বটতলার বিভীষিকা

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৪/০৫/২০১২ - ৯:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভট্টাচার্যদের বটগাছে আবার সাধুবাবার আছর হয়েছে- সঙ্গে আছে কয়েকশ’ ভুত-প্রেত। ভুত-প্রেত কারো ঘাড় মটকায়নি। তবে মটকাতে কতক্ষণ! গাঁয়ের লোক তাই ভয়ে-আতঙ্কে তটস্থ। তাছাড়া ভয় পাওয়াটা আবহমান গ্রাম-বাংলার জীবনযাত্রারই অবিচ্ছেদ্য অংশ; মরণনেশা। আর এই নেশা নিয়েই নদীর ঘাটে চলে বিস্তর পর্যালোচনা।
ইছামতীর কিনার থেকে ঝোপ-জঙ্গলের বুকচিরে বোয়ালমারির মাঠে ঢুকে গেছে যে খালটা, তার শেষ মাথায় ভাঙ্গাচোরা একটা জমিদার বাড়ির পাশেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী প্রকাণ্ড একটা বটগাছ। প্রায়ই রাতে ভুতের শিশুর রক্ত হিম করা কান্না ভেসে আসে সেই গাছ থেকে। মানব শিশুর মতো। তবে তীব্রতায় হাজার গুণ- কয়েক মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। তা নিয়ে চলে বিস্তর গবেষণা। নানাজনে আবিষ্কৃত হয় নানা কিংবদন্তি। যারটা যত ভয়য়ংকর তারটা টিকে থাকে জোরালোভাবে। বাকিগুলো স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভয়ের এই রসনায় ইদানিং যুক্ত হয়েছে আরেকটা মশলা। গ্রামবাসীরা তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করে সে রসনার শেষ চুমুক। রাত একটা কি দেড়টার পরে বটগাছ থেকে ভেসে আসে তুমুল হুটোপুটির শব্দ। বটগাছে বানর কি হুনুমান বাস করে- তাও নয়। গভীর রাতে বটতলায় গিয়ে আসলেই
ভুত-প্রেত কিনা খোঁজ নিয়ে আসে এমন দুঃসাহস কার আছে? বরং ভুত-প্রেতের তত্ত্বটা মেনে নিয়ে বদ্ধ ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, কিংবা আখড়া জমিয়ে ভয়ের কলকেয় সুখটান দেয়। সত্যি বলতে কি, মদ-গাঁজা খোরদের নেশা হয়তো চেষ্টা করলে ছুটানো যায়; ভয়খোরদের নেশা ছোটানো বোধহয় ফারাওরাজদের পিরামিডের রহস্য উদঘাটনের চেয়েও শক্ত কাজ।
ভট্টাচার্যদের বটতলার কিংবদন্তিটা লবণযোগে জালি তেঁতুলের মতোই মুখরোচক, নরবলির মতোই ভয়ঙ্কর। ১১০ কি ১২০ বছর হবে হয়তো, তার্করত্ন ভট্টাচার্য এক ছোট্ট বটগাছ লাগিয়ে ভট্টাচার্যদের বটতলার গোড়াপত্তন করেন, সেই সাথে নিজের অজান্তেই রোপন করেন এই গ্রামের ভয় নামের মরণ নেশার বীজ। এরপর ষাট বছর আর দুই প্রজন্মের ব্যবধানে সেই বট শিশুটি ডালপালা মেলে ঝুরি ছড়িয়ে ঊষারত্নের পাক্কা সাত বিঘে জমি গ্রাস করে নিজেকে বিকশিত করে প্রকাণ্ড এক মহিরুহ রূপে। এরপরই শুরু সেই কিংবদন্তির। বটতলায় কোথা থেকে এসে জোটে এক সাধুবাবা। কুঁড়ে বানিয়ে স্থায়ী আস্তানা গড়ে বটতলায়। মদ-গাঁজার আসর বসে সন্ধ্যার পরে। গাঁয়ের দু-চারজন বখে যাওয়া যুবক যোগ দেয় সেই আড্ডায়। ঊষারত্নের ছেলে জয়রত্নও নাকি পায়ের ধুলো দেয় মাঝে মাঝে। এক কান, দু’কান হয়ে কথাটা ঊষারত্নের কানে পৌঁছাতে সময় লাগে না। ভট্টাচার্য মশায় তো শুনে ক্ষেপে আগুন। ছেলেকে ত্যাজ্যপূত্র করণের হুমকি দিয়ে এক সন্ধ্যায় সাধুবাবার আস্তানায় গিয়ে সাফ বলে এলেন, ‘বাবাজি, আপনি এবার পথ মাপুন। এখানে থাকবার আর সুবিধা হবে না। অবশ্যি এক সপ্তাহ সময় আপনি পাবেন। আশাকরি এর মধ্যে আরেকটা ঠিকানা খুঁজে নিতে আপনার কষ্ট হবে না।’
সাধুবাবা মুখে কিছু বললেন না, শুধু মুচকি একটু হাসলেন। পরদিন জয়রত্নকে ডেকে বললেন, ‘জয়রত্ন, ভট্টাচার্যি মশায় কাজটা কিন্তু ঠিক করলেন না। আমি তার কথায় খুবই কষ্ট পেয়েছি। তবু তিনি যখন বলেছেন আদেশ আমাকে মানতেই হবে। কিছুদিনের মধ্যেই আমি এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’
সাধুবাবার এই মন্তব্য নেকাব খুলে তার ভেতরের কদর্যরূপটাই প্রকাশ করে দেয়। জয়রন্তের সন্দেহ হয়- লোকটা তার বাবার বড় কোনো ক্ষতি করবে কিনা।
এই নিয়ে জয়রত্নের সাথে তার পিতার বচসা হয়। বচসা উঠে যায় চরম পর্যায়ে। অবাধ্য ছেলেকে বশ মানাতে ব্যর্থ ঊষারত্ন একদিন আগুন লাগিয়ে ভষ্মিভূত করে দেন সাধুবাবার আস্তানা। কিন্তু কুড়েঘর পুড়লেও সাধুবাবা বটতলা ছাড়েন না।
এরপরই কেউটের মতো ফনা তুলে, হায়েনার কুটিলতা, ক্ষুধার্ত নেকড়ের হিংস্রতা আর সিংহের হুঙ্কারে তেড়ে আসে কিংবদন্তির সেই বিভীষিকা। একে একে উধাও হয় গাঁয়ের গৃহস্থের হালের বলদ আর দুধেল গাভীগুলো। দিনে, রাতে- সব সময়। শুধু গাভী-বলদে সীমাবদ্ধ থাকে না ছাগল ভেড়া কুকুর বিড়াল- সব। এরপর একদিন হারিয়ে যায় জয়রত্নের ৮ বছর বয়সী ছেলে মানিকরত্ন। ঊষারত্ন তন্ন তন্ন করে চষে ফেললেন গোটা এলাকা। কিন্তু ফল শূন্য।
তৃতীয় দিনে বৃদ্ধ গণেশ ঠাকুরের লাশ সৎকার করতে গিয়ে শশ্মান ঘাটে সন্ধান মেলে মানিকরত্নের; তিনদিনের পচা-গলা লাশ। সারা গায়ে হিংস্র জানোয়ারের আঁচড়ের চিহ্ন, বামপাশের চোয়াল থেকে এক খাবলা মাংস তুলে খাওয়া। শুধু মানিকরত্নের লাশ নয়, এই ক’দিনের হারিয়ে যাওয়া সব পশুদের আধা খাওয়া ক্ষত বিক্ষত দেহগুলোও পড়ে আছে সেখানে। শেয়াল কিংবা শকুনেও শুকে দেখেনি সেগুলো।
শশ্মানঘাটটা গ্রামের একেবারে একপাশে। মনুষজন না মরলে ওই পথের ছায়া মাড়ায় না কেউ। তাই এতোদিন মড়াগুলোর সন্ধান পায়নি গ্রামবাসীরা। গ্রামে বাঘ কিংবা অন্য হিংস্র প্রাণীর বাস নেই নেই; অথচ নিশ্চিত এই বিভীষিকার পেছনে দায়ি কোনো হিংস্র প্রাণী। কিন্তু কী সেই প্রাণীটা? গ্রামবাসীদের সন্দেহ হয়, এর পেছনে সাধুবাবার হাত আছে। ঊষারত্ন তার সাথে টক্কর দিয়ে কাজটা মোটেও ঠিক করেনি। এখন সাধুবাবার অভিশাপ নেমে এসেছে গোটা গ্রামের ওপর।
দুদিন পরেই আবিষ্কার হয় আততায়ী হিংস্র প্রাণীদেরও যম- গ্রামের গরু ছাগল কুকুর বিড়াল মানুষ বাদ দিয়ে বাঘ হায়েনা সিংহ মেরে খাওয়া শুরু করেছে। প্রতিদিন কোনো কোনো হিংস্র প্রাণীর ক্ষত-বিক্ষত দেহ পড়ে থাকে বটতলায়- গভীর রাতে হিংস্র প্রাণীদের তীক্ষè চিৎকার ভেসে আসে সেখান থেকে। সাধুবাবাই যে নাটের গুরু- এ বিষয়ে যাদের একটু আধটু সন্দেহ ছিল- এতোদিনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে সেটুকুও। তাই বাঘের রাজ্য বাংলায় আফ্রিকান সিংহের মৃতদেহ দেখে কেউ অবাক হয়নি। তবে ভয়ে আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে গেছে।
পূত্রশোকে জয়রত্ন ভয় আতঙ্ক সব ভুলে গেছে। যে সাধুবাবার জন্য একদিন বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেনি আজ নিজে পূত্রশোকে কাতর বাবাতে পরিণত হয়ে নিজেই ব্যাপৃত হয়েছে সাধুবাবার ধ্বংসসাধনে। সাধুবাবার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় সে, কিন্তু মামলার মোটিভ জোরালো নয়। তবুও ওয়ারেন্ট হয় সাধুবাবার নামে।
দিনের বেলা সাধুবাবাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তাই রাতের বেলায় আসে পুলিশ। জয়রত্ন জানে দিনের বেলা যেখানেই থাকুক রাতের বেলা সাধুবাবা বটতলায় আসবেই।
ভরা পূর্ণিমার রাত। পুলিশকে পথ দেখিয়ে বটতলায় নিয়ে যায় জয়রত্ন। পুলিশ সাধুবাবাকে গ্রেফতার করবে কী; যে দৃশ্য দেখে তাতে তারা প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে এটাই আগের জনমের ভালো কাজের পুরস্কার।
বটতলার দাঁড়িয়ে শারদীয় জোসনার আবছা আলোয় তারা দেখতে পায়, খালের ধারে কী যেন নড়াচড়া করছে। জয়রত্ন ফিসফিস করে বলে, ‘সাধুবাবা।’
ওরা শিকারির মতো সাবধানে এগিয়ে যায়। তারপর খুব কাছাকাছি একটা ঝোপের আড়ালে অবস্থান নেয়। স্পষ্ট দেখতে পায় সাধুবাবা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে খালের কিনারে, এক হাতে দড়িতে বাঁধা বাঘের মতো একটা প্রাণী। মুহূর্তকাল পরে সাধুবাবা হড়হড় করে বমি করে বেশ সময় নিয়ে। তারপর সেই ভয়ংকর দৃশ্য- সাধুবাবাবা বমি করতে করতে তার পেটের সব নাড়িভুড়ি উগরে বের করে ফেলে! খালের পানিতে উল্টে পাল্টে ধোয় সেই নাড়িভুড়ি। তারপর আবার গিলে ফেলে সেগুলো।
এরপর হঠাৎ দড়িতে বাধা প্রাণীটার গলা চেপে ধরে সাধুবাবা। বিরাট একটা গর্জন ছাড়ে প্রাণীটা- বাঘের গর্জন! সাধুবাবার দাঁত কামড়ে ধরে প্রাণীটার বামদিকের চোয়াল। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি আবার গর্জন, একসময় গর্জন পরিণত হয় আর্তনাদে; অবশেষে নিস্তবদ্ধতা!
'এই সুযোগ, চলুন স্যা,‌' বলে জয়রত্ন এগোতে থাকে।
কয়েক পা এগোতেই বুঝতে পারে সে একাই এগোচ্ছে। পেছনে তাকিয়ে দেখে পুলিশদের একজন মূর্ছা গেছে, আরেকজন বেঁচেছে পালিয়ে।
এই বিভীষিকা দেখেও ভড়কে যায়নি জয়রত্ন, পূত্রহত্যার প্রতিশোধে সে অটল। পরের দিন কোলকাতায় যায় চোরা কারবারীদের কাছ থেকে বন্দুক কিনতে। কিন্তু পুত্রহত্যার প্রতিঘাত সে হানতে পারে না- গ্রামে ফিরে এসে শোনে বটতলায় সাধুবাবার লাশ শেয়াল শকুনে টানাটানি করছে!
----------------------
আব্দুল গাফফার রনি


মন্তব্য

জুঁই মনি দাশ এর ছবি

ঠিক ভয় বা আতংক নয় কেমন যেন বিভৎস........

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

বিভৎসতাই হরর গল্পের অন্যতম উপাদান বলে জানি। আমার জানায় ভুলও থাকতে পারে...

মরুদ্যান এর ছবি

কিছুই বুঝলাম না।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

না বোঝাটাই সাভাবিক। আবার না বঝার কিছুই নেই।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

বিভৎসতাই হরর উপদান। বুঝতে না পারাটা রহস্য...

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

সবই তো ঠিক আছে,
কিন্তু আফ্রিকান সিংহের ব্যাপারটার একটু ব্যাখ্যা থাকলে মনের আশ মিটত।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।