অনুবাদ - The Furnished Room by O. HENRY

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১১/০৩/২০২৪ - ৭:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিউইয়র্ক শহরের পশ্চিম প্রান্তে যে পুরোনো লাল বাড়ি গুলো আছে তাদের বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। এরা সবাই সাধারণত যাযাবর প্রকৃতির, অস্থির আর ঘড়ির কাঁটার মতো সদা গতিশীল।

এরা সাধারণত ছিন্নমূল মানুষ। নিজের ঘর/বাড়ি বলে কিছু নেই। সেজন্য পৃথিবী জুড়ে এদের হাজার হাজার ঘর। সব শহরেই এদের ঠিকানা। কিন্তু প্রতিটি ঠিকানাই ক্ষণস্থায়ী। শুধু ঠিকানা নয় ওদের সুখ-দুঃখ, আবেগ, অনুতাপ সবকিছুই তাদের বাসস্থানের মতো ক্ষণস্থায়ী। ওরা কখনো বা হয়তো গলা ছেড়ে গান ধরে Home, Sweet Home. কিন্তু সে গান অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করে না। তাদের যাবতীয় সম্পদের পুরোটাই তারা ছোট একটা বাক্সে করে বহন করতে পারে। প্রকৃতি, ফুল, বাগান, পাখি নিয়ে কাব্য করা তাদের কাছে বিলাসিতা।

শহরের এই প্রান্তের প্রতিটি বাড়িতে অসংখ্য মানুষের বাস। প্রতিটি বাড়িরই অসংখ্য গল্প আছে বলার জন্য। কিন্তু কোন গল্পই তেমন চিত্তাকর্ষক হবার কথা নয়। সেই সাথে এসব বাড়িতে কেউ যদি অশরীরীদের উপস্তিতি অনুভব করে সেটাও খুব আশ্চর্য নয়। একেকটি বাড়ি কত অসংখ্য মানুষের আশ্রয় দাতা। তাদের মধ্যে কত মানুষের আত্মা এখানে আটকা পড়ে আছে কে জানে!

একদিন বিকেলে শহরের এই প্রান্তে এক যুবকের আগমন ঘটলো। প্রতিটি বাড়িতে থাকার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে একসময় এসে ১২ নম্বর বাড়ির সামনে এসে থামলো। হাতের ব্যাগ মাটিতে রেখে রুমাল দিয়ে একবার কপালের ঘাম মুছে ডোরবেলে হাত রাখলো। মনে হল বহু দূরে মাটির নীচে গিয়ে ঘন্টা বাজলো।

বাড়িওয়ালী এসে দরজা খুললেন। তাকে দেখে যুবকের মনে হলো বুঝি পাতাল ফুঁড়ে বেঢপ আকৃতির কোন অতিমানবী উঠে এসেছে। এখুনি যাকেই সামনে পাবে চিবিয়ে খেয়ে নেবে। যুবক তার কাছে জানতে চাইলো রাতটা কাটানোর জন্য কোন ঘর তার খালি আছে কি না।

'ভেতরে আসুন'। মহিলা নরম গলায় বললেও যুবকের কাছে তার গলার স্বর আন্তরিক মনে হলো না। ' তেতলার পেছনদিকের একটা ঘর খালি আছে। দেখতে চান?'

যুবক মহিলার অনুসরণ করলো। মাঝখানের হলে খুব সামান্য আলো। সেটা কোথা থেকে আসছে বুঝবার উপায় নেই। মেঝের কার্পেট পুরোনো হতে হতে ক্ষয়ে গিয়ে চটের মতো হয়ে গিয়েছে। দেয়ালের গায়ে কিছু খোপ আছে ফুলদানি রাখার জন্য। সেসব ফুলদানির ফুলও বহু বছর আগে মরে গিয়েছে। ভেতরের বাতাস এত ভ্যাপসা দুর্গন্ধযুক্ত যে এখানে কোন ফুল ফোটা অসম্ভব।

'এই যে এই ঘরটা। ', মহিলা তার নরম ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন। 'খুব ভালো ঘর। কখনো ফাঁকা পড়ে থাকে না। এই গ্রীষ্মের সময় যারা ছিলেন, ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন। সবসময় ভাড়ার টাকা ঠিক সময় মত দিয়ে দিতেন। কখনো কোন ঝামেলা হয়নি। মাস তিনেক ছিলেন। নাম হলো স্প্রাউল আর মোনি। চেনেন নাকি? থিয়েটারে একটিং করেন দুজনেই। এই যে ঘরের মধ্যে গ্যাসের লাইন আছে আর হলের ওই মাথায় জলের ব্যবস্থা। ঘরে আপনার জামা-কাপড় রাখবার জন্য কতটা জায়গা আছে দেখুন। এই ঘর যাকেই দেখাবো সেই সাথে সাথে নিয়ে নেবে। আপনার নেয়ার ইচ্ছে থাকলে জলদি করুন। না হলে আরো লোক আছে ঘরখানা নেবার জন্য।’

'আপনার বাড়িতে থিয়েটারের অনেক লোকজন থাকে বুঝি?’ যুবক জিজ্ঞেস করল।

'থাকে আবার চলে যায়। এই এলাকায় বহু থিয়েটার এক্টরের বাস। কিন্তু কোন বাড়িতেই তারা বেশিদিন থাকে না। যাওয়া আসার মধ্যে আছে।’

যুবক এক সপ্তাহের ভাড়া দিয়ে দিল। এখানে সে কদিন বিশ্রাম নেবে। মহিলার হাতে টাকা গুনে দিতে দিতে সে জানালো।

'বেশ কথা। ঘরতো তৈরীই আছে। যা যা প্রয়োজন সবই পাবেন।', বলে মহিলা চলে যাচ্ছিলেন। যুবকের প্রশ্নে দাঁড়াতে হল।

'এলোইজ ভ্যাশনার বলে কোন অল্পবয়সী মেয়েকে কি আপনার মনে পড়ে? কখনো কি তাকে কোন ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন? সেও খুব সম্ভব থিয়েটারে গান গায়। দেখতে রোগা, মাঝারি উচ্চতার। মাথায় লালচে সোনালী একঢাল চুল। আর বাম চোখের কাছে একটা কালো তিল।’

'নাহ! এই নামে কাউকে মনে পড়ছে না। তাছাড়া থিয়েটারের মানুষ বাসা বদলানোর মতো সারাক্ষণ নিজের নামটাও বদলায়। কত মানুষ আসা যাওয়া করে। আমার অত মনে নেই।'

"না", সবসময় এই একই উত্তর – "না"। যুবক গত পাঁচ মাসে যতবার যত জায়গায় এই প্রশ্ন করেছে সবখানে এই এক উত্তর পেয়েছে।

থিয়েটারের সাথে সংযুক্ত আর তার চেনাজানা যত মানুষ আছে তাদের প্রায় প্রত্যেকের কাছে গিয়ে যুবক ওই অল্পবয়সী তরুণীর খোঁজ করেছে। তাদের কারো কাছে কখনো সেই তরুণী কাজের সন্ধানে গিয়েছিল কি না। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যাবেলা যুবক থিয়েটারে থিয়েটারে গিয়ে ঢুঁ মারতো। ভালো নামকরা থিয়েটার, নামহীন অখ্যাত থিয়েটার, কুখ্যাত থিয়েটার। কিছু থিয়েটারের পরিবেশ এতই খারাপ যে যুবক মনে মনে ভয় পেত যে ঠিক ওখানেই না আবার তার খোঁজ মেলে। তবু তাকে পাবার আশা ছাড়তে পারতো না।

ওই তরুণীকে যুবক ভালোবাসে। তাই তার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে। একদিন হঠাৎ করেই ওই তরুণী তার বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এই যুবক নিশ্চিত এই বিশাল শহরদ্বীপেরই কোথাও না কোথাও সেই তরুনী আছে। কিন্তু এই শহরের সবকিছুই অস্থির চঞ্চল। আজ যার অবস্থান সমাজের শীর্ষ স্থানে কালই তাকে কোন অন্ধকার কোণাতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুবক শহরে এসে অবধি প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ওই তরুণীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আজ এই ঘরখানা যেন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে যুবককে বরণ করে নিলো। ঘরখানা দেখেই যুবকের মনে হল এই ঘরটায় সে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে পারে। ঘরটা যেন তাকে বলছে 'এসো। আমার কাছে কিছুদিন বিশ্রাম নাও'। ঘরটাতে একটা খাট আছে। বিছানা পাতা। দুটো চেয়ার আছে। সেগুলোর উপরে গদির আবরণ ছেড়া। চেয়ার দুটোর মাঝখানে ১২ ইঞ্চি চওড়া একটা আয়না। এক দেয়ালে একটা ছবিও ঝোলানো রয়েছে।

যুবক একটা চেয়ারে বসলো। ঘরটা যেন তখন যুবককে তার জমিয়ে রাখা গল্পগুলি বলতে শুরু করলো। সেই গল্পের ভাষা খুব সহজবোধ্য নয়। যেন নানা দেশের নানান ভাষা একত্র হয়ে অনেককিছু একসাথে বলার চেষ্টা করছে।

ঘরের মেঝেতে ঠিক মাঝখানে একটা ছোট গালিচা পাতা। তাতে পৃথিবীর এমন কোন রঙ নেই যা উপস্থিত নেই। যেন একটা ছোট রঙিন দ্বীপ। তার উপরে রাজ্যের ধুলো। দেয়ালে ক্যাটক্যাটে উজ্জ্বল রঙের ওয়ালপেপার। ঘরে একটা ফায়ার প্লেসও আছে। ফায়ারপ্লেসের উপরের দেয়ালে একটা রঙিন পর্দার মতো ঝুলিয়ে ঘরের শোভা বর্ধনের কিছু চেষ্টা হয়েছিল যেটা একেবারেই সফল হয়নি। দেয়ালে ঝোলানো ছবির আরো ভালো এবং পরিচ্ছন্ন সংস্করণ এই যুবক এই শ্রেণীর আরো ফার্নিশড রুমে দেখেছে।

ঘরের এখানে ওখানে প্রাক্তন বাসিন্দাদের ব্যাবহৃত ছোট ছোট জিনিস ছড়িয়ে আছে। থিয়েটারের লোকজনের ছবি, ফুলদানি এরকম ছোট ছোট টুকটাক জিনিস। কোনটাই খুব মূল্যবান নয়। এক এক করে তারা যুবকের চোখে ধরা দিল। এরা যেন নিজেদের অস্তিত্বের মাধ্যমে যুবককে বলছে এই ঘরে আগে কারা ছিল।

আয়নার সামনে মেঝেতে ছোট পায়ের দাগ বললো এঘরে কোন মহিলা বাস করেছে। দেয়ালের কোথাও কোথাও বাচ্চাদের হাতের ছাপ। আরেক দেয়ালে আরেকটা বড় দাগ দেখে মনে হয় কেউ যেন ভীষণ আক্রোশে এখানে কিছু ছুড়ে মেরেছে। আয়নার একটা কোণে কেউ খুব ছোট করে নিজের নাম লিখেছে -ম্যারি।

যুবকের মনে হলো আগে যারা এ ঘরে ছিল তাদের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভ জমে ছিল। সেই ক্ষোভে তারা বারবার ঘরটাকে আঘাত করেছে। সেজন্যই হয়তো ঘরটা এত মলিন নিস্প্রভ। সত্যিকারের কোন ভালোবাসার চিহ্ন এ ঘরে নেই। চেয়ারে ফুটো, দেয়ালে গর্ত, নড়বড়ে খাট। মেঝের উপর হাটলে সে যেন প্রতিবারই আর্তনাদ করে উঠছে।

অল্পসময়ের জন্য হলেও ঘরটা প্রাক্তন বাসিন্দাদের ঘর ছিল। তবুও তারা বারবার এই ঘরকে আঘাত করেছে। অদ্ভুত মনে হলেও নিজের ঘরের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষাই হয়তো আঘাতের কারণ। যারা এ ঘরে ছিল তারা হয়তো জানেই না ঘর কেমন হয়। তারা শুধু এটুকু জানতো এ ঘর তার নিজের ঘর নয়।

যুবক বসে বসে এমন নানা কথা ভাবছিল। বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলো থেকেও নানা রকম আওয়াজ তার কানে আসছিল। কার যেন হাসির আওয়াজ এলো। সেই হাসিতে আনন্দ ধ্বনিত হলো না। আরেকটা কোন ঘরে কোন মহিলা কার সাথে যেন খুব চিৎকার করে যাচ্ছে। আরেকঘরে কিছু মানুষ জুয়ার আসর বসিয়েছে। আরেকটা কোন ঘরে কোন মহিলা তার বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে ঘুমপাড়ানি গান গাইছে। উপর থেকে গান বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। দরজা খোলা বন্ধ হবার শব্দ, বাইরে রেলগাড়ি যাওয়া আসার শব্দ। রাস্তায় কিছু বেওয়ারিশ কুকুর বেড়াল ঝগড়া মারামারি বাধিয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে এই যুবক যেন এই বাড়ির ধুঁকে ধুঁকে নি:শ্বাস নেবার শব্দ শুনতে পেল। এই বাড়ির গায়ে ঠাণ্ডা অসুস্থ মৃত্যু পথযাত্রীর গন্ধ।

যুবক চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হল ঘরের ভেতরের অসুস্থ মৃত্যুর গন্ধ উধাও হয়ে যেন পুরো ঘর সুগন্ধে ভরে উঠলো। মিগনিওয়েট ফুলের কড়া মিষ্টি গন্ধ। সে গন্ধ এতই প্রকট যে যুবকের মনে হল কেউ যেন ঘরে প্রবেশ করেছে। তাকে উদ্দেশ্য করে সেই যুবক নিজের অজান্তেই বলে উঠলো, “কিছু বলছিলে?”। যেন কারো কথার জবাব দিচ্ছে।

সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সুরভী গন্ধ তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রয়েছে। সে শূন্যের মধ্যেই ফুলের সৌরভ লক্ষ্য করে হাত বাড়িয়ে দিল। কয়েক মুহুর্ত সে বুঝতেই পারলো না সে কোথায়! কী করছে!

কোন গন্ধ কি কোন মানুষকে ডাক দিতে পারে। যুবক মনে হল যেন কারো গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু শব্দকে কি স্পর্শ করা যায়!
‘সে এই ঘরে ছিল’, যুবক বলে উঠলো। তারপর পাগলের মতো ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজতে শুরু করলো। যদি তার ব্যাবহার করা কোন সামান্য জিনিসও সে খুঁজে পায় তাহলেই ও বুঝতে পারবে সেটা তার প্রিয়তমার। কিভাবে বুঝতে পারবে তা সে জানেনা। কিন্তু সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। যুবকের চারপাশ যে ফুলের গন্ধ ঘিরে রয়েছে সেই ফুলের সুগন্ধি তার প্রিয়তমার ভীষণ পছন্দ ছিল। কিন্তু গন্ধটা আসছে কোথা থেকে!

আগের ভাড়াটে চলে যাবার পর ঘরটা কোন রকম দায়সারা ভাবে পরিস্কার করা হয়েছে৷ যুবক ঘরের মধ্যে মেয়েদের ব্যাবহৃত অনেক ছোট ছোট জিনিস খুঁজে পেল। চুলের ফিতে, ক্লিপ, রুমাল, বই। কিন্তু কোনটাই তার প্রিয়তমার নয়। শিকারী কুকুরের মত ঘরের প্রতিটি কোণা সে তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। উপুড় হয়ে মেঝের প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করলো। কিছু একটা, কোন সামান্য চিহ্নও যদি সে দেখতে পায়। যুবক জানলো না তার প্রিয়তমা ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে তাকে ডাকছে। সেই ডাকের খানিকটা হয়তো যুবকের কানে পৌছাল। সে চমকে পেছন ফিরে আবার নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করে উঠলো, 'কী বলছো?' কিন্তু পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পেল না। শুধু গন্ধ। মিগনিওয়েট ফুলের সুগন্ধির কড়া গন্ধ। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না, ছোঁয়া যাচ্ছে না। কোথা থেকে আসছে এই গন্ধ। কবে থেকে গন্ধও কথা বলে ওঠে!

তন্নতন্ন করে খুঁজে যুবক যেসব জিনিস পেল সেগুলো একেবারেই বিশেষত্বহীন। কোনটাই তার প্রিয়তমার চিহ্ন বহন করে না। সে এক মুহুর্ত বাড়িওয়ালির কথা চিন্তা করলো৷ তারপর ঘর থেকে বের হয়ে বাড়িওয়ালির সন্ধানে চললো। নীচের তলায় গিয়ে একটা ঘরের ভেতর থেকে সামান্য আলো দেখতে পেল৷ সে দরজায় কড়া নাড়তে বাড়িওয়ালি বের হয়ে এলেন।

যুবক তার গলার স্বর যথা সম্ভব শান্ত রেখে তাকে জিজ্ঞেস করলো, 'দয়া করে বলবেন আমার ঘরে আগে কে থাকতো?'

'নিশ্চয়ই। একটু আগেও তো বলেছি। স্প্রাউল আর মোনি। তারা স্বামী স্ত্রী। কিন্তু স্ত্রীটি স্বামীর নাম ব্যাবহার করতেন না। থিয়েটারের লোকজন এমনটা করে থাকে।’

'স্ত্রীটি সম্পর্কে বলুন৷ দেখতে কেমন ছিলেন।'

'কালো চুল, খাটো, মোটা। এক সপ্তাহ আগেই তারা বাসা ছেড়ে গিয়েছে।’

'তাদের আগে?'

‘এক ভদ্রলোক। তিনি থিয়েটারের নন। টাকাও ঠিক মতো দিতেন না। তার আগে ছিলেন মিস্টার ক্রোডার তার দুই বাচ্চা নিয়ে। তারা মাস তিনেক ছিলেন। তার আগে ছিলেন বৃদ্ধ মিস্টার ডয়েল। তার ছেলে তার ভাড়া দিয়ে যেত। উনি মাস ছয়েক ছিলেন। এইতো! এরাই ছিলেন গত বছর। তার আগের ভাড়াটেদের কথা আর আমার অত মনে নেই।’

যুবক ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ফিরে গেল। সে ঘরে আবার অসুস্থ মৃত্যুর গন্ধ। ফুলের সুগন্ধে এ ঘরে প্রাণ ফিরে এসেছিল। কিন্তু সেই সুগন্ধ এখন ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে।

এতদিন ধরে যত আশা নিয়ে যুবক তার প্রিয়তমাকে খুঁজে ফিরেছে আজ যেন তার সবটুকু নি:শেষ হয়ে গেল। হলুদ গ্যাসের আলোর দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর উঠে বিছানার কাছে গিয়ে বিছানার চাদরটা টুকরো করে ছিড়লো। সেই ছেড়া চাদরের টুকরো গুলো নিয়ে দরজা জানালাসহ ঘরের আর যেখানে যত ফাঁকফোকর আছে সব বন্ধ করলো। যাতে কোন বাতাস ঢুকতে না পারে। কাজ শেষ হলে গ্যাসের আলো নিভিয়ে দিয়ে বসে রইলো। তারপর চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলে আবার গ্যাস চালু করলো। এবারে আর আলো জ্বাললো না। শুধু গ্যাস চালু করে সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

----

আজ মিসেস ম্যাককুলের পালা ছিল পানীয় কেনার। তিনি পানীয় নিয়ে মিসেস পার্ডির ঘরে এলেন। মিসেস পার্ডি এবাড়ির বাড়িওয়ালি। নীচতলায় তার ঘরে বসে দুজনে আড্ডা দিচ্ছিলেন।

'আজ এক অল্প বয়সী ছোকরার কাছে তেতলার ওই ঘরটা ভাড়া দিয়ে দিলাম', পানীয়ে চুমুক দিয়ে মিসেস পার্ডি জানালেন। ’ঘন্টা দুয়েক আগে দেখলাম সে আলো নিভিয়ে ঘুমাতে গেল'।

'তাই বুঝি!’ মিসেস ম্যাককুল বললেন। তার চোখেমুখে বিষ্ময়ের ছাপ। ' আপনি কোন না কোন ভাবে ঠিক ঘরের ভাড়াটে জোগাড় করে ফেলেন। কিভাবে যে পারেন! ওই ছোকরাকে ঘরটা সম্পর্কে সব কথা বলেছিলেন?'

'প্রশ্নই আসে না। এত কষ্ট করে ঘরগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি ভাড়া দেবার জন্য। সব কথা বললে ভাড়া দিতে পারতাম নাকি!'

'ঠিকই বলেছেন। ঘর ভাড়া দিয়েই তো আমাদের চলতে হয়। আপনার চাইতে এই ঘর ভাড়ার ব্যাবসা আর কেউ ভালো বোঝে বলে আমার মনে হয় না। বেশিরভাগ মানুষই সব কথা শুনলে পর আর ও ঘরে থাকতে চাইবে না। কজনের সাহস আছে বলুন ওই ঘরে ওই বিছানায় শুয়ে কেউ আত্মহত্যা করেছে জেনেও সেখানে থাকতে চাইবে!'

'যা বলেছেন। আর ভাড়া দিতে না পারলে আমাদের চলবে কী করে!', মিসেস পার্ডি বললেন।

'সত্যিই মাত্র সপ্তাহ খানেক হল তাই না! আমিই তো আপনাকে ঘরটা ঠিকঠাক করতে সাহায্য করলাম। যাই বলুন মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরীই ছিল। এমন মিষ্টি মেয়েটা শেষে কি না গ্যাস জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করলো।’

'সুন্দরীই বলা যায়। শুধু যদি বাম চোখের কাছটায় অতবড় তিলটা না থাকতো। সে যাক! আরেক গ্লাস চলবে না কি মিসেস ম্যাককুল?'


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।