নিরিবিলি বই পড়া

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: শুক্র, ১৩/০৬/২০০৮ - ৮:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অমিত আহমেদের সাথে আলাপ হচ্ছিলো গোয়েন্দা গল্প নিয়ে। দেখা গেলো, আমার দুই গোয়েন্দা চরিত্র, যথাক্রমে গোয়েন্দা ঝাকানাকা আর গোয়েন্দা গুল মোহাম্মদের মধ্যে প্যাঁচ লেগে যাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্যাঁচ ছাড়ানোর জন্যে তাই পুরনো একটা লেখা তুলে দিচ্ছি। বহু আগে অন্যত্র প্রকাশিত।

১.

রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস হাতে পেলে গুল মোহাম্মদের আর হুঁশ থাকে না। তিনি নাওয়াখাওয়া এবং হাওয়া খাওয়া ভুলে সেই বই নিয়ে মেতে থাকেন। আর একবার বই হাতে নিলে সেটার শেষ না দেখে, একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়েন না তিনি। এক আসরেই একটা বই মাত করে দেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গোয়েন্দা। কিন্তু গুল মোহাম্মদ দরিদ্র মানুষ, দরাদরি করে কিনে বই পড়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। আর যেসব মারদাঙ্গা কিসিমের বই তিনি পড়েন, সেগুলো লাইব্রেরিতে পাওয়া যায় না। লাইব্রেরিগুলো যেন পণ করেছে, যাবতীয় নিরামিষ গদ্যপদ্যপ্রবন্ধ পড়িয়ে পড়িয়ে ন্যুব্জপৃষ্ঠক্যুব্জদেহ ভেতো বাঙালিকে ভেতোতর করে তুলবে। পানসে কিছু প্রেমের উপন্যাস আর সেগুলোর কিছু নিরামিষ সমালোচনাগ্রন্থ দিয়ে শেলফ সব জায়গায় বোঝাই, সেগুলো পড়তে গেলেই ভারি ঘুম পায়। তাই তিনি লাইব্রেরিবিমুখ হয়ে, ওদিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, আর অনেক মাথা খাটিয়ে বিনা পয়সায় বই পড়ার একটা ফন্দি বের করেছেন। পাড়ার যাবতীয় ছেলেছোকরার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ আলোচনা করে তিনি একটা পঞ্চবার্ষিকী বই লেনদেন প্রকল্প দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। এখন যেটা হয়, পিন্টুর কাছ থেকে তিনি বই এনে পড়েন, তারপর সেটা পড়তে দেন মিন্টুকে। এর বদলে মিন্টুর কাছ থেকে যে বইটা পান, সেটা আবার পড়া শেষ হলে পিন্টুকে পড়তে দেন। এমনি করে আরো অনেকের সাথে বিনিময় করে তিনি দুকূল বাঁচিয়ে চলছেন, আবার পয়সাও খরচা হচ্ছে না। তবে একটা ব্যাপারে গুল মোহাম্মদ ভারি ভয়ে আছেন, গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে যদি এই ছোকরাগুলো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ব্যবসাটা মাটি করে, তাহলে?

গুল মোহাম্মদ অত বেছে পড়েন না, একটা গোয়েন্দা মাকর্া বই হলেই তাঁর একদিন চলে যায়। তবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দ হচ্ছে আলোছায়া প্রকাশনীর বাঁধা লেখক নিঝুম পুরীর 'গোয়েন্দা ঝাকানাকা' সিরিজ। সেখানে গোয়েন্দা ঝাকানাকা এক বিশাল বড়লোক মানুষ, হাতে কোন কাজ নেই বলে সময় কাটানোর জন্যে সে এমনি এমনি বিনিমাগনা লোকের রহস্য সমাধান করে দেয়। গোয়েন্দা ঝাকানাকা ভারি দরদী লোক, গরীব দুঃস্থদের কাছ থেকে সে কোন পয়সা নেয় না, কিন্তু ধনী লোকদের জন্যে তার ফি ভারি চড়া। হয়তো কোন রিকশাওয়ালার স্যান্ডেল চুরির রহস্য সে নিখরচায় করে দিলো, উল্টে নিজের গাঁট থেকে আরো পঞ্চাশটা টাকা সে বেচারার হাতে ধরিয়েও দিলো, কিন্তু শহরের বিখ্যাত ধনী আবদুল গোলাম হক, যিনি ফি হপ্তায় একটা না একটা রক্তজলকরা রহস্য নিয়ে গোয়েন্দা ঝাকানাকার শরণাপন্ন হন, তাঁর জন্যে পঞ্চাশ হাজার এক টাকা রেগুলার রেট। পঞ্চাশ হাজার টাকা গোয়েন্দা ঝাকানাকার তরফ থেকে গোপনে নানা রকম দাতব্য প্রতিষ্ঠানে চলে যায়, আর এক টাকা সে একটা মাটির টুনিব্যাঙ্কে জমিয়ে রাখে --- এটাই তার নেশা। তার একগাদা গাড়ি আছে, ছয় সাত রকমের অস্ত্রশস্ত্র আছে, তার আলিশান বাড়িতে ছদ্মবেশ নেয়ার জন্যে বিশাল একটা মেকআপ রূম আছে, মাসে মাসে মাইনে দিয়ে রাখা মেকআপম্যান আছে --- এক কথায় গোয়েন্দা ঝাকানাকা সবসময় সবরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। সে প্রয়োজনে কখনো গোলাপ গাছের ছদ্মবেশে গিয়ে কোন ঘাগু খুনীকে ধরে ফেলতে পারে, আবার কখনো ল্যাম্পপোস্টের ছদ্মবেশে বসে থেকে দুর্ধর্ষ ডাকাত বদরু খাঁ, যে কিনা শুধু রাত বারোটায় খুন করে, তার কোন বদখদ অপরাধের পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পারে। ঝাকানাকার অসাধ্য, এমন কিছু নেই বললেই চলে।

যার যেটা নেই, তার সেটার প্রতিই টান থাকবে। সে জন্যেই গোয়েন্দা ঝাকানাকার নানা অভিযানের গল্প পড়ার জন্যে আমাদের গোয়েন্দা গুল মোহাম্মদ অত টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে বই যোগাড় করে পড়েন। পড়েন আর ভাবেন, ইশ, আমারও যদি ভাড়াটে চিলেকোঠার বদলে ওরকম একটা বাড়ি থাকতো, গুলতির বদলে অমন বন্দুক পিস্তল থাকতো, ওরকম মেকআপরুম মেকআপম্যান দু'টোই থাকতো --- তিনি ভাবেন আর ভাবেন, আর ফোঁসফোঁস করে দুঃখের শ্বাস ফেলেন। পঞ্চাশ হাজার এক টাকার প্রসঙ্গ এলে তিনি আরো কাতর হয়ে যান। মাটির টুনিব্যাঙ্ক একটা তাঁরও আছে, তবে সেটার অবস্থা খুব একটা সুবিধার না।

যাই হোক, আজ সকালে তিনি তাঁর লেনদেন প্রকল্পের অন্যতম সদস্য, তাঁর বাড়িওয়ালার ছেলে হাবলুর কাছ থেকে ঝাকানাকা সিরিজের শাঁসালো একটা বই বাগিয়েছেন, সেটা নিয়েই তিনি তাঁর চিলেকোঠার সামনে খোলা ছাদে মাদুর বিছিয়ে যোগাসনে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলেন। বইটার নামটাও রীতিমতো রোমহর্ষক, 'খানবাহাদুর হত্যা রহস্য।' প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে ইয়া মোটাসোটা মোচওয়ালা এক ভদ্রলোক, তিনিই সম্ভবত খানবাহাদুর, কারণ তিনি উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন আর তাঁর পিঠে খাসি কাটার একটা খাসা ভোজালি খুব নৃশংস ভঙ্গিতে বিঁধে আছে। গুল মোহাম্মদ নিজের মুখে একমুঠো ছোলা গুঁজে দিয়ে সবেমাত্র প্রথম পাতায় চোখ রেখেছেন, এমন সময় তিনি সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেলেন। স্যান্ডেলের বিচ্ছিরি খসখসানির শব্দ শুনেই তিনি বুঝলেন, এটা তাঁর বাড়িওয়ালা শাহেদ সাহেবের আগমনের আলামত।

শাহেদ সাহেব প্রতি তিনদিন পর পর ভাড়ার তাগাদ দিতে আসেন। গত চার পাঁচমাস ধরে গুল মোহাম্মদ বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না, কোন কেসটেস নেই তাঁর হাতে, কিন্তু সে কথা তো শাহেদ সাহেব বুঝতে রাজি নন। আজকেও তিনি ছাদে গুল মোহাম্মদ দেখার সাথে সাথে ঘ্যানর ঘ্যানর করা শুরু করলেন।

'না না না গুল মোহাম্মদ সাহেব, এ আপনার ভারি অন্যায়। আপনি কি আমাকে না খাইয়ে মারতে চান?' নাকি গলাটাকে বাজখাঁই করে তোলার একটা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার বৃথা চেষ্টা নিয়ে বলেন তিনি।

গুল মোহাম্মদ বইটা বন্ধ করে উঠে বসে বলেন, 'কেন? আমার কি আপনাকে খাইয়ে দেবার কথা?' যুৎসই কথাটা বলেই গোয়েন্দা ঝাকানাকার মতো একটু মুচকি হাসি হেসে গোঁফে তা দেন তিনি, যদিও তাঁর গোঁফ নেই।

এ কথা শুনে, আর হাসিটা দেখে, আর নেই মোচে তা দেয়ার ভঙ্গি দেখে শাহেদ সাহেব আরো চটে যান।

'পাঁচমাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে আছে ভাই সাহেব। পাঁচ দুগুনে দশ হাজার টাকা। অমন দশাসই অঙ্কের টাকা আপনি বাকি বকেয়া ফেলে রেখেছেন।' বকেয়া নিয়ে বকে যান তিনি। 'দশ হাজার টাকা নগদানগদি হাতে পেলে কত কিছু করা যায়, জানেন? আমারও তো ঘর সংসার আছে, ছেলেপুলের পড়াশোনার খরচ আছে, কলাটামূলোটাকচুটা খাবার খরচ আছে ---।' তিনি এক গাদা খাতে টাকা পয়সার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে যান, আর গুল মোহাম্মদ মাথা চুলকাতে থাকেন। শাহেদ সাহেবের মুখে কলা, মূলো এবং কচু খাবার কথা শুনে তাঁর কেমন কেমন যেন লাগে। এই খাদ্যদ্রব্যগুলো কি নিতান্ত দরিদ্র লোকেরই ভোগ্যবস্তু নয়? শাহেদ সাহেব কি মুরগি-গরু-খাসির গোস্ত ফেলে এগুলো খাবার জন্যে অতটাই লালায়িত? দশ হাজার টাকার কলা, মূলো এবং কচু তো পাড়াপড়শি সবাই মিলেও খেয়ে শেষ করতে পারবে না। তাছাড়া, এত কলার খোসা, মূলোর ডগা এবং সর্বোপরি কচুর ভগ্নাবশেষ তাঁর গোয়েন্দাদৃষ্টি এড়িয়ে যাবে কোথায়?

ওদিকে একটানা বকে বকে এক পর্যায়ে হাঁপিয়ে গিয়ে শাহেদ সাহেব একটু দম নেবার জন্যে থামেন, তখন গুল মোহাম্মদ গম্ভীর মুখে বলেন, 'আপনার জীবনে কোন রহস্য নেই?' এটাই তাঁর মোক্ষম অস্ত্র, বার্টার নীতিতে, মালের বদলে মাল লেনদেনেই তিনি বিশ্বাসী।

অমনি শাহেদ সাহেব ভারি চটে যান। 'আপনি পেয়েছেন কি? রহস্যের সমাধান করে আপনি দশ হাজার টাকা শোধ করবেন? না ভাই, আমার জীবনে অ্যাতো বড় রহস্য কোনদিন ছিলও না, আজো নেই। তবে আপনি এই হারে ভাড়া বাকি ফেলা শুরু করলে দু'দিন পর একটা রহস্য গজাবে। সেটা হলো গিয়ে, আমি কিভাবে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে বাঁচবো? আপনি যদি ঐ রহস্য জন্মানোর আগেই সমাধান করতে চান, আমার বাড়ি ভাড়া শোধ করে দিন, ল্যাঠা চুকে যাবে।'

গুল মোহাম্মদ আবার থমকে যান। এহহে। ব্যাপারটার মধ্যে কেমন একটা প্যাঁচ বোধ করতে থাকেন তিনি। রহস্য সমাধান করলে তিনি টাকা পাবেন, কিন্তু সে টাকা আবার সমাধানের পেছনেই বেরিয়ে যাবে। তা হলে ঐ রহস্য সমাধান করার কি দরকার, থাক না সেটা অমনি পড়ে? গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা দেখতে পান তিনি। শাহেদ সাহেব সরকারী চাকরি করতেন বলেই বোধহয় সোজা জিনিসক পেঁচিয়ে এতো জটিল করতে পারেন। তাছাড়া, তাঁর ধারণা, শাহেদ সাহেব ভারি অপয়া মানুষ, কারণ এই লোকটার বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে আসা ইস্তক গুল মোহাম্মদ সমস্যার মধ্যে আছেন, কোন কেসটেস জুটছে না তার।

গুল মোহাম্মদ শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেন, ভারি হতাশার একটা শ্বাস ফেলে বলেন, 'আচ্ছা ঠিক আছে। আগামী সোমবার, মাসের শুরুতে আপনাকে বাড়ি ভাড়া কড়ায় গন্ডায় চুকিয়ে দেবো। দরকার হলে আমার কাপড়জামা বাসনকোসন, এমনকি বদনা অবধি মহাজনের কাছে বন্ধক দেবো, তবুও আপনার পাই পয়সা বাকি ফেলবো না। আপনি এবার খুশি?'

শাহেদ সাহেবের গোমড়া কালো মুখে খুশির আলো ফোটে। 'আচ্ছা আচ্ছা, অত কিছু করতে হবে না, তবে নিতান্ত যদি বন্ধক দিতেই হয়, আমার চেনা মহাজন আছে, আপনাকে আলাপ করিয়ে দেবো নাহয়।' আনন্দিত গলায় বলেন তিনি। 'তা কী করছেন এই রোদে শুয়ে শুয়ে?' বলতে বলতে তাঁর নজর পড়ে গুল মোহাম্মদের হাতে ধরা বইটার দিকে। 'অ্যাঁ? আপনিও পড়ছেন বইটা? খানবাহাদুর হত্যা রহস্য?' চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি। গুল মোহাম্মদ খানিকটা লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করে সাফাই গাইতে যান, কিন্তু তার আগেই শাহেদ সাহেব বকতে থাকেন, 'ওফ, বেড়ে একখানা বই লিখেছে নিঝুম পুরী। সেদিন আমার হাবলুর কাছ থেকে নিয়ে পড়লাম। পড়ে আমার রাতে এমন কষে ঘুম হয়েছে, কী বলবো? পড়ে দেখুন, আপনারও হবে। প্রথম খুনটার কথা কী বলবো ভাইসাহেব, দারুণভাবে করেছে লোকটা। তবে মাঝে মাঝে গা ছমছম করে ওঠে, বুঝলেন, বিশেষ করে যখন খানবাহাদুরের খুনী দ্বিতীয় খুনটা করে ---।'

'নাআআআআআআআআ!' গুল মোহাম্মদ আঁতকে ওঠেন। 'প্লিজ, প্লিজ! বলবেন না। গল্পের মাঝখানটা বলে দিলে গল্প পড়ার মজা পনেরো আনা নষ্ট হয়ে যায়, তা আপনি জানেন না?'

শাহেদ সাহেব এই কথা শুনে মোটেও বিচলিত হন না। 'আরে সাহেব, কিসের মজা নষ্ট? আপনি শুনে রাখেন আমার কাছ থেকে। এতে করে আপনার বাকি অর্ধেক পড়ার জন্যে একটা প্রিপারেশন হবে ---।' তিনি আবার মুখ খোলার আগেই গুল মোহাম্মদ চোখের পলকে উঠে দাঁড়ান। শাহেদ সাহেব একটু ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যান, বেলি্লক গোয়েন্দাটা না আবার তার ওপর হামলা চালায় ভেবে, এই ফাঁকে গুল মোহাম্মদ তাঁর মাদুর ভাঁজ করে চট করে ঘরে রেখে আসেন, তারপর হাফপ্যান্টের ওপরেই প্যান্ট পরে, তাঁর দুর্ধর্ষ সবুজ টুপি মাথায় চাপিয়ে, মুখে আরও একমুঠো ছোলা গুঁজে, খানবাহাদুরের বইটাকে তাঁর ঝোলায় পুরে এক ছুটে ছাদের কার্নিশ টপকে পানির পাইপ বেয়ে একতালায় নেমে পড়েন। প্রায়ই তিনি প্র্যাকটিসের জন্যে পাইপ বেয়ে ওঠেন আর নামেন, এই বিদ্যেটা কখন কোন তদন্তের জন্যে কাজে লাগে কে জানে? শাহেদ সাহেব প্রথমটায় ভেবেছিলেন গুল মোহাম্মদ বুঝি আত্দহত্যা করতে যাচ্ছেন, কিঞ্চিৎ সন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিলেন অবশেষে চিলেকোঠাটা খালি হলো ভেবে, আবার পুলিশকে সামলানোর জন্যে টাকাপয়সা খরচ হবে ভেবে খানিকটা মুষড়েও পড়েছিলেন, তিনি যখন দেখলেন গুল মোহাম্মদ বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে মোড়ের দিকে চলছেন, মনে মনে ভারি চটলেন।

২.

গুল মোহাম্মদ ছুটতে ছুটতে ভাবছিলেন, কোথায় নিরিবিলি শুয়ে শুয়ে বইটা রসিয়ে রসিয়ে পড়ে শেষ করা যায়। নিজের ঘরে যখন টিকতে পারলেন না, অন্য কারো বাসায় গিয়ে পড়ার ভরসা তাঁর নেই। দেখা যাবে যাঁর কাছে যাবেন, সে-ই বইটার অর্ধেক কাহিনী বলে দিচ্ছে। ভারি মুশকিল।

মোড়ের পাতিমুদি দোকানদার আক্কাস আলির দোকানের সামনে একটা বেঞ্চ আছে। কথাটা মনে পড়তেই গুল মোহাম্মদ সেদিকে হনহন করে এগোলেন। বেঞ্চটা ছায়ায় পেতে, ঝোলাটা মাথার নিচে গুঁজে তিনি আরাম করে শুয়ে পড়তে পারবেন। যাক, হাতের কাছেই একটা নিরিবিলি জায়গা পাওয়া গেলো।

চৈত্র মাসের দুপুর বেলা, চারিদিকে আগুন হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, রাস্তা শুনশান, শুধু মাঝে মাঝে পাড়ার দস্যি ছেলেরা সেখানে হৈহৈ করে ছুটে যাচ্ছে। আক্কাস আলির দোকানের পাশে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, সেখানে একটা কাক ছায়ায় বসে ঝিমুচ্ছে। গুল মোহাম্মদ এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসেন বেঞ্চের ওপরে, তারপর গামছা দিয়ে মুখ মোছেন। কাকের অভ্যেস জানেন তিনি, তাই একবার পরখ করে নেন, কোনভাবে তাঁর মাথার ওপর কাকের বসার মতো জায়গা আছে কি না। তাঁকে মাথা নাড়তে দেখে কাকটা কর্কশ গলায় একটা ডাক দিয়ে উড়ে চলে যায়।

হঠাৎ গুল মোহাম্মদের মাথায় কাব্য ছলাৎ করে ঘা মারে, নিমেষে একটা চার লাইনের পদ্য বানিয়ে ফেলেন তিনি, যেমনটা তিনি আগে কখনো হাজার চেষ্টা করেও মেলাতে পারেননি। ভারি অবাক হয়ে যান তিনি, ব্যাপারটা একটা নূতন রহস্য বলে ঠ্যাকে তার কাছে। নিজের মনে লাইন চারটা খানিক গুনগুন করে দোকানে বসা আক্কাস আলিকে ডেকে বলেন তিনি, 'কি আক্কাস ভাই, একটা পদ্য শুনতে চাও?'

আক্কাস আলি খানিকক্ষণ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে গুল মোহাম্মদের দিকে, তারপর গুরুগম্ভীর অমুদিসুলভ গলায় হেঁকে বলে, 'বলেন, শুনি।'

গুল মোহাম্মদ গলা খাঁকরে চোখ বুঁজে একটা হাত তুলে শুরু করেন:

চৈত্র মাসের দুপুর বেলা, আগুন হাওয়া বয়
দস্যি ছেলে ঘুরে বেড়ায় সকল পাড়াময়
কাকেরা সব ছায়ায় বসে এদিকসেদিক চায়
শুকনো গলায় ডাকছে, কা কা, হঠাৎ উড়ে যায়।

আক্কাস আলি আরো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, 'তো?'

গুল মোহাম্মদ ঘাবড়ে গিয়ে বলেন, 'না, মানে, এটা এইমাত্র বানালাম মনে মনে, তাই ভাবলাম তোমাকে শোনাই ---।'

আক্কাস আলি আরো গম্ভীর হয়ে বলে, 'এইটা আপনে এখন বানাইলেন?'

গুল মোহাম্মদ মাথা ঝাঁকান।

আক্কাস আলি হঠাৎ চটে ওঠে। 'বিটলামির আর জায়গা পান না? এইটা তো আমার পোলার ইস্কুলের বইতে লেখা আছে!'

গুল মোহাম্মদের সহসা মনে পড়ে যায়, সত্যিই তো, এমন একটা ছড়া ইস্কুল আমলেই পড়েছিলেন তিনি। সেজন্যেই বোধহয় অত চটজলদি মাথায় খেলে গেলো, নইলে এমন ছন্দ তো তিনি কখনোই মেলাতে পারেন না! মাথায় চিড়বিড় করতে থাকা রহস্যের সমাধান করতে পেরে খুশি হয়ে ওঠেন তিনি, বলেন, 'হ্যাঁ, তাই তো!'

আক্কাস আলি ক্ষেপে ওঠে, 'আরে ভাই, আরেক লোকের কবিতা নিজের নামে চালাইতাছেন ক্যা?'

গুল মোহাম্মদ থতমত খেয়ে বলেন, 'না না, এটা আমার না, আমি অন্য আরেকটা বানিয়েছি।'

আক্কাস আলি চোখ সরু করে বলে, 'তাই নাকি? বলেন দেখি?'

গুল মোহাম্মদ একটু বিব্রত হয়ে বলেন, 'এটা ইংরেজিতে।'

আক্কাস আলি চুপ করে যায়।

নিজের তীক্ষ্ম বুদ্ধির দৌড় দেখে গুল মোহাম্মদ মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে দেন। তারপর বেঞ্চের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে, ঝোলাটা মাথার নিচে গুঁজে দিয়ে, আয়েশ করে বইটা খুলে বসেন। খানবাহাদুর খুন হয়ে গেছেন, ওদিকে বাসাভর্তি লোকজন, তাদেরই কেউ একজন খুন করেছে ব্যাটাকে। সবার সন্দেহ গিয়ে পড়েছে খানবাহাদুরের আদরেআহ্লাদেবখেযাওয়া ভাগ্নে ঈমান পাশার ওপর। কেবল ঈমানই এমন বেঈমানের মতো পাশবিক একটা খুন করার লায়েক, অন্য কেউ নয়। খুনের মোটিভও নিশ্চয়ই আছে, একটু ভালো করে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। পুলিশও তাকে খুব করে চেপে ধরেছে, রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে প্যাঁদানোর হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু ঈমান পাশা রোজ সকালে বারবেল ভাঁজে, ছোলা খায়, পুলিশের মারকে সে থোড়াই কেয়ার করে, সব হুমকির মুখে সে কেবল হো হো করে হাসে, আর গম্ভীর হয়ে একটা কথাই বারে বারে বলে, 'আমি কিছু জানি না, অ্যান্ড আই ডোন্ট কেয়ার!'

কাজেই গোয়েন্দা ঝাকানাকাকে খবর দেয়া হলো।

হঠাৎ আক্কাস আলি বলে ওঠে, 'কী, এই বইখানও কি আপনের লেখা?'

গুল মোহাম্মদ ধড়ফড় করে উঠে বসেন। 'অ্যাঁ? আরে না, এটা নিঝুম পুরীর লেখা গোয়েন্দা ঝাকানাকা সিরিজের "খান বাহাদুর হত্যা রহস্য!"'

আক্কাস আলি এগিয়ে আসে। 'কন কী? আপনিও পড়তাছেন এইটা? আরে, জব্বর কাহিনী, বুঝলেন? আমি তো কাইল সারারাইত ধইরা জাইগা পইড়া শ্যাষ করছি এইটা!'

গুল মোহাম্মদ খানিকটা শঙ্কিত হয়ে বলেন, 'ওহ, তাই!'

আক্কাস আলি আরো এগিয়ে আসে। 'কদ্দূর পড়ছেন, দেখি? মাত্র বারো লম্বর পৃষ্ঠা? এহহে! অহনও খেইল শুরু হয় নাই। ঈমান পাশা এই খুন করে নাইক্কা। কিন্তু ঝাকানাকা তারে ধইরা এমন ধোলাই দিছে, যে সে কবুল করছে, সে-ই গলা টিপ্যা মামুরে খুন করছে। কিন্তুক ঝামেলা হইলো, খান সাবেরে তো গলা টিপ্যা মাঠার করা হয় নাই, করা হইছে একটা চাক্কু দিয়া! তখন গোয়েন্দা ভাইজান ---।'

গুল মোহাম্মদ এক সেকেন্ডও দেরি করেন না, বইটা চোখের পলকে ঝোলায় ভরে, দুকানে আঙুল দিয়ে নক্ষত্রবেগে ছুট লাগান।

৩.

তেলেভাজার দোকানী কলিমুদ্দির কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা বাকি ফেলেছেন গুল মোহাম্মদ। কিন্তু রোজই তার দোকানে গিয়ে তেলেভাজা খান তিনি, নইলে তাঁর সন্ধ্যেটাই আলুনি ঠ্যাকে। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, আক্কাস আলির হাতে বিপুল সময় থাকায় সে তার স্কুলপড়ুয়া ছেলের পাঠ্যবই থেকে শুরু করে নিঝুম পুরীর রহস্যরোমাঞ্চোপন্যাস সবই পড়তে পারছে। কিন্তু কলিমুদ্দি মহা ব্যস্ত মানুষ, হাজারটা কাজ তার, সে কখনো এই জাতীয় বই পড়ে সময় নষ্ট করবে না। কাজেই ওর দোকানের নিরালায় বসে বইটাকে শেষ করাটাই সঙ্গত ঠেকে তাঁর কাছে। তিনি হনহনিয়ে যথাযথ দিকে রওনা দেন।

দোকানে ঢুকতে না ঢুকতেই কলিমুদ্দি হাঁ হাঁ করে ওঠে, 'গোয়েন্দা ভাই, আপনের বিল ---।'

গুল মোহাম্মদ হাত নাড়েন। 'দিয়ে দেবো, অত জলদি কিসের? আর আজকে মাসের কত তারিখ খেয়াল আছে? মাস শেষে পয়সা চাও কেন? মাসের শুরুতে চাও না কেন?'

কলিমুদ্দি গম্ভীর গলায় বলে, 'আইজকা ছয় তারিখ।'

গুল মোহাম্মদ ভারিক্কি চালে বলেন, 'দুপাতা ইংরেজি পড়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছো মনে হচ্ছে? সব কিছু খালি ইংরেজিতে মাপো? বাংলা মাসের শুরুতে তোমার বিল শোধ করে দেবো না হয়।'

কলিমুদ্দি মাথা চুলকায়, বাংলা মাসের হিসাব রাখা তার জন্যে ভারি শক্ত কাজ, জানেন গুল মোহাম্মদ। নিজের পিঠ আরেক দফা চাপড়ে দিয়ে তিনি ধপ করে একটা বেঞ্চে বসে পড়েন, তারপর সন্তর্পণে ঝোলা থেকে বইটা বের করে পড়া শুরু করেন। হারামজাদা আক্কাস আরেকটু হলেই দিতো বইটার মজা মাটি করে। পড়তে থাকেন তিনি বারো নাম্বার পৃষ্ঠা থেকে।

আসলেই, গোয়েন্দা ঝাকানাকা অকুস্থলে এসে দুয়েকটা সূত্র যাচাই করে কেন যেন হঠাৎ ক্ষেপে গেলেন, পকেট থেকে একটা পাটের দড়ি বের করে ঈমান পাশার হাত পা কষে বাঁধলেন, তারপর তার মুখে নিজের পা থেকে খুলে নেয়া একটা ময়লা মোজা গুঁজে দিয়ে কোত্থেকে একটা কাঠের রুলার যোগাড় করে এনে সেটা দিয়েই আচ্ছা করে শুয়োরপেটা পেটালেন তাকে। মারের চোটে ঈমান পাশার সব স্মার্টনেস হাওয়া হয়ে গেলো, সে কিছুক্ষণ মাটিতে কইমাছের মতো লাফঝাঁপ দিয়ে অবশেষে মরার মতো পড়ে রইলো। তারপর তার মুখ থেকে মোজা খুলে নেয়ার সাথে সাথে সে স্বীকার করলো, সে নিজের হাতে তার মামা ওরফে খানবাহাদুর চমনকুমারকে গলা টিপে খুন করেছে।

কিন্তু চমনকুমারের গলায় কোন দাগদুগ নেই, বরং পিঠের ওপর একটা পেল্লায় সাইজের ভোজালি আমূল বিদ্ধ!

এটুকু পর্যন্ত পড়েই গুল মোহাম্মদের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগে। ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তাহলে? অনেক বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, তাঁর ক্ষিদে পেয়েছে। সেই কখন কিছু ছোলা খেয়েছেন, এখন ঝাঁ ঝাঁ দুপুর, কিছু খেতে হবে। কিন্তু কলিমুদ্দির তেলেভাজার দোকানে পুরিসিঙ্গারা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। সাতপাঁচ ভেবে তিনি হাঁক ছেড়ে জুম্মনকে ডাকেন, দুটো সিঙ্গারার অর্ডার দেন।

অবিলম্বে জুম্মন ছোকরা একটা স্টিলের প্লেটে দুটো গরমাগরম সিঙ্গারা আর জঘন্য চেহারার কমলা রঙের নামকাওয়াস্তে তথাকথিত সস নিয়ে হাজির হয়। প্লেটটা নামিয়ে রেখে তাকে চলে যাওয়ার ইশারা করেন গুল মোহাম্মদ, কিন্তু জুম্মন দুপাটিতে বত্রিশখানা দাঁত বায়ুমন্ডলে বার করে রাখে।

'কী হলো?' ভুরু কুঁচকে বলেন গুল মোহাম্মদ।

'হে হে, এই বই পড়তাছেন?' জুম্মন হাসে।

'তাতে তোর কী? যা ভাগ!'

'জোস বই, স্যার! আমিও পইড়া ফালাইছি!' জুম্মন আরো হাসে।

গুল মোহাম্মদ আঁতকে ওঠেন। 'বলিস কী?' প্রমাদ গোনার প্রস্তুতি নেন তিনি।

'হ স্যার। এই সময় তো কোন কাম থাকে না, দোকানে বইসা বইসা বই পড়ি।' জুম্মন খুশির চোটে গড়িয়ে পড়ে, কেন কে জানে।

'ভালো করিস। এখন ফোট!' গুল মোহাম্মদ সিঙ্গারায় কামড় দেন।

জুম্মন কিন্তু আপনাআপনি ফোটে না, গুল মোহাম্মদের জন্যে সে তার পাঠকহৃদয় কুসুম বিকশিত করে তোলে একেবারে। 'আপনাগো স্যার, ইশটাইলই আলাদা।'

'আমাদের কোন ইশটাইল?' গুল মোহাম্মদ ক্ষেপে ওঠেন, জুম্মন তাঁর নিখরচায় রোজ রোজ সিঙ্গারাসেবনের দিকে কটাক্ষ করছে ভেবে।

'মানে স্যার, গোয়েন্দাগো কামকারবার স্যার।' জুম্মন শুদ্ধিপত্রে প্রকাশ করে।

'কেন, কী করেছি আমি?' গুল মোহাম্মদ নিজের গোয়েন্দাসুলভ ইশটাইল সম্পর্কে সচকিত হয়ে ওঠেন।

'আপনে আর কী করবেন, কিছুই করেন নাই। মাগার, এই ঝাকানাকা ভাইসাব, কঠিন পাবলিক স্যার! ঈমান পাশা নামের এক মস্তানরে বাইন্ধা এমন কচুয়া মাইর লাগাইছে, ঐ হালায় কানতে কানতে স্বীকার গেছে স্যার, সে নাকি নিজেই গলা চাইপ্যা তার মামুরে ফিনিশ কইরা ফালাইছে! কিন্তুক, মামু হালায় তো ছেনির কোপ খায়া মরছে। তারপর, বুঝলেন স্যার, আপনারে আর কী কমু, আপনে নিজেও তো গোয়েন্দা, ঝাকানাকা ভাইসাবে গিয়া হেই খানবাহাদুরের ভাইস্তারে শুরু করলো মাইর। ঐ হালায় আবার এক মন্ত্রীর শালা, কিন্তুক ঝাকানাকা এইসব মন্ত্রীপেসিডেন্টগো পোঁছে না স্যার, তারে মাইরা ভর্তা বানায়া তারে দিয়া কবুল করাইছে, যে হেই ব্যাডাই খুনী। হেই ব্যাডা নিমকহারাম ভাইস্তা তখন কয় কি, হ্যায় নাকি নাইনশুটার দিয়া গুলি কইরা মারছে তার চাচারে ---।'

গুল মোহাম্মদ একটা সিঙ্গারা প্রায় শেষ করে এনেছিলেন, পরবর্তীটাকে বগলদাবা করে ঝেড়ে দৌড় মারেন তিনি, তবে তার আগে বইটাকে ঝোলায় পুরে নিতে ভোলেন না।

৪.

পার্কে শুয়েই বইটা পড়া শেষ করতে হবে, ভাবলেন গুল মোহাম্মদ। পার্কটা এখান থেকে মোটামুটি দূরে, কাজেই জোর হাঁটা শুরু করলেন তিনি। এ কী ঘোর বিপর্যয় তাঁর সামনে, জুম্মন পর্যন্ত তাঁর আগে এই বই পড়ে শেষ করে ফেলেছে।

পথে পিন্টুর সাথে দেখা হলো তাঁর, ঝট করে টুপিটা খুলে মুখ আড়াল করলেন তিনি, পিন্টু নিঃসন্দেহে বইটা পড়ে ফেলেছে, এবং তাঁর সাথে দেখা হলেই এটার আরো খানিকটা তাঁকে শুনিয়ে দেবে সে। কোন দরকার নেই। পিন্টুকে পাশ কাটিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে যান তিনি।

খানিক বাদে মিন্টুকেও একই কায়দায়, ক্যামোফ্লেজের মাধ্যমে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে সামনে এগিয়ে যান তিনি। তবে পিন্টু আর মিন্টুর মধ্যে দেখা হওয়ার পর তাদের কথোপকথনটা তিনি শুনতে পান না।

মিন্টু জানায়, গুলু ভাইয়ের মাথা পুরোপুরি আউট হয়ে গেছে। আজ সকালে নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার জন্যে খুব লাফাচ্ছিলো, হাবলুর বাবা না থাকলে এতক্ষণে আঞ্জুমানে মফিদুলে খবর দিতে হতো। আর আক্কাস আলির দোকানে গিয়েও খুব উৎপাত করেছে, ইস্কুলের বই থেকে কি কি যেন মুখস্থ বলা শুরু করেছিলো।

পিন্টু জানায়, তারও সেরকমই ধারণা। একটু আগে সে দেখেছে, কলিমুদ্দির দোকানে ঢুকে জুম্মনের একটা ইন্টারভিউ নিয়েছে গুলু ভাই। তারপর কি একটা জিনিস কেড়ে নিয়ে দোকান থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে বেরিয়ে এসেছে। তাকে দেখে টুপির আড়ালে আত্মগোপন করতে গিয়েছিলো ব্যাটা, কিন্তু টুপিটা যে তার শরীরের মাপে না বানিয়ে মাথার মাপে বানানো হয়েছে, এই কথাটাই লোকটার মনে ছিলো না।

ওদিকে আধঘন্টা হনহনিয়ে হেঁটে পার্কে পৌঁছে একটা পরিচ্ছন্ন বেঞ্চ খুঁজে নিয়ে ঝোলাটা মাথায় গুঁজে বইটা খুলে বসেন গুল মোহাম্মদ, আর আপন মনে গজরাতে থাকেন। এই জুম্মনটাও এই সব বই পড়া শুরু করে দিয়েছে? বখে যাবার আর বাকি রইলো কী তবে?

পড়তে পড়তে গুল মোহাম্মদ আবিষ্কার করেন, কথা সত্য, গোয়েন্দাদের ইশটাইলই আলাদা। ঝাকানাকা ঈমান পাশাকে পেঁদিয়ে তার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করেও সন্তুষ্ট হন না, কী আরেকটা সূত্র যাচাই করে তিনি এবার খানবাহাদুর চমনকুমারের ভ্রাতুষ্পুত্র খাজা খরমুজ মোহান্তের ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়েন। তাঁর নির্দেশে পুলিশ খাজা খরমুজ মোহান্ত, যে কি না দেশের তৎকালীন ছাগলসম্পদ মন্ত্রীর নিতান্ত আপনজন, চরম কুটুম্ব, পিছমোড়া করে বাঁধে, তারপর তাঁকে ফ্যানের হুকের সাথে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর ঝাকানাকা একটা রুমাল পাকিয়ে ঠাস ঠাস করে মারতে থাকেন মোহান্তের মুখে। প্রথম প্রথম মোহান্ত খুব চোটপাট করছিলো, থানার ওসিকে নাকি সে খাগড়াছড়ি বদলি করে দেবে, ঝাকানাকাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ধরে নিয়ে গিয়ে এই প্যাঁদানির শোধ নেবে, কিন্তু আধ ঘন্টা ধোলাই দেবার পর সে সুর পাল্টায় এবং স্বীকার করে, কথা সত্য, সে নিজে একটা নাইনশুটার দিয়ে নয়টা গুলি গুনে গুনে করেছে চাচার পেটে। ব্যাপারটা খানিকটা অবিশ্বাস্য, কারণ মোহান্ত নয় পর্যন্ত গুনতে জানে, এই কথাটা কেমন যেন জল মেশানো।

কিন্তু, যা আগেই জেনেছেন গুল মোহাম্মদ, নিহত খানবাহাদুর কোন গুলি খেয়ে মরেননি, বরং কে বা কাহারা ইয়াবড় একটা ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে।

এ পর্যায়ে কে যেন গুল মোহাম্মদের কানের কাছে বলে ওঠে, 'এই বাদেএএএএএম!'

মনোযোগ নষ্ট হওয়ায় চটে যান গুল মোহাম্মদ। ঘাড় ফিরিয়ে বাদামওয়ালা ছোকরাটাকে কষে ধমক দেন তিনি, 'এই দিনে দুপুরে গোল করছিস যে বড়? যা ভাগ!'

ছোকরা তবুও বাদাম সাধে তাঁকে। 'লন স্যার, বাদাম খাইতে খাইতে পড়েন।'

গুল মোহাম্মদ আড়চোখে বাদামগুলোকে খানিকটা দেখে নিয়ে বলেন, 'উঁহু, বাদাম খাওয়ার পয়সা নেই সাথে। তবে তুই যদি আমাকে দুটাকার বাদাম এমনি এমনি দিস, তাহলে তোকে এই বইটা থেকে একটা গল্প শোনাতে পারি।'

বাদামওয়ালা ছোকরা হো হো করে হাসে। 'কী যে কন স্যার!'

গুল মোহাম্মদ তাকে পাল্টা প্রলোভন দেখান। 'আরে ব্যাটা, গল্প শুনতে সমস্যা কী তোর? সারাদিন ঘুরে ঘুরে বাদাম বেচিস, একটা গা ছমছমে গল্প শুনলে তোর রাতে ভালো ঘুম হবে!'

এবার ছোকরা চোখ টিপে বলে, 'এই বইটা স্যার আমি অলরেডি পইড়া ফালাইছি!'

গুল মোহাম্মদের প্রায় বেঞ্চ থেকে পড়ে যাবার দশা। 'বলিস কী? তুই বই পেলি কোথায়?' কোনমতে টাল সামলে বলেন তিনি।

'বাদামের ঠোঙ্গা বানামু দেইখা এক জায়গা থেইক্কা দুই ট্যাকা দিয়া কিনছিলাম বইটা, তো মনে করলাম, ঠোঙ্গা বানানের আগে একটু পইড়া দেহি কী লিখছে। --- জব্বর একখান বই স্যার, দুই লম্বর খুন যখন হয়, ঝাকানাকা ভাইজানের তো মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা! যারে সে প্রথমে ভাবছিলো খুনী, হেই ঈমান পাশারে কে জানি আইসা গলা টিপ্যা মাইরা রাইখা গেছে। বুইঝ্যা দ্যাহেন স্যার, এমুন জোয়ান লোকরে গলা টিপ্যা মারতে পারে, কে সেই তালেবর ---?'

সেই তালেবরের পরিচয় বলে দেয়ার আগেই গুল মোহাম্মদ বিকট একটা চিৎকার দেন, তারপর ঝোলার মধ্যে বইটা পুরে কষে একটা দৌড় দেন পার্কের কোণাকুণি রাস্তা ধরে।

৫.

ঝুম বৃষ্টি নামে। গুল মোহাম্মদ বুঝতে পারেন, এই বৃষ্টিতে তিনি বাইরে ঘোরাঘুরি করতে পারবেন না। শুধু তাই না, তিনি পার্কে একটু শান্তিমতো শুয়ে বইটা পড়তে পারবেন না, বাদামবাজ ছোকরাটা তাঁকে তাড়া করে সেই ঈমানঘাতী তালেবরের পরিচয় শুনিয়ে ছাড়বে। কলিমুদ্দির দোকানে বৃষ্টির সাথে তেলেভাজা বেশ জমতো, কিন্তু জুম্মন রাসকেলটা তাঁকে ছাড়বে না, গল্পের আরো খানিকটা শুনিয়ে দেবে তাঁকে, মন্ত্রীর শালাদের লাঞ্ছিত হবার গল্প শোনানোর এমন সুযোগ কি জুম্মন ভবিষ্যতে আর কখনো পাবে? আক্কাস আলির দোকানের বাইরে সেই বেঞ্চটায় বসার আর জো নেই, বৃষ্টিতে একেবারে কাকভেজা হয়ে যাবে সেটা, আর যদিও বা না যায়, আক্কাস আলি তাঁর সর্বনাশ করে ছাড়বে, গল্পের মুখরোচক সব অংশ মাটি করে ছাড়বে। এর মানে হচ্ছে, আবার তাঁকে সেই হতচ্ছাড়া হাবলুর বাবা শাহেদ সাহেবের বাড়ির চিলেকোঠাতেই ফিরে যেতে হবে। কিন্তু বাড়ি ফেরা মাত্রই শাহেদ সাহেব উজিয়ে এসে খুনীর নামটা বলে দেবেন, গল্পের মজাটাই নষ্ট করে দেবেন, শালা!

এর কী সমাধান?

চটজলদি গুল মোহাম্মদের উপমহাদেশখ্যাত মস্তিষ্কে একটা বুদ্ধি খেলে যায়, তিনি হুঙ্কার ছেড়ে একটা রিকশা ডাকেন। এক বাচ্চা ছোকরা, সারা গায়ে পলিথিন জড়ানো, ভারিক্কি চালে প্যাডেল মেরে হাজির হয় তাঁর সামনে। তিনি রিকশায় চড়ে বসেন, হুডটা তুলে দেন, একটা ক্যানভাস টেনে নেন শরীরের ওপর, তারপর ঝোলা থেকে বইটা বের করে তাঁর বাসস্থানের ঠিকুজি চিনিয়ে দেন পিচ্চি রিকশাওয়ালাটাকে। তারপর পড়তে থাকেন। এই রিকশায় বসে বসেই বইটা পড়ে শেষ করবেন তিনি।

পড়তে পড়তে শিউরে ওঠেন গুল মোহাম্মদ। আশ্চর্য! ঈমান পাশাকে কে বা কাহারা গলা টিপে খুন করে রেখে গেছে। নিজের বাড়ির বৈঠকখানায় ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলো ঈমান পাশা, আর ঝালমুড়ি খাচ্ছিলো, তাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে তার বাবুর্চি, জিভ বেরিয়ে আছে, চোখ খোলা। তাড়াহুড়ো করে পুলিশে ফোন করে সে। পুলিশ আবার ফোন করে ঝাকানাকাকে। ঝাকানাকা অকুস্থলে গিয়ে কয়েকটা সূত্র খুঁটিয়ে দেখে বাবুর্চিটার কান মলে দিয়ে গালে কষে একটা থাপ্পড় মারেন। তিনি বলেন, এমন নিম্নমানের ঝালমুড়ি কাউকে খেতে দেয়া হলে সে নিঃসন্দেহে দম আটকে মরবে, ঈমান পাশা তো আর এক্কাগাড়ির সাথে জুতে দেয়া ঘোড়া নয়, যে যা সামনে পাবে তা-ই গিলে খাবে, তারও তো একটা রুচিবোধ আছে। বাবুর্চিকে আরেকটা থাপ্পড় মারতে যাবেন ঝাকানাকা, এমন সময় পুলিশের ডাক্তার ঘোষণা করে, ঈমান পাশাকে মুড়ি খাইয়ে নয়, বরং গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে, তার গলায় স্পষ্ট দাগ দেখা যাচ্ছে, যা কোন ঝালমুড়ির পক্ষে গলার ভেতরে অবস্থান করে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।

ঝাকানাকা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন, আরো দুয়েকটা সূত্র আরো ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে তিনি ছুটে যান খাজা খরমুজ মোহান্তের বাড়িতে। সেখানে সুইমিং পুলে এক লাস্যময়ী তরুণীর সাথে একটা লাল প্লাস্টিকের হাফপ্যান্ট পরে সাঁতার কাটছিলো মোহান্ত, ঝাকানাকা তাকে চুলের মুঠি ধরে সুইমিং পুল থেকে বেড়ালছানার মতো টেনে তুলে আনেন, তারপর সেই লাস্যময়ীর সামনেই পেঁদিয়ে মোহান্তকে একশা করে ছাড়েন। মোহান্ত প্রথমটায় খুব তড়পাচ্ছিলো, বলছিলো ঝাকানাকার পেছনে নাকি মাফিয়া লেলিয়ে দেবে, বম্বের গুন্ডাসর্দার দাউদ আব্রাহাম নাকি তার ছোটবেলার বন্ধু, ইত্যাদি, কিন্তু কুলাতে না পেরে অবশেষে ভেজা বেড়ালের মতো মোহান্ত স্বীকার করে, সে-ই ছুরি দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে খুন করেছে ঈমান পাশাকে।

কিন্তু, কী আপদ, ঈমান পাশাকে তো গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে, মোটেই তাকে ছুরি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপানো হয় নি!
তখনকার মতো মোহান্তকে সেই লাস্যময়ীর কোলে ছুঁড়ে ফেলে রেখে ফিরে যান ঝাকানাকা। পরের কয়েকটা দিন নিজের ঘরে বসে দিনরাত পায়চারি করে, মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে অবশেষে ঝাকানাকা যখন প্রায় খুনীকে ধরে ফেলেছেন, তখন ফোন আসে, খাজা খরমুজ মোহান্তকে কে বা কাহারা সুইমিং পুলের পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে, তার ইয়া মোটা হাতির মতো লাশ ভাসছে পানিতে, পরনে সেই লাল প্লাস্টিকের হাফপ্যান্ট।

অমনি ঝাকানাকা অকুস্থলে ছুটে যান, তারপর সেই লাস্যময়ী তরুণী, যে কিনা তৎকালীন তামাকসম্পদ মন্ত্রীর খালাত বোন --- মোহান্ত নিজেও মন্ত্রীর আত্মীয়, তাই সে মন্ত্রীর আত্মীয় ছাড়া কারো সাথে বড় একটা মেশে না --- তাকে চুলের মুঠি ধরে পুলের সামনে নিয়ে আসেন, তারপর একেবারে দজ্জাল স্বামী যেভাবে নিরীহ বউকে পিটিয়ে নারীনির্যাতন করে, সেভাবে মেয়েটাকে আগাপাশতলা ধোলাই লাগান। সত্যি, আশ্চর্য এই গোয়েন্দাপ্রবরের ইশটাইল। মারের চোটে অস্থির হয়ে মেয়েটা স্বীকার করে, সে-ই এককেজি ইঁদুর মারা বিষ মদের সাথে গুলিয়ে খাইয়ে ঐ হাতির মতো মোটা মোহান্তকে খুন করেছে।

কিন্তু, আবারও সেই ফ্যাকড়া, কী যন্ত্রণা, মোহান্তর শরীরে বিষক্রিয়ার কোন চিহ্ন নেই, বরং তাকে যে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়, অটোপ্সিতে তার ফুসফুস ভর্তি ক্লোরিন মেশানো পানি পাওয়া গেছে।

এতটুকু এসে কাহিনী খুব জটিল মোড় নেয়, আর রিকশাটাও এক জটিল মোড় নিয়ে গুল মোহাম্মদকে হাজির করে তাঁর বাড়ির সামনে। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে।

গুল মোহাম্মদ সিদ্ধান্ত নেন, তিনি পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে যাবেন, যাতে ঐ শাহেদ সাহেব নামের বাজে লোকটার সাথে তাঁর মুখোমুখি হতে না হয়। পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে রিকশাওয়ালা ছোকরার দিকে বাড়িয়ে ধরেন তিনি।

কিন্তু ছোকরাটা চরম খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে থাকে। এই বৃষ্টির মধ্যে সে ছোটমানুষ বাতাস ঠেলে ঠেলে এতদূর প্যাডেল চালিয়ে এসেছে, কমসে কম দশটাকা ভাড়া দেয়া উচিত তাকে।

গুল মোহাম্মদ তেড়ে ওঠেন। 'বটে, পয়সা সস্তা পেয়েছিস? আর তুই তো দেখছি আগাগোড়া পলিথিনে মোড়া, বৃষ্টির মধ্যে এসেছিস তো কী হয়েছে? আর বাতাস কি ঠেলার মতো জিনিস নাকি রে ব্যাটা মর্কট? বাতাস কি ঘানিগাছের হ্যান্ডেল, যে ঠেলে বেড়াবি?'

ছোকরাটা তবুও ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে নানা যুক্তি তুলে ধরে সে। ট্যাক্সমন্ত্রী যে কী চামারের মতো নির্লজ্জভাবে দরিদ্রের লুঙ্গির গিঁটে গোঁজা যৎসামান্য পয়সা চালডালের দামবাড়িয়ে দিয়ে লুটে নিচ্ছেন, তার এক চিত্রসফল বর্ণণা দেয় সে। এবং এই মন্ত্রীর অত্যাচারের হাত থেকে টিকে থাকার জন্যে তাকে কমসে কম আট টাকা ভাড়া দিতে হবে, সাফ জানিয়ে দেয় সে, নয়তো অচিরেই তার লুঙ্গিটিও নাকি মন্ত্রী খুলে নিয়ে যেতে পারেন, কিছুই বলা যায় না।

গুল মোহাম্মদ নিজেও এই আলোচ্য মন্ত্রীটির ওপর খাপ্পা, তাঁর মনে কিঞ্চিৎ সহানুভূতি জেগে ওঠে, অতিরিক্ত একটি এক টাকার কয়েন তিনি ছোকরার দিকে বাড়িয়ে ধরেন।

রিকশাওয়ালা কয়েনটা হাতে নিয়ে সেই আলোচ্য মন্ত্রীআক্রান্ত বিপর্যস্ত লুঙ্গিটির গিঁটেই গোঁজে, তারপর বলে, 'আর দুই ট্যাকা?'
এই বাড়াবাড়িতে গুল মোহাম্মদ ক্ষেপে ওঠেন, 'ঐ গেলি, নাকি মন্ত্রী ডাকবো?'

ছোকরা এবার ঠান্ডা চোখে তাঁকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। তাঁর মাথায় চাপানো দুর্ধর্ষ সবুজ টুপি, তাঁর কাঁধের ঝোলা, তাঁর হাতে ধরা 'খানবাহাদুর হত্যা রহস্য', তাঁর পায়ের মলিন স্যান্ডেল, সবই সময় নিয়ে দেখে সে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে, 'যাইতাছিগা। কিন্তুক একখান কথা হুইন্যা রাখেন!'

গুল মোহাম্মদ তেড়ে যান তার দিকে। 'কী, কী শোনাবি তুই আমাকে?'

ছোকরাটা তাঁর হাতে ধরা বইটার দিকে ইশারা করে, তারপর বলে, 'এই বইটা কি আপনের পড়া শ্যাষ?'

গুল মোহাম্মদ খানিকটা শান্ত হয়ে বলেন, 'না, মাত্র তিরিশ পৃষ্ঠা শেষ হয়েছে, আরো পঞ্চাশ পৃষ্ঠা বাকি। কেন?'

এবার ছোকরা সন্তুষ্ট গলায় বলে, 'আর পইড়েন না।'

গুল মোহাম্মদ তেড়িয়া হয়ে বলেন, 'কেন হে বদ বালক? পড়বো না কেন?'

এবার রিকশাটা ঘুরিয়ে নিতে নিতে রিকশাওয়ালা বলে, 'মাঠারগুলি সব খান সাহেবের দ্বিতীয় পক্ষের বউ করছে!'

(সেপ্টেম্বর ১৯, ২০০৩)


মন্তব্য

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হে হে হে। টাটকা টাটকা পড়ে ফেললাম।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হু বুঝলাম...
কিন্তু চা খাওয়া কি শেষ হইছে না? এইবার তবে তোমার ঘরে বাস করে কারা রহস্যের সমাধান হউক?

বিরাট লেখা এইটা... পড়া হইলো না... কাজের ফাঁকে আসি তো... তুইলা রাখলাম... পরে পড়বো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রেনেট এর ছবি

ঘটনা কি? এক গল্প শেষ না করে আরেক গল্প নিয়ে হাজির? যান, পড়লাম না এই গল্প।
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

দ্রোহী এর ছবি

আ.সা.শি বলতো আমি নাকি খালি কুমিরের বাচ্চা দেখাই। মানে এক লেখা বারবার, বহুবার প্রকাশ করি।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি আমাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।

গুল মোহাম্মদের এই গল্প সপ্তাহখানেক আগেও একবার রয়েসয়েতে পড়েছি।

এই দিকে গতকালকের গল্পের কোন খবর নাই। আপনে মিয়া এক্কেরে.............................

(যাব্বাড়া!!!!!!!!!! সাপোর্ট করলাম ইতালিরে আর গোল দিল রুমানিয়া)


কি মাঝি? ডরাইলা?

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আপনি বলছেন এক কুমির ছানার পৌনঃপুনিক প্রদর্শনের কথা? আর আমি বলি, ছানাগুলোর আকার দেখেছেন?

আমাকে দিয়ে অ্যাত্তো বড়ো (শুধু আকারেই নয়) লেখা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে ঘোর সংশয় আছে আমার। ‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

দ্রোহী এর ছবি

ওরে ইতালিও শোধ দিয়ে দিল!!!!!!!!!!!!!!!


কি মাঝি? ডরাইলা?

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হিমু, আমার ধারণা আমার ঘরে বাস করে ক'জনা গল্পটা ওখানেও শেষ করা যায়। কিছু হলো না, কিন্তু অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। এরকম। কী জানি, বুঝিনি হয়তো। তবে স্টাইলটা দারুণ লেগেছে। প্রথম বাক্য থেকেই গল্পের কেন্দ্রে চলে যাওয়া গেছে।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

হিমু এর ছবি

হাসি ... আইডিয়াটা খারাপ না। তবে ঐ গল্পটা সামনে অনেকখানি আগে বাড়বে। ঠান্ডা আর মাথাব্যথা কাবু করে ফেলেছে আমাকে। মনে হচ্ছে আরেককাপ চা খাওয়া দরকার হো হো হো!


হাঁটুপানির জলদস্যু

দ্রোহী এর ছবি

আবার চা????????????
হো হো হো


কি মাঝি? ডরাইলা?

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হ খান। বেশি কইরা চা খান।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

গল্প অর্ধেক রাইখাই চা খাইতে যায়...
আবার অন্য গল্প দিয়া আগেরটা শেষ না কইরাই চা খাইতে যায়... হিমুরে ফুটন্ত চায়ের পুকুরে ছাইড়া দিলে কেমন হয়?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অনিন্দিতা এর ছবি

কী সাংঘাতিক! বেশী চা খাইলে আগের গল্প আর শেষ করতে পারবেন না। নতুন গল্প লিখতে থাকবেন।
আপনার মতলব কী?

ধুসর গোধূলি এর ছবি
রণদীপম বসু এর ছবি

হা হা হা ! একটানে পড়লাম। বড়ো মজা পাইলাম ! লেখায় আকর্ষণ আছে।
ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

স্পর্শ এর ছবি

দারুণ!
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আমার কষ্ট লাগতাসে গুলমোহাম্মদের নিগা। হা হাহাহা!

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অমিত আহমেদ এর ছবি

নতুন লেখা ছাড়েন মিয়া


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।