ঘূর্ণিঝড় এবং সাংবাদিকের ক্ষয়ে যাওয়া চোখ...

বিপ্লব রহমান এর ছবি
লিখেছেন বিপ্লব রহমান (তারিখ: রবি, ২৫/১১/২০০৭ - ২:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.
সহকর্মি সঞ্জয় দে পটুয়াখালির বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে গত কয়েকদিন ধরে পাঠাচ্ছেন ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার তাজা খবর। মর্মস্পর্শী সেই সব খবর পড়ে মাথা স্থির রাখা সত্যিই কঠিন। কিছুক্ষণ আগে মোবাইল টেলিফোনে কথা হচ্ছিলো তাঁর সঙ্গে।

তিনি বললেন, বিপ্লব দা, মানুষের কাছ থেকে মৃত্যূর খবর, ঘর ভাঙার খবর, আর অনাহারের খবর শুনতে শুনতে কোনটাকেই এখন আর খবর মনে হয় না। ধ্বংস যজ্ঞ আর লাশ দেখতে দেখতে আমার চোখ এখন ক্ষয়ে গেছে! অফিসকে বলেছি, দক্ষিনাঞ্চলে নতুন কাউকে পাঠাতে, যে নতুন চোখ দিয়ে উপদ্রুত এলাকার নতুন নতুন খবর লিখবে!

*

সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার মনে পড়ে যায় আরো এক ঘূর্ণিঝড়ের কথা। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, এই খবরে পরদিনই সকালে নোয়াখালি চলে যাই সরেজমিন সংবাদ সংগ্রহ করতে। সেখানে গিয়ে শুনতে পাই, ঘটনাস্থল আরও দুর্গম এলাকায়, লক্ষ্মীপুরের চরাঞ্চলে। একরাতের কয়েক ঘন্টায় বদলে গেছে পুরো নোয়াখালির চিত্র। বিদ্যুত, টেলিফোনের লাইন লণ্ডভণ্ড। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বসে গেছে। উপড়ে পড়েছে গাছপালা। মানুষ ও গবাদী পশুর ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কতো, কেউ বলতে পারছে না।

সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। মোবাইল টেলিফোন এতোটা সহজলভ্য হয়নি। তো পুলিশ - বিডিআর এর ওয়্যারলেস সেটই ভরসা করে প্রশসন নোয়াখালির একটা মোটামুটি চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারি, ঘূর্ণিঝড় যে সব চরাঞ্চলে আঘাত হেনেছে, তার কোনো একটিতে না পৌঁছালে ঘটনার ভয়াবহতা বোঝা যাবে না।

অবিরাম ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সহায়তায় লক্ষ্মীপুর পৌঁছাই। সেখানে রেস্ট হাউজে দেখা হয় মন্ত্রী আসম আব্দুর রব। তিনি নিশ্চিত করেন, ঢাকা থেকে এক জাহাজ ভর্তি ত্রাণ এসে লক্ষ্মীপুর পৌঁছেছে, দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রীর কোনো অভাব হবে না, বৃষ্টি থামলেই ত্রাণ দেওয়া শুরু হবে -- ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি আবার ঢাকার সাংবাদিককে না খাইয়ে ছাড়বেন না!

যথারীতি দুপুরে খাবারের পাতে পড়ে থালা উপচানো বিশাল আকৃতির মাছ। খাসি, গরু, মুরগি, শাক - সব্জি, ভর্তা -- এ সব তো আছেই। সব শেষে আসে মোষের দুধের তৈরি মিষ্টি দই। অর্থের কি মারাতœক অপচয়! সব কিছু দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কোনো রকমে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচি।

*

দুর্গত এলাকার তথ্য সংগ্রহ করতে লক্ষ্মীপুর থানায় যাই। সেখান থেকে খবর পাই, ঘূর্ণিঝড় যে সব চরাঞ্চলে আঘাত হেনেছে, তার সবচেয়ে কাছের চর হচ্ছে চরগজারিয়া। দ্রুত সংবাদ সংগ্রহের স্বার্থে আমি সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু উত্তাল নদীতে সব ধরণের নৌকা চলাচল বন্ধ। তাহলে উপায়? থানার ওসিকে অনুরোধ করে একটি পুলিশের ট্রলার চেয়ে নেই। তেলের খরচটুকু শুধু আমি দেবো।

নদীর তীরে পুলিশের নীল রঙের ছোট্ট ট্রলারের কাছে পৌঁছে পাই আরেক বাধা। উথাল - পাতাল ঢেউ দেখে মাঝি কিছুতেই ট্রলার ছাড়তে রাজি নয়। বাড়তি বখশিসের লোভ দেখিয়ে কাজ হয়। বর্ষাতিতে পুরো শরীর মুড়ে ছই বিহীন ট্রলারের এক কোনো শক্ত হয়ে বসি। প্রতি মুহূর্তে ট্রলার ডুবির আশঙ্কা। আমি আবার সাঁতার জানি না; সে জন্য অবশ্য দুঃখ হচ্ছিলো না। কারণ এই পাগলপাড়া নদীতে ডুবলে সাঁতার জেনেও লাভ হবে না। স্রেফ লাশ হয়ে কোনো এক অজ্ঞাত চরে ভেসে ওঠা যেতে পারে!

মাঝ নদীতে চোখে পড়ে মন্ত্রীর কথিত ত্রাণ ভর্তি সাদা রঙের জাহাজ নোঙর করা রয়েছে। আর মাঝে মাঝেই নদীতে ভাসতে দেখা যায় মরে - পঁচে ফুলে উঠা অসংখ্য গরু - ছাগলের মরদেহ।

সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় ট্রলার থামে চর গজারিয়ায়। পাড়ে ছাতা মাথায়, টর্চ হাতে রেড ক্রিসেন্টের হলুদ জ্যাকেট পড়া একজন মাঝ বয়সী সেচ্ছা সেবকের দেখা মেলে। তাকে ঘিরে দুর্গত মানুষের ছোট খাট একটি জটলা। পেশাগত পরিচয় দিতে হতাশ হন স্বেচ্ছা সেবক। নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, ট্রলারের শব্দে তারা ভেবেছেন, এটি বোধহয় ত্রাণের কোনো ট্রলার!

*

সেই স্বেচ্ছা সেবকের সহায়তায় পৌঁছানো যায় কাছের একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে। বৃষ্টির হাত থেকে মাথাটুকু বাঁচাতে সেখানে ঘরবাড়ি, সাহায় - সম্বল হারা কয়েকশ দুর্গত মানুষ পোকামাকড়ের মতো গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে অসাড় হয়ে শুয়ে - বসে থাকা নারী- পুরুষ- শিশু, ঘন অন্ধকারের ভেতর দু - একটি কুপি বাতির টিমটিমে আলো, ঝাঁক ঝাঁক মশার উৎপাত আর বাইরে এক ঘেয়ে বিষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোথাও যেনো কিছু নেই।...

আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষের গাদগাদির মধ্যেই একটি ছোট খাটের এক কোনায় স্বেচ্ছা সেবকের রেডিও (ওয়্যার লেস) বসানো। জানতে পারি, এই রকম রেডিও আশেপাশের চরের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে একটি করে রয়েছে। এরই মাধ্যমে যোগাযোগ করে স্বেচ্ছা সেবক জানতে পেরেছেন, চরগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের রাতে জলোচ্ছাসে অন্তত চার হাজার মানুষ ভেসে গেছেন! প্রতিদিন শত শত মানুষের লাশ এখানে সেখানে ভেসে উঠছে। চরগজারিয়াতেই মারা গেছেন অন্তত দুশ মানুষ। নিখোঁজ আরো কয়েকশ। আর এখানে যারা আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের অনেকরই পরিবারের কেউ না কেউ মারা গেছে!

আমি ঘটনার ভয়াবহতা দেখে মনে মনে চমকাই। রাতের খাবার হিসেবে ওই স্বেচ্ছা সেবকের দেওয়া টিনের থালায় একমুঠো মুড়ি আর এক ডেলা গুড় জোটে। কিন্তু আমাকে ঘিরে বসা উদম শরীরের এক দল বুভুক্ষু শিশুর সামনে সেই খাবার গলা দিয়ে নামে না। আমি টিনের থালাটি ওদের দিয়ে দেই। আধা গ্লাস টিউবয়েলের পানি খেয়ে খাটের এক কোনো বসে ঝিমিয়ে রাতটুকু কোনো রকমে পার করে দেই।

ভোরে আমি নোট করতে থাকি থাকি স্বেচ্ছা সেবকের ভাষ্য, দুর্গতদের আহাজারী, জলোচ্ছাসে ভেসে স্বজন হারানো আরও কয়েকজনের কথন। ছোট্ট অটোমেটিক ক্যামেরায় কয়েকটি ছবি তুলি।

এখনো মনে পড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আলাপ হওয়া নাম বিস্তৃত অল্প বয়সী এক মাঝির মুখ। বৃদ্ধ বাবা, স্ত্রী আর দুই শিশু সন্তানকে হারিয়ে তিনি তখন পাগলপ্রায় । চরগজারিয়ার কোনো মানুষই বিশ্বাস করেননি, ওই দিন রাতে ঘূর্ণিঝড় হবে। তাছাড়া গরু - বাছুর, ঘর - বাড়ির মায়ায় কেউ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রেই যাননি!

জলচ্ছাসের কবল থেকে বাঁচতে ওই রাতে সেই মাঝি পরিবার - পরিজন নিয়ে উঠেছিলেন বাড়ির পাশের এক আম গাছে। কিন্তু ঝড় থেমে গেলে দেখেন তিনি একাই বেঁচে আছেন। পরে তার স্ত্রীর লাশ নদীতে ভেসে উঠলেও বাবা আর দুই সন্তানের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। এই সবের সঙ্গে বাড়তি উপসর্গ হিসেবে এখন যোগ হয়েছে অনাহার।...

*

আবারো বৃষ্টির ভেতর উত্তাল নদী ভেঙে আমি ফিরে আসি লক্ষ্মীপুরে। আবারো সেই থানা। পুলিশের একটি জীপ ফেনীর দিকে যাচ্ছে শুনে তাতে চেপে বসি। পুরো পথ জুড়ে শুধু ধ্বংস যজ্ঞের নির্মম চিহ্ন। কোথাও নেই বিদ্যুত ও টেলিফোন সংযোগ। ফেনীতে পৌঁছে দেখি একই অবস্থা। তবু একটি ফোন - ফ্যাক্সের দোকানে বসে কাগজ - কলম নিয়ে দ্রুত আমি নিউজ লিখতে বসে যাই। ওই দোকানীই আমাকে খবর দেয়, কি ভাবে যেনো কাছের একটি পেট্রোল পাম্পে এখনো সচল আছে একটি টেলিফোন!

আমি বৃষ্টির কবল থেকে নিউজটিকে রক্ষা করতে প্লাস্টিকের শিটে মুড়িয়ে ছুটে যাই সেই দোকানে। তখনকার কর্মস্থল দৈনিক আজকের কাগজে অনেক কষ্টে পেয়ে যাই এনালগ টেলিফোন লাইন। যে কোনো মূহুর্তে লাইন কেটে গেলে আর সংযোগ না পাওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবে অফিসকে রিং ব্যাক করতে বলি না। একজন সহকর্মিকে পুরো সংবাদটি পড়ে শোনাই। সে খবরটি নোট করে নেয়।

ওই বিকালেই আমি একটি হোটেলে সামান্য ভাত খেয়ে ঢাকার বাসে চেপে বসি। একরাত একদিন পরে সেটিই ছিলো প্রথম কিছু খাওয়া।

পরদিন আট কলামে ব্যানার লিড নিউজ ছাপা হয় আজকের কাগজে: লক্ষ্মীপুরে মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে ত্রাণ বিতরণ হয়নি!

ওই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এক জাহাজ ভর্তি ত্রাণ সামগ্রী থাকা সত্বেও মন্ত্রী আসম আব্দুর রব ঝড়- বৃষ্টির অজুহাতে দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেননি। এ কারণে তার নির্বাচনী এলাকার হাজার হাজার দুর্গত দুদিন ধরে অনাহার - অর্ধাহারে আছে।

সংবাদটি ছাপা হওয়ার দিনই সকাল থেকে মন্ত্রীর সাঙ্গপাঙ্গরা ঢাকা থেকে অফিসে টেলিফোনের পর টেলিফোন করতে থাকে এই খবরের প্রতিবাদ ছাপার জন্য। আমি ততক্ষণে প্রমান হিসেবে ত্রাণভর্তি জাহাজের ফটো বার্তা সম্পাদক আবু বকর চৌধুরীর টেবিলে জমা দিয়েছি; ওই ছবিতে এক কোনায় অটোমেটিক ক্যামেরার তারিখও প্রিন্ট করা আছে।

বার্তা সম্পাদকের উৎসাহে বসে যাই ফলো আপ নিউজ লিখতে। পরদিন আবারও ছাপা হয় দুটি সরেজমিন প্রতিবেদন (এবার ছবিসহ)। একটি বলা হয়, দুর্গত মানুষের ত্রাণ সামগ্রীর প্রয়োজনীয়তার কথা। আরেকটিতে তুলে ধরা হয় সেই মাঝির করুণ কাহিনী।...

ছবি: সিডর, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম।


মন্তব্য

সবজান্তা এর ছবি

যায় যদি যাক প্রাণ , হীরকের রাজা ভগবান। দেঁতো হাসি
-------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বৃষ্টির মধ্যে টিভি ক্যামেরায় ছবি ভালো আসবে না যে!
আচ্ছা, সঞ্জয় কি গলাচিপার?

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

মন-খারাপ-করা পোস্ট আর না দিলেই কি নয়?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

বিপ্লব রহমান এর ছবি

সবজান্তা ভাই,
যথার্থই বলেছেন!

বলাইদা,
সঞ্জয় দের বাড়ি গলাচিপাতেই।

সন্ন্যাসী দা,
উপায় নাই গোলাম হোসেন।।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অমিত আহমেদ এর ছবি

মন্তব্যহীণ!


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।