আমার বান্দরবেলা

বন্দনা এর ছবি
লিখেছেন বন্দনা [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৬/২০১১ - ৮:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকাল না চাইলেও মাঝে মাঝেই দৌড়াতে হয়। এই যে এখন রাস্তার ওপারের স্টপেজে গিয়ে বাসটা ধরতেই হবে, না হলে আর আধঘণ্টা পরের বাসটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই একটুখানি পথ দৌড়েই ক্লান্ত লাগে, অথচ একটা সময় ছিল বন্ধুদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে একটু ও ক্লান্তি লাগতোনা। কত খেলেছি বরফ-পানি, ছোয়াছোয়ি, দাড়িয়াবান্ধা, বউচি কিংবা হা-ডূ-ডু। খুব সকাল কি ভরদুপুর, কি ভরা বর্ষা, কিচ্ছু আমাকে বেধে রাখতে পারতোনা। স্কুল শুরু হতো সকাল সাড়ে সাতটায়, আমি পৌঁছতাম তার অনেক আগেই। শীতের সময় হলে সাদা শিউলি ফুল আমার আগে কেউ কুড়িয়ে নিয়ে যাবে এমনটা হতেই পারতোনা। তারপর দাড়িচার কোর্ট কেটে বন্ধুরা দুভাগে ভাগ হয়ে খেলা চলতো এসেম্বলির আগ পর্যন্ত। এরপর টিফিনের সময়, তারপর আবার ছুটির পর ও চলতো সেই খেলা। সেই জংলির মত খেলার ফলাফল হোল আমার স্কুল ড্রেসের কাঁধের ফিতা আর কোমরের বেল্ট এর ফিতা প্রায়ই ছেড়া থাকতো।আর ও শোচনীয় ছিল আমার পায়জামার অবস্থা।দুহাটুতে অসংখ্য ফুটা নিয়ে স্কুলে আসতে খুব লজ্জা লাগতো। কিন্তু ওটা ছিলো বাবার দেয়া শাস্তি। স্কুলের দুসেট ড্রেসের পায়জামারই একি দশা করেছিলাম।মা রিফু করে আর কুলাতে পারতেননা আমার দস্যিপনার সাথে। এমনই বিচ্ছু ছিলাম আমি এবং আমার বন্ধুরা। স্কুলে আমার বন্ধুদের কেউ কিছু বলে পার পাবে এমনটা হতেই পারতোনা।আমি ছিলাম দলের হোতা। কিছু হলেই আমার কানে খবর আসতে যা দেরী, এরপরই দলবল নিয়ে গিয়ে শাসিয়ে আসতাম। ওহ কি ছেলেমানুষ ছিলাম!

একবারতো আমাদের স্কুলের এক আপু আত্মহত্যা করলো স্কুলের পুকুরে। পরে সবাই বলছিলও যে ওনাকে নাকি রাতের বেলা দেখা যাচ্ছে মাঝেমাঝে। তখন আমার আরও দুইটা জানকা দোস্তরে নিয়ে আমি কিশোর হয়ে গেলাম এই ঘটনার তদন্ত করার জন্য। তিন গোয়েন্দার বালিকা ভার্সন আরকি।সেই বয়সে কিশোরের প্রেমে এমন হাবুডুবু খাইছি যে বন্ধুরা মিসেস কিশোর বললে একটু ও মাইন্ড করতামনা!

খেলাধুলায় বরাবরি ভালো ছিলাম।স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কখনও তিনটার কম পুরষ্কার পাইনি।হিটের সময় সব বন্ধুরা কখনো একসাথে দাঁড়াতামনা, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া এত ভালো ছিলো।যদিও শেষমেশ ফাইনালে নিজেরাই কমপিট করতাম, তাতে কি পুরষ্কারতো নিজেরাই ভাগাভাগি করে নিতাম।পুরষ্কার হিসেবে পাওয়া কাঁচের থালা-বাটির সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকলে আমি মাকে বলতে লাগলাম এগুলা কিন্তু আমি শ্বশুড়বাড়িতে নিয়ে যাবো, কাউরে দিবোনা। মা খালি হাসতেন।

আমার স্কুলটা ছিলো পুরান ঢাকা্য, বেশ নামকরাই বলা চলে। ওখানে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য তখনকার সময় ও বাবামাদের খুব কম্পিটিশন চলতো।আমরা তিন বোনেই পড়েছি শেরে-বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে। কিন্তু আমার বাবার স্বপ্ন তার একটা মেয়েকে অন্তত কামরুন্নেসা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে না পড়লেই না। আমার বড় দুবোনে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে না পারায় আমাকেই নিতে হলো সেই গুরুদায়িত্ব। তাই যথারীতি ক্লাস ফোর এর জন্য এডমিশন টেস্ট দিতে হলো এবং আমার বাবার মুখ উজ্জ্বল করে চান্স ও পেয়ে গেলাম।বাপজান রেজাল্ট পেয়ে বাসায় এসেই আমারে কোলে নিয়ে নিলো, তার সেকি আনন্দ, আমার অবশ্য মন খারাপ, এখানকার বন্ধুদের ছেড়ে চলে যাবো। সুমির জন্য খুব কষ্ট লাগছিলো বেশী। বেচারি তার টিফিন একদম খেতে পছন্দ করতোনা। সুমির টিফিনের নিউটেলা দেয়া পাউরুটিগুলাতো আমিই সাবাড় করতাম।ওর সাথে না দেখা হলে কে এখন ওর পাউরুটিগুলা শেষ করে দিবে এই চিন্তায় আমার ঘুম আসছিলোনা।

নতুন স্কুলে এসে খুব দ্রুতই আমার মত বান্দর-টাইপ পোলাপাইন জুটাইয়ে ফেললাম।এই বান্দর টাইপ পোলাপাইনের মাঝে এখনকার নামকরা গায়িকা চম্পা বনিক ও ছিলো। সে ও পুরা আমার ধাতেরই।তখন থেকেই ও এত ভালো গাইতো। আমিতো বাচ্চা-কাল থেকেই ওর গানের বিশাল ফেন। এসেম্বলিতে যখন ও জাতীয় সংগীত ধরতো আমার বন্ধু গাইছে এই গর্বে আমার বুক দুহাত ফুলে যাইতো। সেই ছোটবেলায় ওর মুখে অঞ্জলি লহ মোর, খেলিছো এই বিশ্ব লয়ে এই গানগুলি শুনে শুনে আমি নজরুল সংগীতের প্রেমে পড়ে গেছিলাম। ও খুব ভালো কুরান তেলাওয়াত ও করতো। একবারতো আমার সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কুরান তেলাওয়াতে ও কমপিট করে ফেললো।ও যে বড় হয়ে ভালো গায়িকা হবে সে আমি তখনি বুঝেছিলাম।
এই স্কুলের আপারা খুব ভালো ছিলো। আমি যে এত বান্দর ছিলাম তা জানা সত্তে ও আমার জন্য তাদের আদরের কমতি ছিলোনা। একবার আমার ক্লাস-টিচার বাবাকে উনার সাথে দেখা করতে বললেন। ভয়ে ভয়ে বাবাকে বললাম এই কথা আর ভাবতে লাগলাম এই কয়দিনে কি কি অ-কাম করছি।ক্লাসের সহপাঠিরাতো সবসময়ে আমার যন্ত্রণায় অস্থির, কিন্তু ওদের মধ্যে কে আমার নামে নালিশ করতে পারে আকাশপাতাল ভেবেও সেই হদিস পেলামনা। যাই হোক পরদিন বাবা দেখা করে গেলেন। ক্লাস-টিচার আমার জন্য এক্সটা কেয়ার নেয়ার জন্য বলে দিলেন, আমি নাকি বেশ পটেনশিয়াল ছাত্রী। বাবা যখন চলে যাচ্ছিলেন, আমি দোতালার জানালা দিয়ে ওনাকে বাইবাই বলছিলাম, তখন ছিলো টিফিনের পরের পিরিয়ড। সমাজে আপা রুমে ঢুকে আমাকে আবিষ্কার করলেন জানালা দিয়ে বাবার সাথে কথা বলা অবস্থায়। উনি বললেন এই তুই কি করিস জানলায় দাঁড়িয়ে। বললাম বাবা চলে যাচ্ছে, উনাকে বিদায় দিচ্ছি। উনি বলে উঠলেন ওরে তুই কি শ্বশুড়বাড়িতে আসছিস যে তোর বাবাকে বিদায় দেস, ফাজিল মেয়ে জানালা থেকে সরে আয়, ক্লাসে মন দে, কখন শেষ হয়ে গেছে টিফিন পিরিয়ড সেই খবর আছে। পুরা ক্লাস উনার কথায় হেসে উঠলো। আমি মন খারাপ করে এসে ক্লাসে বসলাম।পুরা স্কুলজীবনে উনার ক্লাস অনেকবার পেয়েছি পরে।উনাকে আমরা কিটকিট আপা বলতাম, আসল নামটা এতদিন পরে মনে পড়ছেনা। একবারতো সমাজ পরীক্ষার খাতায় বলা নাই কওয়া নাই ৪ মার্কস বেশী দেয়ে দিলেন।আমি গিয়ে উনাকে বললাম সেকথা। প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলেন না যে উনি বেশি মার্কস দিছেন, আর আমি মার্কস কমাতে চাইছি। পরে যখন দেখলেন আসলেই বেশি মার্কস দিয়েছেন, অনেক আদর করে দিলেন, আরও বললেন আমাকে একটা পুরষ্কার দেয়া হবে তার নাম সততার পুরষ্কার। পরে যখনই উনার সাথে দেখা হয়সে উনি জড়িয়ে ধরে রাস্তায় আদর করেছেন, খোঁজখবর নিসেন। স্কুল জীবন শেষে আমার মনে হয়সে উনি আমার খুবি প্রিয় একজন টিচার ছিলেন। আমার প্রিয় শিক্ষকের তালিকায় যদি ও আরও অনেকেই আছেন কেন জানি উনাকে খুব মনে পড়ে।

বন্দনা


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

মজা পেলাম।

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ কৌস্তুভদা।

অপছন্দনীয় এর ছবি

চিন্তিত

বন্দনা- এর ছবি

এত কি চিন্তা করছেন।:)

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

বাহ চলুক

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ অনার্য সঙ্গীত।

হাসিন এর ছবি

খুব ভালো

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ হাসিন।

আয়নামতি1 এর ছবি

বন্দনার বান্দর বেলা পড়ে মজা পেলাম হাসি

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ আয়নামতি। মজা পেয়েছেন জেনে ভালো লাগলো।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

স্কুলের স্মৃতিগুলো খুব মজাদার হয়। ভালো লেগেছে স্মৃতিচারণ। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ ভাইয়া। লইজ্জা লাগে

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

বন্দনার বন্দনা করছি... হাসি

বন্দনা- এর ছবি

মন্তব্য পড়ে খুব ভালো লাগছে, আবার একটু লজ্জা ও লাগছে লইজ্জা লাগে ।ধন্যবাদ ভাইয়া।

রাত জাগা তারা এর ছবি

পড়ে খুব ভালো লেগেছে চলুক

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

guest_writer এর ছবি

চলুক
nawarid nur saba

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ সাবা। হাসি

মৌনকুহর. এর ছবি

শৈশবের স্মৃতি আর বন্ধুদের নিয়ে লেখা সবসময়-ই চমৎকার, এই লেখাটাও দারুণ হাততালি

তবে দু'এক জায়গায় 'নিসেন', 'হয়সে' ধরণের শব্দ ব্যবহার না করলেই বোধ হয় বেশি ভালো হত।

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ মৌনকুহর হাসি ।এত অভ্যাস হয়ে গেছে এইসব শব্দগুলা ব্যবহার করতে করতে, লিখাতে ও চলে আসছে, চেষ্টা করবো এই জিনিসগুলো পরিহার করে চলতে।

বন্দনা কবীর এর ছবি

অনেক আগে আমি বন্দনা হিসেবে সচলে রেজিঃ করেছিলাম কিন্তু কোনো পোস্ট দেয়া হয়নি। শুধুই পাঠক। কমেন্টও করা হয়নি কমেন্ট করার ঝামেলা থাকার কারনে। পরে তো পাসওয়ার্ডই ভুলে গেছি।
আজকে হটাত বান্দরবালা পড়ে নীচে বন্দনা নামটা পড়ে চমকে উঠলাম, আরে! আমি আবার কবে এটা লিখলাম?!!

নতুন এক বন্দনাকে দেখে অনেক ভাল লাগল। আমার নতুন মিতাকে অভিনন্দন ।

বন্দনা কবীর

বন্দনা- এর ছবি

ইস আমি আপনার নিক নিয়ে নিলাম ঠিক হোলনা একদম মন খারাপ ।আপনাকে দেখে আমার ও ভালো লাগছে। অনেক অনেক ভালো থাকুন।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

কথায় বলে যে বান্দর বুড়া হইলেও গাছে ঝোলো। তাই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে যে আপনার এখন কি অবস্থা! চলুক

লেখাটা ভালো লেগেছে। চলুক।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

বন্দনা- এর ছবি

ধন্যবাদ ভাইয়া। বুড়া হইছি, আর কত বান্দারামি করবো বলেন ।এখন খেমা দিছি।আপনাদের দোয়ায় বান্দর এখন মানুষ হয়ে গেছে হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হুম...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বন্দনা- এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।