আমাদের গাড়িয়াল ছকমল দা হাতের কঞ্চির একটানে আশ্চর্য ক্ষমতায় ঝোপের মধ্য থেকে থোকা থোকা ফল উঠিয়ে আমাদের দিত। ওগুলোর নাম পানিয়াল ফল, হাতের তালুতে নিয়ে জোরে জোরে নাড়ু বানানোর ভঙ্গিতে ওগুলোকে ঘষতে হত, তখন সেই ফল হয়ে উঠত অমৃতের মতো। ছকমল দা আমাদের হাতে ফলগুলো দিয়ে বলত, বইন, কও- আম পাকে জাম পাকে হাতোতে পানিয়াল পাকে। আমরা বলতাম, আম পাকে জাম পাকে হাতোতে পানিয়াল পাকে। দূর্গাপুর থেকে মোগলহাট স্টেশনে যাওয়ার পথে পানিয়াল ফলের অনেক ঝোপ ছিল।
কোদ্দিন দা আর ফাউক্সা দা আমাদের গরু গুলোকে গিদারী নদীর ওদিকটায় নিয়ে যেত চরাতে। আসার সময় গামছা ভরে ওরা নিয়ে আসত কাঁচা পাকা বড়ই। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কখন আসবে কোদ্দিন দা'রা। বিবর্ণ আলোর আভায় গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফেরার মুখে ওরা ডাকতে ডাকতে আসত, বইন...বইন...বইন...
আমরা যে যেদিক থেকে পারি ছুটে এসে ঘিরে ধরতাম ওদের। গামছা ভর্তি বড়ইয়ের পোটলা টা আমাদের কারো হাতে দিতে দিতে কোদ্দিন দা বলত- এই যে ন্যাও, দিয়া থুইয়া খাও, ভাগাভাগি করি খাও, কাউটাল করেন না তোমরাগুলা।
কোদ্দিন দা, ছকমল দা, মান্নান দা, মোসলেম দা ওরা কাজ শেষে যে যার বাড়ি ফেরে। পাড্ডা দা থাকত রাতে, অনেকটা প্রহরীর মতো, আব্বাকে সাইকেলে করে দূরে দূরে যেতে হত, ফিরতে অনেক রাত হত। আমাদের ওস্তাদজিও পাড্ডা দা’র সাথে খুলিবাড়ির বড় ঘরটায় থাকতেন। আব্বা ফেরার পর খাওয়া দাওয়া করে ওস্তাদজির সাথে আলাপ সালাপ করতেন, বিভিন্ন বিষয়ে। এই দুইজনে আলোচনার বিষয় মূলত শেখ সাহেব, পূর্বপাকিস্তানের দিনকাল ইত্যাদি। আব্বা সারাদিন বাইরে বাইরে, রেডিও শোনার সময় পান না, বাড়ি ফেরার পর ওস্তাদজিই সারাদিনের নানা খবর আব্বাকে দিতেন। ওস্তাদজি যদিও আমাদের আরবির শিক্ষক ছিলেন, তবু অন্যান্য পড়াশুনার ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিতেন, আমাদেরকে সবসময় উদ্বুদ্ধ করতেন খবর শোনার কথা বলতেন, বিবিধ বই পড়তে বলতেন, বিশেষ করে মেয়েদের কে সবসময় বলতেন, লেখাপড়া চালায় যাইবা তোমরা। আব্বার সাথে আলাপের সময় ওস্তাদজি বলতেন- এই দ্য্যশ একটা স্বাধীন দ্য্যশ হোক দিনে রাতে এই দোয়া করি ভাইসাব।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে আব্বা আমাকে পাঠিয়ে দেয় কালীগঞ্জে, খালার বাড়ি। হাইস্কুলটা খালার বাড়িতে থেকেই পড়েছি। একাত্তরে আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। দেশের অবস্থা তখন উত্তাল। একাত্তরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমি ছিলাম কালীগঞ্জে। ফেব্রুয়ারির দিকেই হবে, কালীগঞ্জে আমাদের জনৈক পড়শি, আমরা চিনতাম শহিদ দারোগা নামে, উনি একদিন এসে বেশ তোড়জোড় করেই আমাদেরকে জানালেন, দেশের অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছে না, যে যার বাড়ি চলে যাও। আব্বাকে চিঠি দিলাম। আব্বা উত্তর দিলেন নির্ধারিত দিনে মোগলহাট স্টেশনে ছকমল দা কে মহিষের গাড়ি সহ পাঠাবেন, সেই মোতাবেক খালা করিমপুর স্টেশন থেকে আমাকে তুলে দিলেন। করিমপুর থেকে লালমনিরহাট এসে, লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটের গাড়ি ধরলাম। ছকমল দা মোগলহাটে ছিল আগে থেকেই। আমি বাড়ি ফিরলাম।
মার্চ মাস আসল। আমরা রেডিও শুনছি নিয়মিত। আব্বা নানা জায়গা থেকে নানা খবর নিয়ে আসতেন। পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে আমরা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু কতটা খারাপ এই আন্দাজ করতে পারিনি তখনও। আসলো পঁচিশে মার্চ, যখন আমরা পঁচিশে মার্চের খবর শুনতে পেলাম, বিমুঢ় হলাম। যুদ্ধ হলে কতটা কি হতে পারে এটা আমার ধারণার আন্দাজে কুলিয়ে উঠিনি তখনও।
লালমনিরহাটে পাকিস্তান থেকে আসা অবাঙালীদের খুব আধিক্য ছিল, বাঙালিদের সাথে তাদের খুব সংঘর্ষ শুরু হলো। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা, পাকবাহিনী লালমনিরহাটে নারকীয় যজ্ঞ চালাল, লালমনিরহাটের সাধারণ মানুষ কল্পনা করারও বোধহয় সময়টা পায়নি যে কতটা নির্মম হতে যাচ্ছে পরিস্থিতি। আব্বা এসে একদিন খবর দিলেন ঝাঁকেঝাঁকে মানুষ মারছে পাকবাহিনী লালমনিরহাটে, বহু বাচ্চাকেও নাকি মেরে ফেলেছে, বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। লালমনিরহাটে স্থান নিয়েছে পাকবাহিনীর। আমরা শুনলাম সেখানে নাকি শান্তি কমিটি নামে এক কমিটি হয়েছে, ওরা কোনও ছাড় দিচ্ছে না, বাড়িতে বাড়িতে গ্রামে গ্রামে পাকবাহিনীকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।
একদিন বাতাসে যেন ভেসে আসল হাহাকার, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়েই হয়ত, ঠিক মনে নেই, খবর পেলাম গন্ধমরুয়া গ্রাম একেবারে জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা, বহু মানুষ কে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। গন্ধমরুয়া গ্রামে শান্তি কমিটি আর পাকবাহিনী তাদের নির্মমতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রাখতে মোসলেম উদ্দিন নামক একজন ছাত্রকে হত্যা করেছে, শুনলাম সে রংপুর কলেজে পড়ত, শুনলাম, প্রথমে ছেলেটার চোখ উপড়ে নিয়েছে তার পর তাকে হাত ধরে টেনে টেনে সারা ইউনিয়ন ঘুরিয়েছে, মানুষকে যখন যেখানে পেরেছে দেখিয়েছে বাঙালি বাড় বাড়লে কি হয় কি হতে পারে, মানুষকে ভয়ে সিটিয়ে দিতে চেয়েছে।
তরতাজা নবীন একটা ছেলেটাকে এক গুলিতে না মেরে পাশবিক ভাবে হত্যা করেছে। কিছু মানুষকে একটা দেশে যুদ্ধ করতে পাঠালে আর কিছু মানুষ এই ভূমির স্বাধীনতার বিপক্ষে থাকলেই এইসব নির্মমতা হয় না, এই স্তরের ক্রূরমতি হতে হলে মানুষকে পাশবিকতার উত্তুঙ্গ আসনে অধিষ্ঠিত হতে হয়, মনকে বছরের পর বছর এহেন বর্বর দুষ্কার্য সম্পাদনের নিমিত্তে প্রতিপালন করতে হয়, এইসব পশ্বাচার মানবমনের বহুদিনের সাধনায় ফসল।
গন্ধমরুয়া গ্রামের পরের গ্রাম দিঘলটারী, তারপরই আমাদের গ্রাম দূর্গাপুর। আব্বাকে চিন্তিত হতে দেখলাম। আমাদের গ্রামেও শান্তি কমিটি তৈরি হয়েছে শুনেছি। আমরা কি করব বুঝতে পারছিলাম না। সেইরকম একদিন, হাটখোলায় আব্বাকে এক লোক একটা চিঠি দিল। ভূপেন কাকার চিঠি। লোকটার দিনহাটায় গিয়েছিল, সেখানে ভূপেন কাকা তাকে চিঠিটা আব্বাকে দিতে বলেন। কাকা লিখেছেন,
প্রিয় সাদের, মঙ্গল মতো আছো তো? তোমাদের খবর পাচ্ছি কিন্তু তোমার খবর বেশ কিছুদিন পাই নাই। তুমি জরুরি ভিত্তিতে আগামীকাল সন্ধ্যা নাগাদ আমার সাথে দেখা কর। আমি বর্থর সীমান্তে তোমার অপেক্ষায় থাকব। সাক্ষাতে বিস্তারিত আলাপ হবে। কল্যাণ কামনায়, তোমার বন্ধু ভূপেন্দ্রনাথ ভট্ট
আব্বা পরদিন ভূপেন কাকার সাথে দেখা করলেন। বাড়ি ফিরে আমাদের জানালেন, কালই দুটো ঘর খুলবেন।
ভূপেন কাকা ওনার জায়গায় গিয়ে আমাদের ঘর তুলতে পরামর্শ দিয়েছে আব্বাকে। পরদিন ওস্তাদজি চলে গেলেন তাঁর দেশের বাড়ি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। তাঁর পরিবার পরিজন থাকত সেখানে। ছকমল দা, মোসলেম দা, পাড্ডা দা, কোদ্দিন দা, ফাউক্সা দা সবাই ঘর খুলতে, বাক্স প্যাটরা গোছাতে উঠেপড়ে লাগল। সবকিছু খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করল। কিছু টিন আগে থেকেই বাড়িতে ছিল, আর দুটো ঘর তুলে নিয়ে ছকমল দা’রা বর্থরে গিয়ে দুইদিনের মধ্যেই রান্নার জায়গা আর তিনটা ঘর তুলে দিলেন আমাদেরকে, আর শৌচাগার তৈরি হতে হতে আরও এক দুই দিন। আম্মা যেতে রাজি হলো না, আম্মার বিন্দু থেকে সিন্ধু হওয়া সংসার, আম্মার তিরিশ চল্লিশটা গরু, গোলা ভরা ধান, ফলের বাগান, হাঁস মুরগী কবুতর, এইসব ফেলে আম্মা এখনই যাবে না তবে বর্থর যেহেতু বাড়ির কাছেই আম্মা তেমনটা মনে করলে ছোট বোন নাজুকে নিয়ে যখন ইচ্ছা চলে আসতে পারবে। ঠিক হলো আব্বা আমাদের সাথে বর্থরে গিয়ে থাকবেন। আম্মার পাহাড়ায় থাকল পাড্ডা দা'রা, তবে মাঝে মাঝে রোগী দেখে ফিরতে খুব রাত হলে আব্বা বাড়িতেই থেকে যেতেন।
বর্থর ছিল কুচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার একটা পল্লী অঞ্চল। ভূপেন কাকা তার পরিবার নিয়ে থাকতেন গীতলদহ। বর্থরে তিনি তাঁর পতিত জমি আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সাথে সাথে গ্রামের আরও কিছু পরিবার আস্তে আস্তে চলে আসলো সেখানে, জায়গায় যতটুকু কুলায়, সবাই মিলেঝিলে ঘর তুলে ওখানে আমাদের নতুন জীবন শুরু হলো।
একদিনের ঘটনা, আব্বা আমাদের সাথে আছেন বর্থরে, এক রাতে একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে কারা যেন নিয়ে আসল আব্বার কাছে। শুনলাম একটা ব্রিজের সামনে মুক্তিযোদ্ধার সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়েছে। আহত নিহত অনেক। ছেলেটার উরুতে গুলি লেগেছিল, কয়েকজন মিলে তাকে ভারতে দিকে নিয়ে আসে। আব্বা গুলি বের করলেন, আমরা দেখলাম গুলি দেখতে কেমন। ছেলেটা কয়েকদিন ছিল, আব্বার ঘরে। সুস্থ হয়ে ছেলেটা চলে গেল কিছুদিন পর, জানি না আবার যুদ্ধে গেল নাকি বাড়িতে ফিরে গেল।
সেই ঘটনার পর আব্বা চিকিৎসার সব সরঞ্জাম দূর্গাপুর থেকে গুটিয়ে নিয়ে বর্থরে চলে আসলেন, ছকমল দা’রা এসে আব্বার একটা ডিসপেনসারি ঘর বানিয়ে দিয়ে গেল। আব্বা ছলমল দা, কোদ্দিন দা কে নিয়ে সিংগিমারী নদীর ওপাশে গিতলদহ থেকে আরও অনেক অসুধ কিনে আনলেন, আরও তুলা, গজ, জীবাণুনাশক কেনা হলো, আব্বার মধ্যে নতুন এক উদ্যম দেখতে পেলাম। সেই সময়ে আব্বার কম্পাউণ্ডার আহছান উল্লাহ, আমরা ডাকতাম আহছান চা, ওই পরিস্থিতিতে আব্বার সাথে বর্থরে চলে আসতে পারলেন না। আব্বার কাজের চাপ বাড়ল। মনে আছে মাঝে মাঝে আসত একাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়ল গরম পানি, তুলা গজ এইসব এগিয়ে দেয়া, সেলাই দেয়ার সময় ওদের কারও কারও সে কি চিৎকার। মুক্তিযোদ্ধারা আসত চিকিৎসা নিত কয়েকদিন আব্বার ডিসপেনসারির বিছানাটায় থাকত, তারপর চলে যেত। আব্বা প্রত্যেককে হাতে কিছু টাকা দিতেন যাওয়ার সময়। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় যেত, বাড়ি ফিরে যেত নাকি আবার যুদ্ধ করতে যেত, তাদের কিইবা ছিল নামধাম, আমরা কিছুই মনে রাখতে পারিনি। একটা ঘটনা যখন ঘটে তখন কালের বিচারে ঘটনাটা তার দীপ্তিময়তা নিয়ে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় না, কিন্তু অনেককাল পর টের পাওয়া যায় তার দ্যুতি। তাই মুক্তিযোদ্ধা দর্শনের মতো সুন্দরতম একটা ব্যাপার তখন এত সৌন্দর্য নিয়ে এক গ্রাম্য ষোড়শীর চোখে ধরা পড়েনি, যতটা ধরা পড়েছে এতকাল পরে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেই আব্বাকে বলেছিল মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে, আব্বা বলেছিলেন, ওটা হবে ভাতের ফ্যান বিলিয়ে নাম নেওয়ার মতো একটা ব্যাপার, কারণ চিকিৎসা সেবা দেওয়া তার পেশা, আব্বা বলেছিলেন, আমি শুধু আমার কর্তব্য পালন করেছি মাত্র।
বাড়ির ছোট রেডিওটা আব্বা আমাদের দায়িত্বে দিয়েছেন। আমার দায়িত্ব ছিল খবর শুনতে হবে আর আব্বা কাজ শেষে আসার পর জানাতে হবে। আমি আশেপাশের বাড়িগুলোতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম, মেজবুজান সেজবুজান ওরা রান্নাবান্না দেখত, সেজবুজানের কোলে দুধের শিশু দুটি, আমি ওদের জন্য জামা বানাতাম, কাঁথা সেলাই করতাম, একটা কাজ রোজই করতাম, আকাশবাণীর খবর শুনতাম। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কণ্ঠে যেন পাহাড় টলে। আমরা চুম্বকের মতো আটকে থাকতাম, আব্বা আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন খবর শুনে যতটুকু পারি খাতায় নোট নিয়ে রাখার, আব্বা সারাদিন রোগী দেখতেন, কখনও দূর-দূরান্তে যেতে হতো। আমার কাজ ছিল আব্বা ফিরলে আব্বাকে সংবাদ দেওয়া। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেহেশতি কণ্ঠের খবরের সময় আমরা গোল হয়ে রেডিওটা ধরে বসে থাকতাম। আমরা চলে যেতাম এক অনির্বচনীয় শব্দলোকে। সেই শব্দের শক্তি আর জাদুতে, সেইসব খবর শুনে, আমাদের হাত-পা কাঁপত। আমরা বুঝতাম যে আরও আরও বহু মানুষ, মুক্তিবাহিনী এবং সব মানুষের কাছেও হয়ত পৌঁছে যাচ্ছে এই কণ্ঠস্বর, আমরা ভাবতাম, প্রচণ্ড এক বিক্ষুব্ধ লড়াইয়ের উদ্দাম রক্তকণিকা নেচে বেড়াচ্ছে আমাদের মতো গেঁয়ো মানুষের শরীরে, তাহলে কি মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা কোনওভাবে শুনতে পাচ্ছে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলিত করা ভঙ্গিমায় এইসব খবর। আমাদের তখন মনে হত, এই ঘনঘোর দুর্দিনে আমরা একা না তাহলে, তাহলে আরও অনেকেই আছে আমাদের পাশে। ওনার হৃদয় মন ঢেলে দেওয়া সেইসব কথা শুনে আমরা ঘরের মধ্যে বসেও কি যে সোচ্চার হয়ে উঠতাম, সেইসব শব্দের শক্তি, খবর পড়ার মহিমায় দুশ্চিন্তা মধ্যেও আমাদের মন কোথায় যেন চকচক করত। নিরবচ্ছিন্ন ভয়ের মধ্যেও ওই আমাদের বিনোদন- দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের খবর, হয়ত হারের খবর থাকবে, ভস্মীভূত জেলা গ্রামাঞ্চলের খরব থাকবে কিন্তু তারপরও নিজেদের মানুষের খবর, কি উন্মুখ হয়ে যে আমরা খরব শোনার জন্য বসে থাকতাম। আজকে এখানে কালকে ওখানে কত জায়গায় মুক্তিবাহিনীর আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনতাম, আবার জেতার খবরও শুনতাম, আব্বা আসার পর আমি যতটুকু পারি আমার খাতার টুকটাক লিখে রাখা থেকে আর কিছুটা মনে রাখা থেকে আব্বাকে খবর দিতাম। বুঝতাম আব্বা আরেকটা খবরের জন্য উদ্বিগ্ন থাকতেন, শেখ সাহেবকে মেরে ফেলল কিনা এই ভয়টা আব্বার মধ্যে দেখতাম। একদিন আমি আব্বাকে বলেছিলাম, আব্বা হয়তো ওনাকে এতদিনে মেরে ফেলেছে, আব্বা বলেছিলেন- এতবড় একজন রাজনৈতিক নেতার গায়ে আঁচর দেয়াও কঠিন কাজ, শেখ সাহেবকে মারবে না।
কোথায় কোথায় আগুনে গ্রাম পুড়ল, কোথায় ব্রিজ ভাঙলো, আরও কোন কোন জেলায় আক্রমন হলো এতখবরে আমরা মাঝে মাঝে খুব ভীত হয়ে পড়তাম। আব্বা আমাদের কথা শুনে বলতেন- যত যাই করুক, দেশ তো স্বাধীন হবেই, মুক্তিবাহিনী অটল, এই দেশের মানুষ অটল। এর মধ্যে একবার শুনলাম শেখ সাহেবকে কে ইয়াহিয়া ফাঁসি দিয়েছে। আব্বা বললেন- না না, এত সহজ না।
আমাদের গ্রাম দূর্গাপুরে মাঝে মাঝেই চিৎকার শোনা যেত, পালাও পালাও, খান আইল, খানসেনা আইল...। আম্মা তখন কোনও মতে ঘর দোরে তালা দিয়ে নাজুকে নিয়ে আর সবার সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসত বর্থরে। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য দূর্গাপুরে হানাদার বাহিনী আসেনি।
বর্থরে আমাদের আশেপাশের বাড়িগুলোর সাথে আমাদের অনেক টান তৈরি হয়েছিল। ওখানকার মানুষের জীবন ছিল রিক্ত, অপুষ্ট, ক্লান্ত, কিন্তু মানুষগুলোর ছিল সখ্যতাপরায়ণ। দেখতাম ঘরে ঘরে বউরা কি একটা যেন হাতে বানিয়ে চনচনে রোদে শুকায়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- এগুলো কি জিনিস, ওরা বলেছিল- এগুলো ডালের বড়া, সেই প্রথম দেখলাম ডালের বড়া। মাষ কলাইয়ের ডাল সারারাত ভিজিয়ে রেখে পরদিন চটের বস্তা দিয়ে ডলা দিত ওরা, তারপর বাটত শিলপাটায়, অনেক কষ্ট করত, তারপর পুষ্ট চাল কুমড়া কুড়নি দিয়ে কুড়ে, বাটা ডালের সাথে মিশিয়ে ছোট ছোট বড়া করে বানিয়ে রোদে শুকাত।
ডিসেম্বরের প্রথমদিকে আমরা জানতে পারলাম লালমনিরহাট হানাদার মুক্ত হয়েছে। হইহই রইরই।
তারপর শুনলাম আমদের বিজয়ের বারতা।
আমরা ফিরে আসলাম আমাদের স্বাধীন ভূখণ্ডে, সে এক অন্তহীন স্ফুর্তির ব্যাপার। আসার সময় গ্রামের বউগুলোর কি মন খারাপ, বউ-বাচ্চাগুলো এসেছিল অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে, আমাদের সাথে সাথে, তারপর ওরা ফিরে গেল ওদের ঘরে, আমরা এলাম আমাদের ঘরে।
খন্দকার রেহানা সুলতানা
২০২৩
মন্তব্য
অনবদ্য স্মৃতিচারণ। আপনাকে ধন্যবাদ!
পড়ার ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অসাধারণ স্মৃতি চারণা। মুক্তিযুদ্ধের এ ধরনের স্মৃতি চারণার অনেক মূল্য। শুধু যুদ্ধের ইতিহাস দিয়ে পুরো সমাজকে কখনো বুঝা যাবেনা। এখনই মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে না রাখলে একদিন তাও হারিয়ে যাবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, পড়ার ও মন্তব্যের সময়ের জন্য।
খুব চমৎকার একটা স্মৃতিচারণা। আপনার বাবা খুব দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, অথচ কোন কৃতিত্বের দাবী করেননি। একাত্তর নিয়ে এরকম টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো আরো বেশি করে লেখা উচিত।
এখানে একটা প্রশ্ন। সীমান্তের পাশে ওই জায়গাটার নাম কী বর্থর নাকি বাথার? বর্তমান মানচিত্রে বাথার নামের একটা জায়গা দেখতে পাচ্ছি ওখানে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
জ্বী আপনি ঠিকই বলেছেন। ম্যাপের ওই জায়গাই। এখন নাম কোনও কারণে বাথার হয়েছে, অন্তত ম্যাপে এই বাথার নামই দেখায়। আমরা সবসময় বর্থর বলতাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার ও মন্তব্যের সময়ের জন্য। ভালো থাকুন।
রেহানা
নতুন মন্তব্য করুন