মুভি অফ দা উইক: Like Father Like Son (Soshite chichi ni naru)

জিপসি এর ছবি
লিখেছেন জিপসি [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০২/১২/২০১৪ - ৩:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৬ বছর বয়সী কেইতা বসে আছে স্কুলে ভর্তি-পরীক্ষার ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে।
প্রশ্ন: তোমার প্রিয় ঋতু কোনটি? কেইতা: গ্রীষ্মকাল প্রশ্ন: গ্রীষ্মের ছুটিতে কি করেছ তুমি? কেইতা: আমি বাবার সাথে ক্যাম্পিংয়ে গিয়ে ঘুড়ি উড়িয়েছি। প্রশ্ন: তোমার বাবা কি ভাল ঘুড়ি উড়াতে জানে? কেইতা: আমার বাবা সবার সেরা।

পাশে বসে থাকা গর্বিত বাবার মুখে ফুটে উঠে আনন্দের হাসি।(ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ে ভালই মিথ্যে বলতে শিখেছে কেইতা)

টোকিওর বাসিন্দা সফল স্থপতি রিয়োতা(Ryota) পিতা হিসেবে কিন্তু অতটা খারাপ মানুষ না। পরিবারের সব অধিগম্য চাহিদাই তো মিটিয়ে এসেছে সবসময়। ক্যাম্পিংয়ে গিয়ে ছেলের সাথে ঘুড়ি উড়ানোর মত সময় তাঁর নেই কিন্তু ক্যারিয়ারের এই সুবর্ণ সময়ে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠতে হলে অন্য বিষয়াদিতে এক-আধটু ছাড় তো দিতেই হবে। আজকের সিনেমা সেই রিয়োতার একটি বিশেষ ‘ছাড়’ দেবার গল্প যেখানে পিতৃত্বের দাবি আর রক্তের সম্পর্কের দোটানায় একজন সফল পিতা কি সে হতে পারবে?

ফিল্মের মূল প্লট কিন্তু নতুন কিছুনা। একই হাসপাতালে দুটি শিশু জন্মের পরপর নানা কারণে পিতামাতা অদলবদল হয়ে বেড়ে উঠে তারপর একদিন সবাই জানতে পারে আসল সত্য যা জটিল করে তোলে পারিবারিক সম্পর্ক এমন প্লটে অনেক ভাল চলচিত্র তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছরে। তারপরও আজকের জাপানি ফিল্মটি আমি বাতি নিভিয়ে হেডফোন লাগিয়ে দ্বিতীয়বার দেখেছি চরম কৌতূহলে যার অনেকটাই একান্ত ব্যাক্তিগত। বাকি মুভিগুলি রাজনৈতিক পটভূমিতে বানানো যেখানে মাতৃত্বের আবেগটা প্রাধান্য পেয়েছে, যার বিপরীতে জাপানি মুভির চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে বাবার ইমশোনটাকেই গুরুত্ব দিয়ে। হয়ত একারণেই সংলাপের সংখ্যাও অনেক কম। কেইতা(Keita) আর রিউসেই(Ryusei) নামের ৬ বছরের দুটি বাচ্চা ছেলের নিষ্পাপ চোখের জিজ্ঞাসু চাহুনি আর দুই বিভ্রান্ত পিতার নীরবতার মাঝেই দর্শককে খুঁজে পেতে হয় অনেক প্রশ্নের উত্তর। আবহসঙ্গীতে হঠাৎ হঠাৎ বাজতে থাকা সুমধুর পিয়ানোর কর্ডে যেন হয়ে যায় বলা অনেক না বলা হৃদয়ের কথা।

রিউসেই আর কেইতা কারোরই কিন্তু পিতামাতার ভালবাসার কমতি নেই। শিখিয়ে দেয়া মিথ্যে কথা ইন্টারভিউ বোর্ডে কেইতা বলেছে কিন্তু ভাল একটা স্কুলে ভর্তি হতে হলে সেতো একটু বলতেই হয়। বাবা রিয়োতা অনেক উচ্চভিলাসি স্বপ্ন দেখে ছেলেকে নিয়ে, কঠোর নিয়মানুবর্তিতার অনুসরণ করেই তো একদিন সফল পুরুষ হয়ে উঠবে সে। রিউসেইকে অবশ্য বানিয়ে বানিয়ে ঘুড়ি উড়ানোর গল্প বলতে হয়না। তাঁর বাবা ইউদাই(Yudai) নিজ হাতেই ছেলেকে শিখিয়েছে কিভাবে ঘুড়ি বানাতে হয়। লোকটার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, বাচ্চাদের সাথে সারাদিন হুটোপুটি খেলেই যেন তাঁর দিন কেটে যায়। এতটুকু এক বাথটাবে তিনটি সন্তান নিয়ে একসাথে স্নান করার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেসেখেলে কাটাতেই সে পছন্দ করে। পেশায় ইলেক্ট্রেশিয়ান তাই বাচ্চাদের খেলনা রোবট নষ্ট হয়ে গেলে মেরামত করায় তাঁর জুড়ি নেই। রোবট নষ্ট হয়ে গেলে অবশ্য কেইতাকেও কষ্ট পেতে হয়না, বাবা নিমিষেই তাঁকে কিনে দেয় নতুন রোবট। স্নানের সময় বিশাল বাথটাব কেইতা কোনদিন শেয়ার করেনি।

হাতে সময় আছে মোটে ৬ মাস। আইনজীবীদের মতানুসারে স্কুল শুরু হবার আগেই দুটি পরিবার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নিবে তা ঠিক করাই উত্তম। রিয়োতার সাফ কথা ওই ইলেক্ট্রিশিয়ান ইউদাই যা কামায় তা দিয়ে কেইতাকে পালতে পারবে না আর তাঁর নিজ রক্তের সন্তান রিউসেইকেও ওই মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হতে দিবে না। দুটি বাচ্চাকেই নিজের সন্তান হিসেবে বড় করে তোলার মুরোদ তাঁর আছে। টাকা পয়সা যা লাগে তা ওই ইলেক্ট্রিশিয়ান নিয়ে নিক কিন্তু ন্যাটা চুকে ফেলুক।

আর ১০টা বাণিজ্যিক মুভির মত অত সহজে ন্যাটা চুকে গেলে আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।

সিনেমায় হাতে গোনা যে অল্প কয়টি চরিত্র আছে তাঁদের অভিনয় শিল্পীদের দক্ষতা দেখে চমৎকৃত হয়েছি। প্রতিটি সংলাপের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে পারিবারিক সম্পর্কের ভঙ্গুরতা আর দৃঢ়তা যেন সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রতিটি চরিত্রের মুখায়বের অঙ্গভঙ্গির অতি সামান্য হেরফেরও কিভাবে একটি সুখি পরিবারের আপনজন চিরতরে দূরে ঠেলে দেয় তা ক্যামেরাতে চমৎকার ভাবে ধারণ করেছেন নির্দেশক। পিতৃত্বের সংজ্ঞা দেয়াটা যে কতটা কঠিন তা পরিচালক সাহেব বড় মুন্সিয়ানার সাথে দেখিয়ে দিয়েছেন সিনেমার শেষ অংশে। দুটি মায়ের বুকফাটা হাহাকার যেভাবে দর্শককে কাঁদাবে সেভাবেই দুটি বাবার দোদুল্যমান সিদ্ধান্তহীনতার মুহূর্ত পীড়া দেবে অন্তরের অন্তরস্থলে। পরিচালক সাহেব কোন মেলোড্রামা না দেখিয়েই, সতর্কতার সাথে বাড়তি চরিত্রের অন্তর্ভুক্তি না করেই সাবলীলভাবে বলে গেছেন মানবতার গল্প। রক্তের সম্পর্কের টান আর তিল তিল করে গড়ে উঠা ভালবাসার সম্পর্কের দাঁড়িপাল্লায় সমান তাল বজায় রেখেই সিনেমার গল্প এগিয়ে চলে অন্তিম মুহূর্তে।

এই সিরিজের আগের পোষ্টসমুহ:

লেমন ট্রি(ইসরায়েল)
নাঙ্গা পর্বত(জার্মানি)
হান্সি(দক্ষিণ আফ্রিকা)
ওয়াজদা(সৌদি আরব)
দিয়াস দে পেসকা এন পাতাগোনিয়া (আর্জেন্টিনা)
এল বানিয়ো দেল পাপা (উরুগুয়ে)


মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

দেখতে ইচ্ছে করছে

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

জিপসি এর ছবি

দেখে ফেলুন। ভাল লাগবে।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ। বেশ লাগল রিভিউ!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

জিপসি এর ছবি

তারেক অণুর মত অত দেশ ঘুরার সুযোগ আমার নেই। তাই ঘরে বসেই দেশ-বিদেশের ফিল্ম দেখি। ছোট বেলায় ডাকটিকিট সংগ্রহ করতাম আর এখন হার্ডডিস্কে নানান দেশের মুভি জমাই। মাঝে মাঝে কিছু ফিল্ম এত ভাল লাগে যে ইচ্ছে হয় সবার সাথে সেই ভালোলাগাটা শেয়ার করতে। এটাকে রিভিউ না বলে মুভি দেখার আমন্ত্রণ হিসেবে গণ্য করাটাই শ্রেয়।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।