স্মৃতির ক্রিকেট ও একজন রাজেশ-দা

বাউলিয়ানা এর ছবি
লিখেছেন বাউলিয়ানা [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৭/০১/২০১০ - ৫:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
১৯৯২ সাল, আমি তখন হাইস্কুলের প্রথম দিকে পড়ি। সেটা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা থানা শহরে। সকাল-বিকাল ক্লাস করার পর বাসার সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলি। স্কুলের টিমে চান্স পাইনা, ওখানে খেলেন স্কুলের সব বস্‌ মানে সিনিয়র প্লেয়াররা। আমরা স্কুলের বিশাল মাঠের পাশে বসে বসে উনাদের খেলা দেখি আর দীর্ঘশবাস ফেলি-কখন বড় হব, কখন স্কুলের টিমে খেলতে পারব। একদিন মাঠের পাশে বসে খেলা দেখছি আর হাত তালি দিচ্ছি। ড্রিঙ্কস ব্রেকের সময় একজন এগিয়ে আসলেন সোজা আমার দিকে, আমাকে বল্লেন, তুমি ক্রিকেট খেল? আমরা আগে থেকেই টিমের দুর্দান্ত পেস বোলার হিসেবে উনাকে চিনতাম। উপজাতি হলেও হঠাত দেখে বোঝা যেত না। আমি হ্যা বলতেই বল্লেন কাল একটু সকাল সকাল নেট প্র্যাকটিসে আসতে। আমারতো বুকের মাঝে হাতুড়ী পেটানোর শব্দ শুরু হয়ে গেছে। মনে আছে, এক দৌড়ে স্কুলের মাঠ থেকে বাসায় ফিরেছিলাম।
২।
স্কুল ছাড়বার আগ পর্যন্ত স্কুলের টিমে খেলেছি। স্কুলের সেই বড় ভাই ছিলেন আমার গাইড কাম কোচ। যখন ব্যাট করতে নামতাম, উনি গার্ড পরেছি কিনা মনে করিয়ে দিতেন। টিমের সবচেয়ে ছোট ছিলাম বলে প্যাড ঠিকমত পরতে পারতামনা। উনি প্যাড পড়তে সাহায্য করতেন। যখন অন্য শহরে খেলতে যেতাম, উনি কি কি জিনিষ নিতে হবে বলে দিতেন। ওখানে গিয়ে ঠিকমত খাচ্ছি কিনা খেয়াল রাখতেন। চাঁদা দিয়ে কিছু কেনার দরকার হলে অবধারিত ভাবে আমাকে গোনার বাইরে রাখতেন। বলতেন ওতো এখনও ছোট। একবার রমজানের মধ্যে খেলা পড়ে গেল। জেলা শহর থেকে টিম আসছে। এর আগে আমরা ভিজিটিং টিম হয়ে খেলে এসেছি। এবার আমরা হোম টিম। আমাদের দলে উপজাতি সদস্যের সংখ্যা বেশি বলে রোজা রাখার ব্যপার নেই। মাত্র দুইজন মুসলিম সদস্যের একজন রোজা রাখবেননা। বাকি থাকি আমি, যে রোজাও রাখব আবার প্রথম একাদশেও আছি। আগের দিন প্র্যাকটিসের পর সেই বড় ভাই আমার জন্য ইফতার কিনে আনলেন। আমাকে সামনে বসিয়ে খাওয়ালেন। পরদিন ম্যাচের মধ্যে বার বার জিজ্ঞেস করেন কষ্ট হছে কিনা।
৩।
এর কয়েক বছর পর আমরা সেই শহর ছেড়ে চলে যাই। পরে আরও কয়েকবার গিয়েছি, কিন্তু উনার দেখা পাইনি। অন্যদের জিজ্ঞেস করতেই বলে, কী এক রাজনৈতিক গন্ডগোলের পর উনি শহর ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর এই এত বছর যখনই আমি কোন উপজাতি ছেলেকে দেখতাম, চেনার চেষ্টা করতাম-ইনি কি আমার সেই বড় ভাই কিনা। কিন্তু কখনই উনাকে আর খুঁজে পাইনি। আমার আর ক্রিকেট খেলা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু টিভিতে নিয়মিত খেলা দেখি বা পেপারে ক্রিকেটের খবরটাই সবার আগে পড়ি। কয়েক বছর আগে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে আসার পর অবশ্য টিভি দেখা আর হয়ে ওঠে না।
৪।
আজকে সকালে মনটা খারাপ হয়ে গেল ভারতের কাছে বাংলাদেশের ১০ উইকেটের হারের খবর পড়ে। তারপর যেই কাজেই হাত দেই-ঠিকমত হয়না। প্রোগ্রাম চালাই-এরর দেখায়, এরর ঠিক করে আবার প্রোগ্রাম রান করি, কি সব উল্টা-পাল্টা রেজাল্ট দেখায়। মন বার বার চলে যাচ্ছিল সেই ছোট্ট মফসবল শহরে। এই জানুইয়ারী- ফেব্রুয়ারীর প্রত্যেক সপ্তাহে আমাদের ম্যাচ থাকত। হয় অন্য জেলা শহর থেকে টিম আসত অথবা ভিজিটিং টিম হয়ে আমরা যেতাম।
মন খারাপ করে সদ্য শেষ হওয়া টেস্ট ম্যাচের হাইলাইটস এর জন্য গুগলিং করতে করতে একটা সাইট পেলাম, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেলের খবর দেখা যায়। আমি একুশে টিভির খবর চালু করলাম। সেটা ছিল আগের রাতের খবর। খবরের শুরুতেই হেডলাইন দেখানোর পর সংবাদ পাঠক বল্লেন, “আসসালামু আলাইকুম, আমি রাজেশ ত্রিপুরা প্রত্যেককে স্বাগত জানাই রাত এগারটার একুশে সংবাদে।” আমি শুধু তাকিয়ে থাকি মনিটরের দিকে-আমার কানে কিছু ঢুকেনা। এই সেই রাজেশ-দা, আমার ক্রিকেটের গুরু, ক্রিকেটকে ঘিরে আমার অনুপ্রেরণার উৎস। আমার মনটা ভাল হয়ে যায়। আমার মনে পড়ে যায় ব্যাকফুটে গিয়ে লেগ-গ্লান্স করতেই রাজেশ-দার চিৎকার, "সাবাস সাবাস"।

(বাউলিয়ানা)


মন্তব্য

ফাহিম এর ছবি

আজকে সকালে মনটা খারাপ হয়ে গেল ভারতের কাছে বাংলাদেশের ১০ উইকেটের হারের খবর পড়ে। তারপর যেই কাজেই হাত দেই-ঠিকমত হয়না।

সকাল নয়টায় অফিস আসছি, এখন বেলা একটা, এক ফোটাও কাজ করতে পারি নাই এখনো। ছাগল দিয়া আসলে হালচাষ হয় না...

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

বাউলিয়ানা এর ছবি

ভাই মন খারাপ কইরেননা। রাতের অন্ধকারের পর সূর্য উঠবেই।

ফাহিম এর ছবি

আর উঠসে...

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

তিথীডোর এর ছবি

হারিয়ে যাওয়া প্রিয় একজনকে এমন নাটকীয়ভাবে খুঁজে পাওয়া দারুণ একটা ব্যাপার...
ভাল্লাগলো!!

--------------------------------------------------
"আমি তো থাকবোই, শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা/
এই ইচ্ছেমৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো..."
*সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

বাউলিয়ানা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

ধুসর গোধূলি এর ছবি
বাউলিয়ানা এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় ধুগো।
হাসি

সাবিহ ওমর এর ছবি

জট্টিল...আমরা যতই বলি পৃথিবী সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, স্থানিক দূরত্ব সম্পর্ক রক্ষার পথে এখনো একটা বড় বাধা। আমরা ফেলে আসা প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলি, কারণ তাকে আমরা খুঁজে বের করি না। পাকেচক্রে দেখা পেলে বরং মনটা আরো খারাপ হয়। মনে হয় এই কি সেই?

বাউলিয়ানা এর ছবি

আমরা ফেলে আসা প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলি, কারণ তাকে আমরা খুঁজে বের করি না।

সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার মাঝে সুন্দর একটা নাটকীয়তা আছে। ভাল লাগল।

শেখ আমিনুল ইসলাম

বাউলিয়ানা এর ছবি

পড়বার জন্য ধন্যবাদ হাসি

অনন্ত [অতিথি] এর ছবি

সুন্দর করে লিখেছেন। আমারও অনেক পুরাতন কথা মনে পড়ে গেল। আপনার সেই বড় ভাইকে নাটকীয় ভাবে খুজে পাওয়া বেশ ভাল লাগল।
আর বাংলাদেশের ক্রিকেট।আহ্‌......

===অনন্ত===

বাঊলিয়ানা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর লেখা। পড়ে অনেক ভালো লাগলো।
আপনার মতো আমিও আশা রাখছি। কিন্তু গোড়ায় পানি না দিয়ে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের নিয়ে লাফালাফি করলে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। ক্রিকেটের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অঞ্চলিক ক্রিকেটের দিকে নজর দিতে হবে।
---- মনজুর এলাহী ----

বাউলিয়ানা এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

বাঃ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এমন খুঁজে পাওয়ার খবর শুনে।
পড়ার শুরুতে ভয় পাচ্ছিলাম, রাজেশদার হয়ত কোনো করুণ পরিণিতির কথা শুনতে হবে। ভালো কিছু তো ঘটে না বাংলাদেশে!
আপনার লেখাটা চমৎকার। স্মৃতি জাগানিয়া।
সবার শৈশবেই বোধহয় এরকম কিছু বড় ভাই থাকেন, যাদের মমত্ব ভোলা যায় না। কিছু অপরিশোধিত এবং অপরিশোধনযোগ্য ঋণ তাড়া করে ফেরে সারাজীবন।
সাধারণত এই মানুষগুলো হারিয়ে যায়। আপনি একজনকে খুঁজে পেলেন। আপনি সৌভাগ্যবান।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

বাউলিয়ানা এর ছবি

আরে মৃদুল'দা !
আপনি এই পুরানো লেখাটা পড়েছেন দেখে খুব ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।