মাধবকুণ্ডের কান্নাভেজা চোখ

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন ফিরোজ জামান চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৫/০৮/২০০৯ - ৭:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকবার সিলেট অঞ্চলে গেছি; কিন্তু মাধবকুণ্ড যাওয়া হয়নি- এই শোক দীর্ঘদিনের। এবার আর কিছুতেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। যতই থাক না, মেঘের চোখ রাঙানি আর বৃষ্টির টাপুরটুপুর। আমরা শপথে বদ্ধপরিকর! ২১ জুলাই আমরা তিন ভ্রমণপিয়াসি হাজির হলাম মাধবকুণ্ডে।

কোন কালে, কোনো এক অতীতকালে এখানে আস্তানা গেড়েছিলেন এক সন্ন্যাসী মাধব চন্দ্র, মতান্তরে মাধবেশ্বর- যাঁর নামানুসারে এ এলাকার নাম হয়েছে 'মাধবকুণ্ড' -আজ তা প্রাগৈতিহাসিক। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সে ইতিহাস। এ প্রজন্মের কেউই এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারেন না। এখন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেই মাধবকুণ্ডের পরিচিতি। মাধবকুণ্ডের অবস্থান (সিলেটের) মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়। স্থানীয় পাথারিয়া বনাঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু সীমানাই এখন 'মাধবকুণ্ড' নামে পরিচিত।

পাঁচ টাকা করে টিকিট কেটে শুরু হলো মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক দর্শন। শুরুতেই রয়েছে পর্যটন রেস্টুরেন্ট। এখানে চা-টা খেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে রওনা হলাম গহিনের পথে। জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছানোর বেশ আগেই চোখে পড়ল মাধবেশ্বর মন্দির। একজন সন্ন্যাসী সাধু রয়েছেন মন্দির রক্ষণাবেণের দায়িত্বে। মন্দিরের সামনে তাঁর একটি ছবি তুলেই এগিয়ে চললাম আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে।

এতদিন তো শুধু শুনেই এসেছি, সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোর অন্যতম হচ্ছে মাধবকুণ্ড। এবার স্বচক্ষে দেখার পালা। স্রোতস্বিনী জলের কলকল ধ্বনি শোনা যাচ্ছে কিছুটা দূর থেকেই। মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাতের নেশার টানে আমরা পৌঁছে গেলাম অনেকটা কাছে। কী অপূর্ব! কী দারুণ এই সৌন্দর্য! প্রায় ২০০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে তীব্রবেগে সশব্দে নেমে আসছে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের ধারা। পাহাড়ি জলরাশির মধুর সুরে আচ্ছন্ন হয়ে যায় আমাদের মন। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। একজন স্বেচ্ছাসেবক কিশোর আমাদের দলবদ্ধ ছবিটা তুলতে সাহায্য করল।

আমরা জলতরঙ্গের আরও কাছে এগিয়ে যাই। নিরাপত্তারীর ‌'না'। কাছে যেতে মানা- দুর্ঘটনা ঠেকাতে সম্প্রতি বেষ্টনী দিয়ে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জলপ্রপাতের আশপাশে বড় বড় পাথর। জলপ্রপাতের পানি গড়িয়ে যাচ্ছে একটি অপ্রশস্ত ছড়া দিয়ে। ছড়াটির নাম মাধবছড়া সেখানেও ছোট ছোট পাথরের সারি। একদল কিশোর-কিশোরী পানিতে নেমে এ-ওর গায়ে পানি ছিটিয়ে উপভোগ করছে জলপ্রপাত দর্শনের আনন্দ। জলপ্রপাতের ডান দিকে অর্থাৎ আমাদের বাঁ দিকে তাকালে মনে হবে যেন পাথরের তৈরি এক গুহা। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী স্থানীয় বন্ধু শোয়েব জানালেন, স্থানীয় ভাষায় এ গুহাকে বলে 'কাব'।

হাতে এখনো বেশ কিছুটা সময় আছে। সোহেলের উৎসাহে আমরা ঢুকে পড়লাম মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের গহিনে। ইকোপার্কে চলার সময় দূরে তাকালে চোখে পড়ে ছোট ছোট পাহাড় ও টিলার পাদদেশে খাসি (খাসিয়া) আদিবাসীদের পুঞ্জি। পাহাড়ি উঁচু পথ বেয়ে কী অবলীলায় আদিবাসী নারী-পুরুষ উঠে যাচ্ছে পাহাড়চূড়ায়। আর সামান্য পথ হাঁটতেই কিনা আমাদের পা ধরে যাচ্ছে!

শুধু মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতই নয়, পুরো ইকোপার্কই এক চমৎকার দর্শনীয় এলাকা। ঘুরতে ঘুরতে সারাটা দিন কখন যে কেটে গেল, তা টেরই পাওয়া গেল না। ইকোপার্কের মধ্যে রয়েছে বাহারি সব উদ্ভিদ। চোখে পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি।

ইকোপার্ক ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেয়ে গেল। ক্ষতি নেই, পর্যটন রেস্টুরেন্টে রয়েছে রুচিসম্মত খাবারের ব্যবস্থা। পর্যটনের এক কর্মী জানালেন, পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে ইকোপার্কের মধ্যেই আছে একটি ডাকবাংলো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানেও থাকা যায়। আলাপে এক পর্যায়ে শোয়েব বাতলে দিলেন মাধবকুণ্ড আসার সহজ পথ: ‌‌'ঢাকা থেকে আন্তনগর ট্রেনে কুলাউড়া নামতে হবে। কুলাউড়া থেকে সড়কপথে মাধবকুণ্ড আধাঘণ্টার পথ। এ ছাড়া সড়কপথে মৌলভীবাজার হয়েও সহজে আসা যায়। এ পথেও সময় লাগবে আধাঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিটের মতো।'

রবিনের এক প্রশ্নের জবাবে শোয়েব জানায়, 'মৌলভীবাজার জেলার মোট ৫২টি চা বাগানের ২৭টিই কুলাউড়া ও বড়লেখায় অবস্থিত।' তাই মাধবকুণ্ড যাওয়া-আসার পথে চা বাগানের সবুজে চোখ রাঙিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। সত্যিই, পুরো সিলেটই তো সবুজের সমারোহ। দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগানের সবুজে সবুজে চোখ জুড়িয়ে যায়।

পর্যটন রেস্টুরেন্টে থেকে গল্পের পাঠ চুকিয়ে আবার ফিরে এলাম জলতরঙ্গের টানে। জলপ্রপাতের সঙ্গে মিশছে বিকেলের আলোর খেলা। সেই সঙ্গে দর্শনার্থীদের হইচই। স্মৃতিতে স্থায়ী আনন্দের এক আবাস গড়ছে এই মুহূর্তটুকু। অপলক চেয়ে থাকি জলপ্রপাতের দিকে- এ কি তবে মাধবের কান্নাভেজা চোখ? কোনো এক প্রেয়সীর জন্য তার ক্রন্দনগীত? অন্ততকাল।

আলো কমে আসছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছে দিগন্ত। দূরে যেখানে আকাশ মিশেছে মাটিতে, সেখানে; কোনো এক বৈকুণ্ঠের পথে হারিয়ে যেতে চায় মন। কিন্তু ঘরে ফেরার তাড়া। সব মোহ বিসর্জন দিয়ে ফিরতে হয় মাধবকুণ্ড থেকে। ফের ঢাকার নাগরিক কোলাহল!

জলপ্রপাতের বেশ আগেই চোখে পড়বে মাধবেশ্বর মন্দির

কার জন্য মাধবের এই ক্রন্দনগীত?


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চমৎকার লাগল ভ্রমণকাহিনী।

এই তো ক'মাস আগে আমিও মাধবকুণ্ড ঘুরে আসলাম। দারুণ এক অভিজ্ঞতা ছিল।

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

একদিন যাবো নিশ্চিত...

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ শাহেনশাহ।
যান ঘুরে আসুন, ঢাকা থেকে খুবই কাছে।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

ভালো লেগেছে।
----------------------------------------
শুধু শরীরে জেগে থাকে শরীরঘর
মধ্যবর্তী চরকায় খেয়ালী রোদের হাড়

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ আশরাফ।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

উজানগাঁ এর ছবি

আপনার ভ্রমণকাহিনী পড়ে চমৎকার লাগলো। তাই নিজের তোলা এই ছবিটি শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। ক্ষমা করবেন।
Madhabkunda_Falls

আমার মাধবকুণ্ড ভ্রমণ অভিজ্ঞতা খুব একটা ভাল না। আমাকে কেনো জানি টানেনি। পুরো জায়গাটাকে আমার অরক্ষিত মনে হয়েছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এছাড়াও পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার অভাব রয়েছে। ময়লা আবর্জনাতে ভর্তি জলপ্রপাতের আশেপাশের জায়গা।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ছবিটার জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ উজানগাঁ।
আপনার সঙ্গে একমত, জায়গাটার নিরাপত্তা বাড়ানো দরকার।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ অতন্দ্র প্রহরী।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

তারেক মাহমুদ [অতিথি] এর ছবি

হ্যাঁ ফিরোজ আমার অবস্থাও আপনার মত- "অনেকবার সিলেট অঞ্চলে গেছি; কিন্তু মাধবকুণ্ড যাওয়া হয়নি" ।
আপনার অসাধারণ কাব্যিক বর্ণণা পড়ে আর লোভ সামলাতে পারছিনা। দৌড় দেব যে কোন সময়।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

একটু বেশি হয়ে গেল না!!!

ধন্যবাদ তারেক।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

দেখা হয় নাই চক্ষু মিলিয়া! ইশ! কবে যে যামু!
..................................................................

ঐ যে হাঁটছি মুদ্রা দোষে নাকটা ঘষে
আড্ডা মানেই সেকেণ্ড হাফে খেলছি সোলো
গুজবো না শার্ট আমার পাড়া স্মার্ট পেরিয়ে
সে রোদ্দুরের স্মরণ সভাও লিখতে হল

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ পান্থ।
কাছেই তো। ঘুরে আসুন। ঢাকা থেকে দুই দিনের ট্যুর।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।