১৯১১-২০০২) এর ছোটগল্প Die rote Katze(১৯৪৮), মূল জার্মান থেকে অনূদিত।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ লাগলো...
বেড়ালটার জন্য একটু মায়াও রহিয়া গেলো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আয়েশা আখতার এর ছবি

হাসি

হাসিব এর ছবি

অনুবাদ ভালৈছে। তবে আমার মনে এই জাতীয় গল্পের প্রেক্ষাপটটা গল্পের শুরুতে দিয়ে দিলে পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হয়।

আয়েশা আখতার এর ছবি

এই গল্পটার প্রেক্ষাপট ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানী। গল্পে উল্লেখিত সাল থেকেই সেটা অনুমান করা যায় হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এক নম্বর কথা হলো, 'বাংলা বানানরীতি আলোচনা'র পরবর্তী পর্বগুলো কবে পাওয়া যাবে?

দুই নাম্বার কথা হলো, অ্যাতো লম্বা সময় ডুব দিলে কীভাবে চলে!

তিন নাম্বার কথা হলো, অনুবাদ ভালো লেগেছে, চালিয়ে যান। আমাদের অনেকের মতো অনুবাদের অনুবাদ করার চেয়ে এটা ভালো উদ্যোগ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আয়েশা আখতার এর ছবি

খুব ব‌্যস্ততার কারণে কাজটা আর এগুতে পারিনি। এখন আবার প্রবাসে নতুন ব্যস্ততা। পরের পর্ব কবে আসবে বলতে পারছি না। তবে অনুবাদ চালিয়ে যেতে চাই।

ধন্যবাদ

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

মর্মভেদী গল্প, সাবলীল অনুবাদ! নির্মমতার মধ্যদিয়েও যে কি চমৎকার করে মমতার কথা বলা যায়, ভেবে বিস্ময়াভিভূত হই!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আয়েশা আখতার এর ছবি

ধন্যবাদ

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আরে এটা তো আমার জীবনের গল্প। বিড়াল নিয়ে আমারো একটা মর্মান্তিক ঘটনা আছে। কান পাতলে সেই বেড়াল ছানার কান্না মাঝে মাঝে কানে বাজে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

চমৎকার একটি গল্প। অনুবাদ খুব ভালো লাগলো।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

ভাল লাগল অনুবাদ হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।