মুভি অফ দা উইক: হান্সি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৬/০৬/২০১৩ - ১২:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আশির দশকের একসময় দক্ষিন আফ্রিকার ব্লুমফনটেন শহরের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রে কলেজের এক অলরাউন্ড ছাত্র ছিল একাধারে রাগবি আর ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক। ক্লাসের হেড প্রিফেক্টও ছিল সে। স্কুলের হেডমাষ্টার যোহান ভলসটেড ছেলেটিকে নিয়ে অনেক আশাবাদী। ওলন্দাজ বংশোদ্ভূত অতিশয় ধার্মিক এই অবস্থাপন্ন পরিবারের বড় ছেলেটিও গ্রে স্কুলের উপরের ক্লাসের মেধাবী ছাত্র। স্কুলের ক্রিকেট টিমের অনেক জয়ে এই দুই সহোদরের ব্যাটিং নৈপুণ্য অবদান রেখেছে। টিম ক্যাপ্টেন ছোট ভাইটি একদিন হেডমাস্টারকে বলে বসল যদি একদিন সে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে খেলার সুযোগ পায় তবে স্যারকে সে প্লেনের টিকিট পাঠাবে। তখনও দক্ষিন আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ এক দেশ। কথা সেই বালকটি রেখেছিল। ১৯৯৪ সালে লর্ডসে অনুষ্ঠিত দক্ষিন আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডের সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখার আমন্ত্রণ সহ বিমানের টিকিট পৌঁছে যায় গ্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ঠিকানায়। প্রেরকের নাম হান্সি ক্রনিয়ে, মিডল অর্ডারের উদীয়মান প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান।

হেডমাষ্টার যোহান ভলসটেডের উপস্থিতিতেই লর্ডসে দক্ষিন আফ্রিকা টেস্ট ম্যাচ জিতে নেয় ৩৫৬ রানের বিশাল ব্যাবধানে। গ্রে স্কুলের আরেক সাবেক ছাত্র অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলস সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে জিতে নেন ম্যান অফ দা ম্যাচের খেতাব। ক্রিকেট বিশ্বে শুরু হয় দক্ষিন আফ্রিকার বীরোচিত প্রত্যাবর্তন। কিছুদিন পরেই কেপলার ওয়েসেলস অবসরে গেলে হান্সি ক্রনিয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সেই বনে যান দক্ষিন আফ্রিকার অধিনায়ক। এর পরের ইতিহাসের সাক্ষী আমার মতই অগনিত ক্রিকেটপ্রেমী।

আজকের সিনেমার গল্পটা সেই ক্রনিয়েকে ঘিরেই। একজন সফল ক্রিকেট অধিনায়কের সাফল্যগাঁথা আর কালক্রমে সেই ক্রিকেটবিশ্ব থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত এক চরিত্রের চারপাশে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা নিয়ে বানানো এক আত্মজীবনীমূলক সিনেমা। মুভির প্রডিউসার এবং স্ক্রিপ্ট রাইটার নিজেও একজন ক্রনিয়ে, হান্সি ক্রনিয়ের বড় ভাই ফ্রাঞ্জ ক্রনিয়ে। একসাথে একই স্কুল-কলেজে পড়াশুনা আর অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট প্রদেশের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলার সুবাদে খুব কাছে থেকেই দেখতে পেড়েছে হান্সির সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠার দিনগুলি। ম্যাচ ফিক্সিং এর অভিযোগে ক্রিকেট জগত থেকে বিতাড়িত ছোট ভাইয়ের পাশেও থেকেছে ফ্রাঞ্জ। তাই বলে ছোট ভাইকে সাধু বানানোর কোনও অপচেষ্টা হিসেবে মুভিটা বানানো হয়নি। ফ্রাঞ্জ ক্রনিয়ের ভাষায় “We are not doing a movie about cricket, we are doing a movie about our frailty before temptation and our weeknesses. That is what it’s all about for me” । কিশোর হান্সির ধীরে ধীরে দক্ষিন আফ্রিকার গোল্ডেন বয় হয়ে উঠা আর জুয়াড়িদের কাছ থেকে টাকা গ্রহনের মত অমার্জনীয় অপরাধে বহিষ্কৃত হবার ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই এই মুভির প্রথম ভাগ। আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে মুভির দ্বিতীয় অংশ যা আমার মত অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর ছিল অজানা।

ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হবার পরও হান্সি ক্রনিয়ে বেঁচে ছিল আরও ১৮ মাস। খ্যাতির চূড়া থেকে এই অপমানজনক বিদায়ের পরবর্তি দিনগুলি প্রথমে খুব হতাশায় কেটেছে হান্সির। স্ত্রী এবং পরিবারের ভালোবাসায় আর একজন সাবেক দক্ষিন আফ্রিকান ক্রিকেট গ্রেটের অনুপ্রেরণায় নতুন করে আবার জীবনটাকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে হান্সি। ক্রনিয়ে পরবর্তী অধিনায়ক শন পোলোকের পিতা ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক পিটার পোলোক হল সেই অনুপ্রেরনাদায়ী। চমৎকার লেগেছে সেই অভিনেতার চরিত্র। সিনেমাতে গল্পের প্রয়োজনেই এসেছে আরও কিছু বিখ্যাত ক্রিকেটারের প্রসঙ্গ। কোচ বব উলমার, বন্ধু আর সতীর্থ অ্যালান ডোনাল্ড, বোর্ডের চেয়ারম্যান আলি বাকারের ভূমিকা বারবার এসেছে সিনেমাতে।

২০০২ সালে ১লা জুন বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুকালে ক্রনিয়ের বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। জীবনটাকে সবে নতুন করে গড়ার চেষ্টায় ছিল সে, বেল ইকুইপমেন্ট কোম্পানির হিসেবরক্ষন বিভাগের চাকরির এক বছরও হয়নি ততদিনে। ১৫০০ মাইল দূরে থাকা স্ত্রীর সাথে উইকএন্ড কাটানোর সুযোগ হারাতে চায়নি বলে চড়ে বসে এক ছোট কার্গো প্লেনের একমাত্র যাত্রী হিসেবে। ভাগ্যবিধাতা হান্সি ক্রনিয়েকে তাঁর জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস খেলার সুযোগ দেয়নি।

শৈশবের সেই গ্রে স্কুলের হলরুমেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয় ক্রনিয়ের। ডোরাকাটা সবুজ ব্লেজারের স্কুল ইউনিফর্ম পরিহিত হাজারো ছাত্র সমস্বরে গেয়ে উঠে “Hansie is our hero ....we will not be moved" ছয় বছর বয়সে যে স্কুলে হান্সি প্রথম পদার্পণ করে সেখানেই মেমরিয়াল ওয়ালে রক্ষিত আছে ওর ছাইভস্ম। দক্ষিন আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন মেন্ডেলা তাঁর শোকবানীতে বলেন 'Here was a young man courageously and with dignity rebuilding his life after the setback he suffered a while ago. The manner in which he was doing that promised to make him once more a role model of how one deals with adversity.'

(পাদটীকা: ক্রনিয়ে ছিল আমার দেখা সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেট অধিনায়ক। ওর ক্যাপ্টেনসি দেখার জন্যও অনেক ভোর রাতে উঠে টিভি চালু করেছি। উলমার আর ক্রনিয়ের জুটিটা জমেছিল বেশ। এখনও পরিসংখ্যানের বই খুললে দেখা যাবে কতটা সফল অধিনায়ক ছিল হান্সি। ম্যাচ ফিক্সিংয়ে ওর জড়িয়ে যাওয়াটা আমাকে বড় এক ধাক্কা দেয়। ক্রিকেট দেখাই ছেড়ে দেই কিছু সময়ের জন্য। এরপর প্রবাস জীবনে টিভি খুলে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার সুযোগও আর হয়ে উঠেনি। এককথায় ক্রনিয়ের মত আমিও ক্রিকেট জগত থেকে নির্বাসনে চলে যাই প্রায় একই সময়ে। হালের নতুন ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে আশরাফুলের স্বীকারোক্তি আমাকে আবার ভাবিয়ে তোলে ক্রিকেট আর জুয়াড়িদের সম্পর্ক নিয়ে। হান্সি ক্রনিয়েকে নিয়ে ২০০৮ সালে বানানো এই মুভিটা সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনায় ক্রিকেট অনুরাগীদের সাহায্য করবে।)

......জিপসি


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

রিভিউ ভাল হয়েছে। সিনেমাটা দেখা হয়নি অবশ্য।

অতিথি লেখক এর ছবি

আহামরি কোনও ফিল্ম নয় এটি। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে একজন সাবেক ক্রনিয়ে ফ্যান হিসেবে অন্য ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্যই এই পোষ্ট। ফিল্ম রিভিউ আমি লিখতে পারিনা, ভালো লাগাটাই শেয়ার করি।

......জিপসি

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

একসময় আমি খুবই অবাক হতাম যে, এই লোকটার চেহারায় কোন আবেগ দেখা যেত না।
লোকটা অবলীলায় খেলা শেষে জিতে যাওয়া টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে কমেন্টেটরদের সাথে কথা বলত।
"

লোভের সামনে আমরা আসলেই ভঙ্গুর, খুবই বেশি ভঙ্গুর"

অতিথি লেখক এর ছবি

কিং কমিশনের সামনে হান্সি ক্রনিয়ে নিজেই বলে গেছে "I am not addicted to alcohol or nicotine, but I have an unfortunate love for money"।
লোভের সামনে আসলেই আমরা অনেক বেশি ভঙ্গুর...... বিশ্বাস আর লোভের লড়াইটা বড় অসম!

......জিপসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমার কেন যেন মনে হয় ক্রনিয়ের মৃত্যুটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। ক্রনিয়ে ধোয়া তুলসীপাতা অমন দাবি করি না। তবে অনেক বড় রাঘব বোয়ালকে বাঁচানোর জন্য তাকে হয়তো বলি হতে হয়েছে।

ক্রিকেট আর খেলা নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

জেন্টালম্যানদের এই খেলা কিছু অসাধু লোভী মানুষদের দ্বারা কলঙ্কিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমি আশাবাদী একদিন ঠিকই ফিরে আসবে সেই সোনালী দিনগুলি। এখনও ছুটির দিনে ইউটিউবে দেখতে ভালো লাগে নব্বইয়ের দশকে পার্থের পিচে কার্টলি অ্যামব্রোস আর ওয়াহ ভাইদের লড়াই, টেন্ডুলকার আর ডোনাল্ডের তাণ্ডব, অ্যাশেজ ট্যুরে ওয়ার্নের সেই ম্যাজিক ডেলিভারি!

ক্রনিয়ের মত বব উলমারের অকালমৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন জেগেছিল অনেক। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে এই মুভিটা ফ্রাঞ্জ ক্রনিয়ে উৎসর্গ করেছে তাঁর ভাই হান্সি, বব উলমার আর বাংলাদেশের সাবেক কোচ এডি বারলোকে।

......জিপসি

তারেক অণু এর ছবি

লেখা পড়তে পড়তে ১৯৯২ সালের ক্রনিয়ের মুখ সহ পুরো সাউথ আফ্রিকা টিমের কথা মনে হয়ে গেল।

অতিথি লেখক এর ছবি

আহারে সেই ১৯৯২ সালের সেমিফাইনাল ম্যাচ, বৃষ্টির বদৌলতে ফাইনাল খেলে ইংল্যান্ড! ২৩ বছরের ক্রনিয়ে ছিল সেই টিমের অন্যতম তরুণ মুখ।

......জিপসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।