ঈস্টার দ্বীপ ০২

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বুধ, ০২/০১/২০০৮ - ১২:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঈস্টার দ্বীপে আদপেই কত লোক ছিলো?

এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বেশ জরুরি, যদি ঈস্টারের অলিপিবদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে কোন কিছু আঁচ করতে হয়। যে পদ্ধতিটি অনুসৃত হয়েছে তা হচ্ছে ঈস্টারে খুঁজে পাওয়া বাড়িগুলির পাথরের ভিত গুণে তা থেকে অনুমান করা। এ অনুমানে স্বতসিদ্ধ হিসেবে ধরা হয়েছে প্রতি বাড়িতে ৫ থেকে ১৫ জন বাসিন্দা, আর মোট বাড়ির তিন ভাগের এক ভাগ একই সময়ে মানুষের অবস্থান। এ পদ্ধতিতে দেখা গেছে, ঈস্টারের জনসংখ্যা ছিলো ৬ হাজার থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে, যা কিনা বর্গমাইল পিছু ৯০ থেকে ৪৫০ জন মানুষের বসবাসের প্রতি ইঙ্গিত করে (বাংলাদেশে বর্গমাইল পিছু বাস করে প্রায় দু'হাজার ছ'শো জন মানুষ)। ঈস্টারের কিছু কিছু জায়গা অতটা ঊর্বর ছিলো না, কাজেই জনসংখ্যার ঘনত্বের বিন্যাস স্বাভাবিকভাবেই হয়তো আরেকটু বেশি ছিলো অন্যান্য জায়গায়, তবে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দ্বীপের বিরাট অংশই চাষাবাদের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিলো।

ঈস্টারের প্রথম শুমারি (২,০০০ অধিবাসী) হয়েছিলো ১৮৬৪ সালে, যখন খ্রিষ্টান মিশনারিরা প্রথম সেখানে বসতি গাড়েন। এর আগের বছরই ঈস্টারে মারাত্মক এক গুটি বসন্তের মড়কে দ্বীপের অধিকাংশ বাসিন্দাই মারা গিয়েছিলো। তারও আগে পেরুর এক ঠগী জাহাজ ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রির জন্য ধরে নিয়ে গিয়েছিলো দেড় হাজার আদিবাসীকে, তারও আগে ১৮৩৬ সালে দুই দফা গুটিবসন্তের মড়ক দেখা দিয়েছিলো, আর সপ্তদশ শতাব্দীতে ঈস্টারের ইতিহাসে শুরু হয় ব্যাপক জনসংখ্যাধ্বস। এত কিছুর পরও যদি ১৮৬৪ সালে ২ হাজার মানুষ দ্বীপে থাকে, তাহলে ইতিহাসে এর সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ১৫ হাজার বা তারচেয়ে বেশি হওয়া স্বাভাবিক। অন্তত প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লাউদিও ক্রিস্তিনো আর এডমুন্ডো এডওয়ার্ডস এমনই মনে করেন।

এত মানুষের দ্বীপে সংস্থান করতে গেলে এর কৃষি কার্যক্রম যে অনেক তীব্র হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এর প্রমাণ মেলে বিভিন্ন জায়গায় ঝর্ণার ওপর পাথরের তৈরি বাঁধ আর সেচের খাত দেখে। আর একটি হচ্ছে মুরগির বিশাল ঘরগুলি, যেগুলো পাথরের তৈরি, ২০ ফিট লম্বা, ৬ ফিট উঁচু আর ১০ ফিট চওড়া (এর চেয়ে বড়ও কিছু রয়েছে)। এর সাথে রয়েছে পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা উঠোন। মানুষের ঘর ভেঙেচুরে পড়ে গেছে, কিন্তু ঈস্টারের এই দানবীয় মুরগির ঘরগুলি রয়ে গেছে, যার সংখ্যা ১,২৩৩।

এ ছাড়াও আছে আগ্নেয় পাথরে তৈরি বিভিন্ন দেয়াল, যেগুলি ব্যবহার করা হতো ঈস্টারের তীব্র বাতাস থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য। এ ছাড়া মাটি খুঁড়েও কিছু কিছু "গর্তবাগান" তৈরি করা হয়েছে কলা চাষের জন্য। এ ছাড়াও রয়েছে একেবারেই অভিনব কিছু উদাহরণ, যেমন জমিতে পাথর বিছিয়ে বা পুঁতে বাতাসের হাত থেকে শস্যকে রক্ষার চেষ্টা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পলিনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের চাষাবাদের সাথে তুলনা করে ঈস্টারের এই বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কারণ এর জন্যে লক্ষ লক্ষ পাথর বয়ে আনা বা খোঁড়া হয়েছে।

কেন ঈস্টারের চাষীরা এই তুমুল খাটনি খাটতে গেলো?

ঈস্টার শুষ্ক, ঠান্ডা, আর তীব্র বাতাসের অঞ্চল। পৃথিবীর অন্যান্য শুষ্ক আবহাওয়ার অঞ্চলেও পাথরের সাহায্য শস্য রক্ষার এই পদ্ধতিটি পৃথকভাবে আবিষ্কৃত এবং অনুসৃত হয়েছে, উদাহরণ ইজরায়েল, দক্ষিণপশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পেরু, নিউজিল্যান্ড। পাথর মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, তা না হলে হয়তো রোদ আর বাতাসে মাটির পানি বাষ্পীভূত হয়ে যেতো। দিনে রোদের তাপ শুষে রাতে তা মাটিতে ছড়িয়ে দেয় পাথর, কাজেই এভাবে মাটির তাপমাত্রাও কমবেশি একই রকম থাকে। তাছাড়া গাঢ় রঙের পাথর হালকা রঙের মাটিতে বেশি তাপ শোষণ করে তাপের সঞ্চয় করে, আর ধীরগতিতে খনিজ যোগান দেয় মাটিতে। এসব ফ্যাক্টর নিঃসন্দেহে ফসলের ফলন বাড়ায়, যেমনটা দেখা গেছে কৃষি গবেষণায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক ক্রিস স্টিভেনসন তাঁর গবেষণায় বলেছেন, ঈস্টারের আদিবাসীরা প্রথম ৫০০ বছর সৈকতসংলগ্ন নিচু এলাকাতেই বাস করতো, সম্ভবত সামুদ্রিক খাবারের যোগানের জন্যেই। আনুমানিক ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের পর দ্বীপের ভেতরের দিকে উঁচু ভূমিতে চাষাবাদের নমুনা পাওয়া যায়, যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি, কিন্তু তাপমাত্রা কম। ঈস্টারের কেন্দ্রসংলগ্ন উঁচু ভূমির প্রায় সবটুকুই পাথুরে ক্ষেত। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে কোন সাধারণ মানুষের বাড়িঘরের নমুনা নেই, কোন মুরগির ঘর নেই, কয়েকটা চুলো আর ছোট ঘর বাদে যা আছে সবই অভিজাতদের বাড়ি, অনেকটা আমাদের দেশে চা-বাগানের মতো। ধারণা করা হয়, উঁচু এলাকায় ম্যানেজার গোছের কেষ্টুবিষ্টুরা বাস করতো, পাথুরে ক্ষেতে চাষবাস তদারক করার জন্য, আর সৈকত সংলগ্ন এলাকা থেকে চাষীরা সেখানে কাজ করে আবার ফিরে যেতো। সৈকত থেকে উঁচু ভূমির দিকে পাঁচ মিটার চওড়া পাথরে বাঁধানো রাস্তাগুলি এই অনুমানকে সমর্থন করে।

পলিনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতোই ঈস্টারে দুই কিসিমের মানুষের বাসস্থানের নিদর্শন পাওয়া যায়। সর্দার আর অভিজাত লোকজনের বাড়ি, যাকে বলা হয় হারে পায়েঙ্গা, দেখতে অনেকটা উল্টানো ক্যানোর মতো, ৪০ ফিট লম্বা, ১০ ফিট চওড়া, যার মেঝেগুলি নিখুঁতভাবে কাটা আর পালিশ করা ব্যাসল্টের তৈরি, ছাদ আর দেয়াল খড়ের। ঈস্টারের দু'শো গজ চওড়া সৈকতের বিভিন্ন জায়গায় এর মূর্তিগুলি (যাকে বলা হয় মোয়াই) আর তার প্ল্যাটফর্ম (আহু) ছাড়া আছে কেবল ৬ থেকে ১০ টা করে হারে পায়েঙ্গা। অন্যদিকে সাধারণ লোকজন বাস করতো সৈকত থেকে দূরে, সেখানে তাদের সাধারণ ঘর, মুরগির খোঁয়াড়, ক্ষেত, বাগান আর ময়লা ফেলার জায়গা বাদে বিলাসিতার আর কোন নমুনা নেই।

ঈস্টারের লোকায়ত গল্প আর প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা, দুটোতেই দেখা গেছে, দ্বীপটি ১১ বা ১২টি বিভিন্ন গোত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে বিভক্ত ছিলো, অনেকটা পিৎজার বারোটা টুকরোর মতো, সৈকতের দিকে চওড়া, কেন্দ্রের দিকে সরু। প্রতিটি অঞ্চলের ছিলো নিজস্ব সর্দার আর মূর্তি। ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠানে এক গোত্র আরেক গোত্রের সাথে সবসময়ই প্রতিযোগিতায় মেতে থাকতো, যা কখনো কখনো রূপ নিতো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপেও এই একই কাহিনী পুনরাবৃত্ত হয়েছে বারবার। তবে ঈস্টারের ক্ষেত্রে অনুমান করা হয়, এই বারোটি গোত্র ধর্মীয়, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একজন কেন্দ্রীয় সর্দারের অধীনে ছিলো।

কোত্থেকে এলো এই ধারণা?

ঈস্টারের সম্পদগুলি সুষমভাবে এই বারোটি অঞ্চলে ছড়ানো ছিলো না। যেমন, টোঙ্গারিকি এলাকায় ছিলো রানো রারাকু জ্বালামুখ, মূর্তি খোদাইয়ের জন্যে সেরা পাথরের একমাত্র উৎস। মূর্তির মাথায় চাপানো লাল টুপিগুলির পাথর এসেছে হাঙ্গা পৌকুরা অঞ্চলের খনি থেকে। ভিনাপু আর হাঙ্গা পৌকুরা অঞ্চলে ছিলো অবসিডিয়ানের খনি, ধারালো অস্ত্র বানানোর একমাত্র পাথর। ভিনাপু আর টোঙ্গারিকিতে ছিলো সর্দারদের রাজকুটির হারে পায়েঙ্গা বানানোর ব্যাসল্টের খনি। উত্তরে আনাকেনায় ছিলো দু'টি সেরা সৈকত, তার পাশে হেকি'ই তে ছিলো তৃতীয়টি। কিন্তু এরা আবার রুগ্ন ছিলো চাষাবাদে, কারণ ভালো চাষের জমি ছিলো সব দক্ষিণ আর পশ্চিমে। পাখির আড্ডা ছিলো সব ভিনাপুতে। অন্যান্য সম্পদ, যেমন কাঠ, প্রবাল আর কাগুজে মালবেরি (যার ছাল পিটিয়ে কাপড় বানানো হতো), এগুলিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। বারোটার মধ্যে মোটে পাঁচটা অঞ্চলে পাথুরে ক্ষেতের জমি ছিলো।

গোত্রগত সংহতির অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে, টোঙ্গারিকি আর হাঙ্গা পৌকুরার পাথর বাকি সব অঞ্চলের মূর্তিতেই পাওয়া গেছে। একই ভাবে ছড়িয়ে আছে অবসিডিয়ান, মাছ আর অন্যান্য সম্পদ। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সম্পদ স্থানান্তরের জন্য তৈরি রাস্তা নিঃসন্দেহে আরো কিছু অঞ্চলের ভেতর দিয়ে গেছে, এবং কোন কিছু সে রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার জন্যে সে অঞ্চলের গোত্রের সম্মতি অবশ্যই প্রয়োজন। একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা না থাকলে এতো সহজে এই সম্পদের বিন্যাস ঘটতো না।

এত কিছুর পর ঈস্টারের আসল জিনিসগুলির কথা বলা শুরু করাই উচিত। এর দানবীয় মূর্তি আর তার প্ল্যাটফর্ম।

[চলবে আজ আরো কিছুদূর]


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

এত কিছুর পর ঈস্টারের আসল জিনিসগুলির কথা বলা শুরু করাই উচিত।

হেইডার লাইগাই তো ওয়েট কোরতা হায়...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

হিমু এর ছবি

এত খেটেখুটে লেখার পরও এই সিরিজটা পাঠকের আগ্রহ জাগাতে পারেনি। আপনার মতো রহস্যবিমুখ লোকজন সংখ্যায় বাড়ছে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

রহস্যবিমুখ কথাটা ঠিক হলো না।
আমি রহস্যগল্প- এবং রহস্যউপন্যাসবিমুখ। তবে নানাবিধ রহস্যে অগাধ কৌতূহল হাসি

এই সিরিজটি আমি সোত্সাহেই পড়তে শুরু করেছিলাম। এমনকি এই বিষয়ে বিবিসি নির্মিত একটি ডকুর লিংকও দিয়েছিলাম আপনাকে। তারপরেও আমাকে অপবাদ দিলেন মন খারাপ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

হিমু এর ছবি

অপবাদ্দিতে ঠিক্মতো পার্লাম আর্কই?


হাঁটুপানির জলদস্যু

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

এক বছরেরও বেশি আগের হিমু ভাইয়ের লেখায় পঞ্চম মন্তব্য করে রেকর্ড কর্লাম। হাসি
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

tanjim এর ছবি

আমি ষষ্ঠ ব্যাক্তি হওয়ার লোভ সাম্লাতে পারলাম্না।
এই সিরিজটা পড়ছি ২ দিন ধরে ফাঁকে ফাঁকে।খুব ভাল লাইগছে।
পাব্লিক হালায় যে কি খায় হেইডা মনে হয় পাব্লিকও কইতে পারবনা রেগে টং

ফয়সাল এর ছবি

হে হে হে হিমুদা, পাঠকে কিন্তু ঠিকই খুঁইজা খুঁইজা বাইর করছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।