ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ

আবু রেজা এর ছবি
লিখেছেন আবু রেজা [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০৮/২০১০ - ৭:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ
আবু রেজা

কবি রবীন্দ্র্র্র্র্র্র্র্র্র্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসেছিলেন দুইবার। প্রথম বার ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে; দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ঢাকাবাসীদের আমন্ত্রণে।

এক.

১৮৯৮ সাল (বাংলা ১৩০৫)। ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন। সে বছরই ২১ মে (৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৫, শনিবার) ভারতীয় ত্রাণ সমিতি (ইন্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটি)-এর সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে ছিলেন আশুতোষ চৌধুরী, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, গগনেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ। সম্মেলনের সভাপতি মনোনীত হন রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩০ মে - ১ জুন, ১৮৯৮(১৭-১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৫) এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের আয়োজন হয়েছিল ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে।

সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যান্য প্রতিনিধির সঙ্গে ২৯ মে (১৬ জ্যৈষ্ঠ, রবিবার) কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ, যোগেন্দ্রনাথ চৌধূরী প্রমুখ।

৩০ মে (১৭ জ্যৈষ্ঠ, সোমবার) ছিল সম্মেলনের প্রথম দিন। প্রথম দিনে সম্মেলনের কার্যসূচি শুরু হয় দুপুর ২টায়। সম্মেলনের সভাপতি রেভারেন্ড কালীচরণ সে সময়ের রীতি অনুযায়ী ইংরেজিতে সভাপতির ভাষণ দেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতির ভাষণের সারমর্ম বাংলায় পাঠ করেন। রবীন্দ্রনাথের গাওয়া গানের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের অধিবেশন শেষ হয়। গানটি ছিল ‘ কড়ি ও কমল’- র অন্তর্ভুক্ত ‘আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না’।

সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথের গীত গান সম্পর্কে মতবিরোধ আছে। গোপাল চন্দ্র রায়, সুখরঞ্জন রায়ের বৈশাখ ১৩৭২ সংখ্যা ‘রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা উদ্ধৃত করে এই গানটিই গাওয়া হয়েছিল বলে মত প্রকাশ করেছেন।

সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সভাপতির ইংরেজি ভাষণের বাংলায় সারমর্ম পাঠ প্রসঙ্গে বিতর্ক থাকলেও রবীন্দ্রজীবনীকার শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ এ সভায় উপস্থিত ছিলেন ও তিনিই সভাপতির সম্ভাষণের সারমর্ম বাংলায় পাঠ করিয়াছিলেন।’

এ প্রসঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য প্রণিধান যোগ্য। ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ নাটোর সম্মেলনে বাংলাভাষা প্রবর্তনে নিজ প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘পর বৎসরে রুগ্ন শরীর নিয়ে ঢাকা কনফারেন্সও আমাকে এই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হতে হয়েছিল।’
৩১ মে (১৮ জ্যৈষ্ঠ, মঙ্গলবার) ছিল সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হয় দুপুর ১২:৩০ টায়। এই অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উত্থাপিত প্রস্তাব বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেন।

দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় সম্মেলনে অংশ গ্রহণকারী প্রতিনিধিদের জন্য নৌ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নৌবিহহার উপভোগ করেন।

১ জুন (১৯ জ্যৈষ্ঠ, বুধবার) ছিল সম্মেলনের শেষ দিন। শেষ দিনে দশটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সমাপ্তি অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী বছর চব্বিশ পরগনায় সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সম্মেলনে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। এই সম্মেলনে স্বল্প সংখ্যক প্রতিনিধির উপস্থিতি এবং বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করে। সম্মেলন শেষে ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘সমগ্র বঙ্গদেশকে এই সমিতি কতদূর একতাসূত্রে বাঁধিতে পারিতেছেন তাহাই প্রত্যেক অধিবেশনের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান কথা।............ এত বৎসর বাঙ্গালীর প্রাদেশিক সমিতির তর্ক-বিতর্কে বাঙ্গালীর ভাষার সম্যক সমাদার লাভ করিতে পারিল না।’

দ্বিতীয় বার ঢাকা এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা করোনেশন পার্কে এক ভাষণে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বহুকাল পূর্বে আর একবার এই ঢাকা নগরীতে এসেছিলাম সেদিনকার রাষ্ট্রীয় প্রাদেশিক সম্মিলনীর অধিবেশন উপলক্ষে। রাষ্ট্রীয় আন্দোলন ব্যাপারে নিপূণভাবে যোগ দিতে পারি এমন অভ্যাস ও শক্তি আমার ছিল না, - এই অনুষ্ঠানে আমার দ্বারাও যে কাজটুকু হতে পারে আমি কেবলমাত্র তার ভার নিয়ে এসেছিলাম। তখনকার রাষ্ট্রীয় সভাগুলিতে ইংরেজী ভাষাতেই বক্তৃতা হত। যাঁরা বাংলা ভাষার চর্চ্চায় বিরত ছিলেন, যাঁরা এ ভাষা সভাস্থলে ব্যবহার করতে জানতেন না, তাঁদেরই অনেকে রাষ্ট্রিক আন্দোলন- কার্য্যে প্রাধান্য লাভ করেছিলেন। তার ফল হয়েছিল এই যে, জনসাধারণের মধ্যে রাষ্ট্রিক শিক্ষা-বিস্তারের যে একটিমাত্র উদ্যোগ তখন ছিল, ইংরেজী ভাষার চাপে তার উদ্দেশ্যটি মারা গিয়েছিল।’

সম্মেলন শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১ জুন (১৯ জ্যৈষ্ঠ, বুধবার) রাতেই শিলাইদহের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।

সম্মেলন থেকে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সম্মেলন সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘এইসব কনফারেন্সে ডেলিগেট বা প্রতিনিধিদের আদর আপ্যায়ন একটা রাজসূয় যজ্ঞের তুল্য ছিল। দেশের কাজের জন্য সকলে সমবেত হইয়াছেন, অথচ তাহাদের আবদার অভিযোগের অন্ত নাই।’

রবীন্দ্রজীবনীকার শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন,‘এই দৃশ্য রবীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত পীড়িত করিয়াছিল।’

দুই.

১৯২৬ সাল (বাংলা ১৩৩২)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। একই সময়ে ঢাকাবাসী এবং ঢাকার বিভিন্ন সংগঠনও তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায় । রবীন্দ্রনাথের ঢাকায় আগমন নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি শুরু হয়ে যায়। সবাই চায় রবীন্দ্রনাথ তাঁদের আতিথ্য গ্রহণ করুন। রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনার গৌরব লাভ করতে চায় সব সংগঠনই। এ সম্পর্কে ৩ র্ফেরুয়ারির দ্য বেঙ্গলী পত্রিকায় লেখা হয়-

‘ডঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শীঘ্রই ঢাকা সফর করবেন এবং যাঁরা নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে দাবি করেন তাঁরা কবিকে অভ্যর্থনার গৌরব লাভের জন্য অশুভ রেষারেষি শুরু করেছেন বলে মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করেছে তারাই কবির সফরের উদ্যোক্তার গৌরবভাগী এবং তাঁর অভ্যর্থনার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে; বিশ্বভারতী(সম্মিলনী)-এর স্থানীয় শাখা এই গৌরবের অংশীদার হওয়ার জন্য উদগ্রীব। ঢাকার দুইটি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান- সাহিত্য পরিষদ ও পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সমাজও পিছিয়ে নেই। ফলে এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ডঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন দলের জন্য তাঁর সফরের সময় ভাগ করে দেবেন। তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি এখানে পৌঁছবেন এবং প্রথম কয়েকদিন ঢাকার জনসাধারণের অতিথি হিসেবে নদীতে একটি হাউসবোটে থাকবেন। জনসাধারণের পক্ষে অভ্যর্থনা সমিতি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। সফরের শেষ কয়েকদিন তিনি কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ই থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ হয়তো এই পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন কিন্তু এটাই হয়তো তাঁর মহত্বের বিড়ম্বনা।’

রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠিতেও ঢাকাবাসীদের নিমন্ত্রণ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথ জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠিতে লেখেন-

‘ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাঁদের আতিথ্য ভোগ করে কর্ত্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনোমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল।’

এর আগে ১৭ জানুয়ারির দ্য বেঙ্গলী পত্রিকায় কবি রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফর সম্পর্কে লেখা হয়-

৩ ফেব্রুয়ারি ডঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা সফরে আসবেন বলে জানা গেছে। কবি রমনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের আতিথ্য গ্রহণ করবেন। তাঁকে সংবর্ধনা জানাবার বিস্তারিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ সাল (২৪ মাঘ, ১৩৩২)। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন। ঢাকা সফরে তার সফরসঙ্গী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, কালীমোহন ঘোষ, হিরজিভাই মরিস ফর্মিকি ও তুচ্চি প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা পৌরসভা, হিন্দু-মোসলেম সেবা সংঘ, পিপলস এসোসিয়েশন, রেটপেয়ার্স এসোসিয়েশন, দিপালী সংঘ, পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় সংবর্ধনা দেয়। অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ, ঢাকা হল সমিতি, লালেগ্রা ক্লাব, ইডেন গার্লস স্কুল ও কলেজ, সাহিত্য পরিষদ ঢাকা শাখা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দিতে পারেনি। সংবর্ধনার জবাবে দেওয়া ভাষণেও তিনি অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। সে সময় আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য মুসলমান, দ্যা স্টেটম্যন, দ্য বেঙ্গলী ইত্যাদি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার খবর ছাপা হয়। তাছাড়া বুদ্ধদেব বসু, ভবতোষ দত্ত, আবুল ফজল, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, গোপালচন্দ্র রায়, সুখরঞ্জন রায় প্রমুখের লেখায়ও কবি রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফর ও সংবর্ধনার বিবরণ পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সফরসঙ্গী সহ ৭ ফেব্রুয়ারী (২৪ মাঘ) ঢাকার উদ্দেশ্যে স্টীমার যোগে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য স্টীমার ঘাটে উপস্থিত ছিল বিপুল জনগণ। নারায়ণগঞ্জ থেকে মোটরগাড়ি করে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন। ঢাকা শহরের সীমান্তে স্কাউট ও সেচ্ছাসেবকরা কবি রবীন্দ্রনাথকে অর্ভ্যথনা জানায়। সেখান থেকে শোভাযাত্রা সহকারে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বুড়িগঙ্গা নদী তীরে। তিনি নদীবক্ষে ঢাকার নবাবের বোট ‘তুরাগ’-এ আতিথ্য গ্রহণ করেন।

বুদ্ধদেব বসু ‘আমার ছেলেবেলা’ (কলকাতা, ১৯৭৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বোটে অবস্থানের স্মৃতিচারণ করেছেন-

রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথম দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার উপর নোঙর ফেলা একটি স্টিম লঞ্চে, যেখানে নিমন্ত্রণকর্তা বিশ্ববিদ্যালযের সঙ্গে রেষারেষি করে ঢাকার নাগরিকেরা তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। উপরের ডেক-এ ইজিচেয়ারে বসে আছেন তিনি, ঠিক তাঁর ফটোগ্রাফগুলোর মতোই জোব্বা-পাজামা পরনে- আর কেউ কেউ উপস্থিত ও সঞ্চারণমান, রেলিঙে হেলান দিয়ে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি।

উল্লেখ্য, বুদ্ধদেব বসু তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন।

ঢাকায় কবি রবীন্দ্রনাথকে প্রথম সংবর্ধনা দেয় ঢাকা পৌরসভা ও পিপলস এসোসিয়েশন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয় ফরাসগঞ্জে নর্থব্রুক হলে। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে মানপত্র দেওয়া হয়। মানপত্র পাঠ করেন আর. কে. দাস। মানপত্রটি ঢাকা মনোমোহন প্রেসে ছাপা হয়। ঢাকার জনসাধারণের পক্ষে মানপত্রে বলা হয়-

‘বাণীর বরপুত্র তুমি । শ্বেত-সরোজবাসিনী বীণাপাণি তাঁর শ্রীকরধৃত বীলা তোমারই করকমলে অর্পণ করিয়াছেন। তাহার ত্রিতন্ত্রীতে ঝঙ্কার তুলিয়া অমর গীতধারায় তুমি বিশ্বজগৎ প্লাবিত করিয়াছ। প্রাচীন-ইতিহাস-বিশ্রুত, হিন্দু-মোসলেমের শতকীর্ত্তি বিভূষিত, শিল্পকলা-প্রশিদ্ধ-ঢাকা নগরীর অধিবাসী আমরা, তোমাকে সাদরে অভিনন্দিত করিতেছি।’

সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্রনাথ ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন-

‘আপনারা আমাকে যে সাদর অভিবাদন করলেন আমি তার যথাযোগ্য প্রত্যাভিবাদন করতে পারি এমন শক্তির আমার অভাব ঘটেছে। আপনারা বোধ হয় শুনে থাকবেন আমি দুর্ব্বল ক্লান্ত। সে কথা সহসা আপনারা সকলে হয়ত গ্রাহ্য না করতে পারেন। সে জন্য আমিই দায়ী, কারণ, আজ আমার এখানে উপস্থিতিই শারীরিক অপটুতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে। যখন আপনাদের নিমন্ত্রণ আমার কাছে পৌঁছল, দর্ব্বল শরীর বললে, এ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারব না। কিন্তু মনেরও যে দুর্বলতা আছে তাই আপনাদের ডাক এড়াবার সাধ্য রইল না। মন তখন বলে, হ্যাঁ। শেষে মনেরই জিৎ হল। ডাক্তারের উপদেশ লঙ্ঘন করেই এসেছি, এখন আর অসুস্থ শরীরের দোহাই দিয়েই কি হবে? অতএব, আমাকে কিছু বলতেই হবে, কেবল আমার আবেদন এইটুকু যে আমার কাছে বেশি বলা দাবী করবেন না।’

তারপর ঢাকা করোনেশন পার্কে আরেকটি অভিনন্দন সভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসাধারণ, রেটপেয়ার্স এসোসিয়েশন ও হিন্দু-মোসলেম সেবক সমিতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন পত্র পাঠ করা হয়। করোনেশন পার্কের অভিনন্দন পত্র পাঠ করা হয়। করোনেশন পার্কের অভিনন্দনের জবাবে রবীন্দ্রনাথ ভাষণ দেন এবং সকলকে ধন্যবাদ জানান।

দ্বিতীয় দিন ৮ ফেব্রুয়ারী (২৫ মাঘ) রবীন্দ্রনাথের সন্মানে ঢাকার নবাব বাড়ি আহসান মঞ্জিলে চা-চক্রের আয়োজন করা হয়।

সন্ধ্যায় দীপালী সংঘের উদ্যোগে পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে আয়োজিত এক রবীন্দ্রনাথ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে মানপত্র দেওয়া হয়। মানপত্র পাঠ করেন দীপালী সংঘের নেত্রী লীলা রায়। সংবর্ধনার জবাবে কবি প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রায় দু’হাজার নারী উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এত মহিলা এমন শান্তভাবে আমাকে কোথাও অভ্যর্থনা করে নাই।’

তৃতীয় দিন ৯ ফেব্রুয়ারি (২৬ মাঘ) বিশ্বভারতী সম্মিলনীর ঢাকা শাখা রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেয়। এরপর
জগন্নাথ কলেজে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

সন্ধ্যায় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে এক জনসভায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃৃতি ও সভ্যতার ন্বরূপ’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন।

১০ ফেব্রুয়ারি (২৭ মাঘ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে বক্তৃতা করেন। দুপুরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা কবিকে সংবর্ধনা দেয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করেন সে সময়ের কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র, পরবর্তীতে অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত। এ সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিচারণ-

‘স্কুল জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা রবীন্দ্র-সন্দর্শন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে, ১৯২৬-এর গোড়ায় হেডমাস্টার মশাই ডেকে পাঠালেন এবং বললেন যে, রবীন্দ্রনাথ স্কুলে আসছেন সেদিনই আমাকে অভিনন্দন পত্রটি পড়তে হবে।

...রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন দেওয়া হবে আর আমি সেটা পড়বো- গর্বে আমি দশ হাত। যথাসময়ে হেডমাস্টারের নির্দেশ মত টুইলের শার্টের বদলে পরলাম পাঞ্জাবী আর চাদর এবং বালখিল্য ভদ্রলোকের বেশে স্কুলে উপস্থিত হলাম। যথাসময়ে কবি এলেন, অভিনন্দন পত্র পড়া হল; প্রণাম করলে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। প্রশান্ত ঋষি-প্রতিম, মুখে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না, কিন্তু উচ্ছ্বাসপূর্ণ অভিনন্দন (বোধ হয় কোন মাস্টার মশাইয়ের লেখা) আর আবেগপূর্ণ পাঠ শুনে কবি কি ভেবেছিলেন জানি না। তবে তিনি তো এসবে অভ্যস্ত, আমার কাছে সবটাই এক নতুন অভিজ্ঞতা।’
বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ কর্জন হলে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি. এইচ. ল্যাংলি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার সংবর্ধনা পত্র পাঠ করেন।

মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়ন কবিকে সংবর্ধনা জানায়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আবুল হুসেনের লেখা মানপত্র পাঠ করেন ছাত্র সংসদের তৎকালীন সহসভাপতি সুলতান উদ্দিন আহমদ।

মুসলিম হলে সংবর্ধনা সম্পর্কে আবুল ফজলের স্মৃতিচারণ-

‘কবি যখন ঢুকলেন......... হল ঘরের প্রবেশ পথ থেকেই কবির উপর শুরু হয়েছে পুষ্পবৃষ্টি।’

সংবর্ধনার জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-

‘প্রাচীনকালে আমাদের দেশে রাজারা দিগি¦জয় করে ফিরলে তাঁদের উপর পুষ্পবৃষ্টি অর্পণ করা হতো, আমি কি আমার দেশের জন্য তেমন কিছু জয় করে এনেছি যার জন্য আজ আমাকেও পুষ্প বর্ষণ করে সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে।’

সন্ধ্যায় কার্জন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষণ দেন। ভাষণের বিষয় ছিল ‘আর্টের অর্থ’।

১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি (২৭ ও ২৮ মাঘ) অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন নি।

১৩ ফেব্রুয়ারি (১ ফাগুন) রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে বক্তৃতার করেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল- ‘দ্য রুল অফ দ্য জায়ান্ট’।

১৪ ফেব্রুয়ারি (২ ফাল্গুন) রবীন্দ্রনাথ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্ব কুমার চন্দ্রের বাসায় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ কবিতা আবৃত্তি করেন। দিনেন্দ্রনাথ গান শোনান। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, বুদ্বদেব বসু, বিশ্বভারতী সম্মিলনীর সদস্য এবং রবীন্দ্রনাথের অনেক ভক্ত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু স্মৃতিচারণে লিখেছেন-

‘...ঝাকড়া চুল দুলিয়ে, অক্সনিয়ান অঙ্গভঙ্গি ও ...........সিলেটি টানের উচ্চারণ নিয়ে, ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবী পরা অপূর্বকুমার চন্দ্র আমার কলেজের অধ্যক্ষ তিনি, রমনার অধ্যাপক মহলে রমনীয়তম মানুষ। রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে কবিতা-পাঠ আমি প্রথম শুনেছিলাম তাঁরই বাড়িতে এক রবীন্দ্র-সন্ধ্যায়, সবান্ধবে রবাহুতভাবে উপস্থিত হয়ে।’

এদিন রমেশচন্দ্র মজুমদারের ১৩ বছর বয়সী মেয়ে সুষমা ওরফে শান্তিকে রবীন্দ্রনাথ অটোগ্রাফ দেন। রবীন্দ্রনাথ অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে লিখেন-

‘আয়রে বসন্ত হেথা, কুসুমের সুষমা জাগারে
শান্তি স্নিগ্ধ মুকুলের হৃদয়ের নিস্তব্ধ আগারে।
ফলেরে আনিবে ডেকে
সেই লিপি যাস্ রেখে,
সুবর্ণ তুলিকাখানি পর্ণে পর্ণে যতনে লাগারে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. ক্লাসের ছাত্র স্নিগ্ধকুমার গুহকেও একটি অটোগ্রাফ দেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখে দেন -

‘ভারী কাজের বোঝাই তরী কালের পারাবারে
পাড়ি দিতে গিয়ে কখন ডোবে আপন ভারে।
তার চেয়ে মোর এই ক‘খানা হাল্কা কথার গান
হয়ত ভেসে রইবে স্্েরাতে তাই করিলাম দান।’

আগে উল্লেখ করা হয়েছে, অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগন্নাথ হলে ছাত্রদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে পারেন নি। ১৫ ফেব্র“য়ারি (৩ ফাল্গুন) বিদায়ী দিনে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অনুরোধে হল বার্ষিকী ‘বাসন্তিকা’র জন্য একটি গান লিখে দেন। গানটি ছিল-

এই কথাটি মনে রেখো,-
তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে, আপন মনে,
অনাদরে অবহেলায়
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।।

দিনের পথিক মনে রেখো,-
আমি চলেছিলেম রাতে
সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।
যখন আমায় ওপার থেকে গেল ডেকে,
ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়,
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।।

১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ (৩ ফাল্গুন, ১৩৩২) ছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা সফরের শেষ দিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র

১. শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক, ১ম খণ্ড ও ৩য় খণ্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।
২. প্রশান্ত কুমার পাল, রবীজীবনী ৪র্থ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি, কলকাতা।
৩. ভূঁইয়া ইকবাল, বাংলাদেশে রবীন্দ্র- সংবর্ধনা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৪. বুদ্ধদেব বসু, আমার ছেলেবেলা, কলকাতা।
৫. ভবতোষ দত্ত, আট দশক, কলকাতা।


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

গোলাম মুরশিদের পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ বইটাও দেখতে পারেন। আমি একটি বেসরকারি টিভির হয়ে 'এই কথাটি মনে রেখো নামে' একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলাম দুই বছর আগে। গবেষণামূলক লেখার জন্য ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

হিমু এর ছবি
দেবোত্তম দাশ এর ছবি

এই লেখাটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আবুভাই
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

শেখ জলিল এর ছবি

বাপরে! আপনার বেশ ধৈর্য। খুব ভালো লাগলো লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন দেখে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

তানভীর এর ছবি

চলুক

সোয়াদ [অতিথি] এর ছবি

আপনার এতো চমৎকার লেখাটির সুত্র ধরে নিম্নলিখিত ফাজলামো করার লোভ সামলাতে পারছি না। দয়া করে ক্ষমা করবেন এবং লেখা চালিয়ে যাবেন।

"রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এত মহিলা এমন শান্তভাবে আমাকে কোথাও অভ্যর্থনা করে নাই।’"

গুরুদেব এলভিস ট্রিটমেন্ট পেতেন নাকি?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।