অনামা গল্প - ২

বইখাতা এর ছবি
লিখেছেন বইখাতা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/০১/২০১১ - ১০:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মৌমি আমার সহপাঠি ছিল। মৌমি আমার বন্ধু ছিল। মৌমি আমার বোন ছিল। মৌমির সাথে একদিন দেখা না হলে সেই দিনটা আমার অসমাপ্ত মনে হতো। দিনের মধ্যে অন্তত একটাবার আমি মৌমির কাছে যেতাম। অথবা মৌমি আমার কাছে আসতো। আমরা একসাথে কোথাও বসতাম। আমাদের ছাদে চেয়ার পেতে। কিংবা মৌমির বারান্দায়। আমি হয়তো বলতাম, “মৌমি, আজকে আমার মনটা খুব খারাপ। বাসায় যাবোনা।” মৌমি বড় বাটিভর্তি মুড়িমাখা নিয়ে আসতো। আমরা একটু একটু করে খেতাম আর মৌমির পায়রাগুলোকে খাওয়াতাম। আমাদের সামনে রেখে একসময় সূর্য অস্ত যেতো। পায়রাগুলোর ডানা নানা রঙে রঙিন হয়ে যেতো।

আমাদের দুই বাসার মধ্যখানে একটুকরো ছোট মাঠ ছিল। ঐখানে আমরা চড়ুইভাতি করতাম। ইট, কাঠ, মাটির ছোট শহীদ মিনার বানিয়ে ফুল দিতাম। নেট টানিয়ে ভাইয়ারা ব্যাডমিন্টন খেলতো। আর খুব ভোরে আমি আর মৌমি পায়ে সবুজ ঘাসের আদর মেখে হেঁটে বেড়াতাম। সুখ কাকে বলে তা না জেনেও আমরা ছিলাম পরিপূর্ণ সুখী। দুই বাড়ির ধার ঘেঁষে ছিল জবা গাছ, শিউলি আর হাস্নাহেনা। হাস্নাহেনার তীব্র ঘ্রাণে নাকি সাপ আসে। তাই আব্বা গাছ কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। ছোটমা’র জন্য পারেননি। ছোটমাকে আব্বা খুব ভালবাসেন। আমার আম্মাকে ততটা বাসেননা। আমি বুঝতে পারতাম।

আমি আর মৌমি শিউলি ফুল কুড়োতাম। মৌমি সেই ফুল দিয়ে মালা গাঁথতো। ‘কার জন্য রে মৌমি?’ মৌমি শুধু হাসতো। আমিও হাসতাম। কেননা আমরা দুজনেই জানতাম এ মালা কার জন্যে। আমাকে কিছু বলেনি মৌমি। বলতে হতো না। আমি বুঝে যেতাম। ঠিক এমনি করে মৌমিও আমাকে বুঝতো। তাই আমার হাতে মালাটা তুলে দিলে আমি হাতে পেঁচিয়ে রাখতাম। আর বাসায় ফিরে নিঃশব্দে, চুপি চুপি ভাইয়ার টেবিলে, কি বালিশের নিচে, কিংবা জানালার ধারে, কোথাও না কোথাও আলগোছে ফেলে রাখতাম। ভাইয়া কখনো জানতে চায়নি এ মালা কোত্থেকে এলো।

ঈদে আমি দুটো করে জামা পেতাম। মা একটা বানিয়ে দিতেন, ছোটমা আরেকটা। মৌমিও দুটো জামা পেতো। মা’র কাছ থেকে একটা আর ছোটমার কাছ থেকে আরেকটা। পূজোয় আমি একটা জামা পেতাম আর শাড়ি পেতাম একটা। মৌমিও শাড়ি আর জামা পেতো। মৌমির বাবা কিনে দিতেন। ‘এই লালপাড় শাড়িটা পড়ে আমার হাসনা মা’কে টুকটুকে বউয়ের মতো লাগবে’। কাকুর কথা শুনে আমি দৌড়ে পালাতাম। লজ্জায়। সুমিতদার সামনে এসব কথা শুনতে আমার লজ্জা করতো। সুমিতদা অবশ্য পাত্তাই দিতোনা আমাকে। ভারী একটা বইয়ের আড়াল থেকে ভারী কাচের চশমাঢাকা চোখের দৃষ্টি আমার ওপর পড়তো না।

বাবার আদর আমি পাইনি কখনো। শুনে মনে হবে যেন আমার বাবা নেই। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। আমি জানিনা আমাকে বাবা কখনো কোলে নিয়েছেন কিনা। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, দেখেছি বাবা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার বিশাল বৈঠকখানায় এলাকার মানুষের কথা শুনছেন, কথা বলছেন, সলাপরামর্শ করছেন, হাসিঠাট্টা করছেন, তাদের নিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছেন। কখনো কখনো কয়েক ঘন্টার জন্য। কখনো কখনো কয়েকদিনের জন্য। এসব সময়ে কখনো কখনো কাকু তার সঙ্গি হতো। ভেতরবাড়ির মানুষদের সাথে তার দেখা হতো অনেক রাতে। তখন প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। আমিও ঘুমিয়ে পড়তাম। অথচ ভেতর বাড়ির কোথায় কখন কী হচ্ছে তা তিনি ঠিক ঠিক জানতে পারতেন। এ ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম যেদিন আব্বা হালিমা বু’র ছেলে জামাল ভাইকে মোটা একটা লাঠি দিয়ে মারতে মারতে ভেতর বাড়ি থেকে বাইরের বাড়িতে তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। জামাল ভাই ছোটমা’কে লাইব্রেরী থেকে বই এনে দিত।

তিনি ছিলেন ঐ এলাকার চেয়ারম্যান। পরপর তিনবার জিতেছেন। এলাকার মানুষ আর্জি নিয়ে এসে কখনো খালি হাতে ফিরে যায়নি আমাদের বাড়ি থেকে। প্রতিদিনই অনেক মানুষ খেতো আমাদের বাড়িতে। বিশাল হাঁড়িতে রান্না হতো আমাদের। মা রাঁধতেন। সাথে থাকতো হালিমা বু। ছোটমা কখনো কখনো বাবার চোখ এড়িয়ে রান্নার ঘরটাতে যেতেন। বাবা চাইতেন না ছোটমা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। ভেতরবাড়িতে বাবা ঢুকতেন অনেক রাতে, কখনো কখনো দুপুরেও। মা’র ঘরে সচরাচর আসতেন না। কোনো কোনো রাতে আসলে আমি টের পেতাম। ওদের চাপা কন্ঠের ঝগড়ায় আমার ঘুম ভেঙে যেতো। একটানা হিস হিস শাসানি, ফুঁপিয়ে কান্না শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে যেতাম। ভোরে উঠেই চলে যেতাম শিউলি গাছের কাছে। ওখানে আসতো মৌমি। ফুল তুলতে তুলতে গান গাইতো গুন গুন করে। সেই গুন গুন গানের সুরে আমার মাথার ভেতর জমে থাকা চাপা কান্না, হিস হিস শব্দের ময়লা কাটাতে চাইতাম। তারপর একটু সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি। ছোট জায়গায় পাক খাওয়া। সাইকেল নিয়ে বাড়ির সীমানার বাইরে গেলে আব্বা বকবেন তাই যেতাম না। আমার জন্য মৌমিও যেতোনা। সাইকেল পর্ব শেষে মৌমিদের বাইরের বারান্দায় পাটি পেতে বসতাম আমরা। কাকিমা রুটি আর পাঁচফোড়নের সুগন্ধে ভরা নানানরকম সবজি দিয়ে রান্না নিরামিষ তরকারি নিয়ে আসতেন, সাথে ঘন ডাল। কখনো চাকা চাকা বেগুনভাজি। কখনো বয়ামে রাখা ঝোলাগুড়। আর কখনো কখনো তেজপাতা, এলাচ মেশানো চায়ের গন্ধমাখা দুধ। আমি পেটভরে খেতাম। এটা ছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ খাবার। আর কোনো খাবারের সাথে এর তুলনা হয়না। আমার প্রাণটা নিয়ে মৃত্যুদূত যদি বলেন যে এই পথ চলে গেছে স্বর্গে। এই পথ ধরে তুমি চলে যাও। তো আমি নিশ্চিত বলবো ঐ পথে গেলে কি মৌমিদের বাইরের বারান্দায় যাওয়া যাবে? যেখানে পাটি পেতে বসে আছে মৌমি? পাতলা রুটি, ঘন ডাল আর পাঁচফোড়নের ঘ্রাণ মেশা অপূর্ব অমৃত নিয়ে কাকীমা অপেক্ষায় আছেন? তাহলে যেতে পারি।

বাবা তিন বারের বার যখন জিতলেন তখন আমাদের বাড়িতে এক বিশাল আয়োজন হলো। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। সবকিছুর তদারকি করছিলেন অজিত কাকু আর আব্বা নিজে। কাকীমা সারাদিন ধরে আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় আয়োজন হচ্ছিল। আমি সেদিন স্কুলে যাইনি। ঐখানেই ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সবার ব্যস্ততা। বিকেলের দিকে আমার মনে হলো মৌমি স্কুল থেকে ফিরে কি ঘুমিয়ে পড়েছে? এখনও এলোনা এ বাড়িতে!

মৌমিদের বাসার গেটটা লোহার। বাইরের গেট পেরিয়ে কাকীমার বাগানের পাশ দিয়ে কিছুদূর গেলে আরেকটা গেট। এটাও শক্তপোক্ত। খোলাই থাকে সবসময়। এটা পেরিয়ে বাইরের বারান্দা। বাইরের বারান্দা পেরিয়ে আরেকটা খালি জায়গা, ছাদঢাকা। এখানে আমরা ছোটবেলায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। আমরা, মানে আমি, মৌমি, সুমিতদা আর ভাইয়া। সেদিন গেছে হারিয়ে। এই দূর্গের মতো বাড়ি নিয়ে আব্বা প্রায়ই কাকুর সাথে মজা করতেন। কাকু কি নিজেকে রাজা বাদশা ভাবছেন নাকি! বৈঠকখানার বাইরে আড়ালে লুকিয়ে মানুষের কথা শোনার অভ্যাস ছিল আমার। অবশ্য আব্বার কাছে ধরা পড়ার ভয়ও ছিল। তাই সে চেষ্টা বেশি করতাম না। কাকুকে কখনো এ সব কথার, হাসি ঠাট্টার জবাব দিতে শুনিনি।

সেদিনের সেই বিকেলে আমি লোহার গেটটা খোলা পেলাম। রাতে বা বাড়িতে কেউ না থাকলে গেট বন্ধ থাকাই নিয়ম ছিল। দেখলাম, কালাম চাচা নেই। গেটের কাছেই তিনি থাকতেন, বাগানটার আশেপাশে। কেউ এলে গেট খুলে দিতেন। বাগানে এলোমেলো ঘুরলাম কিছুক্ষণ। হরেক রঙের ডালিয়া ফুটেছে। কিছুক্ষণ পর বাড়িতে ঢুকলাম। ছাদ ঢাকা খোলা জায়গাটা পেরিয়ে যাবার সময় কোনো একজনকে আশা করছিলাম মনে মনে। তার দেখা পেলাম না। বাড়িতে ঢুকে কেন জানিনা আমার খুব অস্বস্তি হলো। কেমন শুনশান। ছায়া ছায়া। শীতল। নিজেকে ফাঁদে পড়া খরগোশের মতো মনে হচ্ছিল। দাঁড়িয়েছিলাম ওদের খাবারঘরে। একতলায়। মৌমির ঘর দোতলায়। স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই দোতলায় উঠতে ভয় পাচ্ছিলাম। ওদের জানালাগুলোয় শক্ত কাচ। একটা জানালায় হেলান দিয়ে মৌমিকে চিৎকার করে ডাকলাম। একবার, দুবার। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাড়িটা অস্বস্তিকরভাবে নিরব। ভাবলাম, এখানে দাঁড়িয়ে কাজ নেই। চলে যাই। মৌমি হয়তো অন্য কোথাও গেছে। ফেরার সময় শেষবারের মতো মৌমিকে ডাকতে যাবো, তখুনি একটা গোঙানি শুনলাম। সাথে সাথে আমি জমে গেলাম তীব্র আতংকে । গরু কোরবানি দেয়ার সময় অনেকটা এইরকম শব্দ শুনেছি। অবর্ণনীয় যন্ত্রণাময় গোঙানি। মৃত্যুর সাথে যুঝতে থাকার শব্দ। তৎক্ষণাৎ আমার হাত পা ঠান্ডায় জমে গেলে আমি আর এক পা’ও সরে যেতে পারলাম না। এই কন্ঠ কি মৌমির? আরেকবার। এবার আরেকটু স্পষ্ট। মৌমির গলা বুঝতে পারার সাথে সাথে আমার সব জড়তা কেটে গেল কীভাবে আমি জানিনা। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে দোতলায় উঠে মৌমির দরজায় ঠেলা দিতেই যে দৃশ্য দেখলাম তা মুছে ফেলতে পারিনি বলেই আজ আমি আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি নিজেও বোধহয় চিৎকার করে কাঁদছিলাম। ঠিক মনে করতে পারিনা। ঐ সময়ের স্মৃতি কেমন অস্পষ্ট। আমার ভাই আমাকে ঠেলে বের হয়ে গেল। আর রক্ত লেপটানো মেঝেতে দাঁড়িয়ে আমি বোধহয় আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম। নাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যে কাকু আর আব্বা চলে আসলেন কীভাবে? নাকি আধঘন্টা বা একঘন্টা ধরে আমি শুধু গলা ফাটিয়ে চিৎকারই করে যাচ্ছিলাম? সময়ের হিসাব ছিলনা আমার। আমাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে আব্বা দুহাতে তুলে নিলেন। চিলের মুঠোয় চলে যাবার আগের মুহূর্তে দেখেছি রক্ত ফেটে বেরুনো চাপা লাল। কাকুর চোখ। একটা মুহূর্ত। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম। পুনর্বার সজ্ঞান হয়ে আমি আজীবন সঙ্গি হিসেবে পেয়েছি ওই চোখ। আমার ওপর থেকে তার নজর সরেনি কখনো। ঘোর লাল, রক্ত জমা লাল। কষ্ট, যন্ত্রণা, আঘাত, অভিযোগ, প্রশ্ন। এইসব গায়ে মেখে নিয়ে বেঁচে আছি। কেননা এভাবেই আমার বেঁচে থাকার কথা।

মৌমি আমাকে ক্ষমা করেনি। আমি ক্ষমা চাইওনা আসলে। কারণ এর ক্ষমা হয়না। আমি শুধু একবার...একটাবার ঐ বারান্দায় ফিরে যেতে চাই। পাটি পেতে মৌমির পাশে বসতে চাই। কাকীমার হাতে বানানো রুটি খেতে চাই ডাল দিয়ে। তেজপাতা দেয়া, বেশি করে দুধ মেশানো চা দিয়ে। আর মৌমির গুন গুন গান শুনে মগজে লেগে থাকা পুরু ময়লা সরিয়ে ফেলতে চাই।

ঐ ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ছিলাম আমি। আমার ভাইকে মৌমির ঘর থেকে শুধু আমিই বের হতে দেখেছি। এ ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝলাম যখন আমাকে আমার ঘর থেকে একবারের জন্যেও বের হতে দেয়া হলোনা। কারো সাথে দেখা করতে দেয়া হলোনা, একটিবার ছাড়া। আমি এখন ভাবি, ঐ একবারের আগে ঘরে বন্দি থেকে আমি যা ভাবছিলাম তাই করে ফেললাম না কেন? পেনসিল কাটার ব্লেড দিয়ে হাতের রগ কেটে ফেলতে চাইছিলাম। কেন এ কাজ করতে চাইছিলাম তার কারণ যে আমি নিজে পরিষ্কার জানতাম, তা’ও নয়। শুধু একটাই বোধ ছিল তখন। বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে। অপূরণীয় ক্ষতি। সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেছে। সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আর এর দায়ভার কিছুটা আমার ওপরও পড়ে। কিন্তু যা করতে চাইছিলাম তা করিনি। কারণ আমি আসলে বেঁচে থাকতেই চাই। এভাবে পাপের কালো ময়লা আবর্জনায় চাপা পড়ে হলেও বেঁচে থাকতে চাই। আমি অতি নিকৃষ্ট এক জীবনলোভী।

তার আগের রাতে আব্বা এসেছিলেন ঘরে। মা এসেছিলেন, ছোটমাও। আর আমার ভাই। ওরা অনেক কিছু বলেছে। অনেক ভয় দেখিয়েছে। ভাই মরে যাবার হুমকি দেখিয়েছে। সে তার আব্বা ও দুই মা’র একমাত্র ছেলে। তাদের জাগতিক সবকিছুর আশা ভরসা। সে একজন সুবোধ, ভদ্র, মার্জিত ছেলে। তার সম্মান, আমার বাবার সম্মান, দুই মার সম্মান পেছনের পচা পুকুরের দুই হাত গভীরে আমি পুঁতে দিয়ে আসতে পারি। কিন্তু আমি কি তা করবো?

না, করিনি। সেদিন দুপুরে ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম বাড়িতে মানুষ গিজ গিজ করছে। আমি এই প্রথম এত লোকের সামনে বৈঠকখানায় গেলাম। কারো দিকে তাকাইনি। আমি যখন যন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছিলাম তখন শ্বাস ফেলারও শব্দ পাইনি। কেউ শ্বাস ফেলেইনি আসলে। বলা শেষ হলে স্বস্তির শ্বাসের তোড়ে আমি আধহাত নুয়ে পড়লাম। মালাউনের জাত এইরকমই...... কোনো বিশ্বাস নাই... । ‘হালিমা, ওকে নিয়ে যাও।‘ ......আরে হিন্দু মাইয়াগো একবার দুইবার এইরকম তো হইবোই......। ‘হালিমা...... কথা কানে যায় না কারো?’ ......কে না কে করছে... । ‘’আহা, ......ভাইজান...মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে তো...।‘ .........মাইয়া নিজেও...। ‘ধরো...ধরো ওকে...পড়ে গেলো তো’। .........বাড়িটা দেখসো...! আমাকে একটা বাদামী লোমশ হাত ধরতে এলে আমি চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। ভুল হয়ে গেছে। ভুল সংশোধন করতে হবে। ......ইন্ডিয়ায় দেখো গিয়া বাড়ি বানাইছে আরেকটা......

আমি শুনতে শুনতে... হাঁটতে হাঁটতে...টলে উঠতেই হালিমা বু ধরে ফেললো। আমি টলে উঠছিলাম। কেননা আমার পৃথিবী টলে উঠছিলো...আমার দুনিয়া ভেঙে পড়ছিলো...। মানুষগুলো অচেনা হয়ে যাচ্ছিলো...আমি মনে মনে মরে যাচ্ছিলাম...মানুষ থেকে ক্রমশ পিশাচে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছিলাম আর......আর আমার বোন মৌমি......তুই কি করছিলি তখন?

ঘরে ঢুকতেই বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো হালিমা বু। ঐ ঘরেই ছিলাম আরো অনেকদিন। ছোটমা ঘরে আসতেন মাঝে মাঝে। আমার সাথে গল্প করার জন্যে। ফিস ফিস করে যেই মৌমিদের কথা বলতে শুরু করবেন, তখুনি আব্বা নাহয় মা ঘরে ঢুকে পড়তেন। ছোটমাকে আব্বা বিশ্বাস করতেন না। তবুও দু’একটা কথা জানতে পেরেছিলাম। কাকু নাকি থানা পুলিশ করার চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। আমার সেদিনের সেই সাক্ষী দেবার পর এলাকার লোকজন তাঁকে কী কী বলেছে বা করেছে, গাছের পাতা কীভাবে সবুজ থেকে ধূসর হয়েছে, কাচ কীভাবে গুঁড়ো বালি হয়ে গেছে, ডালিয়ার রঙ কীভাবে রক্ত লাল হয়েছে, সাইকেলের চাকা কীভাবে একা একাই ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছে......... সেসব বিস্তারিত শোনার সুযোগ হয়নি। কারণ হঠাৎ করে আমার ঘরে ছোটমা’র আসা বন্ধ হয়ে গেল।

কতদিন হবে আমি জানিনা। একদিন হঠাৎ আমার দরজা খুলে গেল। বাইরের আলো আমার চোখে ঝাপটা দিলে আমি বিহ্বল হয়ে পড়লাম। গোসল করলাম। খেলাম। বাইরের বাড়ি, ভেতরবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কেউ কিছু বললো না। বিকাল হয়ে আসতে আমি গুটি গুটি পায়ে মৌমিদের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ি ভর্তি মানুষ। অথচ আমাকে কেউ কিছু বললো না। হেঁটে হেঁটে গেটের সামনে গেলাম। গেট খোলা। গেট পেরিয়ে বাগান। বাগান আর বাগান নেই। আগাছায় ভর্তি। বাগান পেরিয়ে বাইরের বারান্দা। কালাম চাচা! আমাকে কিছু বললেন না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আমার গা শির শির করে উঠলো। বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে আমি অবাক.........একি!.........ওদের বাইরের ঘর পালটে গেছে পুরোপুরি। বুকশেলফ নাই। বেতের চেয়ারগুলো নাই। দেয়ালে তিন চারটা ছবি ছিল। ওগুলো নাই। তার বদলে দেয়ালে একটা লোকের ছবি। একে আমি চিনি। একটা বড় টেবিল। কয়েকটা কাঠের চেয়ার, বেঞ্চ। একটা কাঠের আলমিরা। আমি অবাক হয়ে এসব দেখছিলাম তাই মনোজ চাচাকে লক্ষ্য করিনি। আমি তার দিকে চোখ ফেরাতেই মৃদু হাসলেন। ‘অবাক হচ্ছো বেবি?’ আমাকে এ নামেই ডাকেন মনোজ চাচা। আমার জন্মের পর থেকেই। আমাদের বাড়ির মধ্যে এই একটা মানুষকেই আমি ভালবাসি। ও......... আর ছোটমা। তাকেও ভালবাসি।

‘মৌমিরা কই চাচা?’

‘ওরা তো তোমার আব্বার কাছে বাড়ি বেচে দিয়ে চলে গেছেন’

‘চলে গেছে!?’

‘হ্যাঁ বেবি’

‘কেন?’

‘এই জায়গাটা তোমার কাকুর আর পছন্দ হচ্ছিল না।‘

মানে? জন্মের পর থেকে দেখছি কাকুদেরকে। এই বাড়িতে। এবং আমাদের বাড়িতে। মনোজ চাচা মিথ্যা বলছেন।

‘কোথায় গেছে?’

‘আমি জানিনা। কেউ জানেনা। কাউকে বলেনি। ‘

আমি পলক না ফেলে চাচার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। চাচা চোখ সরিয়ে নিলেন।

আমি পেছন ফিরলাম। সাথে সাথে পেছনে চাচার চাপা স্বর শুনতে পেলাম।

‘বেবি, সাবধানে থাকো। বেচাল কিছু কোরোনা। তোমাকে কিন্তু কেউ না কেউ সবসময় খেয়াল করবে। তোমার আব্বাকে তো তুমি চেনো। আমার কথাটা রাখো বেবি।‘

আমার চারপাশে আমাদের নিজের মানুষ। তারপরও ভয়ের হিমশীতল অনুভূতি আমাকে অসাড় করে দিলো। আমি স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। এরপর খোলা দরজা দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসবো ভেবেই হয়তো হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কী ভেবে দোতলায় চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম মৌমির ঘরের দরজা হাট করে খোলা। আমার কেমন জেদ চেপে গেল। এক অসুস্থ জেদ। ঐ ঘরে এখনো কি লেগে আছে রক্তের দাগ? মৌমির রক্ত? ঐ ঘরে ধারালো কিছু আছে কি? আমার রক্ত ফেলা যাবেনা ওই একই জায়গায়? এইসব ভাবতে ভাবতে আলগোছে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখতেই পেছন থেকে শক্ত করে আমাকে চেপে ধরলেন মনোজ চাচা। সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আমার মতলব টের পেয়েছে বোধহয়। তবে তখন আমার জেদ চেপে গেছিল। ঠিক ঐদিনের মতো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম আর আমার কানের কাছে তোতা পাখির মত একই কথা বলে যাচ্ছিলেন চাচা। ‘শান্ত হও বেবি, শান্ত হও। কিছুই হয়নি। কিচ্ছু হয়নি।’

আমি শান্ত হয়েছি। একদম শান্ত। এবং এরপর থেকে শান্তই থাকি। কেটে গেছে দীর্ঘ...দীর্ঘ সময়। আরও শান্ত হতে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছি। দু’একটা কথা বলি ওদের সাথে। যা না বললেই নয়। শুধু দু’বার বেশি কথা বলেছি। একবার যখন প্রথম আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তারকে সব বলেছি। আমার কথার মাঝে একটাও কথা না বলে মহিলা আমার সব কথা শুনেছেন। তারপর একটা ডায়েরি দিয়েছেন। সুন্দর ডায়েরি। হালকা সবুজ মলাট। নরম মলাট। ভেতর ঈষৎ হলদেটে খসখসে পাতা। দিয়ে বলেছেন ওই ডায়েরিতে যেন আমি প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখি। ‘তুমি আবার যেদিন আসবে, সেদিন ডায়েরিটা সাথে নিয়ে এসো, কেমন?’

আমি আর যাইনি তার কাছে। কেউ নিয়ে যেতে পারেনি। আমাকে বেশি জোর করেনি কেউ। তবে ডায়েরিটা আমি রেখে দিয়েছি। কিছু লিখিনি অবশ্য। তবুও পাতাগুলো ভরে গেছে। প্রত্যেকটা পাতায় একটাই ছবি। হলুদ প্রজাপতির। পাখা ছেঁড়া। পিন দিয়ে আটকানো। পাতা উলটে উলটে আমি ছবি দেখি। শুধু আমিই দেখি। আর কেউ দেখতে পায়না।

মৌমি সেদিন একটা হলুদ জামা পরে ছিল। ছোটমা’র দেয়া।

আরেকবার অনেক কথা বলতে হয়েছে। যেবার ওদের ছেড়ে চলে এলাম। হয়তো আবার কোনো একদিন গলায় আটকে থাকা পিন্ডটা সরে যাবে। আমি অবিরল ঝরে পড়া রক্তের মতো অবিরাম কথা বলবো। যদি মৌমির দেখা পাই। যদি মৌমি প্রচন্ড ঘৃণায় আমার সামনে আসতে অস্বীকার না করে। আমি ক্ষমা চাইবো না। শুধু বলবো, ‘মৌমি, বোন আমার, আমি একবার...শুধু একটাবার খোলা বারান্দায় পাটি পেতে তোর পাশে বসতে চাই। আমরা থালা সামনে নিয়ে বসে থাকবো। আর কাকীমা আসবেন খাবার নিয়ে। রুটি। চাকা বেগুন ভাজি। ঘন ডাল। নিরামিষ অমৃত। তেজপাতা, এলাচের ঘ্রাণমেশা দুধ। আমরা মিলেমিশে তৃপ্তি করে খাবো। কাকীমা বসে থাকবেন আমাদের সামনে। রুটি তুলে দেবেন থালায়। সকালের নির্মল বাতাসে বিষাক্ত পৃথিবী সামান্য সময়ের জন্যে নির্মল হয়ে উঠবে। সেই বাতাসে আমরা বুক ভরে শ্বাস নেবো। শুধু একবার...একটাবারের জন্য।‘

১৩/০১/১১


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ। অসাধারণ। অসাধারণ
সচলের সেরা গল্পগুলোর একটি আজ পড়লাম।

---আশফাক আহমেদ

বইখাতা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ......তবে অনেক বাড়িয়ে বলে ফেলেছেন তো হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

কী বলবো! বইখাতা, এমন লেখা পড়লে ভিতরটা স্তব্ধ হয়ে যায়, সমস্ত কিছু থেমে গেছে বলে মনে হয়। তবু নিরুপায় বিশ্বাস রাখতেই হয় মানুষের মনুষ্যত্বে। একদিন সব ভালো হবে এই আশায়।
ভালো থেকো।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

বইখাতা এর ছবি

তবু নিরুপায় বিশ্বাস রাখতেই হয় মানুষের মনুষ্যত্বে। একদিন সব ভালো হবে এই আশায়।

ঠিক তাই। অনেক ধন্যবাদ লেখাটা পড়বার জন্যে আর একটা অতিরিক্ত ধন্যবাদ তুমি করে বলার জন্যে হাসি

অপছন্দনীয় এর ছবি

বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না - কিছু খুঁজে পাবোও না মনে হয়, যতবারই পড়ি না কেন...

বইখাতা এর ছবি

হুম......

সজল এর ছবি

অসাধারণ!

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ সজল।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

চমৎকার লাগল!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

ফাহিম হাসান এর ছবি

অসাধারণ গল্প। বাস্তবতার ঘা বড় সাংঘাতিক।

বইখাতা এর ছবি

হুম। কারো কারো বাস্তবতা এতটাই কঠোর, নিষ্ঠুর যে মেনে নেয়া অসম্ভব মনে হয়......। ধন্যবাদ আপনাকে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ। এটা যেন শুধু গল্প হয়। শুধুই গল্প।

অনীক_ইকবাল (darrel7756@gmail.com)

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার এই আশা পূরণ হোক, সব সময়, সব জায়গায়।

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

ভাবতে ভালোবাসি আমরা কোন এক গল্প সত্যি না হোক...
শিউরে উঠি এরকম বাস্তবতার ছবি চোখে ভেসে উঠলে...
তবু জানি... এ এক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবিই তো...
বেশ কিছুদিন পর তোমার লেখা পড়লাম আপু...
যে গল্প ভেতরটা স্পর্শ করে তা তো এক খন্ড ভালোলাগাই বটে......
শুভকামনা নিরন্তর ... হাসি


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

বইখাতা এর ছবি

হুম......ধন্যবাদ মউ। তোমার নতুন গল্প আসুক। হাসি

তিথীডোর এর ছবি

বেশ কিছুদিন পর সচলে ফেরা হলো......
বেশ কিছুদিন পর এমন অসাধারণ একটা গল্প পডা হলো!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

বইখাতা এর ছবি

বেশ কিছুদিন পর সচলে তিথীকে দেখে ভাল লাগল... হাসি । ধন্যবাদ তিথী।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।