বুঝি না কোন কালে...

মৌনকুহর এর ছবি
লিখেছেন মৌনকুহর [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৫/২০১১ - ১০:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডান হাতে বিকটাকার একটা বই, সাথে চক-ডাস্টার। বাম হাতে একটিমাত্র জিনিস- তিন ফিট লম্বা, লিকলিকে, চকচকে একটা বেত। স্মিতহাস্যে সদা উজ্জল দু'খানা ঠোঁট আর পুরু লেন্সের কারণে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ছোট মনে হওয়া একজোড়া পিটপিটে চোখ- তাঁর শুধু এই দুইটি জিনিস যিনি দেখবেন, তিনি তাঁকে নিতান্ত-ই কোমল মনের রসিক একজন মানুষ বলে ধরে নিবেন। যিনি শুধু তাঁর ডান হাতের দিকে তাকাবেন, তাঁকে প্রচন্ড বিদ্যানুরাগী, জ্ঞান-তাপস একজন মানুষ বলে নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি দিবেন। কিন্তু এই দুইয়ের সাথে, বাম হাতের অদ্ভূত ভয়ংকর ভঙ্গিমায়, তীব্রভাবে দোদুল্যমান বেতখানি যিনি দেখবেন, অভিন্ন একজন মানুষের বিভিন্ন অংশের চরমতম বৈপরীত্য দৃষ্টিগোচর হবার প্রচণ্ড প্বার্শ-প্রতিক্রিয়ায়, হৃদযন্ত্রের যাবতীয় কার্যকলাপ সাঙ্গ করে তৎক্ষনাত তার ইহধাম ত্যাগ করার সমূহ সম্ভাবনা আছে বৈকি!

নিম্ন মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবে মাধ্যমিক পর্যায়ে পা রেখেছি। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা 'উড়ু-উড়ু' ভাব। কিন্তু এই 'উড়ু-উড়ু' ভাব আর 'ওড়া-উড়ি'র রূপ পায় না, তার আগেই আমাদের পক্ষ-যুগল একেবারে রামদা-এ কাটা পরার ব্যবস্থা হয়- সেই তিনি আমাদের ক্লাস-টিচার হয়ে আসেন। বারান্দা দিয়ে যিনি হেঁটে গেলেই ছাত্রদের হৃদযন্ত্র 'দ্বিগুন' উত্সাহে কাজ শুরু করে দেয়, সেখানে আমাদের তখন কী হল, তা বলাই বাহুল্য- হৃদয়ের দুর্দান্ত গতির ধাক্কায় পাজরের হাঁড় যদিবা দু-একটা নড়ে-টড়ে গিয়ে থাকে তো সে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলা চলে।

স্যার পড়াতেন অনেক ভালো, অনেক বেশি বেশি ভালো। যেকোনো একটা বিষয় এমনভাবে বুঝিয়ে দিতেন, ক্লাসের পড়া ক্লাসেই একরকম শেষ হয়ে যেত। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপারটা ছিল বাড়ির কাজ, প্রত্যেক দিন একগাদা করে কাজ দিতেন। আরে ভাই, এত বড় হয়ে যাবার পর অমন করে কেউ বাড়ির কাজ দেয়! আমরা কি 'শিশু-শ্রেণী'র শিশু নাকি! হরমোনের খেলায় নিজেদের তখন বেশ পণ্ডিত বলে মনে হয়, নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তটাকেই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সঠিকতম স্বিদ্ধান্ত বলে ঠাওর হয়। একদিন, দু'দিন, তিনদিন- এরপর রীতিমত বিদ্রোহী হয়ে উঠলো মন| নাহ, এভাবে তো আর হয় না। বাড়ির কাজের চাপে আমাদের মহা-গুরুত্বপূর্ণ কাজ-কর্মের যে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! স্কুল ছুটির পর সানগ্লাসটা চোখে এঁটে পাশের ওই স্কুলটার গেটে দাঁড়িয়ে একটু 'ভাব' মারা, কোচিং-এর কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে সিনেমা হলে একটা ঢু মেরে আসা কিংবা বিকেলে ওই পাশের পাড়ার সাথে ম্যাচ খেলা- ভীষণ মাত্রায় আবশ্যকীয় আমাদের এইসব কাজ যে বন্ধ হবার যোগাড়! এর ওপর দিন কে দিন তিনি আরো বেশি করে কাজ দিচ্ছেন। আমাদের মন আর মানে না- কেমন করে মুক্তি পাই এর থেকে! সরাসরি স্যারকে অনুরোধ করব ভাবলাম, বলব, কাজ একটু কম কম করে দেন। কিন্তু ওই তিন-ফুটি বেতের কথা মনে হতেই পেটের মধ্যে এমন এক মোচড় মারল, সে পরিকল্পনা বাদ দিলাম তত্ক্ষনাত। কিন্তু আর কী করা যায় তাহলে- চিন্তায় আমরা বেঁহুশ। কোন কুল-কিনারা না পেয়ে শেষমেষ ঠিক করলাম, আগামী দিন সবাই এক যোগে বাড়ির কাজ বন্ধ রাখব, যা আচ্ছে থাক কপালে। সবাই তাতে সায় দিল।

পরদিন স্যার এলেন, রোল-কল করলেন এবং যথারীতি সবাইকে বাড়ির কাজ দেখাতে বললেন। এরপর কী ঘটে তা দেখার জন্য আমি একরকম উত্তেজিত। কিন্তু হতভম্ব হয়ে গেলাম দেখে, এক আমি ছাড়া সবাই-ই ভদ্র ছেলের মত সুন্দর করে কাজ এনেছে প্রতিদিনের মত, স্যারের টেবিলে জমা দিচ্ছে। বেশ বুঝলাম, আগের দিন আমার প্রস্তাব কবুল করলেও তা বাস্তবায়ন করা এদের সাহসে কুলোয় নি। আসমান-জমিন সবকিছুকে নিয়ে একটা চক্কর মারল মাথাটা। স্যার আমাকে সামনে ডাকলেন, শির-দাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নেমে গেল। আবিষ্কার করলাম, ভয়ের ঠেলায় 'বিপ্লবী' এই আমার শরীর হিম হয়ে গেছে, হাত-পা সব অবশ! দাঁড়াতে গিয়ে পারলাম না দাঁড়াতে। স্যার কী ভাবলেন জানি না, শুধু দেখলাম, আমার যাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে তিনি নিজেই আসছেন আমার কাছে, হাতে উদ্দাম নাচ, নাচছে সেই তিন-ফুটি বেত। এরপর যা হলো, তা আর বর্ণনা করলে আমাকে রাস্তায় বেরোতে ছদ্মবেশ নিতে হবে। সুতরাং সেই 'স্বর্গীয়' ঘটনার পার্থিব ফলাফলটুকু শুধু বলি, পরের দশ দিন আমি শান্তিমত একদণ্ড বসতে পর্যন্ত পারিনি।

অমন 'স্বর্গীয়' উপহার যিনি অকাতরে দান করেন, তাঁর প্রতি উপহার প্রাপকের মনোভাব যেমন হওয়া স্বাভাবিক, আমারও তা-ই হলো। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার বিন্দু-বিসর্গও আর অবশিষ্ট রইলো না। সামনে পড়লে এড়িয়ে যেতাম নয়ত পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলে যেতাম- ন্যুনতম শিষ্টাচার, সালামটা পর্যন্ত দিলাম না। পেছনে তাঁকে ডাকতে শুরু করলাম নাম ধরে, ক্ষেত্রবিশেষে আগে-পরে জুড়ে দিলাম ভয়ংকর অশিষ্ট সব বিশেষণ আর উপাধি। যত রকম বেয়াদবি একজন ছাত্রের পক্ষে করা সম্ভব, বাদ রাখলাম না কোনটাই। এই করে কেটে গেল বেশ কিছুদিন। একদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম, তিনি কিছুদিনের মধ্যেই অবসরে যাচ্ছেন, চাকরির বয়স শেষ। আমার স্ফূর্তি তখন দেখে কে! খুশির চোটে এমন এক চিত্কার করে বসলাম যে নিজের-ই কান গরম হয়ে গেল। অবশেষে এলো সেই দিন। আজ-ই তাঁর শেষ ক্লাস- ক্লাসে ঢুকতেই একজন দৌড়ে এসে জানাল। খুশির চোটে আরেকটা চিত্কার হয়ত দিয়েই বসতাম, কিন্তু ঘন্টা পরে গেল।

স্যার এলেন। বাম হাত আজ খালি। রোল-কল করলেন, বাড়ির কাজও দেখলেন- এরপর আমাদের লিখতে দিয়ে পায়চারি করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর স্যার কোণার জানালাটার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাকিয়ে দেখি, রুমাল দিয়ে তিনি চোখ মুছছেন বারবার; স্যার কাঁদছেন। এত বড় একজন মানুষকে ওভাবে কাঁদতে দেখলে যে কারো মায়া হবে, এই ক্ষেত্রে আমারও হলো- যদিও মানুষটার উপর অতিমাত্রায় বিরক্ত আমি| ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ল, সবাই সামনে গেল তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতে। সবাই যাচ্ছে, না গেলে খারাপ হয়- এমনটা ভেবে, নিছক আনুষ্ঠানিকতার জন্য সবার পিছু পিছু গেলাম আমিও, অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কিন্তু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম যখন কাছে যেতেই তিনি একেবারে বুকে টেনে নিলেন। জড়িয়ে ধরে স্যার বললেন,
"সেদিন খুব বেশি লেগেছিল, না রে? তুই যে আমাকে ঘৃণা করিস- সে খুব ভালো করে জানি। কিন্তু তোদের যে আমি নিজের ছেলের চেয়ে বেশি ভালবাসি, তা কি জানিস?"

আমার কী হল জানি না, ভেতরটা সম্পূর্ণ ওলট-পালট হয়ে গেল তাঁর এই কথায়। মুহুর্ত-ক্ষণ আগ পর্যন্ত অন্তরের প্রত্যেকটা অণু-পরমাণু দিয়ে পর্যন্ত যাকে ঘৃণা করছিলাম, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছিলাম ক্ষোভের আগুনে, সেই তাঁর কোথায় বুকের উপর আচমকা যেন চেপে বসল জগদ্দল এক পাথর। কোথায় গেল ঘৃণা, কোথায় গেল আগুন! আগুনে পুরে রক্তিম লোহাখণ্ডে কেউ যেন ঢেলে দিল হিমশীতল জল। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার।

স্যার বলে চললেন বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে,
"যা করি, তা যে কেবল তোদের-ই ভালোর জন্য করি সেটা বুঝিস? তোরা ত়া বুঝিস না কোনো কালে।”

এইবার আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। দু'চোখ ঝাপসা হয়ে এল আমার, কেঁদে ফেললাম ঝরঝর করে। স্যার আমার চোখ মুছে দিলেন সস্নেহে। আর থাকতে পারলাম না, ছুটে বেরিয়ে গেলাম ক্লাস থেকে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিত্কার করে কাঁদলাম| প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছিল নিজেকে, ঘৃণা হচ্ছিল নিজের মানসিকতাকে। এত নীচ, এত হীন আমি! কী করে বেড়ালাম এতদিন!

স্যার চলে গেলেন। আমার চোখের জল তিনি না হয় মুছে দিয়ে গেছেন। কিন্তু যে কালবোশেখী আমার মনের রাজ্যে তিনি বইয়ে দিয়ে গেলেন, তার শেষ কোথায়?

মৌনকুহর
১৯.১১.২০১০


মন্তব্য

অপছন্দনীয় এর ছবি

স্কুল জীবনের প্রথম সাত বছর কেটেছে হলিক্রসের একটা মিশন স্কুলে, চরম কড়া ডিসিপ্লিন, কিন্তু একবারের জন্যও ওই বেত বস্তুটার সাথে আমার মোলাকাত হয়নি। নিয়ম মেনে চলতে জানি আমি। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সম্মান করতে শিখেছি এখান থেকেই - শিক্ষকরা কতখানি স্নেহ করেন সেটাও জেনেছি এখান থেকেই। বরিশালে যখনি গেছি, আর কোথাও যাই বা না-ই যাই, স্কুলে একবার গেছি-ই।

ক্লাস সেভেনের শেষের দিকে চলে আসি ঢাকায়, একটা সরকারী স্কুলে। শিক্ষক সম্প্রদায়ের উপরে শ্রদ্ধা উঠে যেতে শুরু করে এখান থেকে। এখানে একদিন ওই বেতের স্বাদটা বুঝেছিলাম, কিন্তু সেটা নিজের দোষে নয়। ক্লাসে দুইজন ছাত্র ছিলো একই উচ্চতা, গায়ের রঙ আর একইরকম চশমা সহ, অন্যজন জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলো না, আমি গাইছিলাম। জনাব আব্দুল গফুর আমাকে সে ভেবেছিলো*।

ভুল করলে ক্ষমা করে দেয়াই যায়, কিন্তু যে শিক্ষক(!) জাতীয় সঙ্গীত চলার সময় পাশের জনের সঙ্গে গল্প করে* জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কাউকে আঘাত করার কোন অধিকার তার* নেই। অপমানবোধটা মনে আছে এখনো। তার* ক্ষেত্রে এটা ভুল নয়, অপরাধ, এবং অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। তাকে* ঘৃণা করি আমি, শেষ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে সে* আর কিছুই পাবে* না - পা ধরে মাফ চাইলেও না।

* সচেতনভাবে সম্মানসূচক "ভেবেছিলেন", "তাঁর", "তাঁকে", "তিনি" এবং "পাবেন" শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়নি - শ্রদ্ধা বস্তুটা অর্জন করতে হয়, পদাধিকারবলে পাওয়া যায়না।

মৌনকুহর. এর ছবি

চিন্তিত

মৌনকুহর. এর ছবি

কিছু বানান ভুল এইমাত্র চোখে পড়ল... আন্তরিকভাবে দুঃখিত... ইয়ে, মানে...
সচল হবার পর সংশোধনের আশা রাখছি... চোখ টিপি

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

খুব ভালো লেগেছে!!! ধন্যবাদ।

মৌনকুহর. এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ... হাসি

রু (অতিথি)  এর ছবি

গল্প ভালো লেগেছে।

মৌনকুহর. এর ছবি

ধন্যবাদ... হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মৌনকুহর. এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ... হাসি

মৌনকুহর. এর ছবি

ধন্যবাদ... হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

লেখা অসাধারণ হয়েছে!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

মৌনকুহর. এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

bashir_ctg এর ছবি

ভালো লাগলো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।