ঘর-দোর সাফ রাখে ঝাড়ু

আবু রেজা এর ছবি
লিখেছেন আবু রেজা [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৫/০৭/২০০৮ - ৫:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটি চারচালা টিনের ঘর। ঘরের পেছনে একটি বড়ই গাছ। গাছ বেয়ে চালে উঠে গেছে শিম গাছ। নীল রঙের ফুল ফুটে আছে শিম গাছে। ঘরের সামনে একটি বড় উঠান। উঠানে বসে রোদ পোহাচ্ছে দাদা-দাদি। নাতি-নাতকুড়রা খেলা করছে। কেউ মিছেমিছি বাজার করছে। কেউ মিছেমিছি রান্না করছে। কেউবা মিছেমিছি ঘর-দোর ঝাড় দিচ্ছে। এটা ছোট ছেলেমেয়েদের ঘরকন্যা খেলা।
নাতি-নাতকুড়দের ঝাড় দিতে দেখে দাদি বলে উঠলেন, এই সাত-সকালে উঠান ঝাড় দিচ্ছ। আজ নিশ্চয়ই বাড়িতে কোনো অতিথি আসবে।
দাদা বললেন, কোত্থেকে কে যে আসে তাই ভাবছি।
এটা আমাদের গ্রামীণ সমাজের এক ধরনের ভুল ধারণা বা বিশ্বাস। এখনো অনেকে বিশ্বাস করেন, ছোট ছেলেমেয়েরা ঘর-দোর ঝাড় দিলে বাড়িতে অতিথি আসেন। আসলে বাড়িতে অতিথি আসার সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়েদের ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এরকম ঘটনা কখনো ঘটে থাকলে তা নিতান্তই কাকতালীয়।
গৃহস্থ বাড়িতে সকালে উঠেই ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার নিয়ম। এতে করে বাড়ি-ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। আবার, এর সঙ্গে নানা কুসংষ্কারও জড়িয়ে আছে। সকালে ঘর-দোর ঝাড় দেওয়া না হলে যাত্রা শুভ হয় না। শুভ কাজে বের হতে ঝাড়ু দেখলে যাত্রা ভঙ্গ হয়। বলা হয়ে থাকে, কারো যাত্রা নষ্ট করতে চাও তো তাকে ঝাড়ু দেখাও। এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বড় সম্পদ ধাঁধা। ধাঁধা তৈরি হয়েছে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে ময়মনসিংহ এলাকায় প্রচলিত একটি ধাঁধা হলো-
আগ ঝুমঝুম গুড়ি আটা,
এইটা যে না ভাঙ্গায় তার বাপ চোট্টা। (ময়মনসিংহ)
এর অর্থ হলো ঝাড়ু।
এমন আরো একটি ধাঁধা হলো-
এ ঘর যাই, ও ঘর যাই
দুম দুমাইয়া আছাড় খাই।
এর অর্থও ঝাড়ু।
বাংলা ভাষায় একটি বড় অংশ জুড়ে আছে লোকপ্রবাদ ও প্রবচন। এখন এমন একটি প্রবাদের কথা বলবো যা খুবই প্রচলিত। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সকলের কাছে এ প্রবাদটি পরিচিত। যেমন-
শ্বশুরবাড়ি মধুর হাড়ি,
নিত্য গেলে ঝাঁটার বাড়ি।
এ প্রবাদটি এলাকা ভেদে একটু ভিন্নভাবে পরিচিত। যেমন-
শ্বশুর বাড়ি মথুরাপুরী
দুদিন পরে ঝাঁটার বাড়ি।
এর অর্থ হলো শ্বশুরবাড়ি বেশি বেশি গেলে বা বেশি দিন থাকলে আদর-যত্ন পাওয়া যায় না। তাই শ্বশুরবাড়ি বেশি বেশি যেতে নেই, বেশি দিন থাকতেও নেই। এই প্রবাদের ঝাঁটা কিন্তু ঝাড়ুরই একটি প্রতিশব্দ।
আবার কাউকে তাড়াতে হলে বলা হয়, ঝেঁটিয়ে বিদায় কর। এই ঝেঁটিয়ে বিদায় করার অর্থ হলো ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে তাড়ানো। কাউকে একই সঙ্গে অপমান ও শাস্তি দিতে হলে তাকে ঝাঁটাপেটা করা হয়। ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কাজটি করা হয় ঝাড়ু দিয়ে। কাউকে অপমান করতে চাইলেও তাকে ঝাড়ু দেখানো হয়। আবার দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য, ব্যর্থ প্রশাসন বা সরকার তাড়াতেও ঝাড়ু মিছিল বের করা হয়।
ঝাড়ু একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। কোথাও ঝাড়ুর নাম 'ঝাঁটা'। কোথাও একে বলে 'পিছা'। কোথাও এর নাম খাংরা। তবে ঝাড়ু নামটি সব জায়গাতেই সমানভাবে পরিচিত। অভিধানে ঝাড়ুর একটি খুব ভালো নাম আছে। তা হলো- সম্মার্জনী। এর অর্থ হলো- যা দিয়ে ঝাঁট দেওয়া হয়; যা দিয়ে পরিষ্কার করা হয়; ঝাড়ু; খাংরা। আর সম্মার্জন মানে হলো- পরিষ্কারকরণ; সাফকরণ।
ঘর ঝাড় দেওয়ার তিন ধরনের ঝাড়ু দেখা যায়। যেমন- শলার ঝাড়ু, ছনের ঝাড়ু, ফুলের ঝাড়ু।

শলার ঝাড়ু
শলার ঝাড়ু তৈরি করা হয় নারকেল পাতার শির দিয়ে। নারকেল পাতা রোদে শুকানো হয়। শুকনো পাতার দুই পাশটা কেটে শির আলাদা করা হয়। এই শিরই ঝাড়ু তৈরির শলা। এরপর পরিমাপ মতো শলা একত্র করে গোড়ার দিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিলেই তৈরি হয় ঝাড়ু। দড়ির বদলে টিন দিয়েও মুড়ে দেওয়া হয়। দড়ি দিয়েই বাঁধা বা টিন দিয়েই মোড়া হোক না কেন, দুই ক্ষেত্রেই গাছের ডাল বা কাঠের টুকরা ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এতে বাঁধন শক্ত হয়।
ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হলেও এর মধ্যেও শিল্পের ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায়। দড়ির বাঁধন এমনভাবে দেওয়া হয় যাতে নক্শা ফুটে উঠে। আবার, মেলায় এমন ঝাড়ু দেখা যায় যার বাঁধন দেওয়া হয় রঙিন দড়ি দিয়ে। এতে ঝাড়ুর গোড়ায় নকশা ফুটে ওঠে।

ছনের ঝাড়ু
ছনের ঝাড়ু তৈরি হয় ছন দিয়ে। ছন গ্রামিনি (graminae) গোত্রের ঘাস জাতীয় গাছ। ছনকে শনও বলা হয়। কুড়েঘরের চাল ছাওয়া হয় যে ছন দিয়ে সেই ছন দিয়ে ঝাড়ুও তৈরি হয়। এক সময় ঘরের চাল ছাওয়ার জন্যে কৃষক জমিতে শস্যের পাশাপাশি জমিতে ছনের চাষ করত। সেই ছন দিয়ে ঘরের চাল ছাওয়া হতো, ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার জন্য ছনের ঝাড়ু তৈরি করা হতো। এখন ছনের ঝাড়ুর উৎপাদন ও ব্যবহার দুই-ই কমে গেছে।
ছনের ঝাড়ু তৈরির জন্য শুকনো ছন মাপমতো কেটে নেওয়া হয়। পরিমাণ মতো ছন একত্র করে বেঁধে নিলেই তৈরি হয় ঝাড়ু। ছনের ঝাড়ু নকশাদার করার জন্য এমনভাবে বাঁধা হতো যা দেখতে অনেকটা বেনীর মতো হয়। বেনীর মধ্যে পাটের দড়ি জুড়ে দেওয়া হতো। অনেক কারিগর দড়ি নানা রঙে রাঙিয়ে নিত। এতে বেনীর মধ্যে নানা রঙের নক্শা ফুটে ওঠে।

ফুলঝাড়ু
ফুলঝাড়ু তৈরি হয় গ্রামিনি (graminae) গোত্রের ঘাস জাতীয় গাছ দিয়ে। চট্টগ্রাম এলাকায় এ গাছ অর্জুনশর নামে পরিচিত। কোথাও একে মায়দাশনও বলা হয় । ফুলঝাড়ু তৈরি হয় এ গাছের পুষ্পমঞ্জরী (inflorecences) দিয়ে। এ গাছের পুষ্পমঞ্জরী কেটে ভালো করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। পুষ্পমঞ্জরী ঝাড়ুর মাপমতো কেটে গোড়ার দিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝাড়ু তৈরি করা হয়। আর আগার অংশ দিয়ে ঝাড় দেওয়ার কাজটি সারা হয়।
এছাড়াও আরো নানান ধরনের ঝাড়ু আছে। যেমন- ঝুলঝাড়ু, এটা দিয়ে ঘরবাড়ির ঝুল ঝাড়া হয়। এক মুঠো ছন বাঁশের কঞ্চির আগায় বেঁধে তৈরি করা হয় ঝুলঝাড়ু। আবার, গাড়ির ধুলোবালি পরিষ্কার করার জন্য মোরগ-মুরগির পালক দিয়ে তৈরি করা হয় এক ধরনের ঝাড়ু এর নাম কি ধূলঝাড়ূ ?
আজকাল ফুলঝাড়ুর গোড়ার দিকে ধরার জায়গায় প্লাষ্টিকের কভার পরিয়ে দেওয়া হয়। শুধু কি তাই! প্লাষ্টিক দিয়েও ঝাড়ু তৈরি হচ্ছে। প্লাষ্টিকের ঝাড়ু দখল করে নিচ্ছে শলার ঝাড়ু, ছনের ঝাড়ু ও ফুলঝাড়ুর জায়গা। শলার ঝাড়ু, ছনের ঝাড়ু, ফুলঝাড়ু তৈরি হয় গাছের পাতা ও ফুলের অংশ দিয়ে। এগুলো প্রাকৃতিক উপাদান। ব্যবহারের পর ফেলে দিলে তা প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে। অপর পে প্লাষ্টিকের ঝাড়ু তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম উপকরণ দিয়ে, যা কখনো পচে না। বরং নানাভাবে মাটি, পানি ও বাতাসের দূষণ ঘটায়। তাই আমাদের এসব কৃত্রিম উপকরণ দিয়ে তৈরী জিনিস বর্জন করা উচিত।

আবু রেজাabureza3551@yahoo.com


মন্তব্য

রাফি(লগইন করলাম না) এর ছবি

এই লেখাটা প্রথম পাতায় নাই কেন???

আবারো দারুন টপিক নিয়ে দারুন লেখা...। এখন থেকে আপনার লেখার অপেক্ষায় থাকব ভাই। নিরাশ করবেন না।

আবু রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ। আরো লেখার আশা আছে।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

হুম, ভিন্ন ধরণের লেখা।


রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!

আবু রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ। ভিন্ন ধরনের আরো লেখা দেওয়ার ইচ্ছা আছে।

শেখ জলিল এর ছবি

আবারও ভিন্ন আঙ্গিকের লেখা। ধন্যবাদ আবু রেজা।
..লোকজ এইসব বিষয় নিয়ে আরও লিখুন।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

আবু রেজা এর ছবি

লোকজ এইসব বিষয় নিয়ে আরও লেখার ইচ্ছা আছে। ধন্যবাদ জলিল ভাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।