নিঃশ্বাসের কণিকা

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: সোম, ১৬/০৪/২০১২ - ২:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শুক্কুর আলি যেদিন বিষ খেয়েছিলো সেদিন কী বার ছিলো সঠিক মনে করতে পারে না মোস্তাক মিয়া। সেবারই প্রথম মোশেদার প্রতি চোখ পড়েছিলো তার অথবা বলা যায়, সেদিনই প্রথম ভালো করে, মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখেছিলো। সেদিন তার চোখে বিস্ময় নাকি মুগ্ধতা ছিলো তেমন ভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখেনি সে। মড়ার কান্না শুনেই হয়তো মোশেদাও গিয়েছিলো সে বাড়িতে। অবশ্য শোনা গিয়েছিলো শুক্কুর আলির মা নাসিমা নিজেই চায়ের চামচে করে দু চামচ বিষ মুখে তুলে দিয়েছিলো। প্রথম চামচ খাওয়ার পর দ্বিতীয় চামচ মুখে নিতে চায়নি ছেলেটি। বলেছিলো, গন্ধ! হলের ওষুধের বাস আইতাসে।

ওষুধ মজার খাওন না! বলেই নাসিমা এক হাতে ছেলের দুগাল চেপে ধরে অন্য হাতে আরেক চামচ ওষুধ জোর করে ঢেলে দিয়েছিলো শুক্কুর আলির মুখে। এ কথাগুলো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিলো নাসিমা আর মাঝে মাঝে উঠোনের শেষাংশে নানা রকম জঞ্জালের পাশে উঁচু-নিচু মাটির ওপর গড়াগড়ি দিচ্ছিলো।
সন্তান-শোকে বোধ-বিবেচনাহীন নারীর বুকের আঁচল, এমনকি ব্লাউজের বোতাম যথাস্থানে না থাকার কারণে তার আব্রু যথাযথ রক্ষিত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। কিন্তু দুরাচার মোস্তাকের দুর্বিনীত মন সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করতে কোনো আগ্রহ বোধ করেনি সেদিন। বিলাপ-রত বা সন্তান শোকে আহাজারিতে বিপন্ন কোনো মায়ের বোধকরি বয়স, সৌন্দর্য বা শারীরিক আকর্ষণের চাইতেও তার শোক সন্তপ্ত চিত্রটিই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে বেশি। যে কারণে বদমাশ মোস্তাক মিয়ার লোলুপতাও হয়তো সে মুহূর্তে মাথা তুলতে লজ্জা পেয়েছিলো।

নিজের সুন্দরী স্ত্রী থাকলেও পরস্ত্রীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতি প্রচণ্ড লোভী মোস্তাক মিয়া অদ্ভুত রকমের নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো নাসিমার বিশুষ্ক চোখের দিকে। সে চিৎকার করে কাঁদলেও এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তে দেখেনি সেখান থেকে। ভেতরে ভেতরে তার সন্দেহ হচ্ছিলো যে, নাসিমা হয়তো ইচ্ছে করেই ছেলেটিকে খুন করলো। হয়তো বা সেই অপরাধ আড়াল করতেই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে এখন পাড়া জানাচ্ছে।

হাটে-বাজারে বা দোকান-পাটে আসা যাওয়ার সময় প্রায়ই তাদের ঘরোয়া সমস্যা জনিত ঝগড়া-বিবাদ শুনতে পাওয়া যেতো। এ কথাও অনেকবার সে নাসিমার মুখে শুনেছে যে, ছেলে-মেয়েগুলোকে বিষ খাইয়ে মেরে তার দু চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই চলে যাবে সে। অবশ্য স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া লাগলে অনেক ধরনের রাগের কথাই বলে যা, পরবর্তীতে মনে পড়লেও হয়তো স্বীকার করতে চাইবে না কেউ।

উঠোনের আরেক পাশে মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো শুক্কুর আলি। কেউ তেঁতুলের পানি, কয়লা-গুঁড়ো মেশানো পানিও খেতে দিচ্ছিলো তাকে। সে সেসব মুখে নিয়েছিলো কিনা সেদিন চোখে পড়েনি মোস্তাকের। শুনতে পাচ্ছিলো, ব্যস্ত কণ্ঠে কেউ পরামর্শ দিচ্ছে ‘গু খাওয়াও!’

কিন্তু সে কথায় হয়তো কেউ কর্ণপাত করেনি। পাশ থেকে আরেকটি নারী কণ্ঠ বলে উঠলো, হাসপাতালে নেও না ক্যান? ওয়াশ করলে পোলা বাইচ্যা উঠবো!

শুক্কুর আলির বাপ কবিরুদ্দিন মাঝ পথে দাঁড়িয়ে উঠে বললো, না না। আমার পোলারে হাসপাতালে নেওনের কাম নাই। পেট ওয়াশ করলে আমার পোলা কষ্ট পাইবো!

তখনই বয়স্ক কেউ লোকজনের আড়াল থেকে বলে উঠলেন, আরে হারামজাদা তর পোলা কি অহন কষ্ট পাইতাছে না?

তারপর আরো কী কী বলতে বলতে তিনি চলে গেলেন হয়তো তার ঘরের দিকেই। ঠিক তখনই ফের পূর্বেকার নারী কণ্ঠ বলে উঠলো, হেই তো যাইবা, সময় খোয়াইয়া যাইবা!

সতর্ক ভাবে পরিচিত কণ্ঠস্বরকে অনুসরণ করে মোস্তাকের দৃষ্টি। দেখতে পায় বয়রা সোবানের স্ত্রী মোশেদা। তাকে তো সে দেখছে প্রায় আট-দশ বছর ধরেই। বয়রা সোবান যেদিন মোশেদাকে বিয়ে করতে যায়, বৈরাতী হয়ে সে নিজেও গিয়েছিলো বিয়ে বাড়িতে। প্রতিদিনই তো সে চাপ-কল থেকে কলস ভর্তি করে পানি নিয়ে যাচ্ছে দু বেলা। ঝড়ের পরে বা বৃষ্টির দিনে, কাদা পথে পা টিপে। এমন কি চৈত্রের গনগনে রোদ্দুরে ঘেমে-নেয়ে। ঘরের জানালা দিয়ে তা প্রায়ই দেখেছে সে। কিন্তু আজকের মতো এমন আকৃষ্ট সে কখনোই হয়নি তার প্রতি। অথচ সেই একই নারী, তেলের অভাবে যার মাথার আলগা চুলগুলো লালচে হয়ে প্রায় পাটের আঁশের মতো হাওয়ায় উড়তে থাকা। সস্তার ছাপার কাপড়ের আঁচলের কাছে বা পায়ের কাছে খানিকটা ছেঁড়া। সাবানের অভাবে না ধোয়া ময়লা আর রঙ-জ্বলা ব্লাউজের হাতার কোনো একটা সেলাই ছুটে যাওয়া বা শরীরের সঙ্গে নিত্য ঘষা খাওয়ার ফলে ফেটে গিয়ে ফর্সা বাহুর খানিকটা দৃশ্যমান থাকা। সবই তো তার কাছে পরিচিত দৃশ্য। কিন্তু তার পরেও যেন বাড়তি কিছু একটা তার দৃষ্টিকে ক্রমাগত টানছিলো, যা সে নিরন্তর ভেবে নির্ণয় করতে পারছিলো না। অথচ অন্যরা দেখলে খারাপ ভাবতে পারে বুঝতে পেরে চেষ্টা করেও পাঁচ সন্তানের জননী মোশেদার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলো না সে।

মোস্তাকের লোভাতুর বা বিস্মিত দৃষ্টির ব্যাপারটি দু একবার হয়তো খেয়াল করে থাকবে সে। এদিকে বেশ কয়েকবারই মুখ ফিরিয়ে তাকাতে দেখা গেছে তাকে। হয়তো বা সে কারণেই কিংবা নারী সুলভ দীর্ঘকালীন অভ্যাসের বশে আঁচল টেনে মাথায় তুলে নিয়েছিলো। ফলে অজানিত ভাবেই হয়তো মোস্তাকের চোখে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো তার বগলের কাছাকাছি ব্লাউজের ছেঁড়া অংশ ফুঁড়ে বুকের পাশের স্ফীত ঈর্ষনীয় সৌন্দর্যটুকু। তারপর যে তার কী হয়। মৃত মানুষের বাড়ির কান্না, চিৎকার, নানা বয়সী মানুষের কণ্ঠস্বর সবই যেন স্তব্ধ হয়ে যায় তার শ্রবণযন্ত্রে আঘাতের ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। সে দেখছিলো মোশেদার স্থানান্তর, কথা বলার সময় ঠোঁট নড়া কিংবা চোখের পাপড়ি দুটোর প্রক্ষেপণ।

তার স্মৃতিতে ছাপ রেখে যাওয়া বিভিন্ন বয়সের নারীদের সঙ্গে নানাবিধ তুলনা করে মোশেদার অঙ্গ-সৌষ্ঠবকেই যেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিতে চায় সে। আসলে তার জীবনের প্রথম দিককার নারীরা তাকে দিতে পারেনি কিছু। উলটো তাকে দিয়ে তাদের মধ্য যৌবনের খরা-তপ্ত রুখু জমিনে অযাচিত লাঙল টানিয়েছে। অবিরাম পানি সেঁচেও যেখানে শুষ্কতা-মোচন অসম্ভব তা জেনে-বুঝে তাকে দিয়ে তাই করাতে চেয়েছিলো তারা। কিন্তু নির্বোধ চাষা নতুন নতুন হাল চালাতে শিখে পরিমাপ করতে পারেনি কোন জমিতে কয় চাষ লাগে! বালকের হাতে চাকু উঠলে যেমন হাতের কাছে প্রথম যা পায় তাতেই সে চাকুর ধার পরীক্ষা করে, মোস্তাক মিয়ারও সব ছিলো হাতের কাছেই, যৌবনের পাঠ নিতে বাইরে যেতে হয়নি তাকে।

হঠাৎ কারো কর স্পর্শে যেন তন্দ্রা ছুট মোস্তাক মিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসে। মোশেদা তার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলছে, যাইবেন না রুগীর লগে?
মোস্তাক মিয়া তাকিয়ে দেখে কথা বলার সময় মোশেদার ঠোঁট দুটো পরস্পর পরস্পরের দিকে এগিয়ে গিয়ে জড়াজড়ির ভঙ্গীতে আলতো চাপ খেয়ে ফের বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার মিলে গেল। যেন গভীর পানি থেকে মুহূর্তকালের ভেতর লাফিয়ে ওঠা মাছের পুনরায় পানিতে তলিয়ে যাওয়া শেষের জলতরঙ্গ। তারপর সে তাকায় মোশেদার পিঙ্গল দুটো চোখের দিকে। তার কাছে মনে হচ্ছিলো, সে যেমন তার চোখের ওপর দৃষ্টি বিছিয়ে রাখা চোখ দুটোর মধ্যকার সূর্যের দ্যুতি ছড়ানোর মতো খানিকটা স্বচ্ছ গোলাকার বৃত্তের মাঝে ছোট্ট কালো বিন্দু দুটো দেখতে পাচ্ছে, তেমনি করে কখনো কেউ ঠকায়নি তার চোখের দিকে। তার ভাইয়ের স্ত্রীরা কর্ষিত হওয়ার কালে, আগে বা পরে কতভাবেই না তার চোখে চোখ রেখেছে, কিন্তু সে চোখের দৃষ্টি এতটা শাণিত ছিলো না কখনোই।

(লিখতে পারলে বাকিটা অন্য কোনোদিন।)


মন্তব্য

cresida এর ছবি

খুব চমৎকার লিখেছেন।পরবর্তী অংশ পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

ক্রেসিডা

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ধন্যবাদ জানাই।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

কর্ণজয় এর ছবি

সিচুয়েশনটার ডিটেইলস বর্ণনা ভাল লেগেছে...

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

কিন্তু শেষটা পইড়া কেমন ভাবেন তা জানার আগ্রহ রইলো।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

কতোদিন পর লিখলেন!
আবার বলেন, লিখতে পারলে বাকিটা...?
লিখে ফেলেন।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

বুজি, সচলে পোস্ট কইরা সেইটা তো আরো বাইশখানে পোস্টানো যায় না। হাসি

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

পুরাটা লেখেন, একবারে পড়ব। অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে। ভালো আছেন আশা করি।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ভালো তো আছি। আপনে?
মাঝে মাঝে বিরতি ভালো। হাসি

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।