আহাম্মকের আমলনামা ১

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি
লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ (তারিখ: রবি, ০৬/০৪/২০০৮ - ৭:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার কেবলই নানান কিসিমের রঙ্গ মনে পড়ে।
কোটালরাজ বহুকাল পর বাজার দেখিতে বাইরাইছেন। দেখা কর্তব্য। কর্তব্য পালনের প্রদর্শনী করা আরো বিরাট কর্তব্য। সেই কর্তব্য সারিতে গিয়া দেখিলেন, ‘না, চালের তো অভাব নাই!’ জানিলেন, লোকজন ভয়ের আছর খাইয়া বেশি বেশি চাল কিনিয়া চালের দাম বাড়াইয়া দিয়াছে। এই গবেষণা হইতে তাঁহার সিদ্ধান্ত: চালের সমস্যা কৃত্রিম সমস্যা, ইহার জন্য দায়ি একশ্রেণীর ক্রেতা_ যাহারা বেশি চাল কেনে, বেশি ভাত খায়। বিক্রেতারা নয়, মজুদদার মহাজনেরা নয় দায়ি কিনা ক্রেতারা! শুনিয়া দিল সাফা হয়, হাঁটুতে বুদ্ধি আসে । তিনি কৃষকদের দুষিতে পারিতেন। কেন তাহারা আরো বেশি ধান ফলায় না! দেশের লোকেরাও কেমন আহাম্মক_ কেন তারা আলু খায় না? আলুর কী দোষ? জনগণের আলু-জ্ঞান ঠিক থাকায় তাহারা আলু খোঁজে না, ভাত বিছরায়। ঐ ভাইত্যা বাঙালি তাহাদের পুছিতে পারে, 'আচ্ছা, আপনারা আলুবাদীরা দল-বল-পরিজনসমেত কয়েক লাখ হইবেন, আপনারাই খান না আলু? তাইলে আমরাও বাঁচি চালও বাঁচে আলুও কাজে লাগে।' কিন্তু বিধি ডান! ক্ষমতা ও উপদেশ নিম্নগামী। আলুবাদীরা বাঙালির এই সদুপদেশ শুনিলেন না।
শুনিতে আলবত পাইতেন, যদি বাজারের পাশের ফুটপাথ আর পেছনের বস্তির যে কোনো স্যাম্পল কপিকে পুছিতেন, 'প্রিয় দেশবাসী! তোমাদেরও কি আলুর দোষ, তাই আলু খাও না? এই কষ্টে কেউ কেউ গরিবের ক্ষুধার পরিমাপ করিতে ভালবাসেন। গরিবের ঘরও নাই, থলেও নাই। তবে পেট চিরিলেই দেখা যাইতো, সেইখানে কী পরিমাণ চাল মজুদ রাখা আছে।
আমার মনে পড়িয়া গেল সেই পারস্যদেশীয় গল্পের কথা। সেই গল্পে এক বাদশাহ শানশওকতের মধ্যে খোদাকে পাইতে চাহেন। যতই তাঁহার দিলে খোদার এশক জাগে ততই তিনি আরো শানশওকতের মধ্যে ডুবিয়া যান। সেই গল্পে এক রাখালও ছিল। একদা সে ঐ বাদশাহর প্রাসাদের ছাদে হারানো উট খুঁজিতে যায়। উভয়ের দেখা হইলে বাদশাহ তাহাকে মশকরা করিয়া বলিলেন, ‌'প্রাসাদের ছাদে কী আর উট চরিয়া বেড়ায় গর্ধভ!' রাখালবেশী দরবেশও সেয়ানা, ‌' শানশওকতের মধ্যে কী আর খোদা থাকেন আহাম্মক!'
কিন্তু এখন কলিকাল। এখন গণতন্ত্র বারিধারার লাল বাড়ি আর উত্তর পাড়া হইতেই জন্মায়।
এ এক আজিব দেশ! এ দেশেই বছরখানেক আগে পথে-ঘাটে আদাড়ে-বাদাড়ে কোটি টাকার গাড়ি, লাখ টাকার টিন আর বেহেশতি বাগিচার হরিণ-ময়ুর-অজগর গড়াগড়ি খেত। এখন সেই দেশেই ভুখা-নাঙা মানুষ পথে পথে গড়াগড়ি দেয়। গাড়িগুলা আবার চলা শুরু করে, হরিণেরা বাগিচায় ফেরত যায়। র‌্যাডিসন হোটেল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফার তকমা অর্জন করে। হোটেলটির মালিক কোটালকল্যাণ সংস্থা। সেই কোটালের হোটেলে বসিয়া বিলাত-মার্কিন-ভারত-পাকিস্তানের কর্তারা বাংলাদেশের ভালর জন্য মিটিং করে। ইহারা বহুকাল এই দেশ পদানত রাখিয়াছিলেন বা রাখিতে মেহনত করিয়াছিলেন। সেই অভ্যাসে এখনও তাহাদের পা টনটন করে। তাই আবার তাহারা রাজত্বের খোঁজ লইতে আসিয়াছেন। কোটাল রাজ ইহাদেরই আন্তর্জাতিক বাহিনীতে হাবিলদারির চাকরি করিতেন। মুনিবরা ভাবিল এ-তো খাসা! ইহাকে দিয়াই হইবে। এবং তিনি হইলেন।
দেখিয়া শুনিয়া আমার কেবলি মনে পড়ে, চেসোয়াভ মিউশের একটি কবিতা। সেইখানে ইঁদুরদের কুলপতি কী এক প্রয়োজেন একাধিক বিজ্ঞ ইঁদুরকে ঊর্ধ্বলোক পরিদর্শনে পাঠাইয়াছিলেন। তাহাদের মধ্যে বিজ্ঞতমটি যখন মাটির ওপরে আসিল তখন সন্ধ্যাবেলা। বাতাসে বৃক্ষের ডাল দুলিতেছে। অন্ধকার নামিয়া আসিতেছে। তো সেই বিজ্ঞ ইঁদুর সাব্যস্ত করিল, 'ঊর্ধ্বলোক আদতে নীচেকার মতোই। কেবল সেইখানে উর্ধ্বচারী শিকড়েরা নড়াচড়া করে'। আহা কেউ যদি উহাকে সোজা করিয়া দেখা পৃথিবী দেখাইতো! তাহলে সে পৃথিবীকে চিনিত এবং নিজেকেও জানিত।
তাইলে তিনি আর 'খোদা আমাদিগকে পরীক্ষা করিতেছেন' বলা কিংবা কয়েক বস্তা চাল বেশি কেনা কোনো নিরীহ ক্রেতার ভয়ের মধ্যে নস্টের গোড়া হাতড়াইতেন না। আয়নার সামনে দাঁড়াইতেন।
পাঠক, মাফ করিবেন পাঠিকা দেমাগ লইবেন না! আমার কেবলি কথা মনে পড়ে! সুকুমার রায় নামক এক দুষ্টু লোক লিখিয়া গিয়াছিলেন:
''ধেড়েটার বুদ্ধি দ্যাখ,
চড় মেরে সে নিজের গালে
কে মেরেছে দেখবে বলে
উঠেছে গিয়ে ঘরের চালে''।
রায়সাহেব তো লিখিয়াই খালাস, এখন উহাকে চাল হইতে নামাইবে সাধ্য কার?


মন্তব্য

বিপ্লব রহমান এর ছবি

ভাত দে হারামজাদা!


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

মুজিব মেহদী এর ছবি

সেনানিবাসগুলোতে মাত্র একমাস চালের বদলে আলু চালালে চালের ওপর থেকে যে পরিমাণ চাপ কমবে, তাতে দাম অনেকটাই সহনীয় হয়ে আসবে।

এরকম কি সম্ভবই নয় যে, ক্ষুধার্ত মানুষ সেনানিবাসগুলোর প্রবেশপথে জড়ো হয়ে চাল ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল?

................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আহাহা
করলেন টা কী?
খামাখা একটা ভালো মানুষকে দোষ দিলেন

তিন যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো তো বাজারের জিনিসপত্র যাচাই করে বলেননি

তার এ্যাসাইনমেন্ট ছিল বাজারে যাওয়া
এবং ফিরে এসে বাড়ি থেকে লিখে নিয়ে যাওয়া স্টেটমেন্টা সবাইকে পড়ে শোনানো

তিনি তাই করেছেন
এছাড়া আর কীই বা করতে পারতেন। তার বিশেষজ্ঞারা যে বহুদিন খেটেখুটে এই স্টেটমেন্টা তৈরি করেছে। তারপর পরিষদ সেটা পাশ করেছে এবং তারই উপর দায়িত্ব দিয়েছে সেটা জনগণকে বলার....

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

দে আর নাউ লুকিং ফর শত্রু'জ_এক্সেপ্ট ইন দেমসেলভস
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

বিপ্লব রহমান লিখেছেন:
ভাত দে হারামজাদা!

বিপ্লব ভাই, আপনার সেনা প্রধান বিষয়ক পোস্টে দেয়াল লিখন এর কথা বলেছেন । সেই সুত্র আপনার উপরের উক্তির নেপথ্য ইতিহাস লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না ।

এটি জাসদের মুখপাত্র গনকন্ঠ তে ছাপা হয়েছিল যা পরে কবি রফিক আজাদ তার কবিতায় ব্যবহার করে।

ঐ পত্রিকার সম্পাদক এমনই দাবি করেছেন ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আইচ্ছা ওরাই বরং আলু খাওয়া শুরু করে না ক্যান? তাতেও তো কিছু চাইল বাঁচে....



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হ্যাঁ সেনাবাহিনী মনে হয় ভাত পছন্দ করে না। আইয়ুব খান ভুট্টা খাওয়াইতে চাইছিলেন, তাতে প্রতিবাদ হয় এবং গুলিতে লোক মারা যায়। জিয়া এবং এরশাদও আলু নিয়া আহ্লাদ দেখাইছিলেন।
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে নির্ঘাত লিখতেন:
হায় চাল, সোনালী দানার চাল...

স্বঘোষিত জনস্বার্থ দেখে নিজেকে আর 'জন' মনে হচ্ছে না, খুঁজে পাচ্ছি না নিজের স্বর্থের খবর

---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।