বাংলা উপন্যাসের ডিকলোনাইজেশন ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি
লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ (তারিখ: রবি, ২২/০৬/২০০৮ - ৬:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্ব

এভাবেই, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড়শ্রীখণ্ডে দেখবো যে সব শেষ হয়ে গেল, সব ভেসে গেল। বানের তোড়ের মধ্যে শুধু দুই শান্দার ইয়াজ আর সুরতুন গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে নতুন জাগা ভূখণ্ডে। তারা শেষের শুরুর দুই নারী-পুরুষ। নতুন এক জেনেসিসের নায়ক-নায়িকা। সেই নতুন চরটা হচ্ছে পূর্বদিকে। অর্থাত নতুন ইতিহাস শুরুর ইঙ্গিত পাচ্ছি, একটা ময়না দ্বীপে ও আর এ নতুন চরে। এই নতুন জাগা চরকে কি নতুন বাংলাদেশ বলা যায়? এই কাহিনীগুলো ২০/৩০ এর দশকের পূর্ব বাংলার কাহিনীও বটে। গ্রাম সমাজের ভাঙ্গন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং নতুন সামাজিক ও উতপাদন সম্পর্কের আবির্ভাব এর বিষয়। যেখানে রেললাইন হচ্ছে, কলকারখানা হচ্ছে, ব্যবসায়িরা আসছে। এসবের সমান্তরালে চলছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। এই ভাবে ধরে ধরে যেটি দেখবো যে ওই ভাঙ্গাগড়া বা একই কাহিনী নিয়ে প্রায় প্রত্যেকে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকে কাহিনীকে নিজেদের মতো করে তাতপর্য দেবার চেষ্টা করেছেন এবং নিজস্ব সিদ্ধান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন।

এখন সেই জায়গা থেকে যদি আমরা খোয়াবনামাকে তুলনা করি তাহলে সেখানেও আমরা ‘খোয়াবনামা’র সঙ্গে অন্যদের একটা দ্বৈততা দেখতে পাই। প্রথমত দেশভাগ, স্বাধীনতা এবং আধুনিকতার প্রবেশ: এই তিনের মধ্যে একদল ব্যস্ত দেশভাগের বেদনাবিধূরতা নিয়ে, আরেকদল আধুনিকতাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নিচ্ছেন ইতিহাসের অনিবার্যতা হিসেবে। কিন্তু খোয়াবনামায় দেশভাগ নিয়ে কোনো মায়াকান্না নাই। এখানে হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি উপন্যাসটা যদি আমরা খেয়াল করি: পুরো উপন্যাসট একজন নারীর আÍকথন। সে দেশভাগ মানতে পারছে না। পরিবার ভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং পরিবারকেও ছেড়ে দিচ্ছে সে। আর সে থেকে যাচ্ছে নিজের জায়গায়। ফিনিক্স পাখির মতো ওই ধ্বংসস্তুপে আবার বাঁচার চেষ্টা করছে এবং তার পরিবার চলে এলেও সে কিন্তু পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে এল না। এটা হতেই পারে তবে এই ফিলিংসটা পশ্চিমবঙ্গবাসীর হতে পারে, বা যাঁরা এখান থেকে চলে গিয়েছেন তাঁদের হতে পারে। কিন্তু যে পশ্চিমবাংলাকে পূর্ববাংলার কৃষক কোনো কালে দেখেনি, পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত যে কলকাতাকে সব সময় ঈর্ষার চোখে দেখেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেছে, তার জন্য তো আসলে মায়াকান্নার কোনো জায়গা নাই। পূর্ববাংলার অবস্থান থেকে এই কান্নার জন্ম একটা আদর্শবাদী রাজনৈতিক প্রকল্পের ভেতর। তাই আদর্শবাদী প্রজেক্ট হিসেবে অখণ্ড বাংলার প্রশ্নটা কেউ আনতেই পারেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার কৃষকের জীবনে তো পাকিস্তানপ্রাপ্তি ছিল একটা মুক্তির প্রশ্ন। এবং এই মুক্তির প্রতারণাটাই কিন্তু খোয়াবনামার কাহিনী। সেখানে পাকিস্তান হচ্ছে সেই স্বপ্নপূরণ, যেটা পেলে আমরা সমস্ত কিছু পেয়ে যাবো। অথচ যেদিনই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সেদিনই খোয়াবনামা হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাত স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। ওখানে একটা দৃশ্য আছে, যেদিন পাকিস্তান স্বাধীন হলো সেদিনই বিদ্যুতের উঁচু খুঁটিতে পাকিস্তানের সবুজ পাতকা লাগাতে গিয়ে পড়ে মারা যায় এক যুবক। সে পড়ে পতাকার ওপর, আর তার শরীরের রক্ত সেই পতাকার সবুজ জমিনের মাঝখানে একটা লাল ছোপ তৈরি করে। ইলিয়াস এভাবেই দেখেন। তো খোয়াবনামায় একদিকে পাকস্তান নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ এবং আরেকদিকে অখণ্ড বাংলা নিয়ে মায়াকান্না না করা। এই দুয়ের মধ্যে আবার একটা তৃতীয় গন্তব্য তিনি বেছে নিচ্ছেন। যেটা আবার অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড়শ্রীখণ্ডে’ দেখা যাচ্ছে, বন্যার পরে এক চরে এসে দাঁড়াচ্ছে এক নারী ও পুরুষ। সেখানে এসে হাজির হচ্ছে জোতদার আলেফ মিয়াও। দাঁড়াচ্ছে তারা নতূন ভূমিকায়, নতুন দ্বন্দ্বের বিকাশ ঘটছে তাদের মধ্যে। সে চরটি পূর্বদিকে এবং সেই নতুন ভূমিকা হচ্ছে বাংলাদেশের উদ্ভবের শর্ত। মূলত এখানে বাংলা সাহিত্য এবং নিম্নবর্গের ইতিহাসের একটা অন্যরকম মোচড় ঘটেছে। যার মধ্য দিয়ে দেবেশ রায়ও স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশের সাহিত্য স্বতন্ত্র হচ্ছে। আর তাতে ইলিয়াসের একটা ভূমিকা রয়েছে।

সেই জায়গাটিতে যাওয়ার আগে উপন্যাস নিয়ে আরও দুএকটি কথা বলা দরকার। সাধারণত উপন্যাসে ধরে নেওয়া হয় যে, দু ধরনের জিনিস থাকবে বা থাকা উচিত কিংবা তারা বিদ্যমান। একটা হচ্ছে ন্যাচারালিজম যেটা খুবই রোমান্টিক। আরেকটা পাচ্ছি রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ। এবং এই বাস্তববাদের কাজ হলো নিস্পৃহ দৃষ্টিতে বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা, যা লেখক দেখছেন কেবল তা-ই আনা। আর ন্যাচারালাজিমের কাজ হচ্ছে, বাস্তবতার অতীত কোনো ভাবের প্রকাশ ঘটানো। অর্থাৎ যা নেই বাস্তবতার মধ্যে সেটা কল্পনা করা, ভীষণভাবে রোমান্টিক। এই দুয়ের মধ্যে তুলনা করে গিয়র্গ লুকাচ বলেছেন যে, উপন্যাসকে বস্তুবাদী হতে হবেÑ হতে হবে ইতিহাসবাদী। আর উপন্যাস যেহেতু বুর্জোয়া সমাজের ফসল অর্থাৎ ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসেরও বিকাশ হয়; সেক্ষেত্রে ব্যক্তির পতনের অর্থাত বুর্জোয়া সমাজের পতনের পর উপন্যাসেরও পতন হতে পারে। এ শঙ্কা তিনি প্রকাশ করেন। তার রেশ ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের থিওডর অ্যাডর্নো তাঁর ডায়ালেক্টিক অব এনলাইটেনমেন্টে উপন্যাসের উতস অনুসন্ধান করতে গিয়ে গ্রীক ট্রাজেডির ভেতর পর্যন্ত দৃষ্টি দিয়েছেন। বুর্জোয়া চেতনার উতপত্তি খুঁজতে গিয়ে গ্রীক সময় পর্যন্ত যাচ্ছেন। মোট কথা দাবিটা হচ্ছে এই, কোনো সাহিত্য শুধু কোনো বিশেষ যুগের বা বিশেষ শ্রেণীর ফসল নয়; এটা বিশেষ একটা ধরন যা নিয়ে লেখক নিজের সময়, জীবন ইত্যাদিকে উপস্থাপন, ব্যাখ্যা কিংবা তার উন্মোচন ঘটান। বাস্তববাদের সমস্যা হলো তা সাহিত্যকে সমাজতত্ত্বে নামিয়ে আনে আর রোমান্টিক কল্পনাচারিতার মুশকিল এই যে, তা অধিবিদ্যা হয়ে ওঠে। শিল্পের যে সাবজেক্টিভিটি জগত ও জীবন সম্পর্কে নতুনতর বোধ ও দিশা দেবার মাধমে জ্ঞানের অন্যান্য শাস্ত্রের মতোই অন্টোলজিকাল কাজ সাধন করতে পারে, সেই মাত্রাটা তখন হারিয়ে যায়। কেননা শিল্প কেবল যা আছে তার কথা নয়, যা নাই বলে মনে হয়, তারও কথা। তা অবিদ্যমানের নিঃশ্বাস, বিদ্যমানের প্রশ্বাস।

খোয়াবনামায় কৃষক চৈতন্যের রূপান্তর ঘটতে দেখি আমরা। ইলিয়াস দেখান স্বপ্নশাসিত কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ানো এক জীবন। সেই স্বপ্ন ফকির মজনু শাহ’র অনুচর মুনশী বয়তুল্লাহর প্রতিশ্র“তিরও যেমন আবার পাকিস্তানপ্রাপ্তির আশাও তেমন। মুনশীর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, কিন্তু মুনশীকে দেখা যায় না। মাঝিপাড়ার মাঝিরা দেখে রাতের বেলা কাৎলাহারের বিলের উত্তর শিথানের পাকুড় গাছ থেকে ছড়ানো মুনশীর জালের মধ্যে বিলের এপার ওপার, মাঝি পাড়া জেলে পাড়া জোলা পাড়া কুলুপাড়া সব একাকার হয়ে গেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, বাস্তবে নয় স্বপ্নে এমন মিলন সম্ভব। যেখানে এমন একটা সময় বা সমাজ থাকবে যেখানে এই জিনিসগুলো আলাদা থাকবে না। এবং একাকার করবার মধ্যস্থতা করে ইতিহাস থেকে মিথের অবয়বে আসা এক চরিত্র। সে বর্তমানে নেইÑমৃত, কিন্তু সে আবার ইতিহাসেরও অংশ এবং সে কিংবদন্তীর চরিত্র। আধুনিক যুক্তিশীল মনে তার অস্তিত্ব নেই, আমাদের সময় একরৈখিক আর ওখানে অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যত একাকার হয়ে বিরাজ করে। আমরা একে কুসংস্কার হিসেবে দেখতে পারি, যেটা অনেকেই দেখেছেন, কিংবা তারা নিম্নবর্গের ইতিহাস চৈতন্যে মিথ-বিশ্বাস-ধর্মভাবের সক্রিয়তা দেখতে পান না। ফলে ঐ জগতের মধ্যে তার সংগ্রাম ও মুক্তির আকাক্সার আদলটা বোঝাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। রিয়েলিজম একে বুঝবে না। কিন্তু তার মানে এটা ম্যাজিক রিয়েলিজমের কুহকও নয়। আমার সময়ের মধ্যে, আমার সংস্কৃতির মধ্যে আমার মনের মধ্যে তার যে রূপ দানা বাধার চেষ্টা করছে তার স্বরূপটা যদি আমি বুঝতে না পারি; তাহলে কিন্তু আমি আমার বর্তমানকে ঐ সীমিত বাস্তব হিসেবেই দেখবো, যে বাস্তব প্রসারিত হবে না। খোয়াবনামার মধ্যে এই রোমান্টিসিজম বা ন্যাচারালিজম এবং রিয়েলিজমের প্রভাব ওভাবে দেখতে পাই না। কিন্তু দুটোরই যে মূল বৈশিষ্ট্য, মূল শ্বাস যেটা স্বপ্ন দেখায় একদিকে, অন্যদিকে বিষয়কে বিষয়ের চারপাশের বিশাল পরিমণ্ডলের মধ্যে দেখতে শেখায় সেই লণটার উপস্থিতি পাই। বাস্তবের মধ্যে একটা অন্য-বাস্তব তৈরি করে, যা এই বাস্তবকে সমালোচনা করতে শেখায়, তুলনা করতে শেখায়। এই বাস্তব থেকে যদি বড় মানদণ্ড আমার না থাকে, তাহলে আমি কীসের নিরিখে বুঝবো? ব্যাপারটা ঐ গল্পটার মতো হবে যে দর্জির কাছে এক লোক গিয়েছে সে জামার মাপ দিচ্ছে দর্জি বললো যে, বহর কতো? ৬০, কোমর কত? ৬০ বেড় কত? ৬০। তো ঐ ব্যক্তি রেগে গিয়ে বলছে, বেটা আমি কি শুয়োর না কি? আমার আগাপাশতলাবহর সব সমান! উত্তরে দর্জি বলে, ভাই আমি কি করবো, আমার এই ফিতাটার সব দাগ মুছে গেছে, শুধু ৬০ দাগটা আছে যে! আমাদেরও যাতে তেমন না হয়!

আমাদের বাস্তববাদ যাতে সেই জায়গায় না হয় যেখানে আমি আমার স্কেল দিয়ে মাপবো। আমি দেবেশ রায়ের উক্তি থেকে এবং তার সঙ্গে দ্বিমত করেই বলছি যে, উনি বলছেন বাংলাদেশের উপন্যাস অনাগরিক আর সেই অনাগরিকতার কথা মোহাম্মদ আজমও বললেন। এবং ঠিকই তো এই সমাজ ঐ রকম বুর্জোয়া বিকাশের মধ্য দিয়ে যায়নি। যেটা কলকাতার সমাজ গিয়েছিল। এই সমাজ এখনও আধা কৃষক বা আধা মফস্বলীয় চরিত্রগুলোকে লালন করছে। এই সমাজ প্রধানত এখনও পর্যন্ত নিম্নবর্গীয় সমাজ। এর যে কণ্ঠ সেটা ব্যক্তির কণ্ঠ হতে পারে না। ব্যক্তিকে নায়ক করে কিংবা মহৎ করে এই জনগোষ্ঠীর বাঁচামরা কিংবা তার টানাপড়েন, তার আকুতি, তার ঐতিহাসিক যাত্রা ও রাজনৈতিক মাত্রাকে আমরা ধরতে পারবো না। ফলে উপন্যাস একটা নতুন রূপ নেবে পূর্ববঙ্গে। নেওয়াটাই স্বাভাবিক। যেটা ল্যাটিন আমেরিকায় নিয়েছে বা আফ্রিকায় নিয়েছে। আগেই বলেছি যে, উপন্যাসের সঙ্গে আশু-পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতা থেকেই যে ঐ বাস্তবতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এখন যে প্রশ্নটা এসে দাঁড়ায় সেটা হচ্ছে যে, এ কাজটি বা প্রচেষ্টাটি শুরু হয়েছিল আমাদের এখানে মানিক- ওয়ালিউল্লাহ-র হাত ধরে। সেখান থেকে ইলিয়াস পর্যন্ত প্রত্যেকেই একটা একটা রিয়েলিটি খুঁজেছেন বা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে ময়নার দ্বীপ সৃষ্টি হচ্ছে। যেটা এই সমাজ ইতিহাস ও ভুগোলের বাইরে একটা জায়গা। দেবেশ রায় তার ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’তে তৈরি করেছেন যে বাঘারু নামের এক আধা সভ্য, আধা প্রাকৃতিক, আধা মানবিক আর আধা জান্তব একটা চরিত্রকে। আমরা দেখবো যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালুতে বাস্তববাদীতা প্রধান, আর কাঁদো নদী কাঁদোতে তিনি তৈরি করেছেন কুমুরডাঙ্গা নামের নিমশহর যা আমাদের বাস্তবতার বাইরের একটা জায়গা। এবং এই শহরটা ইতিহাসের বাইরে রয়ে যাচ্ছে এবং তার কান্না আমরা শুনতে পাই।

এভাবে আমরা প্রত্যেকের মধ্যে দেখবো যে একটা নতুন জায়গা খোঁজার চেষ্টা করা এবং সেটার জন্য নতুন ভাষা-ভঙ্গিমা-পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখি। এবং এটা করতে গিয়ে ইলিয়াস ফিরলেন ঐতিহ্যের কাছে। যেটা আমরা ষাট দশকীয় আধুনিকতার তোড়ে বাতিল করে দিয়েছিলাম। কৃষক জনগোষ্ঠীর ভাষা-রূপ-অভিজ্ঞতা উপো করেছিলাম। তার সৌন্দর্যানুভূতির সঙ্গে আধুনিক রুচিবান-সংস্কৃতির হেলেনিক সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে বিবাদ থাকে। সেখানে ঘ্যাগওয়ালা একটা মেয়েকেও তার প্রেমিকের কাছে সুন্দর মনে হতে পারে। ইলিয়াসের কাজে নন্দনতত্বের বিদ্যমান গড়নেরও একটা সমালোচনা তাই উঠে আসে। সুতরাং ওই জায়গা থেকে স্বপ্নের যে রূপান্তর: যেমন উপন্যাসের শুরুতে তমিজের বাপ কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে মেঘ তাড়াচ্ছে আর মুনশী বয়তুল্লাহকে খুঁজছে। আর শেষ দৃশ্যে এসে তমিজের মেয়ে সখিনা শক্ত মাটিতে পা রেখে চাঁদের হেসেলে জোনাকির আলোয় ভাত রান্না হতে দেখে আকাশে। কুয়াশাকে তার ভাতের ভাপ বলে মনে হয়। তাই তমিজের বাপের স্বপ্নটি হারিয়ে যাচ্ছে না কিন্তু সেই স্বপ্নের জমিন আরও শক্ত। এবং সেই মুহূর্তেই চেরাগ আলী ফকিরের খোয়াবনামাটি হারিয়ে যাচ্ছে। তার মানে এখন আর অর্ধচেতনে নয়, ইতিহাস পূর্ণচেতনতার মধ্যে প্রবেশ করেছে। এরকম দ্বিত্ব আরো পাব। তমিজের বাপ খোঁজে মুনশির পাকুড় গাছ আর তমিজ ছোটে তেভাগার দিকে। এই যে কৃষক চরিত্রের রূপান্তর, খোয়াবনামা হচ্ছে তার আখ্যান এবং এটার কখনোই রিয়েলিস্ট উপন্যাস হওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য লৈাকিক বিশ্বাসে এবং আঞ্চলিক ভাষা-ভঙ্গিমাকে নানাভাবে আশ্রয় করতে হয়। এই উপন্যাসকে আমরা কখনোই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের মডেল বা তার যে গদ্যভাষা বা তার আকার আয়তনের মধ্যে কখনোই পড়তে পারবো না।

আমার আলোচনার এই জায়গায় এসে শেষ করবো যে, উপন্যাস তো শেষ পর্যন্ত একটা প্রবাহ। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের উপন্যাসের পুরো কাহিনী মনে থাকে না। কিন্তু উপন্যাস একটি পুর্ণাঙ্গ কাহিনীও বটে কিন্তু সেখানেই তা শেষ হয় না। শেষ পর্যন্ত যেটা আমাদের মনে থাকে সেটা হচ্ছে একটা বিমূর্ত অনুভূতি বা উপলব্ধি। একটা বিরাট যাত্রা শেষে যাত্রার প্রতিটা বাঁক আমরা মনে রাখি না বরং তার নির্যাসটা মনে রাখি। সেই বিমূর্ত চৈতন্যটাই হচ্ছে উপন্যাসের চৈতন্য। আর এটা যদি আমরা দাবি করে থাকি, তাহলে খোয়াবনামার ঐতিহাসিক চৈতন্য এবং তার পূর্ববর্তী উপন্যাসের চৈতন্যের মধ্যে একটা মৌলিক বদল ঘটে যায়। এর মধ্য দিয়েই সীমিত অর্থে বললে উপন্যাসের উপনিবেশায়ন বা উপনিবেশীকরণ থেকে মুক্ত করার জায়গাটি এসে দাঁড়ায়। এই কাজে ইলিয়াস আমাদের নতুন এক পথের দিশা দেখান, যা আবার তাঁর পূর্বসূরীদের অস্বীকার করে না, বরং কয়েক যুগের অনেক মনীষির কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে, তাকে উত্তরণের দিকে নিয়ে যান। আমার প্রস্তাব: ইলিয়াস আমাদের জন্য এক নতুন ঐতিহ্যের ঘরানা ও বাহিরানা হাজির করেছেন। সেই ধারাকে বোধহয় আমাদের অবলম্বন করতে হবে।


মন্তব্য

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

ইলিয়াসের ফেরাটাকে বুঝতে পারা লেখালেখির জন্য খুব জরুরী।
ধন্যবাদ ফারুক ওয়াসিফ।

---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ঠিকাছে।

১৯৯৯ সালের ৫ বা ৬ জানুয়ারী সম্ভবত মুক্তকণ্ঠে খোয়াবনামা: বাংলা সাহিত্যে কৃষক চৈতন্যের রূপান্তর নামে একটা লেখা পড়ছিলাম। ঐটাও ভালো লাগছিল।

ফেরা প্রসঙ্গে শুধু একটু ছুট্ট ফোড়ন কাটবো।

ইতিহাসে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহা বোধকরি ইতোমধ্যেই বহুমাত্রিক দ্বান্দ্বিকতা গলাধ:করণ করিয়াছে। আজিকার চলমান দ্বন্দ্বে সহস্রচ্ছিন্ন আমি বা পারিপার্শ্ব কিন্তু জড়বাদের অর্থে আর ফিরিতে পারি না। যা পারি তা হলো এই সহস্রচ্ছিন্নতাকে ফিরিয়া ফিরিয়া পরবর্তী ফুটোস্কোপে মাপিতে, যাহা আমার আজিকার স্বত্ত্বার অচেনা বা বিস্মৃত কিমা কিম্বা বটিকণা চিনাইবার প্রয়াস পায়। আক্ষরিক অর্থে ফেরার অর্থ বিগত শখানেক বৎসরের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের নথিপত্রসমূহ এককথায় বাতিল করিয়া, হৈলে কী হৈতোর দেয়ালেপাটাতনে মাথা টাকানো। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাহা করেন নাই বলিয়াই জানি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে।

সুতরাং ফেরা নহে, ফিরিয়া দেখা। যে দেখা আজিকার আমি'র রসায়ণ চেনায়।



ঈশ্বরাসিদ্ধে:

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

গুড জব ।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

লেখাখানা তোমাকেই উতসর্গ করা গেল সুমন চৌধুরী।
অপিচ তোমার ফোড়নটা যথার্থভাবেই ফাটিয়াছে এবং আমার ডাইল ঘুটায় কিঞ্চিত সৌরভও বাড়াইয়াছে।
কথা হইল, ধর্ম, সেকুলারিজম বা ইতিহাস প্রশ্নে আমি ঊনিশ শতকীয় বিশ্বজনীনতাকে অস্বীকার করিয়া আসিতেছে একটা কারণে। প্রথমত তাহা ইতিহাস সম্মত হয় না বলিয়া এবং দ্বিতীয়ত উহাতে এককেন্দ্রিকতার দোষ আছে।
ফিরিবার খায়েশ আমার নাই, তাহা আমি ইতিহাসের ওপরও চাপাইব না। ইতিহাসে কোনো মজুদ বিন্দু বা জংশন নাই যেইখানে গিয়া আবার শুরু করা যাইবেক। যাহা আছে তাহা বর্তমানেই আছে। তাহার এক পিঠ লইয়া অর্থাত পুঁজির বাসনাকে নিয়া আমরা যত বলি, সেই পুঁজি স্থানীয় শর্তের কারণে যে বদলাইয়া যাইয়া কোর্সের বাহিরের ফল ফলায় তাহা খেয়াল করা হয় না।
সাহিত্যে, সংষ্কৃতিতে এবং রাজনীতিতে ডিকলোনাইজেশন না হইলে বিপ্লবও হয় না। পৃথিবীতে ইহার বিপরীত কোনো প্রমাণ নাই। কোনো ব্রিটিশ কলোনীতে সেইজন্য বৈপ্লবিক কিছু ঘটে নাই। কারণ ব্রিটিশরা সংষ্কৃতি ও শ্রেনীগঠন পর্যন্ত পাল্টাইয়া দিতে সক্ষম হইয়াছিল। ইহার নেতিকরণ না ঘটাইলে কোনো অগ্রগতি সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।
সাহিত্যে এই কাজ চিনুয়া আচেবে, এমে সেজেয়ার কার্পেন্থিয়েররা করেছেন। বঙ্গদেশে ইহার তাগাদা অনুভূত হইতেছে মাত্র। চিরাচরিত ব্যববহারে ব্যবহারে জীর্ণ নির্ধারণবাদের খোপে এই সত্য হারাইয়া যায়। তখন মনে হয়, রাজনৈতিক স্বচৈতন্য হইল 'আজিকার স্বত্ত্বার অচেনা বা বিস্মৃত কিমা কিম্বা বটিকণা'।
হইলে কী হইতো'র আলোচনা কৈশোরিক, সেই কাল কাটিয়াছে। কী হইতেছে তাহার বিশ্লেষণে দেখি, পুঁজির বিশ্ববিজয়ে যাহা ঘটিবার কথা তাহা ঘটিতেছে না। অঞ্চল মাথা তুলিতেছে, আত্মপরিচয় বোধ ধর্মের নামে প্রখর হইতেছে এবং ভিন্ন ভ্ন্নি ইতিহাসকাঠামোর দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের নতুন বলবিদ্যা প্রষ্ফূটিত হইতেছে। ইহাকে অস্বীকার করিয়া চাঁদের বুড়ির চরকায় আবারো সুতা কাটা যায়, তবে সেই সুতা মাকড়সার জাল ভিন্ন আর কোনো কাজে লাগিবে বলিয়া মনে হয় না।

সুতরাং ফেরা নহে, ফিরিয়া দেখা। যে দেখা আজিকার আমি'র রসায়ণ চেনায়।

সেই রসায়নের রং কিন্ত বিশুদ্ধ লাল নয়। বিশুদ্ধ নং হয় তত্ত্বে ও বিমূর্ততায়, মূর্ত লাল গোলাপের মতো বা রক্তের মতো বা গোধূলির মতো। কেবল লাল বলিয়া কিছু প্রকৃতিতে নাই। তাই বিশ্বজনীনতাকে স্থানীয় রংয়ে রাঙাতেই হয়। সেইখানেই কবি কাঁদিয়া ওঠেন যে!

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

সঠিক।

তবে কিনা আত্মপরিচয়বোধ সর্বত্র ধর্মের নামে প্রখর হইতেছে না, কোথাও কোথাও আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বের সহিত ঐ অঞ্চলে প্রচলিত ধর্মবোধ ঐতিহাসিক কারণে মিশ্রিত হইতেছে। ইহার রূপ সর্বত্র সমান নহে, যেহেতু অঞ্চল মাথা তুলিতেছে সেহেতুই নহে। দূরপ্রাচ্য,মধ্যপ্রাচ্য এবং বঙ্গদেশের পৃথক রসায়ণ ঐক্যতানের পরিবর্তে বিশেষায়নের ঝাড়িই মারিতেছে, সরলীকরণের বিপরীতে।

এই আর কি.....



ঈশ্বরাসিদ্ধে:

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

এই কথাই তো বলিতে চাহি সরলীকরণের বিপরীতে। লাউ আর কদু কি আর এক হইয়াও কম সাধে আলাদা!

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

রাগিব এর ছবি

কঠিন পোস্ট, যদিও অনেক খানিই মাথার উপর দিয়ে গেছে। কমেন্টেও জাঝা। তবে আমার মতো নাদান মিস্তিরিকূলের জন্য একটু শানে নযুল সহকারে দিলে ভাল হতো হাসি


যে পশ্চিমবাংলাকে পূর্ববাংলার কৃষক কোনো কালে দেখেনি, পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত যে কলকাতাকে সব সময় ঈর্ষার চোখে দেখেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেছে, তার জন্য তো আসলে মায়াকান্নার কোনো জায়গা নাই।

আসলেই। দেশ বিভাগের আদর্শিক ও মানবিক দিক ও রোমান্টিকতা বাদ দিয়ে চিন্তা করতে গেলে, নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে দেখতে গেলে, আমার কৃষক পিতামহের চোখে দেখলে দিনের শেষে মনে হয়, পূর্ববঙ্গের জন্য আখেরে সেটা মঙ্গলজনকই হয়েছে। খেয়াল করুন, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছিনা, এটা বলছি ব্যক্তিস্বার্থের বিচারে। অন্তত আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আদৌ রূপ নিতো না, আর আমার পিতার প্রজন্মও মফস্বুলে হয়ে থাকতো, সেটার চেয়ে হয়তো যা হয়েছে, ব্যক্তি হিসাবে আমার জন্য ভালো হয়েছে।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

আসলে এইটা একটা লেকচার মার্কা জিনিষের ট্রান্সক্রিপ্ট। আগের আলোচকের সূত্র ধরে এবং পরের বিতর্কের কথা মাথায় রেখে লেখা। ভাষাটাকে আর মসৃণ করার সময় পাইনি।
দেশভাগে লাভ হয়েছে দেখা যাচ্ছে। ক্ষতিও যে হয় নাই তা নয়। বড় লাভ ভাষাভিত্তিক সেকুল্যার আত্মপরিচয় নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করতে পারা। এটা আর মুছবে না।
তবে এখানকার বিদ্বত সমাজের মধ্যে একটা ভাবনা আছে যে, দেশভাগ একটা বিরাট ক্ষতি। ওয়াহিদুল হক মনে করতেন এই দোষে বাঙালি মুসলমানরা পাপী। এর জবাবে দেবেশ রায় বলেন, সেই পাপ তো তাহলে সমান মাত্রায় হিন্দু বাঙালিরাও করেছে।
আমি দেশভাগকে পাপ মনে করি না, দুপক্ষই সমান ভাবে সম্মত হয়েছে যে, তারা এক থাকবে না। এক থাকলে ভারতের পাশে বিরাট এক সমৃদ্ধ বাংলা হতো কি? মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের অধীনে হিন্দুরা থাকতে চাইতো কী? দেশের কেন্দ্র অনুর্বর-উষর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে গঙ্গার মতো সরিয়ে আনায় রাজি থাকতো কি? আরেকটা বিরাট দাঙ্গার পর আখেরি দেশভাগ হতো না কি? তাই যা হয়েছে, তার বিকল্প তখন ছিল না, এ ভেবে যা পেয়েছি তার তাতপর্য ও যত্ন নেয়াটা বেশি জরুরি। আর ঐ পাপবোধ এক ধরনের মানসিক প্রবাস থেকে আসা। মুসলমান অভিজাত আরব-ইরানে বাস করতে মনে মনে, আর অভিজাত বাঙালি কলকাতা-লন্ডনে বাস করতে চায় মনে মনে। সেকারণেই বলা যে বাংলা পূর্ববঙ্গের কৃষক কখনো দেখেইনি, সে দেখেছে কলকাতার জমিদার, নবাব-নাইট, বড়লাট আর মুতসুদ্দী। কলকাতার আলো কখনোই তার ঘরে আসেনি। সেই কলকাতাকে হারাবার বেদনা সে পাবে কোত্থেকে? বরং দেশভাগে সে তার দেশে পেয়েছে। এটা তার পয়েন্ট অব ভিউ, এবং এতে দোষের কিছু দেখি না। এর বাইরে সাহিত্যে ও রাজনীতিতে বিভিন্ন ইউটোপিয়ার আসক্তি চলে, সে বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সাধক শঙ্কু এর ছবি

পরিণতি বিচারই বিবেচ্য। সেই পরিণতি কি আসলে সিরাতুল মোস্তাকিমে গেছে? সবরকম পরিবর্তনের নানা রকম বেনিফিশিয়ারী থাকে। কিন্তু ক্ষতি যতটুক হইছে সেইটাও তো রেকর্ড বুকে থাইকা যায়, নাকি? আইজকা ষাইট বছর পরে বাংলা ভাগ লইয়া হাহুতাশ করা বেকুবের কাম। কিন্তু হুতাশনের এক্কেরে কিছুই ছিল না এইটা ঠিক না। ছিল, অন্তত যাগো গায়ের উপর দিয়া বিষয়টা গেছে তাগো কাছে ছিল। পরে দাঙ্গা লাগতো কি লাগতো না তার থিকা অনেক জরুরি কথা, হইছে দাঙ্গা কত জান নিছে, সেই দাঙ্গার লগে একই টাইমের ব্ল্যাকমার্কেটিং থিকা পাতি লুম্পেনগো পলিটিক্যাল এলিট হিসাবে উইঠা আসার ফলাফল কী হইছে, সেইটা। সব থিকা বড় কথা যা ঘটছে তাতে আলটিমেট লাভ কার হইছে? দাঙ্গা দেশভাগের আসল বেনিফিশিয়ারী সাহেবরা, তাগো সব থিকা বড় হেল্প করছে গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেলগো কংগ্রেস এই কথা মাইনা নিলেও কি মোছলেম লীগের "দ্বিজাতিতত্ত্ব" হালাল হয়? তাইলে যে হিন্দুরা পাকিস্থানে আর যেই মুসলমানরা ভারতে থাইকা গেলো তাগো কী হইবো? জিন্না শালার পুতের লাস্ট বাক্যমোতাবেক যদি সকলেই পাকিস্থানী হয় তাইলে আর হিন্দুমুসলমান দুইজাতি কইয়া গইড়াইয়া কানছিল ক্যা আগের পনের বছর? ইতিহাসের খুঁটিনাটি খুব জরুরি। তাতে সব কিছুই হিসাবে নেওয়া লাগে। তয় কোন হিসাবেই সাম্প্রদায়িকতা হালাল হয় না। সেইটা প্যাটেলই করুক আর নাজিমুদ্দিই করুক।


খোয়াব উড়ে
মিচকা ঘোড়ার কানপাখাতে
মাইট্যা খোলের
বুকের ভিতর শুকনা তাঁতে
ডিগবাজী খায়
খর-বিচালির আস্তাবলে
রাস্তা প্যাচায়
দমভরসার চিমনি জ্বলে


গড়ি দালানকোঠা ফেলে দিয়ে শ্মশাণে বৈঠকখানা

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

পাকিস্তান যেভাবে সৃষ্টি হয়, সেই ভাব কিন্তু ভারতেরও জন্ম দেয় অর্থাত সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। দ্বিজাতিতত্ব ভূল, এক জাতিতত্ত্ব আরো বড় ভুল। আমরা দ্বিজাতিত্ত্বের ভুল সংশোধন করতে পাকিস্তান ভেঙ্গেছি, ভারতে সেই ভুল টাটা-বিড়লা-রিলায়েন্স, কংগ্রেস-বিজেপি-কমিউনিস্ট আর পারমানবিক বোমার বরাতে আজো পরিপক্ক হচ্ছে।
মার্কস তাঁর অন জ্যু কোশ্চেনে দেখিয়েছেন যে, ধর্মীয় দাবি আসলে রাজনৈতিক দাবিরই অপরিণত দশা। আবার ধর্মীয় রাষ্ট্র আসলে রাজনৈতিক রাষ্ট্র হয়ে না ওঠার বিকলাঙ্গতা। এই অর্থে পাকিস্তান ছিল সেই হয়ে ওঠার অবিকশিত পর্যায়। ১৯৪৭ এর পর বাংলাদেশ আন্দোলনের মাধ্যমে সেই দ্বন্দ্বের বিকাশ ঘটেছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে। আর সেই হযবরল-এর পাঁঠার বড় দাদার অর্ধেকটা বাঘে খেলে বাকি অর্ধেকটার সেই দুঃখে মারা যাবার মত করে পাকিস্তানের পোকায় কাটা বাকি অর্ধেকটা মারা যেতে বসেছে। পাকিস্তান ও ভারতকে এখনও ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতা-বর্ণ ও জাতিগত দ্বন্দ্ব সামাল দিয়ে আসতে হবে আর বাংলাদেশকে সামাল দিতে হবে উপনিবেশিক জেরের সঙ্গে লগ্ন থাকা শ্রেণী দ্বন্দ্ব_সাম্রাজ্যবাদমুক্ত হওয়া যার আরেক নাম।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগ নিয়া স্রোতের বিপরীত একটি গবেষণা করেছেন জয়া চ্যাটার্জি তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডে বইয়ে। সেইটা যেভাবেই হোক দেখার আবদার জানাই।
.................................................................................
ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায় চোখ টিপি

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

দিগন্ত এর ছবি

আপনার সাথে আমার মতেও মেলে অনেকটা অন্যভাবে যদিও। দেশভাগ হয়ে আমার বাবা এপারে উদ্বাস্তু হয়ে না এলে পড়াশোনা করে বড় হবার আশা-আকাঙ্খাই আমাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে তৈরী হত না। উদ্বাস্তুর পায়ের তলায় জমি নেই, পাশে নেই আত্মীয় আর আয় বলতে পুরোনো জমানো টাকা। তাই নিয়ে লড়াই করা আর জীবনসংগ্রামের একটাই হাতিয়ার ছিল - সেটা হল পড়াশোনা। পূর্বের কয়েক শতকের জীবনসংগ্রামের হাতিয়ার লাঙ্গল ফেলে তাই কলম তুলে নিতে সবাই বাধ্য হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা, শিক্ষার দাম সবাই বুঝেছে ... এখনও পশ্চিমবঙ্গে মোটামুটি ভাল স্কুল কলেজের অর্ধেক ছেলেমেয়ে আসে ওই এককালের উদ্বাস্তুদের মধ্যে থেকেই, যদিও তারা জনসংখ্যার ১০-১৫%-এরও কম।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

সেকারণে ইতিহাসে বা রাজনীতিতে এবং অবশ্যই সাহিত্যে বস্তগত সত্য পাওয়া কঠিন। সত্য এখানে সাপেক্ষ সম্পর্কের মধ্যে ধরা দেয়। এবং সত্যের দুই তলকে এক করলেই তার কাছাকাছি যাওয়া যায়।
আপনার এ কমেন্টটা না এলে আলোচনায় একটা ঘাটতি থেকেই যেত মনে হয়।
যারা দেশ ছেড়ে গেছেন, তাঁরা যে এদেশকে কম ভালবাসেন নাই তার প্রমাণ জীবনানন্দ দাশ ও ঋত্বিক ঘটক। আমি ইয়ার্কি করে বলি, বাংলা সাহিত্য প্রবাসেই সোনার খনি বসিয়েছে অর্থাত দেশান্তরি বাঙালিরা। জীবনে একটা দ্বন্দ্ব না হলে বিকাশ হয় না বোধহয়। দেশভাগ অনেকের জন্য সেই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিয়েছিল। কিন্তু তার মূল্য এত বেশি এত বেশি...!
দেশভাগের একটা নিট ক্ষতি পূর্ববাংলার সাংষ্কৃতিক বিকাশের গতি স্লথ হয়ে যাওয়া। বিদ্বান লোকেরা, প্রতিভাবান লোকেরা সবাই তো চলে গিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ৩০ হাজার সদস্যই নাকি ওপারে চলে গিয়েছিল।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সাধক শঙ্কু এর ছবি

এই কমেন্ট না পইড়া আগেরটা দিছিলাম। নিজগুণে ক্ষমা কইরেন।


খোয়াব উড়ে
মিচকা ঘোড়ার কানপাখাতে
মাইট্যা খোলের
বুকের ভিতর শুকনা তাঁতে
ডিগবাজী খায়
খর-বিচালির আস্তাবলে
রাস্তা প্যাচায়
দমভরসার চিমনি জ্বলে


গড়ি দালানকোঠা ফেলে দিয়ে শ্মশাণে বৈঠকখানা

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

আপাতত পাচ তারা
বিস্তারিত কমেন্ট পরে করব

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।