আম্বিয়া খাতুনের গল্প

বইখাতা এর ছবি
লিখেছেন বইখাতা (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৭/২০০৯ - ১:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আম্বিয়া খাতুনের বয়স কত হবে ? ৯০ এর কাছাকাছি তো অবশ্যই। শরীরের শক্তি শেষ প্রায়। বেঁকে গেছে কোমর। পায়ে বাতের ব্যথা। হাঁটতে কষ্ট হয়। তারপরও লাঠি নিয়ে হাঁটতে চায় না সে। কতবার কতভাবে বলেছে সবাই। কিন্তু আম্বিয়া খাতুনের জেদ বড় শক্ত। যেন সময় আর প্রকৃতির সাথে জেদ করেই নুয়ে পড়া কোমর নিয়ে লাঠি ছাড়াই ছোট ফ্ল্যাটের এক ঘর থেকে আরেক ঘরে হেঁটে বেড়ায় আম্বিয়া খাতুন।

ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ । তারপরও আম্বিয়া খাতুন দৈনিক পত্রিকার মোটা, বড় হরফের শিরোনামগুলি পড়তে পারে ! পড়েও প্রতিদিন। কেননা রীতিমত শিক্ষিত সে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছে ! মাষ্টাররা বলত, ”তোর তো মাথা অনেক ভাল রে আম্বিয়া !” অবশ্য এই ভাল মাথা নিয়ে সে বেশিদূর যেতে পারেনি। বিয়ে হয়ে যায়। রসিক আম্বিয়া খাতুন তার বিয়ের গল্প করে নাতনি আর নাতনিদের বান্ধবীদের পান খাওয়া লাল ঠোঁট নিয়ে।

একদিন বাড়ির কাছের পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খাচ্ছিল আম্বিয়া খাতুন। গাছের নিচ দিয়ে তার ২০ বছরের ভাই মোর্শেদের বন্ধু ফরিদউদ্দিন যখন তাদের বাড়ির দিকে যায়, কোন ফাঁকে তাকে দেখে বোঝা যায় না। শুধু বন্ধু মোর্শেদকে বলে, ”তোর বুনেক আমার কাছে বিয়ে দে”। তারপর আর কী ! বড়লোকের কাজ-না-করা ছেলে ফরিদউদ্দিনের সাথে বিয়ে হয়ে যায় আম্বিয়া খাতুনের। বিয়ের পর প্রথম যখন স্বামীর ঘরে যায়, শাশুড়ি তাকে কোলে বসিয়ে কী আদরটাই না করেছিল। আর তার স্বামী ! লাজুক হাসি আম্বিয়া খাতুনের ঠোঁটে। প্রথম প্রথম অভ্যাসমত রাতে বিছানা ভাসিয়ে দিলে ফরিদউদ্দিনই তো নিজে কেচে দিয়েছে বিছানার চাদর কেউ ব্যাপারটা জানার আগে। কেউ জানলে কী লজ্জাই পাবে তার বউটা !
এই কাহিনী শুনে নাতনিরা হি হি হেসে গড়িয়ে পড়ে এ ওর গায়ে!

আম্বিয়া খাতুন নুয়ে পড়া কোমর নিয়ে নিয়ে উঁচু ডাইনিং টেবিলে বসতে পারে না। তাই তার টেবিল বানানো হয়েছে ছোট করে, মাপমত। তার ছেলের বউটা ভাল। যতœ নিয়ে শাশুড়িকে খাওয়ায় এখনো। আর নাতি, নাতনি, নাতবউ সবাই খায় বড় টেবিলে বসে গল্প করতে করতে। আম্বিয়া খাতুনের বড় ইচ্ছা করে ওদের সাথে বসে খেতে, গল্প করতে। অথবা ওদের কেউ যদি এসে তার সাথে একটু কথা বলে যেতো ! তাহলেও বড় ভাল লাগত তার। কিন্তু দাদী কী খায়, আদৌ খেয়েছে কিনা সেই খোঁজ নেবার সময় কারো হয় না। ওদের মনেই থাকে না দাদীর খাওয়ার কথা। জীবনের গতি বেড়ে গেছে অনেক। আম্বিয়া খাতুন ঘোলাটে চোখে মাছের কাঁটা বাছে, খায় একা একাই রান্নাঘরে তার ছোট টেবিলে বসে। অথচ বিশাল একটা সংসারের কর্ত্রী ছিল সে একসময়। সময় বড় তাড়াতাড়ি যায় !

ফরিদউদ্দিনের বাপ যেদিন তার ছেলেকে নিজের আয়-উপার্জনের রাস্তা দেখতে বলল সেইদিন থেকে আম্বিয়া খাতুনের নিজের সংসারের সূচনা। ফরিদউদ্দিন এক কাপড়েই বেরিয়ে গেছিল। শুধু যাওয়ার আগে বউকে এসে বলেছে, ”তুই যাবু আমার সাথে ? গেলে এখুনি আয়।” আম্বিয়া খাতুন আর কী করে ! বেরিয়ে আসে স্বামীর পেছন পেছন। ওরা গিয়ে ওঠে ফরিদউদ্দিনের বন্ধুর বাসায়। বন্ধুর সাথেই ফরিদউদ্দিন শুরু করে আটা, মশলার মিলের ব্যবসা। একসময় ব্যবসাটা তার নিজের হয়। ওই সময়টায় ভাগ্য ফরিদউদ্দিনের সহায় ছিল পুরোপুরি। অনেক টাকা হয় তার। টাকার সাথে আসে নিজের বিরাট বাড়ি, দামী দামী আসবাব, বিদেশী কুকুর যার দৈনিক বরাদ্দ মাংস কসাই বাড়িতে এসে দিয়ে যায়, আসে অনেক আশ্রিত আত্মীয়-স্বজন। আর আম্বিয়া খাতুন হয় এই জমজমাট সংসারের দাপুটে কর্ত্রী। সারা দিনের কাজ শেষে দুপুরে বারান্দায় পাটি পেতে বসে রেডিয়ো শোনার আসর। আর রেডিয়ো কোলে আসরের মধ্যমণি আম্বিয়া খাতুন। মাঝে মাঝে সিনেমা হলে সিনেমা দেখাতেও তাকে নিয়ে যায় ফরিদউদ্দিন। কী সুখের দিন গেছে !

সিনেমা দেখার শখ এখনও আছে আম্বিয়া খাতুনের। শুক্রবারে দুপুরবেলায় টেলিভিশনে যে বাংলা সিনেমাটা দেখায় সেটা দেখার জন্য সে টেলিভিশন সেটের সামনে এসে বসে । কানে সে তেমন ভালো শুনতে পায় না, তবু পর্দায় যে ছবি দেখা যায় তাতেই সে সন্তুষ্ট। কিন্তু সমস্যা একটাই। নাতি-নাতনিরা যদি ওই সময়টায় টেলিভিশন না দেখে, তাহলেই সে দেখতে পারে। তো এই জন্যই তার সিনেমা দেখার শখটা সবসময় পূরণ হয় না।

আম্বিয়া খাতুন আজকাল আর কিছু মনে রাখতে পারেনা। ছেলে, ছেলের বউ, আর ছোট নাতনিটা ছাড়া কাউকে চিনতেও পারেনা। হজম শক্তিও কমে গেছে একদম। নরম ভাত, পাতলা ডাল আর পাতলা মাছের ঝোল ছাড়া তার আর সবকিছু খাওয়া নিষেধ। কিন্তু তার খিচুড়ি-মাংস খেতে ইচ্ছা করে খুব। আরও খেতে ইচ্ছা করে ডিম ভুনা, ঝাল-ঝাল কষানো মুরগি, সরিষা ইলিশ, খাশির মাংস...... কত কী ! কিন্তু কেউ তাকে এইসব খাবারের একটা টুকরা, একটু ঝোলও দেয়না। একটু দিলেই যদি পেট খারাপ করে বিছানা নোংরা করে তাহলে কে এসব পরিষ্কার করবে ! ঝামেলার ভয়ে কেউ তাকে তার বরাদ্দ খাবারের বাইরে কোনো কিছুই খেতে দেয় না। অথচ মনটা তার একটু ঝাল, একটু টক, একটু মশলাদার খাবারের জন্য আনচান করে। আহা ! সে যদি নিজের নোংরা করা কাপড় নিজেই ধুতে পারতো ! সেই সামর্থ্য যদি এখন থাকতো তার ! তহলে কী তাকে একটু দিতো না ওরা তার পছন্দের খাবার ! নাতি-নাতনিরা যখন খেতে বসে, ছেলে-বউয়ের চোখের আড়ালে নাতিদের কাছে চায় আম্বিয়া খাতুন, ”দে না ভাই একটু !” নাতি তখুনি চিৎকার করে, ”মা দেখো তো ! দাদী বিরক্ত করে !” আর ছেলে-বউ এসে দেয় বকা। ক্ষুণœ মনে ঘরে ফিরে আসে সে। বেতো পা দুইটা খাটের উপর তুলে, দুইহাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে ঘষা কাঁচের মত চোখ দিয়ে বাইরে কী দেখে সেই জানে। হয়তো মনে করে পুরোনো দিনের কথা।

বাড়ির পিছনের উঠানের গাছতলায় গিয়ে সেই প্রথম কাঁদে আম্বিয়া খাতুন যখন সে জানতে পারে ওই দিনই ফরিদউদ্দিন আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছে। জানতে পেরে ফরিদউদ্দিন কাছে এসে বলে, ”তুই কাঁদিসনা। আমি বিয়ে করতে যাবো না।” এই কথা শুনে আম্বিয়া খাতুন কী আর কাঁদতে পারে ! আর কোনমুখেই বা সে স্বামীর বিয়েতে বাধা দেয় ! তার যে সন্তান হয় না। ছোটবউ ঘরে আসে, কিন্তু ফরিদউদ্দিন ছোটবউয়ের রান্না খেতে ভালবাসে না একদম। বড়বউয়ের হাতের রান্না ছাড়া যে তার মুখে খাবার রোচেই না। বড়বউকে সে খুব ভারবাসে ! কিন্তু আম্বিয়া খাতুনের বুকের মধ্যে যে ক্ষতটা হয়, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ আর বন্ধ হয় না। ক্ষতটা বড় থেকে আরও বড় হতে থাকে।

আম্বিয়া খাতুনের ছোট নাতনিটা থাকে তার সাথে এক ঘরেই। এই নাতনিটাকে সে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। এই নাতনিটাই মাঝে মাঝে দাদীর কাছে এসে বলে, ”দাদী কী করো ? একটা গল্প বলো না।” কী যে ভাল লাগে তখন বৃদ্ধ মানুষটার ! দাঁত নাই, তাই শুধু মাড়ি বের করেই হাসে, আর যেন বেহেশতি আলো ছড়িয়ে যায় তার চারপাশে। কিন্তু এই সৌভাগ্য খুব একটা হয় না তার। নাতনি তার বিছানায় বসে মোটা মোটা বই পড়ে, নাহয় ফোনে অবিরাম কথা বলে। আম্বিয়া খাতুন মাঝে মাঝে নাতনির বিছানায় গিয়ে বসে, নাতনির বই নাড়াচাড়া করে আর শিশুর মত চোখে নাতনির দিকে তাকায় এই আশায় যে নাতনি তার একটু গল্প করবে তার সাথে। কিন্তু নাতনির কী আর সেই সময় আছে ! পাত্তাই পায় না আম্বিয়া খাতুন।

ফরিদউদ্দিন তো ছোটবউ ঘরে নিয়ে এলো সন্তানের আশায়, তবে আম্বিয়া খাতুনই আগে জন্ম দিল এক ছেলের। নাম রাখা হল আজহার। ছোটবউয়েরও ছেলে হলো পরপর তিনটা আর একটা মেয়ে। কিন্তু মানুষের মন কী বিচিত্র ! ছেলে আজহারকে চোখের আড়াল করতে দেয় না ফরিদউদ্দিন। এই ছেলেটা তার চোখের মণি। তার অন্য ছেলে-মেয়েদের সে যেন দেখে ভাসা ভাসা চোখে, আবছাভাবে। এত আদর পায় না তারা। আর এই ব্যাপারটাই সর্বনাশ করে তাদের সংসারের। সম্পত্তির ভাগ নিয়ে সন্দেহ, আশংকা, শীতল রাজনীতি বাধ্য করে আম্বিয়া খাতুনকে আলাদা বাসায় উঠে যেতে। দুইটা সংসার চালায় তখন ফরিদউদ্দিন, দুই বাসায়। ছেলে আজহারের বিপদের আশংকায় কাঁটা হয়ে থাকে সবসময় স্বামী-স্ত্রী। তাই ঠিকানা পাল্টায় আম্বিয়া খাতুন কিছুদিন পর পর। ধীরে ধীরে ধনে, মনে নিঃস্ব হয়ে যেতে থাকে ওরা।

তারপর একটার পর একটা বছর গড়িয়ে যায়। ছেলে বড় হয়। স্কুলে যায়, কলেজে পড়ে, তারপর একসময় যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছেলেকে তার ছেড়ে দিতেই হয় আঁচল থেকে। কী আর করে সে ! তাই শুধু আল্লার কাছে ভিক্ষা চায়, তার ছেলেটার কোন ক্ষতি যেন কেউ না করতে পারে। তা আল্লাহ তার কথা শুনেছে। ছেলে তার এখন অনেক জ্ঞানী মানুষ। তবে তার কষ্ট একটাই, ছেলে আর আগের মত তার কাছে এসে বসে না। তবে ছেলেরই বা কী দোষ ! কত কাজ, দায়িত্ব তার ছেলের ! নিজেকেই নিজে বোঝায় আম্বিয়া খাতুন। ছেলে যখন বাইরে যায়, ঘরে ফেরে, দরজার পর্দাটা ফাঁক করে ছেলেকে প্রাণ ভরে দেখার চেষ্টা করে সে। এতেই সে অনেক শান্তি পায়। এর বেশি আর কীই বা সে করতে পারে ! তার সঙ্গী ফরিদউদ্দিনও তো চলে গেছে সেই কবে আচমকা একদিন।

ঘটনাটা হঠাৎ করেই ঘটে এক দুপুরবেলা। টলমল পায়ে আম্বিয়া খাতুন রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল, আর কোন বাতাস না, কোন ধাক্কা না, কী জানি কেন সে পড়ে যায় শক্ত মেঝেয়। পড়ে গিয়ে সে কোন শব্দও করতে পারে না। ছেলের বউ রান্নার এক ফাঁকে বাইরে এলে দেখে আম্বিয়া খাতুন পড়ে আছে অসহায়। ধরাধরি করে যখন বিছানায় শোয়ানো হলো তখন দেখা গেল মুখের ডানপাশটা বেঁকে গেছে আম্বিয়া খাতুনের। তারপর হাসপাতাল, ডাক্তার, সব পর্ব শেষে ফলাফল হলো এই যে আম্বিয়া খাতুনের ডানহাত আর ডান পা প্রায় অকেজো হয়ে গেল, কথা হয়ে গেল অস্পষ্ট, জড়ানো। বাম হাতটাও দুর্বল। যেন নিয়ন্ত্রণহীন কিছুটা। খাওয়ার সময় হলো এক ঝামেলা, যাই খাওয়ানো হয়, মুখের একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, কাপড়চোপড় নোংরা হয়ে যায়। এতবার এত কাপড় কাচবে কে ? কাজের মেয়েটা প্রবল অসন্তোষ প্রকাশ করে। তার পক্ষে নাকি এত কাপড় কাচা সম্ভব না। পেশাব-পায়খানা করার জন্য টেনে টেনে তাকে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হয়, পা ঘষটে ঘষটে কোনোমতে যায় আম্বিয়া খাতুন। তার কতটা কষ্ট হয়, খারাপ লাগে জানা যায় না, কারণ জানানোর মত ক্ষমতা এখন আর তার নাই। মাঝে মাঝে বিছানাতেই করে ফেলে। কথা না বলতে পারুক, ঘোলাটে, ম্রিয়মান চোখ থেকে চুঁইয়ে পড়ে লজ্জা, অপমানবোধ, অসহায়তা, কিছুটা যেন কৈফিয়তও। তবে এসব বাড়ির বিরক্ত মানুষ বোঝে না, বোঝার মত মানসিকতাটাই হয়তো নাই। মাঝে মাঝে আম্বিয়া খাতুনের মুখ নড়ে। কী বলে বুঝতে মুখের কাছে কান পেতে বুঝতে পারে না কেউ। তারা জানে না, বোঝে না; স্রষ্টার কাছে আম্বিয়া খাতুন আকুল আবেদন জানায়, ”আল্লা আমাক্ দুনিয়া থেকি লিয়ে যাও আল্লা। ” তার ছেলে-ছেলের বউ, নাতি-নাতনিকে সে আর কষ্ট দিতে চায় না। ওদের সে বড় ভালবাসে। সারাজীবন ওদের কত আদর করেছে, যখন সামর্থ্য ছিল, কত আবদার রেখেছে, ছেলেটাকে পাখির মার মত যেন ডানা দিয়ে আগলে আগলে রেখেছে, নাতি-নাতনিগুলেকে সেই তো কোলেপিঠে করে বড় করেছে, আর এখন কী ওদের সে কষ্ট দিতে পারে ! তাও আবার তার নিজের জন্য ! চোখের কোনায় পানি জমে বৃদ্ধ মানুষটার, জমতে জমতে বড় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ে। মোছার ক্ষমতা নাই তার। বার্ধক্য প্রবলভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে আম্বিয়া খাতুনকে।

জরা অবশ্যম্ভাবী, জরা অপ্রতিরোধ্য। জরা সবাইকে গ্রাস করবেই তা সে যত বড় মহাবীর হোক, যত বড় মহানায়ক হোক বা সাধারণ আম্বিয়া খাতুনই হোক না কেন। যে আত্মবিশ্বাসী, নিশ্চিন্ত পায়ে আমি-তুমি হেঁটে বেড়াই, সে পায়ের জোর একদিন জরা ছিনিয়ে নেবেই।

আম্বিয়া খাতুন মারাও যায় হঠাৎ করেই। কাউকে আগাম কিছু বুঝতে না দিয়ে। একদিন সকালে আম্বিয়া খাতুন খাবার সামনে দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে কেন বোঝা যায় না। খেতে চায় না। তাকে খাওয়াতে অবশ্য কেউ জোরও করে না। দুপুরবেলা ভাত নিয়ে এসে ছেলের বউ দেখে তার শাশুড়ির গলা থেকে কেমন ঘড় ঘড় একটা শব্দ হচ্ছে। যা বোঝার বুঝে যায় সে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার চিৎকারে আম্বিয়া খাতুনের ঘরে এসে যায় সবাই। পাড়া-প্রতিবেশী আসে, ফেরে ছেলে আজহার, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-অফিস থেকে নাতি-নাতনি, নাতবউ। বিছানায় বসে কোরান শরীফ পড়তে শুরু করে তিনজন। তবে আম্বিয়া খাতুন এত তাড়াতাড়ি মরে না, আধবোঁজা চোখে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিছু কী দেখে সে ? কিছু কী শোনে ? অথবা ছোটোবেলার কোনো ঘটনা কী চোখে ভাসে তার ? কী ভাবে, দেখে, শোনে আম্বিয়া খাতুন ?

ছোটোবেলায় একবার আম্বিয়া খাতুন তার বোন আসিয়াকে খুঁজতে চলে গিয়েছিল অনেক দূরে। সামান্য চুল-বাঁধা নিয়ে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল ছোট বোনটা। মাথা-সমান উঁচু বড় বড় ঘাস, ঝোপঝাড় ঠেলে যাওয়ার সময় সে শুনতে পাচ্ছিল নদীর পাড় ভাঙার বুকে-কঁপন-ধরানো আওয়াজ। বড় গাঙ তখন রাক্ষুসী হয়ে খেয়ে যাচ্ছিল মাঠ-ঘাট, ক্ষেত-খামার, বাড়ি-ঘর। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই আম্বিয়া খাতুন বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নদীর পাড়ের একদম কিনারে । সে বুঝতেই পারেনি আনমনে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে কখন সে চলে এসেছে নদীর একেবারে কাছে। আর এক পা ফেললেই সে চলে যেত নদীর তীব্র, বড় বড় ঢেউ আর স্রোতের মাঝে। ওই অবস্থাতেই হতবুদ্ধি হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত আম্বিয়া খাতুন দাঁড়িয়ে থাকে নদীর কিনারে, দেখে বড় গাঙয়ের পাক খাওয়া উথাল-পাথাল স্রোত, মৃত্যু থেকে ঠিক এক পা দূরে।

সন্ধ্যায় মারা যায় আম্বিয়া খাতুন। কাঁদে তার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিরা, কাঁদে পাড়া-পড়শী। আফসোস্ করে সবাই, মনে মনে ভাবে আর একটু বেশি কী সময় দেয়া উচিত ছিল বৃদ্ধ মানুষটাকে ! আর একটু বেশি যতœ ! সবাই কাঁদে আর ভাবে। ভাবে আর বিলাপ করে। আর উত্তর দিকে মাথা, হাত-পা সোজা, শুয়ে থাকে আম্বিয়া খাতুন, মৃত।

লেখকঃ "বইখাতা"


মন্তব্য

ফারুক হাসান এর ছবি

অতিথির নামটা জানা হলো না!

আপনার গদ্য সুন্দর গতিশীল, পড়ে আরাম পাওয়া যায়। আরো লিখুন।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

এক টানে পড়লাম, খুবই সাবলীল আপনার লেখনী, নামটা জানাবেন কষ্ট করে, আর এ একটা বিদ্যুৎ বার্তা ছেড়ে দিন, নাম যোগ করে দিবে মডু দাদা

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

বইখাতা [অতিথি] এর ছবি

ফারুক হাসান ও সাইফ তাহসিন, আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ।
আমি বইখাতা।
ঠিক বুঝতে পারছিনা, আমি তো নাম দিয়েছিলাম লেখার শেষে, নামটা আসলো না কেন।
অবশ্য এমনও হতে পারে, নামটা দেইনি হয়তো, াকন্তু মনে হচ্ছে দিয়েছি।
আমার ভুলে যাবার স্বভাব আছে।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

কোন অসুবিধা নেই, এখন একখানা e-mail দিয়ে দিন, ঠিক কোরে দিবে।

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এজন্যই বলি, আপনার সাথে আমার অনেক মিল আছে। আপনি-আমি দুই জনেই আইনস্টাইনের ড্রাইভার। এক লেকচার শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে, তাই নিজেরাই দিয়ে দিতে পারি। মজা পেলাম বেশ। মডু-দের জীবন অহেতুক আরামের করা বন্ধ করতে হবে আমাদের। খাইছে

সাইফ তাহসিন এর ছবি

বস, ঠিকই বলছেন, আসলে নিজে যেসব ভুল করি, তা অন্যদের করতে দেখলে মায়া হয়, তাই তাদের একটু সাহায্য করতে পারলে ভালো লাগে। আবার একটা চিন্তাও কাজ করে, সেটা হল, মডু সুলভ কথা বলে ফেলছি নাতো? সবার সাথে বন্ধু হতে চাই, মডুত্বের অভিশাপ থেকে দুরে থাকতে চাই, বেচারারা এমনিতেই OVER WORKED, আরাম করবে কিভাবে? যেভাবে কমেন্টাই, আমার মন্তব্য পড়তে পড়তে বেচারা মডুরা কাহিল লইজ্জা লাগে

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

বেগুনী-মডু এর ছবি

আপনার নাম লেখায় জুড়ে দেওয়া হল।

মামুন হক এর ছবি

খুব ভালো লেখা বই খাতা, মনটা খারাপ করে দিলেন। আসলেই।

বইখাতা [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ। আমার নিজেরো মন খারাপ ছিল লেখাটা শেষ করার পর।

রণদীপম বসু এর ছবি

'অনিবার্য বার্ধক্য মানুষকে এরকম একা করে দেয়...'

লেখাটা ভালো লেগেছে। অভিনন্দন । আরো লিখবেন এবং লিখতে থাকুন।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

বইখাতা [অতিথি] এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

রানা মেহের এর ছবি

আম্বিয়া খাতুনের গল্প ভালো লাগলো

বাংলায় আমরা বয়স্কদের কোন কথা বলতে গেলে
সম্মানসূচক ক্রিয়া অথবা সর্বনাম ব্যাবহার করি
যেটা এ গল্পটায় একবারো আসেনি।
ইচ্ছাকৃত কি?

কানে সে তেমন ভালো শুনতে পায় না, তবু পর্দায় যে ছবি দেখা যায় তাতেই সে সন্তুষ্ট।

এখানে তিনি এবং পান পড়লে ভালো লাগতো

নিয়মিত লিখুন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

বইখাতা [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

বাংলায় আমরা বয়স্কদের কোন কথা বলতে গেলে
সম্মানসূচক ক্রিয়া অথবা সর্বনাম ব্যাবহার করি
যেটা এ গল্পটায় একবারো আসেনি।
ইচ্ছাকৃত কি?

হ্যাঁ ইচ্ছাকৃত। আসলে আমি সময় ও বয়সবিহীন একটা অবস্থান থেকে আম্বিয়া খাতুনকে শুধুই একজন মানুষ হিসেবে নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করেছি। জানিনা বোঝাতে পারলাম কিনা।
তারপরও আপনার কোন অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকলে, দুঃখিত।
শুভেচ্ছা

সুমন সুপান্থ এর ছবি

বাংলায় আমরা বয়স্কদের কোন কথা বলতে গেলে
সম্মানসূচক ক্রিয়া অথবা সর্বনাম ব্যাবহার করি

হুম, কথা বলতে গেলে রানা, গল্প লিখতে গেলে নয় । না হলে তো বাংলা সাহিত্যের প্রায় সিংহভাগ কর্মকেই এই দোষে দোষী করতে হয় । লেখককে যতোটা সম্ভব স্থান,কাল,পাত্রের পক্ষহীন এক বিন্দুতে দাঁড়ালেই ভালো লাগে বেশী। না হলে কিচ্ছা হয় বেশী, গল্প'র চেয়ে!

বইখাতা, আপনার গল্পটা ভালো লাগলো ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

বইখাতা [অতিথি] এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আরও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা লেখার ব্যাপারে আমার অবস্থানটা বুঝতে পারার জন্য এবং তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।
শুভেচ্ছা

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ লিখেছেন আপনি...
সত্যের খুব কাছাকাছি থেকে গল্প হয়ে উঠে আসা...
সচলায়তনে আপনার দীর্ঘ যাত্রা কামনা করছি...

(জয়িতা)

রানা মেহের এর ছবি

বইখাতা
আপনাকে হয়তো বোঝাতে পারিনি।
যে কাঠামোত অভ্যস্ত সেই কাঠামোর কথা বলেছি।
অনুভূ্তিতে আঘাত লাগার প্রশ্নই আসেনা।

নিরপেক্ষতার যে উদাহরন দিয়েছেন। ঠিক আছে।
তবে ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয়েছে গল্পে একে মানায়নি। ভালো লাগেনি।
সাধারণ পাঠক হিসেবে বলা। আপনি আপনার অবস্থানে ঠিক আছেন।

সুমন ভাইয়া
তোমার যুক্তি ঠিক। কিন্তু এই গল্পের ব্যাপারে মানতে পারছি না।
গল্পে একটা জীবনের পরিবর্তন দেখানো হয়েছে। যার কারন জ্বরা - বার্ধক্য।
একজন বয়স্ক অশায় মানুষের কথা পড়ে আমি তার কষ্ট কীকরে অনুভব করবো
যদি তার বয়স উঠে না আসে ক্রিয়ায় বা সর্বনামে?

এই বিষয়ে লেখা বাংলা সাহিত্যের 'সিংহভাগ কর্মের' উদাহরণ দেবে একটু?
(আমার পড়াশোনার দৌড়তো জানাই আছে তোমার) চোখ টিপি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।