আদিবাসিদের বঞ্চনা

শরদিন্দু শেখর চাকমা এর ছবি
লিখেছেন শরদিন্দু শেখর চাকমা [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৭/২০০৯ - ৮:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শরদিন্দু শেখর চাকমা। মানবাধিকার কর্মী ,সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।
যোগাযোগঃ

বাংলাদেশের আদিবাসিদের বঞ্চনা করা নিয়মেই পরিনত হয়েছে।তাদের কেবল বঞ্চনাই করা হয় না, তাদের বাস্তুভিটা থেকেও জোর করে উচ্ছেদ করা হয়। তাদের মেয়েদের ছিনতাই অথবা ফুসলিয়ে বিয়ে করা হয়।তা সম্ভব না হলে ধর্ষণ করা হয়।

২০০৮ সালের ২৫ নভেম্বর তারিখে পি এস সি মিলনায়তনে ২৮ তম বি সি এস পরিক্ষার প্রস্তুতি সম্পর্কে জ়ানাতে প্রেস ব্রিফিং এ পি এস সি’র চেয়ারম্যান ডঃ সা’দত হোসেন অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে এটাও জানান যে, আদিবাসিদের এর আগে ঠকান হয়েছে।পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২০টি পদ থাকলে আদিবাসিরা পায় ১টি পদ ,এটা তাদের অধিকার। কিন্তু আগে তা করা হয় নি। কেননা তারা অনগ্রসর,প্রতিবাদ করতে পারে না।(দৈনিক সমকাল ২৬ নভেম্বর ২০০৮)
উল্লেখ্য, সরকারি-আধা সরকারি চাকরিতে আদিবাসিদের জন্য ৫% কোটা সংরক্ষিত আছে। কিন্তু সেটা অনুসরণ করা হয় না। ডঃ সা’দত হোসেন এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ২৭ তম বিসিএস পরিক্ষায় আদিবাসি প্রার্থীরা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৩ টি পদ লাভ করে। তার মধ্যে একজন মহিলা পুলিশ ক্যাডারে, অপর একজন পররাষ্ট্র ক্যাডারে নিয়োগ পায়। এটা সম্ভব হয়েছে ডঃ সা’দত হোসেন সরকারি চাকরি নিয়োগ বিধি নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করেছেন সেজন্য। কাউকে খাতিরও করেননি অথবা কাউকে বঞ্চিতও করেননি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সরকারি চাকরিতে আদিবাসিদের জন্য কোন কোটা নির্ধারিত ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের পর, প্রথম যখন অমুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের জন্য ১৯৭৬ সালে বি সি এস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, তখন মেধার ভিত্তিতে ৪০%; বাকি ৬০% জনসংখ্যা অনুপাতে জেলাওয়ারি পদগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম এর জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১%। ফলে ১৯৭৬ সালে অমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুষ্ঠিত ১ম বিসিএস পরিক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দেবদত্ত খীসা মেধা তালিকায় ৫৯তম স্থান দখল করা সত্ত্বেও প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পায়নি।কারণ সেইবার খালি পদ ছিল মাত্র ১০০টি।ফলে দেবদত্ত খীসা মেধা তালিকায়ও চাকরী পায়নি,জেলা কোটায়ও পায়নি।

আমি তখন রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা রাজমাতা বিনীতা রায়ের একান্তসচিব ছিলাম।চাকরি না পেয়ে দেবদত্ত খীসা আমার সঙ্গে দেখা করেন।আমি তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিদের জন্য সরকারি চাকরীতে কোটা সংরক্ষণসহ অন্যান্য আরো কয়েকটি দাবি সহ একটি দাবিনামা তৈ্রি করি এবং রাজমাতা বিনীতা রায়ের দস্তখত নিয়ে সেটা সরাসরি জেনারেল জিয়াউর রহমান এর কাছে পাঠিয়ে দিই এবং সেই সঙ্গে দেবদত্ত খীসার একটি আবেদন পত্র সংজুক্ত করে দিই।এর কিছুকাল পরে আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সংস্লিষ্ট উপসচিব সা’দত হোসেন সঙ্গে দেখা করি।এরপর দেবদত্ত খীসার প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি হয় এবং পরবর্তী সময়ে আদিবাসিদের জন্য সরকারি-আধাসরকারি চাকরিতে ৫% আসন সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রথম কয়েক বছর সরকারি নীতি মোটামুটি ভাবে অনুসরণ করা হলেও পরবর্তী সময়ে সেটা আর অনুসরণ করা হয়নি। ১৯৯২ সালের বি সি এস লিখিত পরিক্ষায় ৭-৮ জন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসি প্রার্থী পাস করলেও কেবল ২ জন নিয়োগ পায়।এমতাবস্থায় আমি পিএসসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ফায়েজ’র সাথে দেখা করি।
আমি তার সঙ্গে খোলামেলা ভাবে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করি।আমি তাকে বলি, ব্রিটিশ আমলে মুসলমান রা শিক্ষা-দীক্ষায় হিন্দুদের তুলনায় অনগ্রসর ছিল বিধায় মুসলমানদের Nomination-এর মাধ্যমে Indian Civil Service, Indian Police service এবং অন্যান্য সার্ভিসে চাকরি দেওয়া হত। পাকিস্তান আমলেও মুসলমান বাঙ্গালিরা Parity নামে কোটায় চাকরি পেয়েছিলেন।এরকম ভাবে নিয়োগ পাওয়া অনেক কর্মকর্তা পরবর্তী সময়ে খুবই সফল আমলা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন। প্রফেস্র ফায়েজ আমাকে আশ্বস্ত করেন, তিনি আদিবাসিদের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন ।

এরপর যতদিন প্রফেসর ফায়েজ পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন,ততদিন অনেক আদিবাসি প্রার্থী চাকরি পেয়েছিলেন,এরপর আবার আদিবাসি বঞ্ছনা শুরু হয়। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমার আবেদন আদিবাসিদের ৫% কোটা সঠিক ভাবে অনুসরণের জন্য সংস্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দিতে,যদি কোন বছর সেই কোটা পূরন করা সম্ভব না হ্য়,পরবর্তী বছরের পরিক্ষার্থীদের দ্বারা সেই কোটা পূরন করতে। সেই সঙ্গে আমি আরও আবেদন জানাই একজন আদিবাসিকে পিএসসির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিতে।
এখানে উল্লেখ্য, ভারতের ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সবসময় বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে এমনকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে চেয়ারম্যান এবং সদস্য নিয়োগ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে শিখ সম্প্রদায়ের গুরবচন সিং জগত কমিশনের চেয়ারম্যান আর মুসলিম সম্প্রদায়ের পারভিন তালহা এবং ক্ষুদ্র সিকিম রাজ্যের ভুটিয়া সম্প্রদায়ের চোকিলা আয়ার কমিশনের অন্যতম সদস্য। আরও উল্লেখ্য ভারতের পাবলিক সার্ভিস কমিশন এখন ১জন চেয়ারম্যান এবং ৯জন সদস্য নিয়ে গঠিত।

গুরবচন সিং জগত এর আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের ডঃ এস আর হাশিম। কমিশনের সচিব হওয়ার আগে চোকিলা আয়ার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন । তিনিই ভারতের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা পররাষ্ট্র সচিব।
ভারতে আদিবাসি এবং নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রয়েছে এবং কোন বছর কোন কারণে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে,পরবর্তী বছর গুলোতে সেই কোটা পূরণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত এই পন্থা অনুসরণ করা।


মন্তব্য

কালো-মডু এর ছবি

একই সাথে অন্য কম্যুনিটি ব্লগে প্রকাশের কারণে পোস্টটি ভেতরের পাতায় সরিয়ে নেয়া হলো।

শরদিন্দু শেখর চাকমা [অতিথি] এর ছবি

আমি এ ব্যাপারে অবগত ছিলাম না।। এ লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে আশাকরি পুনরায় তা প্রথম পাতায় আনা হবে। কারণ আদিবাসিদের বঞ্ছনা নিয়ে এটি এক টি সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ লেখা । অনেকেই যে ব্যাপারে একদম কিছুই জানে না।তাদের কে জানণো এবং সচেতন করাটা বেশি জরুরি ।

হিমু এর ছবি
বেগুনী-মডু এর ছবি

নীতিমালার নিয়মনিষ্ঠ ও সুষম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে আপনার অনুরোধটি রাখা গেল না বলে দুঃখিত। আপনার মানসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ লেখার উপর নীতিমালা প্রয়োগ করতে হওয়ায় আমরাও দুঃখিত, কিন্তু আশা করি আপনি নিয়মাবলির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবেন।

সচলায়তন আপনার কাছ থেকে এমনই আরও অনেক লেখার প্রত্যাশী। আপনার লেখনী দিয়ে সচলায়তন ঋদ্ধ করবেন, এই আশাবাদ রইলো। ধন্যবাদ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে আপনার কাছ থেকে একটি লেখার প্রত্যাশা জানিয়ে রাখলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শরদিন্দু শেখর চাকমা [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার প্রত্যাশা আশা করি শীঘ্রই পূরন করতে পারব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।