কুরবানীর হজ্ব

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১১/০৫/২০১২ - ৯:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নসরউদ্দিন চেয়ারম্যান ঠিক করেছেন এবার হজ্বে যাবেন। আল্লাহ তাকে দুই হাত ভরিয়ে দিয়েছেন। অঢেল টাকা-পয়সা, জমি-জিরাত, বহতুল দালান বাড়ি, ঝকঝকে গাড়ি, শানবাঁধানো পুকুর। তার এই যে শান-শওকত- সে নাকি পুকুর চুরির ফল। অন্তত কস্তুরী বেগম এ কথাটা তার মুখের ওপর প্রায়ই বলেন। অবশ্য আড়ালে আবডালে পাবলিকেও বলে। তবে সামনে বলার সাহস একমাত্র কস্তুরী বেগম ছাড়া কারো নেই।
'লোকে যদি আমাকে চোরই ভাববে তবে বার বার ভোট দেয় কেন?' নসরুদ্দিন এ কথাই বলে বোঝায় বউকে।
'সেই ভোটও তো চুরি করা!' পাল্টা যুক্তি দেখায় কস্তুরী বেগম।
'আহা! চুরি বলছ কেন? আমার দুটো পয়সা না হয় আছে। সারা বছর সময় করে দান-ধ্যান করতে পারি নে। ভোটের সময় তো আর চেয়ারম্যানাগিরির ঝামেলা থাকে না, তখন যদি গরীবদের মাঝে কিছু টাকা পয়সা বিলিয়ে দিই তাতে ক্ষতি কী?'
কস্তুরী বেগম বোঝেন পাপের কালিমায় কালো হওয়া এই হৃদয়টাকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করা অসম্ভব। তাই ইদানিং স্বামীর চেয়ারম্যানগিরি, পুকুর চুরি, গমচুরি... ইত্যাদি নিয়ে কোনো কথা তোলেন না।
সামনে আবার নির্বাচন যথারীতি ঢাকঢোল পিটিয়ে পঞ্চম বারের মতো চেয়ারম্যান পদে লড়ার জন্য মাঠে নেমে গেছেন নসরউদ্দিন। তবে এবার ময়দানটা বেশ গরম। প্রতিপক্ষের সাথে পেরে ওঠা মুশকিল বলে মনে করে তার ডান হাত বিষু।
'ওরে থাম থাম, ওস্তাদের মার শেষ রাত্রি। জয় ঠিক আমার হবে। বিশ লাখ ছড়িয়েছি। দরকার হলে এককোটি ছাড়াতেও আপত্তি নেই। তোরা শুধু আগের মতো কাজ করে যা।'
বিষুরা কাজ করে। কাজ করে প্রতিদ্বন্দ্বীর লোকেরাও। নির্বাচনী বাতাসে পেঁজা তুলোর মতো উড়ছে কালো টাকা। দশ, বিশ লাখ করে আশি লাখ শেষ হয়ে যায় নসরউদ্দিনের। বাকি বিশ লাখও ফুরিয়ে কোটির অংকে পৌঁছতে নির্বাচনী ব্যয় সময় লাগবে না হয়ত ।
'শালার শুকুনের পালের ক্ষিদে মেটে না রে বিশু... মনে হয় কোটিতেও কুলাবে না। আরও পঁঞ্চাশ এর ব্যবস্থা রাখিস। জয় আমার চাই চাই।'
কোটির পরে পঞ্চাশ তো দূরে থাক কোটির অংক পুরাতে বাকি বিশ লাখ টাকাতেও হাত হাত পড়ল না। নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে হঠাৎ ধড়ফড় করে মরে গেলেন কস্তুরী বেগম। হার্ট অ্যাটাক- দশ মিনিটও সময় দেননি। শোকে পাথর হয়ে গেলেন নসরউদ্দিন। চল্লিশ বছরের সুখ দুঃখের বন্ধন এক মুহূর্তের ঝড়ে ছিন্ন হয়ে গেল। বিধাতার এ কী বিচার! টাকার কি তার অভাব ছিল? একটা ঘন্টা সময় দিলে প্রয়োজনে বিমানে করে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারতেন। আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারতেন।
লোকের কানাঘুষা কানে আসে নসরুদ্দিনের- এ নাকি তার সারাজীবনের পাপের ফল। 'আহাঃ কী ভালোই না ছিল বউটা। বজ্জাৎ লোকটার কুকর্ম থেকে দূরে সরাতেই খোদা তাকে তুলে নিয়েছেন।'
লোকের তীর্যক বাণে রাগ করেন না নসরউদ্দিন। বরং ভাবেন, তন্ময় হয়ে ভাবেন- লোকের কথা তো মিথ্যে নয়। তারই পাপের আগুনে পুড়ল কস্তুরী বেগম।
'তওবা করলাম এজীবনে আর পাপ নয়, দুর্নীতি নয়।' কঠোর প্রতিজ্ঞা করে বসেন নসু চেয়ারম্যান। বউকে মাটির গর্তে লুকিয়ে রেখে এসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ধরেন। শার্ট-প্যান্ট বাদ দিয়ে লম্বা আলখাল্লা পরে আর মাথায় পীরদের মতো একবোঝা কপড়ের তৈরি পাগড়ি চাপিয়ে ধোপদস্তুর মুসুল্লি বনে যান।
নির্বচনের ঠিক আগের দিন বোমা ফাটান নসুরুদ্দিন, 'আমি আর চেয়ারস্যান হতে চাই নে। আমার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলাম।
'পাগল হলেন নাকি, চাচাজান?' বিষু তাকে বোঝানোরা চেষ্টা করে।
'পাগল নয় রে, দিন দুনিয়া কিছুই না, বুঝলি। মরণটাই সত্য। পারলে তুইও সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে আল্লাহর পথে আয়।'
একমাসের মধ্যে পোশাকের সাথে নসু চেয়ারম্যানের চেহারাও আমূলে বদলে যায়। কলপের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে এতদিনে তার পাতলা চুলগুলো প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে আসল রূপ। ঘন দাড়িতে ভরে ওঠা চোয়াল-চিবুক এখন মেহেদির রঙে রঙিন। বদলে যায় তার ভেতরের মনুষটাও। আযান শুনলে মসজিদে যাবার জন্য বুকের ভেতর আকুলি বিকুলি করে। জুম্মার দিনে মোনাজাতের সময় ইমামের সাথে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনিও। কে জানে, হয়তো কস্তুরী বেগমের জন্য এ কান্না। মরা বাপ-মায়ের জন্য নয়- তাও তো নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবার পরকালে কঠোর শাস্তির কথা ভেবেও হতে পারে।

হজ্বে যাওয়ার সব ঠিকঠাক। মেয়েরা, আত্মীয় স্বজনেরা- যে যেখানে আছে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেষ বিদায় নিয়ে এসেছেন। ছোট মেয়ে রানু বাবাকে বলে, 'শেষ বিদায় বলছ কেন বাবা? মা মরে যাবার পর তুমি একদম অন্যরকম হয়ে গেছ- সত্যি করে বলো তো তোমার মনে কী আছে?'
'মা রে হায়াৎ-মউতের কথা কিছু বলা যায়? প্রতি বছর কত লোকই তো হাজিদের পায়ের তলায় চাপা পড়ে মরছে। যদি সে রকম কিছু হয়-তো আলহামদুলিল্লাহ- সারাজীবনের পাপ কিছু লাঘব হবে। তোদের সবার প্রতি আমার অনুরোধ, পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়িস আর নাই পড়িস কাউকে এতটুকু কষ্ট দিস নে। কারও এতটুকু ক্ষতি করিস নে।'
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন নসু চেয়ারম্যান। মায়ের কথা মনে পড়ে যায় রানুরও। বাবার বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, 'তোমার কথা আমি রাখব বাবা, তুমিও আমার কথা রেখো...'
মাথা নিচু করে অবাক হয়ে মেয়ের চোখে চোখ রাখেন নসরউদ্দিন।
'হ্যা বাবা, শুধু একটা কথা রাখো- হজ্ব করে আবার ফিরে এসো আমাদের মাঝে।'
'এ কী কথা রে মা! তিনি চাইলে ফিরব। না চাইলে দশজন বডিগার্ড সঙ্গে গেলেও আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।' মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেন, 'আর মায়ার বাঁধনে জড়াস নে মা। আমি যাই...'
একটানে রানুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন নসরউদ্দিন। পেছনে তাকিয়ে ওর করুণ মুখটা আরেকবার দেখার সাহস তার নেই।

হজ্ব এজেন্সির ওয়েটিং রুমে বসে আছেন নসু চেয়্যারম্যান। রাত সাড়ে দশটায় ফ্লাইট। হবু হাজীরা ব্যস্ত দোয়া-কালাম পড়তে। ওয়েটিংরুমের এককোণায় দৈত্যাকার একটা টিভি চলছে। নসরউদ্দিন সেদিকে তাকাচ্ছেন না। টিভি দেখা মহাপাপ! কৈশোরে সিনেমা দেখার জন্য কতবার স্কুল ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন যশোর মণিহারে। সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে কোলকাতা পর্যন্তও গেছেন কতবার, এমনকী মাস পাঁচেক আগেও স্যাঙ্গাতদের নিয়ে রোজ টিভির সামনে মজমা বসাতে না পারলে রাতের ঘুমটাও নাকি বৃথা যেত! সেই টিভি এখন তাঁর শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। মাথা নিচু করে, টিভির শব্দ যাতে কানে ঢুকতে না পারে- সেই রকম মনযোগ দিয়ে তিনি কলেমা পড়ছেন। তালে তালে ডানহাতের তিন আঙ্গুলও চক্রাকারে ঘুরছে তসবিহর সারা গায়ে। হঠাৎ সেই টিভির শব্দেই চমকে ওঠেন তিনি।
'সৌদি আরবে তিন বাংলাদেশি শ্রমিকের প্রকাশ্যে শিরোচ্ছেদ!!!'
পাপের ভয় বেমামুলম ভুলে চোখ চলে যায় টিভির পর্দায়। কী বিভৎস দৃশ্য! শরীয়াহ আইনের নামে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের নগ্ন প্রকাশ!
সৌদি-বাংলা ভিসা এজেন্সিদের জালীয়াতির কথা তার অজানা নয়। তাঁর ইউনিয়নের গোটা বিশজন শ্রমিক সহায় সম্বল হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। জেলে পচছে আরো জনাদশেক। প্রতিশ্রুত কাজ না পেয়ে পথে পথে ঘুরছে কতজন তার সঠিক সংখ্যা জানা নেই নসরউদ্দিনের। প্রতারিত প্রবাসী শ্রমিকরা তাই খুব সহজেই অপরাধ চক্রে জড়িয়ে পড়ে। তারা যদি কাউকে খুন করেও ফেলে সে দায় কি শুধুই শ্রমিকদের; সৌদি সরকারের ব্যর্থতাও কি নয়? মাথায় রক্ত চড়ে যায় নসু চেয়ারম্যানের। কিন্তু কী করবে, কী করলে তার মনের জ্বালা মিটবে? তাঁর নিঃস্বাস ওঠে চরমে। চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে, রাগে ফুলতে শুরু করে। এক হজ্বযাত্রীর সমবেদনা শোনা যায়, 'ভাইজান কি অসুস্থ?'
'নাহ্!' কুড়ি বছরের চ্যোয়ারম্যানি মেজাজটা ফিরে পেতে শুরু করেন নসরউদ্দিন। 'যে কসাইরা আরবের পবিত্রভুমির রাজা হয়ে বসে আছে, তাদের অধীনে আমি হজ্ব করব না। এই আমি চললাম বাড়িতে। আমার লাগেজ কোথায়?'
হৈ হৈ করে ওঠেন হবু হাজিরা। 'ভাইজান বলেন কী, বলেন কী, গুনা হইব তো...আসতাগফিরুল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ! তওবা পড়েন...'
'যে বর্বর দৃশ্য আপনারা এতক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন তার জন্য তওবা পড়েছেন?' নসু চেয়ারম্যান মুখটা বাঁকা করে নব্য হাজিদের উদ্দেশ্যে তীর্যক প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে মারেন।
মুহূর্তে ওয়েটিংরুমে নেমে আসে সুনাসন নীরবতা। গমগম করে ওঠে নসরউদ্দিনের চেয়ারম্যানসুলভ কণ্ঠস্বর- আরবের মাটিতে উট কুরবাণী দিতে চেয়েছিলাম, তার বদলে দেশের মাটিতে ঈদের আগেই কুরবাণী দিলাম আমার আলহাজ্ব উপাধি।

.............................
আব্দুল গাফফার রনি


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

গল্পটা ভালো লাগলো ! তবে বাস্তবে কি আর এমন হয় ?

চালিয়ে যান গল্প লেখা ।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
বাস্তব নয় ঠিকই, তবে নিছক গল্প নয়; জলুমের বিরুদ্ধে আমার কলমের প্রিতিবাদ।

এবিএম এর ছবি

গল্প। অন্য কিছু না।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

অন্যকিছিও। কলমীয় প্রতিবাদ। গল্পের ঢঙে। গুল্লি

অচল  এর ছবি

আপনার গল্প আর প্রতিবাদের ধরন দুইটাই ভাল লাগছে (গুড়) । তবে এইখানে আর একটা দৃষ্টিকোণের সুযোগ আছে। ধর্ম ব্যাপারটা যারা মানেন, তাদের আল্লাহ্‌র সাথে দিদার করার ইচ্ছাটাকে রাস্টীয় বিবাদ আর দেশের
কর্তা- ব্যক্তিদের করা ভুলের সাথে একই ফ্রেমে দেখা উচিত কি না সেটা নিয়ে ভাবার কিন্তু বেশ অবকাশ আছে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

কিছু কিছু প্রতিবাদে টনক নড়ে সবচেয়ে বেশি। এদেশের প্রায় সব মানুষ ধর্মকে মানুক আর না মানুক বিশ্বাসটুকু অন্তত করেন, তাই এভাবে কেউ প্রিতিবাদ করেলেই হয়ত বেশি সাড়া পড়ত। আবার উলটো ফল হওয়ার সম্ভবনাও ছিল।

অমি_বন্যা এর ছবি

ভালো লাগলো।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

গল্পের মধ্যে সুন্দরভাবে আপনি আপনার ভাবনা এবং প্রতিবাদটা প্রকাশ করেছেন।
ভাল লাগল।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভাল্লাগলো।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।