বালিশ (শেষ পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৬/০৪/২০২৩ - ১২:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[ বালিশ একটি ধারাবাহিক গল্প। গল্পের প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের লিংক এখানে দেয়া হল পর্ব ১ **পর্ব ২ ]

আশিসকে পাওয়া গেলো পাক্কা ৩৬ ঘন্টা পর। ম্যাসেজ না, সে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে সরাসরি কল করেছে। ওপাশ থেকে আশিসের উদ্দিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো-

কিরে ব্যাস্ত নাকি ?

ফাহিম বললঃ না, কাজে বের হবো তাই রেডি হচ্ছিলাম। ক’টা বাজে তোর ওখানে?

হতাশ গলায় আশিস বললোঃ রাত আটটা, আর বলিস না, এখনও ল্যাব থেকে বেরুতে পারিনি।

ফাহিম হেসে বললঃ ব্যাপার না, চালিয়ে যা, চালিয়ে যা, আরে ব্যাটা - পি এইচ ডি ডিগ্রী পাচ্ছিস, কষ্ট না করলে তোর সার্টিফিকেট হালাল হবেনা।

ওপাশ থেকে আশিসের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। আমার কথা বাদ দে, তুই এতদিন পর কি মনে করে নক দিলি তাই বল।

ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত, ইয়ে-মানে, আমার কাছে একটা মাছের কাঁটার মত জিনিস আছে। কিন্তু সেটা ঠিক মাছের কাঁটাও না।

কি বলছিস এসব আবোল-তাবোল। কোন মাছের কাঁটা?

আরে না, আবোল-তাবোল নয়। জিনিসটা মাছের কাঁটার মতো। আবার মাছের কাঁটার মত রঙ নয়।

এই বস্তু জোগাড় করেছিস কোত্থেকে?

আমার এক রোগীর আঙ্গুল কেটে বের করেছি। জিনিসটা আমার একজন স্যারকেও দেখিয়েছি। আমি যতটুকু বুঝি- জিনিসটা সচরাচর আমরা যেসব যৌগ দেখে অভ্যস্ত এরকম কিছু দিয়ে তৈরি না।

আশিস বললঃ তুই বুঝলি কিভাবে? পৃথিবীতে কত শত যৌগ আছে জানিস?

ফাহিম অপ্রস্তুত হয়ে বললঃ তা ঠিক আছে, তারপরেও, মানে তুই তো এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করিস, তুই যদি একটু পরীক্ষা করে দেখতি, ধর কোন ক্যামিকেল এনালাইসিস, আমিতো আর এসব বুঝবো না, মানে জিনিসটা কি পদার্থের তৈরি তা যদি বোঝা যায় আর কি।

হুম বুঝলাম, কিন্তু বুড়া রাজি হবেনা।

বুড়া আবার কে?

আমার সুপারভাইজার। প্রফেসর এডওয়ার্ড প্যাটারসন। তাঁর এক পা কবরে, এখন আর ডিপার্টমেন্টে আসেনা বললেই চলে। আমরা দুই তিনজন পি এইচ ডি ছাত্র ঝুলে আছি। আমাদের খালাশ করে সে শান্তিতে অবসর নেবে। আমরা তাড়াতাড়ি সব এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে থিসিস লেখা শুরু করতে চাচ্ছি, এর মাঝে বুড়া নিজেই ঝুলে না গেলেই হয়। যাই হোক তুই ঐ জিনিসটা, মানে কাঁটা না যেন কি- ঐটা কুরিয়ার করে দে, আমি দেখি কি করা যায়। আমি ম্যাসেঞ্জারে ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।

পেছন থেকে একটা যান্ত্রিক এলারম বেজে উঠলো। আশিস বলল, শোন, আজকে আর কথা বলতে পারছিনা, পরে কথা হবে, ভালো থাকিস। ফাহিম উত্তর দেয়ার আগেই ওপাশ থেকে কেটে গেলো।

এই ফোনালাপের তিন দিন পর কাঁটার মত জিনিসটাকে প্যাথোলোজী কালেকশনের কৌটায় ভরে ফাহিম আমেরিকায় কুরিয়ার করে দিলো। ফাহিম ভেবেছিলো আশিস বোধহয় নিজের কাজের চাপে ঠিকানা পাঠাতেই ভুলে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। আশিস সেদিন রাতেই কুরিয়ার করার ঠিকানা দিয়েছিলো।

----------------------------------

এরপর মাস খানেক কেটে গেছে, মাঘ মাসের হাড় কাপানো শীত শুরু হয়েছে। শীতের জন্যই বোধহয় আজ সন্ধ্যার পর ফাহিমের চেম্বারে বেশী একটা রোগী সমাগম হয়নি। সে তাড়াতাড়ি-ই বাড়ি ফিরে এসে, খাওয়া দাওয়া সেরে, লেপের নিচে নিজেকে সমর্পণ করেছে। শুয়ে শুয়ে রিমোট টিপে এই চ্যানেল সেই চ্যানেলে ঘুরছে। নিচে খবরের শিরোনাম উঠছে- দেশজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ বইছে, এই মাসেই আরও দুইটা শৈত্যপ্রবাহের সম্ভবনা আছে।
ঠিক এই সময় ম্যাসেঞ্জারে আশিসের ফোন আসে। ভিডিও কল, ফাহিম রিসিভ করে।

ওপাশ থেকে আশিসের ছবি ভেসে ওঠে, সে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে- কিরে কি খবর? লেপ মুড়ে অমন এস্কিমো হয়ে আছিস কেন?

ফাহিম বলল – আমাদের দেশে তো আর তোদের মত সেন্ট্রাল হিটীং সিস্টেম নেই। যাই হোক, তোর খবর বল।

আরে আমার খবর রাখ, তোর মহার্ঘ্য আবিষ্কারের কথা শোন, এ তুই কি জিনিস পাঠালিরে ভাই?

কেন কি হয়েছে?

আমি কাঁটাটার উপর দুইটা পরীক্ষা করেছি। মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি আর এক্স-রে ডিফ্রেকশান। মাস স্পেক্ট্রমেট্রিতে কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন এসব আছে, মানে জিনিসটা জৈব যৌগই বটে। বস্তুটা মাছের কাঁটা হতেই পারে, কারণ কোলাজেন, প্রোটিন এসব স্ট্রাকচার দাড়াচ্ছে, তবে একটু সমস্যা আছে।

কি সমস্যা?

আমার এনালাইসিস বলছে, সাধারন মাছের কোলাজেনের যেই স্ট্রাকচার, এটার কোলাজেনের স্ট্রাকচার পুরোপুরি উল্টা, অনেকটা মিরর ইমেজের মত,মানে কোলাজেনের স্ট্রাকচার খাতায় এঁকে আয়নার সামনে ধরলে যেমন দেখাবে অনেকটা সেই রকম।

ফাহিমের শিরদাড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে সে বললোঃ আচ্ছা, তারপর?

আশিস বলে যেতে থাকে- আসলে আরও অনেকগুলি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আমি আমার এনালাইসিসে পুরোপুরি কনফিডেন্ট না। বুড়া মিয়ার সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন, কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের থিসিস ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলতে সাহস পাচ্ছিনা। আর বাকি এনালাইসিস গুলি করার যন্ত্রপাতিও আমার ল্যাবে নেই। অন্য ল্যাবের সাহায্য নিতে হবে। অবশ্য মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি করতে গিয়ে জিনিসটার কিছু অংশ ভেঙ্গে নিতে হয়েছে। খুব অল্পই অবশিষ্ট আছে। তুই কি এই জিনিস আরো জোগাড় করে পাঠাতে পারবি?

ফাহিম বললোঃ তা কিভাবে সম্ভব? কাঁটাটা আমার রোগীর আঙ্গুলে ফুটে ছিলো, বললাম না সেইদিন?

সেটা উনার আঙ্গুলে কোথা থেকে বিঁধেছিলো জানিস?

ফাহিম দুর্বল গলায় বললো- উনি নিজেই ঠিকমত জানেনা। আমি জানবো কোত্থেকে? আকরাম সাহেবের স্বপ্নের কথাটা আর বলতে ইচ্ছে হলোনা। আশিস হাসাহাসি করে এমন কান্ড করবে যে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাবে।

আশিস কিছুটা আশাহত গলায় বলে ওঠে- অবশ্য যতটুকু পাওয়া গেছে তা-ও কম না। প্রকৃতিতে এমন উল্টা স্ট্রাকচারের কোলাজেন অনু পাওয়া গেছে বলে তো আমার জানা নেই। আমি দেখি কতটা কি করতে পারি।

ফাহিম বললো- আচ্ছা ঠিক আছে, আর আমার যদি আমার রোগীর সাথে দেখা হয় তাহলে কোথা থেকে কাঁটাটা এলো তা আরেকটু ভালোভাবে জানার চেষ্টা করবো। তুই ভালো থাকিস, পরে কথা হবে।

ফাহিম জানে, আকরাম সাহেবের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলে কোন লাভ নাই। শুধু শুধু ব্যাপারটা উনাকে জানিয়ে উনার মানসিক অবস্থা আবার নড়বড়ে করে দেয়া ঠিক হবেনা।

----------------------------------

প্রফেসর এডওয়ার্ড প্যাটারসন হঠাৎ হার্ট এটাক করে মারা গেলেন। যথারীতি তাঁর পি এইচ ডি ছাত্ররা ঝামেলায় পড়লো। আশিসের থিসিসের বাকি কাজটুকু শেষ করে জমা দেয়ার বিষয়টাকে গাইড করার দায়িত্ব নিলেন তার কো-সুপারভাইজার প্রফেসর লি-হু-মিন। এমনিতেও আশিসের এক্সপেরিমেন্টের কাজ তেমন বাকি নেই, শুধু লেখালেখির কাজ বাকি। প্রফেসর লি-হু-মিন থাকেন পাশের স্টেইটে। এতদিন তিনি আশিসকে অনলাইনে সুপারভাইজ করতেন। আশিসের যেহেতু আর তেমন ল্যাবের কাজ বাকি নেই তাই নতুন সুপারভাইজারের পরামর্শে তাকে পাশের স্টেইটে শিফট হতে হলো।

----------------------------------

প্রফেসর এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর ডিপার্টমেন্ট থেকে তাঁর ল্যাবের জায়গাটা দেয়া হয়েছে প্রফেসর নিকোলাস ইগোরোভকে। প্রফেসর নিকোলাস হাই পারফরমেন্স গাড়ির জ্বালানি ইঞ্জিনের ভেতর কিভাবে কম্বাশচন হয় সেটার সি এফ ডি এনালাইসিস করেন। অনেক অনেক ইন্ডাস্ট্রি এটাচমেন্ট, অনেক অনেক ফান্ডিং, প্রায় বড় বড় সব গাড়ির কোম্পানিই উনার গ্রুপের সাথে কাজ করতে চায়। প্রফেসর এডওয়ার্ডের মত মৌলিক রসায়ন নিয়ে ঘটরঘটর করার সময় তাঁর নেই। প্রফেসর এডওয়ার্ডের ল্যাবের সব যন্ত্রপাতি অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হল। আর ক্যাবিনেটে রাখা স্যাম্পলগুলি বায়োহ্যাজারড সেইফ বিনে ফেলে দেয়া হল। সেই ফেলে দেয়া স্যাম্পলে অপার্থিব জগতের সেই কাঁটা কিংবা কাঁটা-সদৃশ বস্তুও ছিলো। সেটা নিয়ে আশিসের আর কাজ করা হয়নি।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই পর্বের শেষের দুই অনুচ্ছেদের আগে পর্যন্ত গল্প ঠিকঠাক চলছিল। এরপর কী হলো? মনে হলো লেখক ভাবলেন - যথেষ্ট হয়েছে, এই গল্প আর লিখব না। অতএব জোরজার করে গল্পটা শেষ করে দেয়া হলো। অনেকটা ম্যাকগাইভারের মতো। যেখানে বিপুল প্রস্তুতি নিয়ে নানা কাজ করে শেষে ছোট একটা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৌখিন  এর ছবি

কষ্ট করে পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ । হাসি

তিথীডোর এর ছবি

একদম তাড়াহুড়ো করে শ্যাষ করে দিলেন। ইয়ে, মানে...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সৌখিন  এর ছবি

সত্যি বলতে আমি নিজে থেকে কোন তাড়াহুড়ো করিনি। আমার ধারনা ছিলো, জিনিসটা অন্য জগত থেকে এসেছে, এই তথ্যটা বোঝাতে পারলেই হলো। সব কিছু তো আর ব্যাখ্যা করা যায়না। কিন্তু এখন সবার কথা শুনে মনে হচ্ছে গল্পটা আরও লম্বা করলেই হয়তো চমৎকার কিছু হতো। যাই হোক, পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

মেঘলা মানুষ  এর ছবি

এখানে শেষ হওয়াটা কেন জানি, আমার ভালো লেগেছে।
অনেক সময়েই অনেক কিছু হতে পারতো, কিন্তু হয় না।

সৌখিন এর ছবি

ধন্যবাদ। একজন তো পাওয়া গেলো, যার ভালো লেগেছে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।