কাফকার মেটামরফোসিস ও আমার বন্ধু আরিফ

বইখাতা এর ছবি
লিখেছেন বইখাতা (তারিখ: শুক্র, ০৯/০৭/২০১০ - ১২:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আচানক আমাদের আরিফকে কাফকায় পেলো। বলা ভালো কাফকার মেটামরফোসিসে পেল। এটা ছিল এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। অবিশ্বাস্যও বটে! কেননা আরিফ বইটার, মানে মেটামরফোসিসের কথা বলছি, শেষ পাতা পর্যন্ত যেতে পারবে এটা কে ভাবতে পেরেছিল! আমরা যারা আরিফকে চিনি তারা কেউই এটা ভাবিনি। বইটা ও কার বাসা থেকে, আড্ডার কোন ফাঁকে নিজের ব্যাগে পুরে ফেললো এটাই তো কেউ খেয়াল করেনি। তবে বইটা ওকে নাড়াচাড়া করতে দেখা গেছে এটা দু'তিনজন বলেছে। কাফকা হাতে আরিফকে দেখে মজা করার লোভ সামলাতে পারেনি কেউ কেউ। কিন্তু ...তাই বলে এতটা!......কীভাবে সম্ভব! তাহলে সেই পড়তে শেখার পর থেকে ঠাকুরমার ঝুলি দিয়ে শুরু করে ক্রমে ক্রমে মানিক, বিভূতিভূষণ, ইলিয়াস, কামু, কাফকা, মার্কেস, বোর্হেস কী আরো সব নামকরা দেশী বিদেশী লেখক সাহিত্যিকের লেখা পড়ে কতটা কী অনুভব করলাম! আর আচানক একদিন মেটামরফোসিস পড়ে আরিফ কী এমন হাতিঘোড়া বুঝলো যে নিজেকেই চরম দুর্বোধ্য বানিয়ে ফেললো! এটা ছিল আমাদের সবার জন্যই একটা বড় আঘাত।

ঘটনা তেমন বড় নয়। এক লাইনেই শেষ করে দেয়া যায়। নেহাতই সাদামাটা, এমনকি স্তব্ধ জলে হালকা কাঠ ফেলা ঢেউয়ের মতো আলোড়নও তুলবে না কারো মনে। তবে তার আগে আরিফের কথা কিছু না বললেই নয়।

আরিফ চিরসুখী মানুষ, দুঃখকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়ার আশ্চর্য এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে সে। সবুজ বনের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে গান গেয়ে উড়ে যাওয়া রঙবেরঙের পাখির মতো নিশ্চিন্ত সুখী একটা মন আছে ওর; যে মন ভারাক্রান্ত হয়না কোনো দুর্বিপাকে, কোনো দুঃসময়ে। কী করে এমন হওয়া যায় বহুবছর ধরে চেষ্টা করেও শিখতে পারিনি আমরা বন্ধুদের কেউ।

আরিফ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ওর সাথে আমার পরিচয়ের ঘটনাটা বলি।

নিতান্তই নগণ্য, অখ্যাত এক স্কুলের মাঠ। যেটা নাকি সব্জিক্ষেত হয়ে যায় সময়ে সময়ে, পানি জমে ছোটোখাটো এক জল ডুব্ ডুব্ পুকুর হয়ে যায় সময়ে সময়ে; সেইখানে পড়ে পড়ে বেদম মার খাচ্ছি বড় ক্লাসের কিছু ছেলের হাতে। হাতাহাতি মারামারি। জনাচারেক গায়েগতরে বড় ওই বড়ভাইদের একা একা আর কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবো। অপরাধ গুরুতর। বদরাগী হেডস্যারকে জেরার মুখে বলে দিয়েছি ঠিক কে কে নিয়মিত বিড়ি ফুঁকতে যায় নড়বড়ে স্কুলঘরের পিছনের ঝোপটায়। সে কী মার। আমাদের থেকে সামান্য কিছু দূরে দাঁড়িয়ে একসারি ক্ষুদ্র উৎসুক দর্শক। আমার ক্লাসের, আরো ছোট ক্লাসের ছেলেরা সব। কেউ এগিয়ে আসছে না সাহস করে। মার খেতে খেতেই দেখতে পেলাম চিঁ চিঁ করে অতিচিকন কণ্ঠে 'ওকে এত মারছো কেন, এত মারছো কেন'..বলে বোকার মত সবার ওপর আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপিয়ে পড়লো একটা কাঠির মতো রোগাপটকা ছেলে। বলাবাহুল্য, তাকেও বেদম মার খেতে হলো আমার সাথে। এই ছেলেটাই আরিফ। ওইদিনই ছিলো স্কুলে ওর প্রথম দিন। নতুন ভর্তি হয়েছে আমাদের স্কুলে। তো মার টার খেয়ে মাঠের উপর গা মেলে দিয়ে আমি হাঁপাচ্ছি আর সমানে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছি, দেখি ছেলেটা হাত ধরেছে আমার। গাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। ঠোঁট কাটা। কাটা ঠোঁটে নরম হাসি। এইরকম রক্তারক্তি মারামারির পরেও যে কেউ এমন সরল হাসতে পারে, কান্না থামিয়ে সেটাই দেখছি। এই রক্তমাখা হাসিমুখ ছেলেটা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে গেল। রক্তেই বন্ধুত্বের সূচনা। ঠিক করেছিলাম যেখানেই থাকি, যেমন থাকি আমরা দুই বন্ধু কাছাকছি থাকবো। অথচ আরিফ আমাকে ছেড়ে চলে গেল। কীভাবে পারলো আরিফ?

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিলো বেশ আগে। অন্তত মাস ছয়েক আগে তো হবেই। এক রাতে আমি আরিফের ফোন পাই।

'আচ্ছা, কাফকার কোনো বই আছে তোর কাছে?'

আমি তো তাজ্জব। আরিফ খুঁজছে কাফকার বই! ভাবি, সূর্য আজকাল পূর্ব দিকেই উঠছে তো। আমি শুধু বলতে পারলাম
'কাফকা!'
'না.......ইয়ে মানে...হ্যাঁ.........আছে?'
'কাফকার বই দিয়ে তুই কী করবি?'
'পড়বো!'
কোনোমতে মিনমিন করে জবাব দিলো আরিফ, যেন কাফকার লেখা পড়তে চাওয়া বিরাট অপরাধ। ততক্ষণে আমিও একটু সামলে উঠেছি।

'হঠাৎ কাফকার বই পড়ার ইচ্ছা হলো কেন তোর ?'

'ইয়ে......কাফকারই একটা গল্প পড়লাম তো.....তাই.......'
'কোন গল্প?'

ইতোমধ্যে আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতা চলে গেছে।

'মেটামরফোসিস.......তোর তো গল্পটা পড়া আছে, না?'
'হুম!'
আমি শুধু এটুকুই বলতে পারলাম। মনে তখন অসংখ্য প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো একসাথে বেরিয়ে আসতে গিয়ে একটাও বেরোতে পারল না।

'...সেদিন রিফাতদের বাসায় বইটা দেখলাম তো....পড়তে ইচ্ছা করলো.......আচ্ছা গল্পটা পড়ে কী মনে হইসে তোর....?'
'কী আবার মনে হবে....!'

এইটুকুই....কাফকা বা মেটামরফোসিস নিয়ে আরিফের সাথে ওইদিন আর কোনো কথা হয়নি। কথা অন্যদিকে ঘুরে গেল। আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করার গরজ বোধ করলাম না। হয়তো হঠাৎ বই পড়ার শখ হয়েছে কিংবা তানিয়ার চাপে পড়েও পড়তে পারে...। তানিয়া ওর প্রেমিকা। ব্যাপারটাকে পাত্তা দিই নি আসলে। পাত্তা না দিলেও হঠাৎ চোখের সামনে কাফকার পতঙ্গ এসে দুলতে শুরু করলে আমার হাড়ে হাড়ে শীতবোধ হয়, আর আমি আরিফের সাথে কাফকা কিংবা মেটামরফোসিসের সাথে আরিফ জুটি কতটা অস্বাভাবিক সেটা ভুলে যাই।

ছোটবেলা থেকেই গল্প, উপন্যাসের প্রতি ছিল আরিফের চরম অনীহা। আমি কম চেষ্টা করেছি ওকে গল্পের বই ধরাতে! পারিনি। ওর সাফ কথা-
'ওইসব বানানো কাহিনী পড়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।'

'বানানো হবে কেন.....এইগুলা তো আমাদের জীবনেরই কাহিনী.....তারপরও যদি ধরি কাহিনী বানানো....তুই এমন অনেক গল্প, উপন্যাস পাবি যেগুলো পড়লে জীবনকে নতুন ভাবে চেনা যায়, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায়....'

'তোর লেকচার থামা! জীবন আমার কাছে যেমন..তেমনই ভালো...এত নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দরকার নাই আমার...'...

তর্ক বিতর্কে সকাল পেরিয়ে দুপুর........দুপুর পেরিয়ে রাত ....আরিফকে কাবু করতে পারিনি। দেশ বিদেশের কত লেখকের কত রকম বই, কত ধরণের বই দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছি...কোনো কিছুই আরিফকে টানতে পারেনি। ওর ওই এক কথা...
'আমার এসব পড়তে ভাল লাগেনা..এর চেয়ে পিসিতে গেম খেলা অনেক আনন্দের..'

কী আর বলি। তানিয়াও কি কম চেষ্টা করেনি!

তানিয়া! মিথ্যা বলবো না। এই বইপাগল মেয়েটাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি। হয়তো ভালোওবাসি। আমি জানিনা। জানার চেষ্টা করিনি । ভয়ে। আরিফের বন্ধুত্ব হারাতে চাইনি আমি। সযত্নে লুকিয়ে রেখেছি আমার এই গোপন অনুভূতি। আরিফ এর বিন্দুবিসর্গও জানেনা, অন্তত আমি তাই জানি। আমি নিশ্চিত নই।

আরিফ শেষবার আমার অফিসে যখন এসেছিলো ওকে দেখাচ্ছিলো চরম দুর্দশাগ্রস্ত। আমি রীতিমত আঁতকে উঠেছিলাম। হতক্লান্ত একজন মানুষ। লাল টকটকে চোখ। চোখের নিচে রাতজাগার কালো ছাপ। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ওটাই আরিফ। বেশিক্ষণ বসেনি। বারবার এদিক ওদিক চাইছিল। চুল টানছিল অন্যমনস্কভাবে। হাতের আঙুল চেপে ধরছিল আরেক হাত দিয়ে। উৎকণ্ঠায় গলা বুজে আসছিল আমার। কী ওকে তাড়া করে ফিরছে?

'নাহ্, ঘুমাই না........ঘুমাতে পারিনা....'
'কেন? কী সমস্যা আমাকে বল। দুঃস্বপ্ন দেখিস?'
'নাহ্। '
'তাহলে?'
"ভয় লাগে..."
'কীসের ভয়..?'
'ঘুমালে তো ঘুম থেকে উঠতে হবে....তাই না?'
'হ্যাঁ ...তো?!'
'নাহ্, কিছু না!'
'কিছু তো অবশ্যই!...আরিফ তুই আমাকেও লুকাচ্ছিস?'

বেশ খানিকটা সময় আরিফ চুপ করে ছিল। আমি প্রায় দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম আরিফ কিছু একটা বলবে সেই অপেক্ষায়।

'তুই.....আমি...আমরা সবাই কি জেগে আছি?...তোর কী মনে হয়?'
ওই একটা কথাই। আর কিছু বের করতে পারিনি ওর মুখ থেকে। আমি কথা বললাম তানিয়ার সাথে, ওর বাবা-মার সাথে। দিন দুয়েক। আরিফ আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমরা ঘটনাটা ভুলে গেলাম।

আরিফকে পৃথিবীর সব ক'জন মানুষ ভালবাসে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এটা কীভাবে সম্ভব! অন্তত দু'একজন তো থাকবে যারা নাক কুঁচকে বলবে 'ওহ্ আরিফ! ওর ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না!'; বা ভুরু কুঁচকে বলবে ...'হুম, মানুষটা বোধহয় ভালোই!' অথচ এমন কেউ নেই। সবাই ওকে ভালবাসে। তানিয়া ওকে ভালবাসে।

আমি আর তানিয়া । আমাদের আড্ডা জমে খুব। আমরা দুজনেই বইপাগল। শুরু করলে আর কথা থামাতে পারিনা আমরা কেউই। আরিফ বিরক্ত হয়-

'কী ভ্যাজর ভ্যাজর শুরু করলি দুইজন......তারচে গান হোক না...'

ব্যাস! আমরা দুইজনেই খুশি। কারণ আরিফ গায় খুব ভালো। অসাধারণ কণ্ঠ ওর। গান শুনেই না আরিফের প্রেমে পড়লো তানিয়া। আমি খুব ভালো করে ভেবে দেখেছি, নিজের মনের আনাচে কানাচে আতশকাচ রেখে খুঁজে দেখেছি, কোথাও ঈর্ষার কণামাত্রও নেই । ভাগ্যিস নেই। একবিন্দু ঈর্ষাই যথেষ্ট ছিল আরিফের সাথে আমার বন্ধুত্বের দেয়ালে ফাটল ধরাতে। তবে পাতলা তলানির মতো একস্তর হতাশার পরত পেয়েছি, এটা ঠিক। পাত্তা দেইনি।

ওটাই ছিলো আরিফের সাথে ফোনে শেষবারের মত কথা বলা। আরিফ ফোন করেছিলো অনেক রাতে। রাত তখন দেড়টা হবে। আমি জেগে ছেলাম। অযথাই একটা গল্প লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। হচ্ছিলো না কিছুই। এমন সময় আরিফের ফোন। এটা সেটা অনেক কথা........এবং অবশেষে মেটামরফোসিস ।

'আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি তুই?'
'কী কথা?'

সত্যি বলছি, আমার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠেছিল আরিফের প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে। ও কি তানিয়াকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে? আরিফ কি কিছু বুঝতে পেরেছে? আমার লজ্জার সীমা পরিসীমা মাপা যাবে না তাহলে। আরিফের সামনেই বা আমি আর দাঁড়াব কী করে! অথচ আরিফকে ছাড়াও তো বাকি জীবনটা আমি ভাবতে পারিনা। এতটাই জড়িয়ে গেছি আমরা দুই বন্ধু।

'তুই, তানিয়া, তোরা সবাই আসলে কাকে ভালবাসিস বলতো? আমাকে? নাকি আমার চেহারায় যে প্রতিদিন কথা বলে, হাসে, গান গায়, অফিসে যায়, টাকা আনে, তোদের আনন্দ দেয়....এই মানুষটাকে?'

'মানে? এই মানুষটাই তো তুই!'

'হুম! আমিই তো!'

'তাহলে? ঘটনা কী বল তো! কী হইসে তোর?'

'কী আবার হবে! কিছুই না। ...কিন্তু যদি......ধর.......আমি যদি আর ওই মানুষটা না থাকি.......যদি পাল্টে যাই.......যদি.....যদি.....যদি অন্য আমিকে তোদের ভালো না লাগে........যদি..'

ওকে শেষ করতে দেইনি। কেননা আমি তখন আচমকা ক্রমশ গভীর জলে ডুবতে শুরু করেছি আমার অস্তিত্বের এক গোপন অংশে লুকিয়ে থাকা শীতল, সাদা, কঠিন বরফের চাঙড়ের চাপে, ভয় পাচ্ছি এই বুঝি বেরিয়ে পড়লো লুকিয়ে থাকা কুয়াশা । ওকে থামিয়ে দিলাম। এখন বুঝি, শেষ করতে দেওয়াই উচিত ছিলো।

'তুই কালকে কী করছিস?' বললাম আমি।

'কেন! অফিসে যাব....তারপর...'

'কোথাও যাবিনা। আমি আসবো তোর কাছে। কথা আছে। কোথাও বের হবিনা......আমি সকালেই আসবো...অফিসে গিয়ে চেহারা দেখাই ..তারপর।'

'ঠিক আছে! যাবোনা।'

আরিফের কাছে আমি যেতে পারিনি। অফিসে আটকে গেলাম।

শেষের দিকে আরিফের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ হচ্ছিলো না। ফোনেও কথা হয়নি। খুবই ব্যস্ত ছিলাম আমি, অফিসের নতুন প্রোজেক্ট নিয়ে। আন্টির, মানে আরিফের আম্মার ফোন পেয়ে গেলাম ওদের বাসায়। দু'দিন হলো আরিফ ওর ঘর থেকে বেরোয় না। কথা বলে না কারো সাথে। খায় না কিছূ। হাসে না একচিলতেও। শেষেরটাই আমাকে অবাক করলো বেশি।

আরিফ ছিল পুরোপুরি স্বাভাবিক। হাসছিল না একথা সত্যি, তবে কোনো কারণে খুব কষ্টে আছে এমনটাও মনে হয়নি। কোনো কারণে একটু হতাশ, এমন মনে হচ্ছিল। দুই বন্ধুতে আড্ডা দিলাম মিনিট বিশেক। এর পর মিনিট দশেক টানাটানি, জোরাজুরি করলাম বাইরে যাবার জন্য। আরিফ রাজি হলো না। কেন রাজি হলো না সেটাও বললো না। শুধু বললো- 'কী হবে বাইরে গিয়ে!' আরো একঘন্টা থাকলাম। চলে এলাম। যাবার আগে চোখে পড়লো বালিশের নিচে উঁকি দিচ্ছে কাফকার মেটামরফোসিস। ওটাই আমাদের শেষ দেখা।

আরিফ হারিয়ে গেল এর পরদিন সকালে। অফিসে যাবার জন্য রেডি হয়ে খাবার টেবিলে বসলো। নাশতা করলো। টুকটাক কথা বললো ওর ছোট বোনটার সাথে। এরপর বেরিয়ে গেল । আর ফিরলো না।

আরিফকে আমরা সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেছি। আমি, আমরা বন্ধুরা, তানিয়া, ওর আত্মীয়স্বজন। ওকে পাইনি। যে স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেছে তাকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায় আমরা জানিনা। দিন, মাস, বছর। আরো একটা বছর। বছরের পর বছর। এটা একটা জটিল ধাঁধাঁ। এর সমাধান করতে পারেনি কেউ। খোঁজ থেমে গেছে। সবাই ফিরে গেছে নিজ নিজ বৃত্তে। এখনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেউ কেউ। ওটুকুই, পরিধির বাইরে আসেনা কেউ। আমি এখনো খুঁজি। বৃত্তের ভেতরে। বৃত্তের বাইরে।

স্বেচ্ছায় বিশাল এক পতঙ্গে পরিণত হয়ে আরিফ চলে গেছে অজানা কোথাও। সকালে, দুপুরে, বিকালে, রাতে, অফিসে যাওয়ার সময়, ফেরার সময়, কাজে, অকাজে বাইরে বেরিয়ে, রাস্তায়, রিকশায়, বাসে, রাস্তা ঘিরে বড় বড় দালানকোঠার ভেতরে, বাইরে, আমি আরিফকে খুঁজি। আর খুঁজি জাদুর কাঠি, যা তৈরী আগাগোড়া ভালবাসায়, বিশ্বাসে। যার ছোঁয়ায় আমাদের আরিফকে আবার ফিরে পাবো আমি, আমরা।

'তানিয়ার সাথে তোর কিন্তু খুব ভাল মেলে। তোরা একইরকমভাবে চিন্তা করিস।' শেষ যেদিন দেখা হয় সেদিন বলেছিল আরিফ। তানিয়ার সাথে আমি আর কখনো কথা বলিনি, দেখা করিনি। আরিফকে আমি জিততে দেব না। আরিফের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আমার কি কোনো ভূমিকা ছিলো? বা তানিয়ার? নাকি শুধূই মেটামরফোসিসের? নাকি সবারই? এটাও একটা ধাঁধাঁ আমার কাছে। আমি এর উত্তর খুঁজি।

আমি অপেক্ষায় আছি। আরিফের সাথে আমার এক দিন না একদিন দেখা হবেই। আমাকে জানতে হবে এই খেলার শেষ কোথায়। হ্যাঁ, এটা একটা বড় ধরণের বিপজ্জনক খেলাই। আমি তেমনটাই মনে করি। কিংবা নিছক পাগলামি। আমাকে নিশ্চিত হতে হবে। কীসের অভিমানে, কীসের তাড়নায়, অনীহায় আরিফ হারিয়ে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর শুধু আরিফের কাছেই আছে। তাই ওকে আমি খুঁজে বেড়াই। সবার অলক্ষ্যে। খুঁজতে খুঁজতে পার হয়ে যাই রাস্তার পর রাস্তা। শহরের সীমানা ছড়িয়ে যাই। প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগে এগিয়ে যাবার, আর কখনও ফিরে না আসার। লোভ হয় জনঅরণ্যে হারিয়ে যাবার। পা বাড়িয়েও থেমে যাই। থেমে যাই কারণ প্রবল এক সন্দেহ, গভীর এক আশংকা আমাকে থামিয়ে দেয়। আরিফের হারিয়ে যাওয়ার সাথে সত্যিই কি মেটামরফোসিসের কোনো সম্পর্ক আছে? নাকি পুরোটাই আমার কল্পনা? আমি নিজেই কি নিজের প্রতি এক প্রবল সংশয়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত নই? মেটামরফোসিসের গ্রেগর তো এই আমিই, অরূপান্তরিত! জানিনা কবে থেকে হারিয়ে যাবার, পালিয়ে যাবার প্রবল আকাঙ্খা কি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় না? আমার অবচেতনে? আরিফের হারিয়ে যাওয়া তো শুধুই একটা অজুহাত, হয়তো! এ আরেক ধাঁধাঁ। একটার পর একটা ধাঁধাঁর সমাধান না পেয়ে আমি ক্রমশ বিচলিত হয়ে পড়ি। প্রতিদিন এক পা, দুই পা করে আমি আরেকটু বেশি সামনে এগিয়ে যাই, আরিফের খোঁজে। হয়তো কখনো এতটা দূরে চলে যাবো যে ফেরার পথ খুঁজে পাবো না। তাই আমি থেমে যাই। পা বাড়াই এবং পা ফিরিয়ে নিই। ফিরে আসি জীবনের কাছে। হয়তো আরো ক'টা বছরের জন্য, তবুও ফিরে আসি।

.............................................................................................................................
(আমার কিছু কথা: এটা কি গল্প হয়েছে? হয়তো হয়নি। আবার এটাকে ব্লগরব্লগরও বলতে পারছি না। হয়েছে হাবিজাবি কিছু একটা। আসলে এটা একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। কিছু এলোমেলো স্মৃতি, কিছু অনুভূতি, কিছু সময়কে একটা গল্পে গেঁথে ফেলার, ধরে রাখার তাগিদ থেকে তৈরী হওয়া প্রচেষ্টা। এ লেখা আদৌ প্রকাশিত হবে কিনা জানিনা, তবে এটা লিখে ফেলা আমার নিজের জন্য জরুরী ছিল। এ কথাগুলো না বললে স্বস্তি পেতাম না।)

০৮/০৭/১০


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

ভালো লাগলো আপনার লেখার হাত, এবং গল্পটাও। আরো লিখুন।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

পুতুল [অতিথি] এর ছবি

আমার কাছে দুর্দান্ত লাগলো। অসাধারণ গল্প হইছে।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ।

স্নিগ্ধা এর ছবি

বইখাতা - আপনাকে আগেও বলেছি, আপনার 'গল্প'গুলো দুর্দান্ত লাগে আমার!! ছোট বা বড় কোন ঘটনা, অথবা হয়তো নিছক একটা দৃশ্যেরই বর্ণনা, বা এরকম যে কোন কিছু আপনি কী করে কী করে যেন গল্প বানিয়ে ফেলেন!

আরিফের আপাত-অবিশ্বাস্য এবং অযৌক্তিক মেটামরফসিস আপনি যথেষ্ট কনভিন্সিংভাবে উপস্থাপন করেছেন। বর্ণনা টর্ণনা তো আগের মতোই সাবলীল এবং গতশীল। আমার মতে তাহলে আর গল্প না হয় কীভাবে?

তবে, তার চাইতেও বড় কথা আপনার নিজের জন্য লেখাটা জরুরি ছিলো, অর্থাৎ লিখে আপনার ভালো লেগেছে - আর কী চাই? হাসি

তিথীডোর এর ছবি

স্নিগ্ধাপুর সঙ্গে পুরোপুরি সহমত!
দারুণ লেগেছে গল্পটা... চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ তিথী।

বইখাতা এর ছবি

কী বলে যে ধন্যবাদ জানাই। হাসি অনেক স্বস্তি পেলাম।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

গল্পটার যে দুটো জিনিস খুব ভালো লেগেছে, তার একটি হলো উপস্থাপন- অপরটি হলো গতি।

_________________________________________

সেরিওজা

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ সুহান।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এই পোস্টটায় এমন কিছু আছে যেটা আইফোনের সাফারীকে ব্রাউজারকে ক্র্যাশ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেটা কী?

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

বাগ ফাইল করা হয়েছে: https://bugs.webkit.org/show_bug.cgi?id=41906

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এই পোস্টে সমস্যাটা আইসোলেট করার চেষ্টা করছি। ঘটনাটা কি কিছুই বুঝতেছি না।

http://www.sachalayatan.com/mahbub/33493

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

রাহিন হায়দার এর ছবি

খুব ভালো লাগলো।
________________________________
মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো...

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ।

তাসনীম এর ছবি

অসাধারণ লেগেছে।

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লেগেছে গল্পটা।

অনন্ত

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো।খুব ভালো

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

নিবিড় এর ছবি

পুরান একটা কথা আবার বলি, আপনি অনেক ভাল লিখেন হাসি
অফটপিকঃ আছেন কেমন?


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ নিবিড়। হাসি

অফটপিকঃ ভাল খারাপ মিশিয়ে আছি ভাইয়া। তুমি ভালই আছ আশা করি।

স্পর্শ এর ছবি

অসাধারণ! সত্যি অসাধারণ।
মেটামারফসিস পড়ার পরে কী ভয়ানক চাপ যে পড়েছিলো মনের মধ্যে। এই গল্পটা একদম ছুঁয়ে গেল তাই। চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ স্পর্শ।

দময়ন্তী এর ছবি

অসম্ভব ভাল একটা গল্প৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

বইখাতা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

নিবীড় এর ছবি

গল্পটা ভাল লেগেছে ... সাবলিল লেখা।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

অসাধারণ লাগল।

আপনার ভাষাটা একটু আলাদা মনে হল এই গল্পটায়, এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম হাসি

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে। হাসি

ভাষার এই বদলে যাওয়ার ব্যাপারটা স্নিগ্ধাপুও বলেছেন আমার আগের লেখায়। এটা কীভাবে যেন হয়ে যাচ্ছে। এই গল্পে আমি একটা হালকা চেষ্টা নিয়েছিলাম আগের মতো করে লিখতে। সফল হইনি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।