ঈস্টার দ্বীপ ০৪

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: শুক্র, ০৪/০১/২০০৮ - ৯:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

Bishalpost

ঈস্টারবাসীদের মূর্তি নির্মাণ, পরিবহন এবং স্থাপন নিয়ে এখনো গবেষণা এবং উত্তপ্ত বিতর্ক চালু আছে। তবে এরিখ ফন দানিকেনের মতো এর কৃতিত্ব কেউ ভিনগ্রহীদের কাঁধে চাপিয়ে দেননি। কোন ইয়োরোপীয় অভিযাত্রীও ঈস্টারের কোন মূর্তি পরিবহন বা উত্তোলনের কাজ নিজের চোখে দেখে বর্ণনা দিয়ে যাননি, এ ব্যাপারে গবেষকরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন দ্বীপের লোকায়ত কাহিনী এবং পরোক্ষ নিদর্শন থেকে। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড় করানো তত্ত্বগুলির ওপর পরবর্তীতে বিভিন্ন পরীক্ষাও করা হয়েছে হাতেকলমে।

রানো রারাকু খনিতে এখনও অনেক অসমাপ্ত মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ব্যাসল্টের বাটালিগুলিও ছড়িয়ে আছে তার পাশে। একেবারেই অসমাপ্ত মূর্তিগুলি আর কিছু নয়, কেবল পাথর থেকে খোদাই করা একটা পাথরের টুকরো, মুখ আকাশের দিকে, পিঠ তখনো সরু একটা পাথরের দাঁড়ার মাধ্যমে যুক্ত আছে মূল পাথরের সাথে। এর পর মাথা, নাক, কান, হাত, নেংটি ইত্যাদি খোদাই করার কথা। এর পর পাথরের দাঁড়াটা ঠুকে ঠুকে ভেঙে মূর্তিটাকে পাহাড়ের গা থেকে আলগা করা হতো। অসমাপ্ত কোন মূর্তিরই চোখ নেই, এ থেকে ধারণা করা হয়, পরিবহন শেষে অথবা আহুর ওপর তুলে মূর্তিগুলির চোখ তৈরি করা হতোমন্তব্য ১। ১৯৭৯ সালে সোনিয়া হাওয়া এবং সের্খিও রাপু হাওয়া এক দারুণ আবিষ্কার করেছিলেন, একটি আহুর কাছে মাটি খুঁড়ে তারা পেয়েছিলেন সাদা প্রবালে তৈরি একজোড়া চোখ, যার মণিদু'টি লাল স্কোরিয়া পাথরের। এরকম আরো অনেক আহুর কাছে পরবর্তীতে খুঁড়ে আরো চোখ পাওয়া গিয়েছে। এই চোখগুলি মোয়াইয়ের চক্ষুগহ্বরে স্থাপন করলে এক দর্শনীয় চেহারা দাঁড়ায় মূর্তির। তবে খুব বেশি চোখ খুঁজে পাওয়া যায়নি, ধারণা করা হয়, অল্পই তৈরি করা হয়েছিলো, যা পুরোহিতদের পাহারায় থাকতো সারা বছর, আর বিশেষ অনুষ্ঠানে মূর্তির চোখে স্থাপন করা হতো।

রানো রারাকু থেকে পথ বেরিয়ে গেছে দ্বীপের সব দিকে, উঁচু নিচু টিলা এড়িয়ে যা সমতল ধরে গেছে। রানো রারাকু থেকে পশ্চিমসৈকতে অবস্থিত আহুগুলির দূরত্ব ৯ মাইল। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতেও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলি পাথরের তৈরি, এবং সেখানে বেশিরভাগ সময়েই কেবল মানুষের পেশীশক্তি দিয়ে ভারি পাথর পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা ঈস্টার দ্বীপে মূর্তি পরিবহন নিয়ে নানা পরীক্ষা করেছেন, যার শুরু হয়েছিলো থর হেয়ারডালকে দিয়ে, যিনি মূর্তি পরিবহন করতে গিয়ে একটা মূর্তির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। আন্দাজ করা যায়, তাঁর পদ্ধতিটি সঠিক ছিলো না। অন্যান্য পদ্ধতি যা চেষ্টা করা হয়েছে, তা হচ্ছে দাঁড়ানো বা শোয়ানো মূর্তি টেনে নিয়ে যাওয়া, কাঠের স্লেডে রেখে টেনে নেয়া, কাঠের রোলারের ওপর রেখে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি।

জ্যারেড ডায়মন্ডের কাছে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে জো অ্যান ভ্যান টিলবার্গের পরামর্শ, যিনি বলেছেন, ঈস্টারবাসীরা পলিনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী কাঠের মই, যা সাধারণত ব্যবহৃত হয় জঙ্গলে গাছ কেটে সেটা খোদাই করে ক্যানো বানিয়ে সৈকত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে, সেরকম মইয়ের ওপর দিয়ে মূর্তিগুলি টেনে নিয়ে গেছে। ডায়মন্ড নিজেও পাপুয়া নিউগিনিতে এমন মাইলখানেক লম্বা মই দেখেছেন, উঁচু এলাকা থেকে সৈকত পর্যন্ত ক্যানো বানাবার গাছ বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। হাওয়াই দ্বীপে কিছু কিছু ক্যানোর ওজন ঈস্টারের সাধারণ মূর্তির চেয়ে বেশি, যা কি না এই কাঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তবে এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক গবেষণার আলোকে কিছু যোগ করবো আমি, পরে।

জো অ্যান ভ্যান টিলবার্গ তত্ত্ব দিয়েই বসে থাকেননি, হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখেছেন। কাঠের স্লেডে শোয়ানো ১২ টন ওজনের একটা মূর্তিকে কাঠের মইয়েরও ওপর চড়িয়ে দড়ি বেঁধে তিনি ঈস্টারবাসীদের কয়েকজনকে দিয়েই টানিয়েছেন। তাঁর পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৫০ থেকে ৭০ জন লোক যদি দিনে ৫ ঘন্টা করে মূর্তি টানে, আর টান পিছু যদি ৫ গজ করে এগোয়, তাহলে ৯ মাইল রাস্তা পেরোতে সময় লাগে হপ্তাখানেক। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে, মূর্তি পরিবহনের কাজটা অনেক সহজ হয়, যদি সবাই একসাথে, সমলয়ে টানে, যেভাবে বাইচের নৌকাতে সমলয়ে দাঁড় টানে সবাই। এই পরীক্ষা থেকে তথ্য নিয়ে হিসেব করে দেখা গেছে, পারো-র মতো ভারি মূর্তি পরিবহন করতে একই সময়ে ৫০০ লোক লাগবে, যা ঈস্টার দ্বীপের এক একটি গোত্রের পক্ষে (গোত্রের আকার এক থেকে দু'হাজার মানুষ পর্যন্ত) যোগান দেয়া সম্ভব।

ঈস্টারবাসীরা থর হেয়ারডালকে দেখিয়েছিলো, কিভাবে এমন একটা মূর্তি আহুর ওপর খাড়া করা হয়। এ নিয়ে তারা রীতিমতো ক্ষেপেও ছিলো, যে প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাদের একবার জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেনি। পরবর্তীতে উইলিয়াম মালয়, জো অ্যান ভ্যান টিলবার্গ, ক্লাউদিও ক্রিস্তিনো এবং আরো অনেকের গবেষণায় আরো তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ঈস্টারবাসীরা প্রথম পাথরের টুকরো দিয়ে হালকা ঢালু একটা ড়্যাম্প তৈরি করে নেয়, তারপর মূর্তির নিচের দিকটা ওপরে রেখে টেনে সেটাকে আহু পর্যন্ত তোলে। এরপর মূর্তির মাথাকে কাঠের লিভার দিয়ে চাঁড় দিয়ে একটু একটু করে তোলা হয়, ইঞ্চি দুয়েক তোলার পর মূর্তির মাথার নিচে পাথর গুঁজে দেয়। এভাবে পুরো মূর্তিটাকে খাড়া করা হয়। মূর্তির পুকাও একই সময়ে একই ঠেস কাঠামো দিয়ে সম্ভবত তোলা হতো। পাথরের ঢাল পরে সরিয়ে ফেলা হয়।

সবচেয়ে বিপদজনক মূহুর্ত হচ্ছে খুব খাড়া কোণ থেকে একেবারে খাড়া করার সময়টুকু। মূর্তির ভরবেগ একটু এদিক সেদিক হলেই সেটা টাল খেয়ে পেছনে পড়ে যেতে পারে। এ কারণেই মূর্তির কারিগররা একে পুরোপুরি সমকোণে তৈরি করতো না, মূর্তির পাদদেশ থেকে হয়তো ৮৬-৮৭ ডিগ্রী কোণ করে মূর্তিটিকে তৈরি করা হতো। ফলে মূর্তিকে যখন খাড়া করা হতো, সেটা সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে থাকতো, ফলে টাল খেয়ে পেছনে পড়ে যাবার ঝুঁকি কমতো অনেকখানি।

এরকম একটা মূর্তি খাড়া করার প্রকল্পই নিঃসন্দেহে প্রচন্ড খরুচে ছিলো। জনা বিশেক খোদাইকারীকে এক মাস ধরে নিশ্চয়ই খাওয়াতে হতো, কিংবা খাবার দিয়ে মজুরি শোধ করা হতো। এরপর বয়ে আনার জন্য ৫০ থেকে ৫০০ জন লোকের খাওয়া-মজুরি, তারপর মূর্তি খাড়া করার জন্যও একই পরিমাণ মানুষের খাওয়া-মজুরি, তারপর মূর্তি খাড়া হয়ে গেলে নিশ্চয়ই উৎসবে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হতো, তাতে হয়তো যে গোত্রের এলাকা দিয়ে মূর্তি বয়ে আনা হয়েছে, তাদেরও আমন্ত্রণ জানাতে হতো। যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেব করতে বসেছিলেন, কী পরিমাণ ক্যালরি খরচ হয় এ কাজে, এবং তার সূত্র ধরে খোরাকির পরিমাণ নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন যে মূর্তির ব্যাপারটা গোটা প্রকল্পের ছোট একটা দিক, একটা আহুর ওজন মূর্তির চেয়ে কমসে কম ২০ গুণ বেশি, এবং সেই আহুর পাথরও বয়ে আনতে হতো। জো অ্যান ভ্যান টিলবার্গ এবং তাঁর স্থপতি স্বামী ইয়ান, যিনি লস অ্যাঞ্জেলসে নির্মাণ পেশার সাথে জড়িত, হিসেব কষে বার করেছেন, ঈস্টারের আহু এবং মোয়াইয়ের জন্য মূর্ত নির্মাণের ৩০০ বছরে ২৫% অতিরিক্ত খাবার প্রয়োজন হয়েছে। ক্রিস স্টিভেনসনের গবেষণার সাথে এ ফল মিলে যায়, যিনি ঈস্টারের কেন্দ্রসংলগ্ন উঁচু ভূমিতে পাথুরে ক্ষেতে চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই ৩০০ বছর দ্বীপের মানুষকে অতিরিক্ত খাবার যোগাতে ঈস্টারবাসীকে বেছে নিতে হয়েছে অতিরিক্ত কৃষিকার্যক্রমের পথ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রগেভেন এবং অন্যান্য ইয়োরোপীয়রা ঈস্টারকে ন্যাড়া একটা দ্বীপ বলে বর্ণনা করেছিলেন, যেখানে ১০ ফিটের উঁচু কোন গাছই নেই। তাহলে ঈস্টারবাসীরা মূর্তি পরিবহনের কাজে ব্যবহার করার জন্য কাঠ আর দড়ি পেলো কোত্থেকে?

ঈস্টারদ্বীপে বর্তমানে মোটে ৪৮ প্রজাতির স্থানীয় উদ্ভিদ রয়েছে, এদের মধ্যে সবচে বড়টি, তোরোমিরো, গড়ে ৭ ফিট লম্বা হয়; বাকি সব হচ্ছে ঘাস, গুল্ম আর ঝোপ। তবে গত কয়েক দশকে অতীতের ফ্লোরার অস্তিত্ব ও প্রকৃতি যাচাইয়ের বেশ কিছু কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে, এবং এসব কৌশল প্রয়োগ করে দেখা গেছে, ঈস্টারে মনুষ্যবসতির আগে রীতিমতো উপক্রান্তীয় বনাঞ্চল ছিলো।

এসব কৌশলের মধ্যে প্রথমেই আসে প্যালিনোলজি, উদ্ভিদের পরাগরেণু বিশ্লেষণ বিজ্ঞান। এ ধরনের বিশ্লেষণে সাধারণত কোন জলাশয়ের তলা থেকে মাটির স্তম্ভ খুঁড়ে আনা হয়। যদি জলাশয়ের তলদেশ কোন কারণে ব্যাপক ওলটপালট না হয়, তাহলে ধরে নেয়া যেতে পারে, মাটির স্তম্ভের ওপরের দিকটা সবচেয়ে নতুন পলি, নিচের দিকটা আরো প্রাচীন পলি। এভাবে যতো নিচে খোঁড়া যাবে, তত প্রাচীন পলি পাওয়া যাবে। রেডিওকার্বন পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন স্তরের পলির বয়স নির্ধারণ করা যায়। এরপর শুরু হয় এক অবিশ্বাস্য খাটনির কাজ, সেই পলির স্তরে জমা হওয়া লক্ষ লক্ষ উদ্ভিদের পরাগরেণু মাইক্রোস্কোপের নিচে ধরে চলে বিশ্লেষণ। সাধারণত বর্তমান উদ্ভিদের পরাগরেণুর সাথে তুলনা করে নমুনা রেণুগুলিকে শ্রেণীবিন্যস্ত করা হয়। ঈস্টারে প্রথম এ ধরনের গবেষণা শুরু করে সুইডিশ পরাগবিজ্ঞানী ওলফ সেলিং, যিনি হেয়ারডালের ১৯৫৫ সালের অভিযানে রানো রারাকু আর রানো কাউ জ্বালামুখের জলাগুলি থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি এসব নমুনায় প্রচুর পরিমাণে পেয়েছিলেন এক জাতীয় পাম গাছের পরাগ, যে ধরনের পাম গাছ ঈস্টারে এখন আর নেই।

১৯৭৭ এবং ১৯৮৩ সালে জন ফ্লেনলি আরো কিছু পলির নমুনা সংগ্রহ করেন। তবে ফ্লেনলির কাছে তখন ছিলো সের্খিও রাপু হাওয়া-র কাছ থেকে পাওয়া কিছু অশ্মীভূত পাম ফল, সে বছরই একটি লাভা গুহায় ফরাসী অভিযাত্রীদের হাতে আবিষ্কৃত। ফলগুলি দেখতে অনেকটা চিলিয়ান ওয়াইন পামের মতো, তবে আকারে আরেকটু বড়। চিলিয়ান ওয়াইন পাম পৃথিবীর বৃহত্তম পাম প্রজাতির গাছ, যেগুলি লম্বায় ৬৫ ফিট পর্যন্ত উঁচু আর ৩ ফিট পুরু হয়। পরবর্তী অভিযাত্রীরা তেরেভাকা পাহাড়ের লাভা স্রোতে এমন কয়েক লক্ষ বছরের পুরনো পাম গাছের কাস্ট দেখেছেন। এই লাভাস্রোতে মমিকৃত পামের মূলের আকার দেখে ধারণা করা হয়, ঈস্টারের পামগাছগুলির ব্যাস ৭ ফিটেরও বেশি ছিলো, অর্থাৎ চিলিয়ান ওয়াইন পামও ওগুলোর তুলনায় শিশু। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, পৃথিবীর বৃহত্তম পামগাছ এক কালে ঈস্টারে ছিলো।

চিলিতে এই ওয়াইন পামের কদর খুব। এই গাছ থেকে মিষ্টি সাদা কষ বেরোয়, যা থেকে মদ বানানো হয়, আবার ফুটালে গুড়ের মতো মিষ্টি পাওয়া যায়। ফলগুলির আঁটিও খেতে বেশ। এই পাম গাছের পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি দেয়া যায়, মাদুর, ঝুড়ি, নৌকার পাল তৈরি করা যায়। আর এর গুঁড়ি দিয়ে নিঃসন্দেহে মোয়াই পরিবহন আর ভেলা তৈরির কাজও করা হয়েছে।

জন ফ্লেনলি আর সারা কিংসেই কাদার নমুনা থেকে আরো পাঁচটি বর্তমানে-বিলুপ্ত গাছের পরাগ খুঁজে পেয়েছেন। ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক ক্যাথরিন ওরলিয়াক ঈস্টারের বিভিন্ন চুলো আর ময়লার গাদা খুঁড়ে ৩০,০০০ অঙ্গারের টুকরো ছেঁকে বার করেছেন। এর মধ্যে থেকে ২,৩০০ নমুনা তিনি তুলনা করেছেন পলিনেশিয়ায় বর্তমানে পাওয়া যায় এমন অন্যান্য কাঠের সাথে। আরো ১৬টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ তিনি শনাক্ত করেছেন, যেগুলি এখন পলিনেশিয়াতে আছে এবং এককালে ঈস্টারে ছিলো। অর্থাৎ, ঈস্টারে এককালে বেশ ফাঁদালো অরণ্য ছিলো।

বিলুপ্ত এই ২১টি গাছ এখন হাতে পেলে ঈস্টারবাসীরা বর্তে যেতো। দু'টি গাছ, আলফিটোনিয়া জিজিফয়ডেস (১০০ ফিট) আর এলাইওকার্পাস রারোটোঙ্গেনসিস (৫০ ফিট) পলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপে ক্যানো বানানোর কাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পলিনেশিয়ার অন্যান্য জায়গায় ট্রিয়ামফেটা সেমিট্রিলোবা-র ছাল দিয়ে দড়ি বানানো হয়, সম্ভবত ঈস্টারেও তা দিয়েই মোয়াইগুলি টানা হয়েছিলো। ব্রুসোনেশিয়া পাপিরিফেরা, অর্থাৎ কাগুজে মালবেরির ছাল পিটিয়ে তাপা নামের এক কাপড় বানানো হয়, সিডরাক্স ওডোরাটা দিয়ে বানানো হয় হারপুন আর ডিঙি, সিজিগিয়াম মালাক্কেনসে (মালয় আপেল) ছিলো খাবার ফলের গাছ, থেসপেজিয়া পপুলানেয়া থেকে পাওয়া যেতো নির্মাণকাজের জন্যে শক্ত কাঠ, তোরোমিরো থেকে পাওয়া যায় জ্বালানি কাঠ, আর যেহেতু অরলিয়াক এদের পোড়া অঙ্গার খুঁজে পেয়েছেন, তা-ই পরিষ্কার বোঝা যায়, এদের জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহার করা হতো বা হয়েছিলো।

আনাকেনা সৈকত, যেটি সম্ভবত ঈস্টারের বসতিদারদের নাও ভিড়ানোর কূল, এবং প্রথম বসতি, সেখানে খুঁজে পাওয়া ৬,৪৩৩টি হাড়ের সবক'টি যিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন, তিনি প্রাণীপ্রত্নতাত্ত্বিক ডেভিড স্টেডম্যান। স্টেডম্যান তাঁর কাজে, বিশেষ করে পাখির হাড় বিশ্লেষণে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন, হাড় দেখে তিনি বলে দিতে পারেন সেটি কোন প্রজাতির পাখির। আনাকেনায় পাওয়া হাড় পরীক্ষা করে স্টেডম্যান জানিয়েছেন, ঈস্টার, যেখানে আজ একটিও স্থানীয় ডাঙার পাখি নেই, অতীতে কমপক্ষে ছয় প্রজাতির ডাঙার পাখির আবাসস্থল ছিলো, এগুলোর মধ্যে রয়েছে এক প্রজাতির বক, মুর্গির মতো দু'টি প্রজাতির পাখি, দু'টি প্রজাতির টিয়া এবং একটি প্রজাতির প্যাঁচা। এরচেয়েও চটকদার ছিলো ঈস্টারের কমপক্ষে ২৫ প্রজাতির বাসাবাঁধা সামুদ্রিক পাখি, এবং সম্ভবত ঈস্টার ছিলো এককালে গোটা প্রশান্ত মহাসাগরে সামুদ্রিক পাখির সবচেয়ে বড় আবাস। এদের মধ্যে ছিলো অ্যালবাট্রস, বুবি, ফ্রিগেট, ফুলমার, পেট্রেল, প্রিয়ন, ঝোড়ো-পেট্রেল, টার্ন আর ক্রান্তীয়পাখি, যারা মানুষের আগমনের আগ পর্যন্ত ঈস্টারের খাদকশূন্য পরিবেশে সমানে বংশবিস্তার করেছিলো। স্টেডম্যান কতগুলি সীলের হাড়গোড়ও পেয়েছিলেন, যেগুলি ঈস্টারের পূবদিকে গালাপাগোস আর হুয়ান ফেরনান্দেজ দ্বীপপুঞ্জে বংশবিস্তার করে, তবে এগুলি কি স্থানীয় সীল নাকি বেড়াতে এসে ধনেপ্রাণে মারা পড়া সীল, তা বলা দুষ্কর।

আনাকেনার উৎখনন থেকে ঈস্টারের আদিবাসীদের খাদ্যাভাস সম্পর্কে জানা যায় অনেক কিছুই। ৬,৪৩৩টি হাড্ডিগুড্ডির মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় এক তৃতীয়াংশ, হচ্ছে দ্বীপের আশপাশে সবচেয়ে বড় প্রাণীটির, ডলফিন, ওজনে যা প্রায় ১৬৫ পাউন্ড পর্যন্ত হয়। পলিনেশিয়ার আর কোথাও এত বেশি পরিমাণে ডলফিন পাওয়া যায়নি খাবারের গাদায়। ডলফিন থাকে গভীর সাগরে, তীরবর্তী এলাকায় তারা আসেনা, কাজেই তীর থেকে জাল ফেলে বা ট্যাঁটা দিয়ে তাদের মারা সম্ভব না। ডলফিনের হাড় প্রমাণ করে, বড় সাগরগামী ক্যানোতে চড়ে গভীর সমুদ্রে শিকার করা এসব ডলফিন, হয়তো অরলিয়াকের খুঁজে পাওয়া সেই বিশাল গাছ দিয়েই তৈরি সেসব ক্যানো।

আনাকেনায়া পাওয়া হাড়গুলোর মধ্যে মাছের হাড় মোটে ২৩%, পলিনেশিয়ার অন্যান্য জায়গায় যেখানে খাবারের ৯০%ই মাছ। ঈস্টারে তেমন মাছ নেই, কারণ ঈস্টারের চারপাশে অগভীর সমুদ্র কম, বেশির ভাগ জায়গায় সাগর খাড়া নেমে গেছে নিচে। এ কারণে ঈস্টারবাসীর খাবারের টেবিলে ঝিনুকজাতীয় মাছ বা সাগরের অমেরুদন্ডী প্রাণীও কম। এই অভাব পূরণ করেছে পাখি। পাখির স্যুপের সাথে হয়তো যোগ হয়েছিলো ইঁদুরের কাবাব, যেসব ইঁদুর বসতিদারদের নৌকোতে করেই হয়তো ঈস্টারে বাসা বেঁধেছিলো। ঈস্টার পলিনেশিয়ার একমাত্র দ্বীপ, যেখানে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননকেন্দ্রে মাছের হাড়ের চেয়ে বেশি ইঁদুরের হাড় পাওয়া গেছে।

অন্যান্য আরো হাড় থেকে দেখা গেছে, ঈস্টারবাসীরা মাঝে মাঝে সামুদ্রিক কাছিম, বড়সড় গিরগিটি। এ সব খাবারই আগুনে সেদ্ধ বা পুড়িয়ে খাওয়া।

তবে সময়ের সাথে ঈস্টারের খাদ্যতালিকা পাল্টেছে মারাত্মকভাবে। গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ রূপকথার গল্প হয়ে গেছে পরবর্তীতে। গভীর সমুদ্রের শিকার, যেমন ডলফিন বা টুনা সম্পূর্ণ বাদ পড়েছে খাবারের তালিকা থেকে। যেসব মাছ ধরা হতো পরের দিকে, সেগুলি তীরবর্তী মাছ। ডাঙার পাখি সব ক'টাই একে একে বাদ পড়েছে, কারণ প্রতিটি প্রজাতিই অতিশিকার, বননিধন আর ইঁদুরের আক্রমণে লুপ্ত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে ঈস্টারের পাখিদের কপালেই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ লেখা ছিলো, যা ছাড়িয়ে গেছে নিউজিল্যান্ড আর হাওয়াইতে পাখির প্রজাতিবিনাশকেও। ২৫টি সামুদ্রিক পাখির মধ্যে ২৪টি এখন আর ঈস্টারে আসে না, ৯টি মাঝেমধ্যে আসে, তা-ও মূলদ্বীপ থেকে দূরে কিছু টুকরো দ্বীপে। এমনকি খোলসমাছও (শেলফিশের বাংলা পরিভাষা আর কী হতে পারে?) অতিশিকারের কারণে আস্তে আস্তে কমেছে, সময়ের সাথে খাবারের গাদায় যোগ হয়েছে তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের খোলস, যেগুলি স্বাদে ও পরিমাণে কম, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় প্রজাতিগুলি হারিয়ে গেছে ঈস্টারবাসীর নোলার উৎপাতে।

হারিয়ে যাওয়া ২১টি গাছের অপমৃত্যু নিয়েও অনেক অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। অরলিয়াকের অঙ্গারের নমুনা যেমন প্রমাণ করে, গাছগুলি পোড়ানো হতো। মৃতদেহ পোড়ানোর জন্যেও এ কাঠ ব্যবহার করা হতো, ঈস্টারের দেহভস্মাগারে হাজার হাজার মানুষের দগ্ধাবশেষ আর অস্থিভস্ম পাওয়া গেছে। বন "পরিষ্কার" করে ক্ষেত গড়ে তোলা হয়েছে সারা ঈস্টার জুড়েই, শুধু সর্বোচ্চ পাহাড়ি এলাকা বাদে। গভীর সমুদ্রের মাছ দেখে আঁচ করা যায়, ঈস্টারবাসী গাছ কেটে ক্যানো বানাতো, রগেভেন যেসব পলকা ফুটো হয়ে যাওয়া নৌকো ব্যবহার করতে দেখেছিলেন ঈস্টারের অধিবাসীদের, সেসবে চড়ে ডলফিন শিকার সম্ভব নয়। ঈস্টারের ইঁদুরগুলিও গাছগুলিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করতো, ঈস্টারে পাওয়া প্রতিটি পাম ফলের বীজে ইঁদুরের দাঁতের দাগ আছে। বোঝা যায়, এসব বীজ থেকে আর গাছ গজানোর আশা ছিলো না।

বননিধন নিশ্চয়ই মানুষের আগমনের পর, অর্থাৎ ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের পর শুরু হয়েছে, আর শেষ হয়েছে রগেভেন দ্বীপে পা ফেলার আগেই, অর্থাৎ ১৭২২ এর আগে। কিন্তু ঠিক কবে ঈস্টারে বন ধ্বংস হলো, জানা যায় কি?



মন্তব্য ১ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজাতেও কিন্তু মূর্তির চক্ষুদান হয় একেবারে শেষদিকে।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

জট ছুটতে শুরু করেছে। এরকমটাই ভাবছিলাম।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হিমু এর ছবি

আরো ছুটবে। তবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আরো ইন্টারেস্টিং কিছু সাম্প্রতিক তত্ত্ব পেলাম, সেগুলিও শেয়ার করবো।

ঈস্টার নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আর অনুমান আছে, সেগুলি দেবো শেষ পর্বে।

কেশ, ক্যান যে মিস্ত্রি হইলাম মন খারাপ ...।


হাঁটুপানির জলদস্যু

শাহনাজ এর ছবি

প্রবল আগ্রহ নিয়ে সিরিজটা পড়ছি। নেশা লেগে গেছে। সেই সাথে রহস্য উন্মোচনের উত্তেজনাও টের পাচ্ছি। দুর্দান্ত লেখা। হিমুকে শুভেচ্ছা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।