বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বুধ, ২০/০৬/২০০৭ - ৮:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানুষের মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে একটা ভাবনা ইদানীং আমাকে ভোগাচ্ছে। দেড়শো মিলিয়ন মানুষের দেশে বাস করে প্রতিদিন পত্রিকার সামনে পেছনে অন্দরে কন্দরের পাতায় পাতায় মৃত্যু সংবাদ দেখে দেখে এখন ভাবছি, কিভাবে কতজন কী ধরনের মানুষ মারা গেলে আমরা নড়েচড়ে বসি?

মানুষের মৃত্যুর বিন্যাস আমাদের মনের ওপর প্রভাব ফেলে বলে আমি বিশ্বাস করি। কালবিন্যাস আর স্থানবিন্যাসটাই মুখ্য। একক সময়ে কতজন মানুষ মারা গেলে আমরা সেটাকে একটা বড় "ঘটনা" বলে ধরে নেবো? একটা জায়গায় কতজন মানুষ মারা গেলে সেটা আমাদের মনে দাগ কাটবে? কাল আর স্থানের যৌগিক বিন্যাস আরো বেশি ছাপ ফেলবে আমাদের ওপর, নাকি?

যে ধরনের মৃত্যুর সংবাদ রোজ রোজ আমরা দেখি তার আবেদন ফুরিয়ে যায় যদি মৃত মানুষের মধ্যে আমাদের পরিচিত বা স্বজন না থাকে। সড়ক দুর্ঘটনা যতই মর্মান্তিক হোক, এখন একটা দৈনিক ঘটনা। আমরা ধরেই নিয়েছি, কিছু মানুষ কোথাও না কোথাও রোজ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবে। লঞ্চডুবির ফ্রিকোয়েন্সি সে তুলনায় অনেক কম, বছরে কয়েকবার ঘটে, তবে একসাথে মারা যায় অনেক মানুষ, কেউ তার দায় বহন করতে রাজি হয় না, হাতি-হামজা দিয়ে ডুবে যাওয়া লঞ্চ আর ডুবুরি দিয়ে ডুবে যাওয়া মানুষ উদ্ধার করা হয়, আমরা শিউরে উঠি এবং ভুলে যাই।

অভিনব কোন উপায়ে মৃত্যুর ঘটনাই আমাদের ওপর একটা চাপ তৈরি করে। গার্মেন্টসের কর্মীরা যখন বন্ধ দরজার পেছনে আগুনের বাড়িয়ে দেয়া জিভের সামনে হুড়োহুড়িতে, কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায়, কিংবা পুড়ে কয়লা হয়ে মারা যান তখন আমাদের মনে হয়, একটা কিছু করতে হবে। কী করতে হবে তা ভাবতে ভাবতে আবার বড়সড় লঞ্চডুবি বা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, আমরা শিউরে ওঠার জন্য নতুন কোন ঘটনা পাই। ভবন ধ্বসে বা বৃষ্টির তোড়ে পাহাড় গলে পড়ে জীবন্ত সমাধিস্থ হয় মানুষ, আমরা ছটফট করতে করতে ভাবি একটা কিছু করা দরকার। সময়মতো ঝড়ের খবর না জানায় সহস্রাধিক মাছ ধরা জেলে নৌকো নিখোঁজ হয়ে যায় বঙ্গোপসাগরে, আমরা আবার নড়েচড়ে বসি।

ঠিক কতজন মানুষ মারা গেলে আমাদের সয়ে থাকার প্রবণতাটা আর রয়ে থাকবে না? দেড়শো মিলিয়ন মানুষের দেশে বাস করি বলেই কি এক একটা মানুষের জীবন এত মূল্যহীন? কতজন মানুষের মৃত্যু ঘটলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ানোর দাম পরিশোধিত হয়?


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এক একটা মানুষ এক একটা সংখ্যা। হ্যা, তবে হাসিনা-খালেদারা ভিন্ন জিনিস।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

উৎস এর ছবি

মৃত্যুতে শোকাহত হওয়ার প্রক্রিয়া আপেক্ষিক। কর্তাদের টনকও তাই। কে মরছে, কেন মরেছে তারওপর নির্ভর করছে। এই যেমন তোমার উদাহরন গুলো অপঘাতে মৃত্যু। দেশে আরো হাজারো মানুষ প্রতিদিন পরিচিত কারনে মারা যাচ্ছে, যেমন ক্যান্সার, জন্ডিস, হার্টএটাক, ইত্যাদি, এগুলো সংখ্যায় অনেক বেশী বানের জল, বা লঞ্চডুবির চেয়ে, কিন্তু প্রক্রিয়াটা নাটকীয় নয় বলে চোখে পড়ে না।

হিমু এর ছবি

ঠিক অপঘাতে মৃত্যুর জন্যে নয়। আজ যদি দেশে একদিনে এক হাজার লোক ক্যান্সারে মারা যায়, এবং কোনভাবে ঘটনাটা মানুষের গোচরে আনা যায়, তাহলেও আমার ধারণা ক্যান্সার নিয়ে একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কিংবা এক হপ্তায় কোন ইউনিয়নে যদি হৃদরোগে এক হাজার লোক মারা যায়, মিডিয়াতে খবরটা আসে, তাহলেও প্রতিক্রিয়া হবে। আমরা অবচেতন মনে ভাগযোগ করে দেখি, মৃত্যুর কালভিত্তিক ঘনত্ব বা স্থানভিত্তিক ঘনত্ব। এটাই আমাদের মনে ছাপ ফেলে, এই হলো গিয়ে আমার থিসিস।


হাঁটুপানির জলদস্যু

আড্ডাবাজ এর ছবি

কোন কিছুতেই টনক নড়বে না। খবরের কাগজের পাতা উল্টাবে, খবরগুলোও চাপা পড়বে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।